বিদ্রোহে–বিপ্লবে
অভ্যুত্থানের অব্যর্থ হাতিয়ার
ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিল কবিতা, গান, র্যাপ, পোস্টার, কার্টুন আর গ্রাফিতি। এই বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ভাষায় ধরা আন্দোলনের মর্মকথা নিয়ে সচিত্র দলিল বিদ্রোহে–বিপ্লবে।
২০২৪ সালের অবিস্মরণীয় জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনাশাহির পতন ঘটেছে। বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা বিশ্বের ইতিহাসে এই অভ্যুত্থান নানা কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান দিক হলো, এমন অংশগ্রহণমূলক অভ্যুত্থান বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল। বয়স, শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্গনির্বিশেষে সব মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে এই অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শক্তি, প্রতিরোধ ও আকাঙ্ক্ষার রঙে রঙিন।
অনেকেই এই আন্দোলনকে বলছেন জেন-জির আন্দোলন। এই আন্দোলনে ‘আই হেট পলিটিকস’ ছাপ লাগা জেন-জির বহুমাত্রিক অংশগ্রহণ ছিল এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। আর ডিজিটাল যোগাযোগে অভ্যস্ত জেন-জির চৈতন্যে এই আন্দোলনের ভাষা ও মর্মকে মূর্ত করে তুলতে আমাদের ডিজিটাল শিল্পীরা হাতে তুলে নিয়েছেন দারুণ এক অস্ত্র—অনলাইন পোস্টার ও ফেস্টুন। জুলাই অভ্যুত্থানের গণ–আকাঙ্ক্ষাকে নতুন প্রজন্মের কাছে অর্থবহ ও সহজবোধ্য করে তুলতে এই শিল্পমাধ্যমটির অবদান অনস্বীকার্য।
এ ছাড়া ‘তুমি কে আমি কে/ বিকল্প বিকল্প’, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ’ বা ‘সব স্বাভাবিক’ শিরোনামের পোস্টারগুলো হয়ে উঠেছে আওয়ামী বয়ানের বিরুদ্ধে অনলাইনমুখী জেন-জির প্রতিবাদের সুতীব্র ভাষা।
কেবল অভ্যুত্থানের গণচেতনাই নয়, ধরা যাক শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তীর করা পোস্টারগুলোর কথা, যেখানে উঠে এসেছে এই অভ্যুত্থানের ধারাবাহিক সময়ক্রম, সময়োপযোগী দাবিদাওয়া ও অভ্যুত্থানের গতিপথ নির্দেশক নানা ধরনের স্লোগান। লাল, কালো ও হলুদের গভীর প্রতীকী মিশ্রণে দেবাশিস এই অভ্যুত্থানের প্রতিটি পর্যায়কে মূর্ত করে তুলেছেন অসামান্য দরদ ও দক্ষতায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই আন্দোলন তীব্র গতিতে একটি সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৫ বছর ধরে চলতে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের ‘রাজাকার তকমার রাজনীতি’র মুখোশটি মুহূর্তেই খসে পড়ে ছাত্র–জনতার গভীর অর্থবহ নানা স্লোগানে। অধিকার চাইলেই যারা রাজাকার বলে, তারা আসলে স্বৈরাচার—স্লোগানে স্লোগানে এই সরল সত্যটি প্রকট হয়ে ওঠে। দেবাশিসের পোস্টার এ ক্ষেত্রে আপসহীনভাবে তুলে ধরে ছাত্র–জনতার ভাষ্য।
আন্দোলন চলাকালে হাসিনা সরকারের বহুল ব্যবহৃত বয়ানগুলোকে দারুণভাবে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে দেবাশিসের পোস্টারগুলো। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বৈরাচার পার পাবে না’ শিরোনামের একটি পোস্টার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামক আওয়ামী অস্ত্রটিকে ছিনিয়ে এনে জনতার হাতে তুলে দিয়েছে। ‘বাংলাদেশের জনগণ তৃতীয় পক্ষ না’ শিরোনামের পোস্টারটি ‘আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে’ শীর্ষক ভাষ্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে এক কার্যকর প্রতিভাষ্য। এ ছাড়া ‘তুমি কে আমি কে/ বিকল্প বিকল্প’, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ’ বা ‘সব স্বাভাবিক’ শিরোনামের পোস্টারগুলো হয়ে উঠেছে আওয়ামী বয়ানের বিরুদ্ধে অনলাইনমুখী জেন-জির প্রতিবাদের সুতীব্র ভাষা।
