আমার জন্ম নেত্রকোনার বারহাট্টায়। আমাদের ছেলেবেলায় চৈত্রসংক্রান্তিতে বসত বারুণীর মেলা। একবার বারুণীর সময় আমি আমার ভাইবোনদের জাদু দেখিয়ে কিছু উপরি পয়সা কামাই করেছিলাম। আমাদের স্কুলে জাদু প্রদর্শন করেছিলাম। আমাদের স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে জাদু দেখাতে এসেছিলেন এক জাদুকর। তিনি বিচিত্র সব জাদু দেখিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন। ওই জাদুকরের দুটো জাদু আমি নিজে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার মনে হয় জাদু আমার পক্ষে দেখানো সম্ভব।
১. ব্লেড ভক্ষণ ও
২. জ্যান্ত কবুতরছানা ভক্ষণ।
দুপুরের দিকে আমি জাদু দেখানোর সময় স্থির করি। কারণ ওই জাদুকর দুপুরের দিকেই আমাদের স্কুলে জাদু প্রদর্শন করেছিলেন। মধ্যের বাড়ির এক জেঠিমার ঘর থেকে জাদুকরের জন্য একটি নিরীহ কবুতরছানাকে চুরি করে সংগ্রহ করা হয়। জাদু প্রদর্শনের স্থান নির্ধারিত হয় পাশের বাড়ির যাদুদার ঘরে। যাদুদার নামের সঙ্গে জাদুর কোনো সম্পর্ক ছিল না—ঘটনাটি কাকতালীয়ভাবেই ঘটে। যাদুদা ছিলেন আমাদের জেঠতুতো বড় ভাই। যাদুদারা ছিলেন দুই ভাই। বড়টি মধুদা, ভারতে চলে গিয়েছিলেন। জ্যাঠামশাই–জেঠিমা পরলোকগত, একমাত্র বড় বোন লীলাদি বিবাহিত। পুরো বাড়িটিতে যাদুদা একাই থাকতেন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ে। তাঁর ঘরটি ছিল আমাদের সবার দুষ্টুমির নিরাপদ আশ্রয়।
আমার ভাইবোনেরা আমার জাদু দেখার জন্য দুপুরের দিকে ওই ঘরে সমবেত হয়। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে দেখা ওই জাদুকরের অনুকরণে আমি আমার প্রস্তুতি গ্রহণ করি। দর্শকদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য চৌকি বিছিয়ে একটি ছোটমতো মঞ্চও তৈরি করা হয়। আমার এক বোন আমার গায়ে মন্ত্র পড়া জল ছিটিয়ে দেয়। আমি তখন মানুষরূপী রাক্ষসে পরিণত হই। আমার খুব ক্ষুধা পায়। তখন আমি কিছু খাওয়ার জন্য হাউমাউ করে কবুতরটির জন্য হাত বাড়াই। একজন দূর থেকে আমার দিকে কবুতরের বাচ্চাটিকে ছুড়ে দেয়। আমি এমন ভাব দেখাই যেন কাছে এলে আমি তাকেও খেয়ে ফেলতে পারি। কবুতরের বাচ্চাটিকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে আমি উল্লাস প্রকাশ করতে থাকি। অতি অভিনয় আমার কাল হয়। উল্লাসের মধ্যে লক্ষ করিনি যে কবুতরের বাচ্চাটির পদযুগল ভালো করে বাঁধা হয়নি। কবুতরটি ছিল নিতান্তই বেরসিক এবং জাদুকরের নিরীহ শিকার হতে অনিচ্ছুক। আমার জাদু দেখাবার মাশুল গুনবার জন্যই যে এই ধরাধামে তার আগমন ঘটেছে, তা সে এত সহজে স্বীকার করতে রাজি ছিল না। ফলে আমি যখন চকিত হ্যাঁচকা টানে তার মস্তক ছিন্ন করে রক্ত পান করার জন্য মুখের কাছে নিয়েছি, তখনই সে তার সমস্ত শক্তিকে পদযুগলে সংহত করে আমার নাকে–মুখে এমন জোরে খামচা লাগায় যে শুধু কবুতরের রক্তে নয়, কবুতরের নখের আঁচড়ে আমার রক্তেও আমার মুখমণ্ডল রঞ্জিত হয়ে যায়। যন্ত্রণা সইবার চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হই। তখন কবুতরের রক্ত পান করা ও তার জ্যান্ত মাংস ভক্ষণ করার পরিবর্তে তাকে রান্না করে খাওয়ার কথা ভাবতে বাধ্য হই। দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নকল রাক্ষস তখন এক অসহায় কিশোরে পরিণত হয় এবং আহত জাদুকরের পরিচর্যায় উপস্থিত দর্শকদের ব্যস্ত হতে দেখা যায়।
