রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন
যে গল্পটা বলব, সেটা আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনাবে, কিন্তু আদতে এটা আষাঢ়ে গল্প নয়!
কয়েক বছর আগের ঘটনা, উত্তরবঙ্গে এক বন্ধুর বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম নিজের গাড়িতে করে গেলে ভ্রমণটা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের হবে কিন্তু তৃতীয়বারের মতো যখন গাড়িটা বিগড়ে গেল, তখন বুঝতে পারলাম, নিজের গাড়ি নিয়ে বের হওয়াটা ঠিক হয়নি। দীর্ঘযাত্রায় বাস-ট্রেনই ভালো।
এর আগে আরও দুবার ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করে সারিয়ে তুলেছিল গাড়িটা। তবে তৃতীয়বারের মতো সে সফল হবে না বলেই মনে হলো। পথে বেশ কিছু জায়গায় পানি জমেছিল, ইঞ্জিনের ভেতর ঢুকে গেছে নিশ্চয়। মাঝরাতে বিরান এক মহাসড়কে থমকে গেল আমার যাত্রা। গাড়িতে বসেই বাইরে চোখ বোলালাম, অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে, মাঝেমধ্যে সেটার প্রকোপ কমলেও আবার পূর্ণ তেজে শুরু হয়ে যাচ্ছে।
আবছা আলোয় আন্দাজ করতে পারলাম, ধানি জমি আর ডোবানালা ছাড়া আশপাশে কিছু নেই। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে বহু দূরে থাকা গেরস্তের বাড়ির আলোকিত জানালাগুলো ছোট ছোট বিন্দুর মতো দেখায়, আমি সেগুলো দেখার আশায় চোখ কোঁচকালাম। কিচ্ছু নেই, গাঢ় অন্ধকার ছাড়া।
ড্রাইভার সলিম হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে ইঞ্জিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি কিছুক্ষণ গাড়ির ভেতরে বসে থেকে বের হয়ে এলাম। ক্লান্তি আর খিদে আমাকে অস্থির করে তুলেছে সেই কখন থেকে। বৃষ্টির প্রকোপও কমে এসেছে। হতাশ হয়ে পিচের ওপর লাথি মারতেই আমার দিকে তাকাল ড্রাইভার।
‘ধারেকাছে কি খাবারের দোকানটোকান পাওয়া যাবে?’
‘জানি না, স্যার,’ ঠোঁট উল্টে জবাব দিল সে।
এ রকম জায়গায় নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কথা, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার যত চিন্তা উদরপূর্তি নিয়ে! পরিচিতজনরা তো আর সাধেই খাদক বলে না আমাকে। সামনে একটু হেঁটে গেলাম আনমনেই। চোখে পড়ল কিছু একটা। বেশ দূরে, রাস্তার পাশে জ্বলজ্বল করছে একটা সাইন।
‘আমি একটু সামনে গেলাম,’ ড্রাইভারকে বললাম বেশ জোরে, ‘খাবারের দোকান আছে কি না দেখি।’
‘বেশি দূরে যায়েন না, স্যার...আর একটু পরই গাড়ি ঠিক করবার পারুম।’
অনেকটা পথ এগোতেই থমকে দাঁড়ালাম অদ্ভুত সাইন দেখে।
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি!
জীবনে এ রকম কোনো রেস্টুরেন্টের কথা শুনিনি, দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। করপোরেট জগতের মানুষ আমি। কত শত ধান্দাবাজিই না জানি, কিন্তু এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে, মহাসড়কের পাশে উদ্ভট নামের এই রেস্টুরেন্টটা দিল কোন ধান্দাবাজ! কৌতূহল নিয়েই এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে।
মহাসড়কের পাশে চমৎকার একটি বাংলো বাড়ির মতো একতলার এই রেস্টুরেন্টটির সামনে আছে বারান্দা, সেই বারান্দার ওপরে টিনের ছাউনি। বড় বড় ফ্রেঞ্চ জানালা আর নকশা করা বিশাল একটি কাঠের দরজা। বাইরে থেকে জানালা দিয়ে ভেতরটা আলোকিত দেখে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়তেই থমকে গেলাম। রেস্টুরেন্টের ভেতরটায় বেশ স্বল্প আলো জ্বলছে। সাজসজ্জা আর পরিবেশ একদমই ভিন্ন, প্রতিটি রাউন্ড টেবিল ঘিরে আছে তিন-চারটা করে চেয়ার। কিন্তু কোনো কাস্টমার নেই। ওয়েটারও দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত দেরি করে ফেলেছি—আক্ষেপ আর হতাশায় বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।
এমন সময় ঘরের শেষ মাথা থেকে এক যুবক বেরিয়ে এল।
‘বন্ধ হয়ে গেছে নাকি?’ হতাশার সুর আমার কণ্ঠে।
‘না, তবে একটু পরই বন্ধ করে দেব,’ বলেই একটা মেনু সামনের টেবিলের ওপর রাখল সে, ‘বসুন।’
টেবিলে বসেই আমি মেনুর দিকে নজর দিলাম।
মুশকান’স কারি।
মুশকান’স সুপ অব লাইফ!