দেবাশিসের পোস্টারগুলোতে এই আন্দোলনের জল–মাটিলগ্ন অনুভূতির নন্দনতাত্ত্বিক উপস্থাপনাও উঠে এসেছে। ‘রক্তাক্ত জুলাই’ বা ‘অগ্নিঝরা বর্ষা’ শিরোনামের পোস্টারগুলো ছাত্র–জনতার বিপ্লবী চেতনাকে স্থান-কালের ঐতিহাসিকতার মধ্যে হাজির করেছে। তা ছাড়া এই গণ–অভ্যুত্থানের ব্যাপক অংশগ্রহণমূলকতা ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার দিকটিও উঠে এসেছে দেবাশিসের বিভিন্ন পোস্টারে। প্রায় প্রতিটি পোস্টারেই মুষ্টিবদ্ধ কিংবা আন্দোলনরত মানুষের ক্যারিকেচার ব্যবহার করেছেন দেবাশিস। তাতে আন্দোলনরত ছাত্র–জনতা পোস্টারগুলোর মধ্যে নিজেদের বিপ্লবী প্রতিচ্ছবিই খুঁজে পেয়েছে বারবার। এ ছাড়া পোস্টারের ক্যারিকেচারগুলোতে দেবাশিস বেশ সচেতনভাবেই সমাজের নানা শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্গের প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে আগামীর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যে সবার জন্য সমান অধিকারের রাষ্ট্র হওয়া উচিত, সেই চেতনাটিও ব্যক্ত করেছেন বেশ কার্যকর উপায়ে।
‘খুনি হাসিনা’, ‘হুকুমের আসামী’সহ বেশকিছু পোস্টারে দেবাশিস সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার যে প্রবল প্রতাপশালী সত্তাটি জনগণের মনে ও চৈতন্যে সদা বিরাজমান ছিল, দেবাশিসের এই পোস্টারগুলো তা ভেঙে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে। ‘হুকুমের আসামী’ শিরোনামের পোস্টারটিতে শেখ হাসিনার ক্যারিকেচারটি একদিকে প্রচণ্ড নির্মম, অন্যদিকে বেশ হাস্যোদ্রেককারী একটি মানবমুখকে ফুটিয়ে তুলেছে। ফলে গণচৈতন্য ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্মমতার দিকটি বুঝলেও, তাকে নিয়ে বিদ্রূপ করতে ভয় পায়নি একচুলও।
এ ছাড়া পোস্টারের ক্যারিকেচারগুলোতে দেবাশিস বেশ সচেতনভাবেই সমাজের নানা শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্গের প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে আগামীর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যে সবার জন্য সমান অধিকারের রাষ্ট্র হওয়া উচিত, সেই চেতনাটিও ব্যক্ত করেছেন বেশ কার্যকর উপায়ে।
গণ–অভ্যুত্থানের প্রাথমিক সফলতার পরেও দেবাশিস থেমে যাননি। গণ–অভ্যুত্থানকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নানা দিকনির্দেশনা ও জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা হাজির হয়েছে তাঁর বানানো বিভিন্ন পোস্টারে। গণক্ষমতার সরকার গঠন, বিপ্লবী শক্তির অধীনে নতুন গঠনতন্ত্র তৈরি, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবনা, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রতিবাদ, ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণকে বিদ্রূপ করা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ অভ্যুত্থানজাত আরও নানা চেতনা ও দাবি উঠে এসেছে দেবাশিসের পোস্টারগুলোতে। একটি পোস্টারে দেবাশিস ঘোষণা দিয়েছেন, ‘অভ্যুত্থান চলমান’। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেবাশিস পোস্টারে পোস্টারে এই অভ্যুত্থানের প্রাণ, চৈতন্য ও গণ–আকাঙ্ক্ষাকে দিয়েছেন কার্যকর, শক্তিশালী, ধারাবাহিক ও দিকনির্দেশনামূলক ভাষা।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট নতুন আশা ও ভরসার পাশাপাশি, শিল্পী রীশাম শাহাব তীর্থর পোস্টারে ফুটে উঠেছে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সবার জন্য সমতার দেশ গড়ার অঙ্গীকার। পাশাপাশি অভ্যুত্থানে আহতদের সুচিকিৎসার মানবিক দাবিটিও উঠে এসেছে এই শিল্পীর ডিজিটাল তুলিতে।