মুশকান’স হাইব্রিড ক্র্যামচপ!
মুশকান’স গোল্ডেন ড্রিঙ্কস!
মুশকান’স জাস্ট টি!
সব খাবারের আগেই মুশকান! ‘আচ্ছা, এই মুশকানটা কী?’
‘উনি আমাদের রেস্টুরেন্টের মালিক...আবার শেফও।’
এ রকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন মহিলা রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে, সে নিজে আবার শেফ—অবাকই হলাম। দ্রুত মেনুতে চোখ বোলালাম। একেবারে শেষে এসে আটকে গেল আমার চোখ। মূল মেনুতে এটা ছিল না, পরে কাগজে প্রিন্ট করে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রবীন্দ্র নৈশভোজ!
এটাও খাবারের নাম? মর্মাহতই হলাম। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে এর মালেকিন।
‘এটা কী?’
‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক টেবিলে বসে ডিনার করার অফার।’
এ জীবনে খুব কমই এমন উদ্ভট কথা শুনেছি, ‘তুমি আমার সাথে মশকরা করছ?’ রেগেমেগেই বললাম। ক্ষুধার্ত মানুষ এমনিতেই চট করে রেগে যায়।
‘স্যার, আজকে এই অফারটা দিয়েছেন আমাদের মালেকিন নিজে,’ বেশ জোর দিয়ে বলল ওয়েটার।
‘আচ্ছা,’ আমিও পাল্টা বললাম, ‘তাহলে এই অফারটার পাশে মূল্য লেখা নেই কেন?’
‘এটা আসলে উনিই বলতে পারবেন। আমি জানি না।’
আমার ভুরু কপালে উঠে গেল, ‘আচ্ছা, আমি যদি এই অফারটা এখন নিই, তাহলে রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে আমার সঙ্গে বসে ডিনার করবেন?’
‘উনি করবেন না, আপনি করবেন।’
অনেক কষ্টে রাগ দমন করলাম, ‘হুঁ, বুঝেছি।’ জেদ চেপে গেল আমার মধ্যে, ‘আমি এই অফারটা নিচ্ছি তাহলে।’
ওয়েটার কিছু না বলে চলে গেল।
এর শেষ না দেখে আজ যাব না। আমি নিশ্চিত, কী হবে। ইউরোপ-আমেরিকায় এ রকম প্র্যাঙ্ক করতে দেখেছি। এরা কোন কৌশলটা খাটাবে, সেটাও বুঝতে পারছি। সত্যি এক বুড়ো এখানে চলে আসবে একটু পর...
হঠাৎ ঘরটা ভরে উঠল সুবাসে। চমকে ডান পাশে তাকালাম।
অনিন্দ্যসুন্দর এক নারী অভিজাত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। সাদা-লালের জামদানি শাড়ি, চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা।
কর্তৃত্বপূর্ণ ভাব নিয়ে আমার বিপরীতে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সেই নারী।
‘তাহলে আপনি ওঁর সাথে ডিনার করতে চাইছেন?’ তার কণ্ঠ সুললিত।
‘হ্যাঁ! তবে দেখতে কিছুটা রবীন্দ্রনাথের মতো কারও সঙ্গে নয়,’ বললাম তাকে, ‘আমার ধারণা, সেই লোকের নামও হবে রবীন্দ্রনাথ! তখন আমাকে বলবেন, মেনুতে লেখা ছিল রবীন্দ্র নৈশভোজ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলেননি।’
মুচকি হাসল রহস্যময়ী।
‘আর ওই নকল রবীন্দ্রনাথের পদবিটা হবে দাস, রায়, বসু...এ রকম কিছু একটা।’
‘আপনার সঙ্গে এ রকম কিছু করা হবে না,’ মুশকান নামের নারী আশ্বস্ত করে বলল আমাকে।
‘তাহলে নোবেলজয়ী কবিই আসছেন? মৃত্যুর আশি বছর পর? ওয়াও!’
‘হুম।’ আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিল মুশকান।
অদ্ভুত ব্যাপার, আমার কাছে মনে হলো মহিলা সত্যিই বলছে!