ছাত্র–জনতার ভাষা যেমন উঠে এসেছে এসব পোস্টারে, তেমনি এই পোস্টারগুলোও পরে প্রিন্ট বা গ্রাফিতি হয়ে পৌঁছে গেছে মাঠে লড়াইরত ছাত্র–জনতার কাছে। জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে এভাবেই একাকার হয়ে গেছে অনলাইন আর অফলাইন, রাজপথ আর ডিজিটাল পরিসর।
এ ছাড়া ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রচারিত বিভিন্ন পোস্টারে উঠে এসেছে, কীভাবে অভিভাবকেরা এই লড়াইয়ে তাঁদের সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বজন হারানোর বেদনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘সন্তান হারানোর বেদনা আপনার নাই’ বা ‘স্বজন হারানোর বেদনা আপনার আছে, সন্তান হারানোর নাই’। নিজেদের সন্তান বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই রাষ্ট্র যে অনিরাপদ, এই অনিরাপদ রাষ্ট্রে যে কিছুতেই সন্তানদের একা ছাড়বেন না অভিভাবকেরা—এই দীপ্ত প্রতীতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এসব পোস্টারের রঙে, নকশায় ও ভাষ্যে।
অদ্রি রায় নামের এক শিল্পীর একটি পোস্টারে ফটোজার্নালিস্ট ও সাধারণ নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডিভাইস তল্লাশির প্রতিবাদ উঠে এসেছে সোজাসাপটা ভাষায়, ‘ফোনটা তোর বাপের না,/ ক্যামেরা তোর নেতার না!’ আন্দোলন চলাকালে লাশের মিছিলে মুক্তির আশায় বুক বেঁধে হাঁটতে থাকা ছাত্র–জনতার যন্ত্রণাদগ্ধ অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে অদ্রির আরেকটা পোস্টারে, ‘লাশ গুনতে গুনতেই লাশ হয়ে যাব,/ তবু জানি ফিরবার সব পথ বন্ধ।’ আগস্টের শুরুতে প্রবল বর্ষণকে উপেক্ষা করেও রাস্তায় নেমে এসেছিল হাজার হাজার ছাত্র–জনতা। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা সেই গণমানুষের বেদনাদীপ্ত মনের অনুভূতিটি ভাষা পেয়েছে অদ্রির আরেকটি পোস্টারে, ‘সন্তানের রক্তে ভিজে আছি, ছাতার দরকার নেই!’
এ ছাড়া আন্দোলনের আরও বিভিন্ন দিককে কেন্দ্র করে শত শত পোস্টার বানিয়েছেন জানা-অজানা অনেক শিল্পী। প্রায় প্রতিটি সামাজিক গণমাধ্যমে হাজার হাজারবার প্রচারিত হয়েছে এসব পোস্টার। নানা কারণে যাঁরা মাঠে নামতে পারেননি, মোবাইল বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে উদ্বিগ্ন মুখে যাঁরা তাকিয়ে ছিলেন ভবিষ্যতের দিকে, তাঁদের হাতেও প্রতি মুহূর্তে লড়াইয়ের অস্ত্র তুলে দিয়েছে এই পোস্টারগুলো।
স্বৈরাচারের বহুল ব্যবহৃত বয়ানগুলোকে ভেঙে দেওয়া, এই জনযুদ্ধের চেতনা ও লক্ষ্যকে গণমানুষের, বিশেষত ডিজিটাল যোগাযোগে অভ্যস্ত নতুন প্রজন্মের মনে ও মননে সদাজাগরূক রাখা ও নতুন বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত ছবিটিকে রঙে ও ভাষায় মূর্ত করে তোলার কঠিন কাজটি করেছেন এই শিল্পীরা, অনায়াস একটি শিল্পমাধ্যমকে আশ্রয় করে।
মিম আদানপ্রদানে অভ্যস্ত ডিজিটাল প্রজন্মকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করতে পেরেছে এসব অর্থবহ পোস্টারের রং ও ভাষার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংক্ষিপ্ত অথচ সুদৃঢ় বক্তব্য। ছাত্র–জনতার ভাষা যেমন উঠে এসেছে এসব পোস্টারে, তেমনি এই পোস্টারগুলোও পরে প্রিন্ট বা গ্রাফিতি হয়ে পৌঁছে গেছে মাঠে লড়াইরত ছাত্র–জনতার কাছে। জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে এভাবেই একাকার হয়ে গেছে অনলাইন আর অফলাইন, রাজপথ আর ডিজিটাল পরিসর। যোগাযোগপদ্ধতির ইতিহাসে এ এক বিরলপ্রায় ঘটনা! একটি সাধারণ শিল্পমাধ্যমকে ব্যবহার করে এ রকম অসাধারণ এক ঘটনা ঘটিয়ে তুললেন যে ডিজিটাল শিল্পীরা, অগ্নিঝরা জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ইতিহাসে তাঁরাও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
পোস্টারগুলো শিল্পীদের কাছ থেকে সংগৃৃহীত