‘কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! প্ল্যানচেটে মৃত মানুষের আত্মা ডেকে আনার কথা শুনেছি...আপনি কি সে রকম কিছু করবেন নাকি?’
আমার কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন টিটকারি ছিল।
‘আপনি এই অফারটা নিচ্ছেন তো?’ আমার কথার জবাব না দিয়ে জানতে চাইল সে।
‘রবীন্দ্রনাথের ভূতের সাথে নৈশভোজ? হ্যাঁ। মনে হচ্ছে দারুণ ব্যাপারই হবে সেটা।’
‘আমারও তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।’
ওয়েটার ফিরে এল আবার।
‘আপনি খাবারের অর্ডার করুন...আমি আসছি,’ মুশকান নামের নারীটি চলে গেল রেস্টুরেন্টের ভেতরে।
ঝটপট কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে দিলাম। হালকা ভলিউমে জনপ্রিয় একটি রবীন্দ্রসংগীত ভেসে বেড়াতে লাগল ঘরে। একটু পরই ট্রেতে করে গরম ভাত, মাংস আর ডাল নিয়ে হাজির হলো ওয়েটার।
আর কিছু না ভেবে উদরপূর্তি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। একটু পরই আবিষ্কার করলাম, যা খাচ্ছি, তা এক কথায় অসাধারণ। সত্যি বলতে, মাংসটা গরুর নাকি খাসির, সেটাও ধরতে পারলাম না। আর মাংস থেকে যে ঘ্রাণ আসছে, সেটা আমার রুচি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার খাওয়ার মাঝখানে আবারও চলে এল সেই রহস্যময়ী নারী। এবার তার খোঁপায় বেলি ফুলের মালা, কপালে সিঁদুররঙা টিপ আর চোখে সুন্দর করে কাজল দেওয়া। কখনো কোনো নারীকে এত সুন্দর করে কাজল দিতে দেখিনি।
আগের জায়গায় বসে গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিল মুশকান, ‘আপনি খেতে থাকুন...আমি ওঁকে ডাকছি।’
ব্যাপারটা অদ্ভুত আর অসৌজন্যমূলক বলে মনে হলো আমার কাছে। হোক না রবীন্দ্রনাথের ভূত, তার সামনে বসে আমি গাপুসগুপুস খাব?
মিউজিক প্লেয়ারের গান থেমে গেল, আর সুললিত কণ্ঠে গাইতে শুরু করল মুশকান নিজে:
এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে
এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে...
বাহির হয়ে এসো
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।
অসাধারণ তার গায়কি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে গেলাম।
‘এসো আমার ঘরে
এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে
স্বপন দুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
এসো মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে
চিরকালের তরে
এসো আমার ঘরে...’
‘আকুল হয়ে কেন যে ডাকো...সাড়া না দিয়ে পারিনে! হোক না সেটা ক্ষণকালের আবাস হতে...!’
একটা মিহি কণ্ঠ শুনে আমি চমকে তাকালাম রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। দৃশ্যটা দেখামাত্র গায়ের সমস্ত রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। ভূত দেখে নয়, আমি রবীন্দ্রনাথকে দেখে ভড়কে গেলাম। যেন বহুল পরিচিত ছবি থেকে উঠে এসেছেন তিনি, এগিয়ে আসছেন আমাদের টেবিলের দিকে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে রেখেছেন। দেখেই সম্ভ্রম জেগে উঠল। দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো উচিত, কিন্তু আমার সেই বোধশক্তি লোপ পেয়ে গেল।
মুশকানের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথকে দেখে, ‘আমাদের অতিথির পাশে বসো!’
কবি আমার ঠিক পাশেই বসে পড়লেন।
‘একটা শর্ত আছে,’ আমাকে বলল মুশকান, ‘আপনি ওঁকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না।’
আমি হাঁ হয়ে গেলাম। এর আগে কখনো ভেবে দেখিনি, প্রশ্ন ছাড়া কথা বলা কতটা অসম্ভব ব্যাপার।
‘আর ওঁ ডিনারও করবে না...আপনি খেতে থাকুন।’
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। একটা ঘোরের মধ্যে নিপতিত হয়ে কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে লাগলাম। সফেদ চুল-দাড়ি, বলিরেখায় পূর্ণ মুখাবয়ব। আলতো করে আমার দিকে তাকালেন কবি। স্মিত হাসি তাঁর ঠোঁটে।
‘কিন্তু ওর মনে তো হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে!’
‘তোমাকে এভাবে দেখলে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?’ মুশকান এমনভাবে কথা বলল যেন কবির সঙ্গে তার অনেক দিনের চেনাজানা।
‘মানুষ প্রশ্নের জলে আকণ্ঠ ডুবে থাকে সারা জনম। এমনকি মৃত্যুর পরও...’ দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল কবির ভেতর থেকে, ‘কত প্রশ্নের উত্তর যে জানিনে এখনো!’
‘তুমি তো সত্য আর সুন্দরের পূজারি...এত প্রশ্ন কেন তোমার মাথায় ঘোরে...এখনো?’
আবারও স্মিত হাসলেন কবি, ‘সুন্দরের পূজারি হতে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয় না কিন্তু ওই যে বললে, সত্য...ওটার তত্ত্ব-তালাশ করতে হলে শত-সহস্র প্রশ্নের উদয় হয়, উত্তরও জানতে হয়।’
আবিষ্কার করলাম মুশকান আর রবীন্দ্রনাথই কথা বলে যাচ্ছে, আমি যেন ঘরের আসবাব হয়ে গেছি।
‘আপনি কিন্তু খাচ্ছেন না,’ তাড়া দিল মুশকান।
ঢোঁক গিললাম আমি। রবীন্দ্রনাথের ভূতের পাশে বসে কেউ কি খেতে পারে, সে খাবার যত সুস্বাদুই হোক না কেন! তারপরও বাধ্য ছেলের মতো খেতে শুরু করলাম আবার। এ ছাড়া আমার কিছু করারও নেই। প্রশ্ন না করে কথা বলা? কীভাবে সম্ভব!
‘এই সুন্দরপুরে ওঁর আসার কথা ছিল, কিন্তু ওঁর মেয়ে মাধবীলতা মারা গিয়েছিল, তাই আর আসা হয়নি।’
আমার উদ্দেশে বলল মুশকান। খেতে খেতেই তাকালাম আমি, জায়গাটার নাম তাহলে সুন্দরপুর।
কবি একটু বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন।
‘ক্ষমা করো আমাকে,’ মুশকান বলল, ‘আজকের দিনে কথাটা তোলা ঠিক হয়নি।’
‘না। ঠিক আছে।’ মিহি কণ্ঠে বললেও কবির দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম যেন।
‘সেদিক থেকে দেখলে এই রেস্টুরেন্টের নামটা একদম ঠিকই আছে।’
মৃত এক কবি জীবিত অবস্থায় আমার পাশে বসে আছেন, আর আমি গলাধঃকরণ করছি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বাদের খাবার—পুরো ব্যাপারটা যেন মর্ত্যে নয়, অমর্ত্যলোকে ঘটছে!
মুশকান আর রবীন্দ্রনাথ, আদৌ যদি ওঁটা রবীন্দ্রনাথ হয়ে থাকেন—তো অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করলেও সেসবের খুব কমই আমার মনে আছে, শুধু মনে আছে হঠাৎ করে রেস্টুরেন্টের বাইরে গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন কবি। চলে যাওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনেক কথা বলার ছিল কিন্তু বলতে পারলাম না। তার কোনো দরকারও নেই। যা বলার বলে গেছি আমি। এখন একটা কথা বলি আরেকবার, দেশ মানে মৃণ্ময় নয়, চিন্ময়...এ কথা তোমরা কখনো ভুলে যেয়ো না!’
তারপর যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই তিনি চলে গেলেন আমাকে সম্মোহনের মধ্যে রেখে।
‘কত দিতে হবে?’ অনেকক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে মুশকানকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘কিচ্ছু দিতে হবে না। বছরে এই সময়ে মাত্র একজনই এ রকম নৈশভোজ করার সুযোগ পায় এখানে। এ বছর আপনি হলেন সেই ভাগ্যবান একজন। আপনি তাড়াতাড়ি চলে যান। আপনাকে খুঁজতে আপনার লোক এসে পড়েছে।’
অগত্যা অদ্ভুত সেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এলাম আমি। বাইরে এসে দেখি আমার ড্রাইভার সলিম গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে।
‘এখানে কী করতাছেন, স্যার?’
‘এ-এই তো...খাবার খেলাম।’
সলিম আমার দিকে তাকিয়ে রইল বিস্ফারিত চোখে, ‘এইটা তো বন্ধ, খাইলেন কেমনে!’
পেছনে ফিরে দেখি, সাইনটা জ্বলছে না। জীর্ণ একটি স্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা-জানালা ভাঙা।
চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লাম। ড্রাইভার একটা এফএম রেডিও অন করতেই এক তরুণী আরজে বলে উঠল:
‘আজ ২২ শ্রাবণ...কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস...’