আমিও দমবার পাত্র নই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি এবং আমার দ্বিতীয় জাদুটি প্রদর্শনের জন্য তৈরি হই। সপ্রাণ কবুতর ভক্ষণে ব্যর্থ হলেও নিষ্প্রাণ ব্লেড ভক্ষণে আমি অভাবিত সাফল্য প্রদর্শন করি। আমার জাদু প্রদর্শনের খবর অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার বাবার কানে পৌঁছায়। তিনি এসে কান ধরে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান। আমাকে নিয়ে তখন তাঁর মহাদুশ্চিন্তা দেখা দেয়। আমার মুখমণ্ডলের ক্ষতস্থানে ডেটল প্রয়োগ করা হয়, কিন্তু আমার পাকস্থলীর ভেতর থেকে স্টেনলেস স্টিলের ব্লেড দুটো কীভাবে বের করা যায়, তা নিয়ে তিনি মহাচিন্তায় পড়েন। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রাতঃকৃত্যের প্রতি তাঁর উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পায়। পূর্বনির্ধারিত অজানা কারণে ঈশ্বর ওই জাদুকরের সহায় ছিলেন, তাই আমার বড় কোনো বিপদ হয়নি। কিন্তু বাবার চোখে ঘুম নেই। যাঁর পুত্রের পাকস্থলীতে গোটা কয়েক স্টেনলেস ব্লেড থাকে, তাঁর পক্ষে নিশ্চিত থাকা অসম্ভব।
মোটা মোটা কবিরাজি বই পড়ে বাবা তখন আমার জন্য একটি চমৎকার মহৌষধ আবিষ্কার করেন। স্থির হয় প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে খালি পেটে এক গ্লাস ষাঁড়ের মূত্র পান করতে হবে। তাতে নাকি আমার পাকস্থলী, কিডনি ও লিভারের শক্তি বাড়বে। আমাদের গেরস্থালি ছিল। বছরভিত্তিতে কাজের লোক রাখা হতো হালচাষের জন্য। সেই গেরস্থালির কারণে গোয়ালে গরুর অভাব ছিল না। একটি বেশ নাদুস–নুদুস ষাঁড় ছিল গোয়ালে। স্থির হয় ওই ষাঁড়ের সকালের প্রথম মূত্রটা বালতিতে সংগ্রহ করবে খান বাহাদুর (বছর চুক্তিতে আমাদের বাড়িতে কাজ করত) এবং নিদ্রাভঙ্গের পর ওটাই হবে আমার দিনের প্রথম পানীয়। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা শুধু আমার বাবার নয়, আমার নিজেরও হয়েছিল, কারণ ব্লেড ভক্ষণের কাজটি গোপনে দীর্ঘদিন ধরেই আমি করে আসছিলাম। তাই প্রতি সকালে উষ্ণ খেজুরের রস মনে করে গ্লাসভর্তি ষাঁড়ের মূত্র আমি চোখ বন্ধ করে পান করতে শুরু করলাম।
ঘটনাটি যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। বাবা খান বাহাদুর এবং আমার ভাইবোনদের ডেকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেন। বাবার আবিস্কৃত ওই প্রাতঃস্মরণীয় পথ্যটি আমাকে প্রায় মাসখানেক পান করতে হয়েছিল। তাতে আমার স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি হয়।
ঘটনাটি অবশ্য শেষ পর্যন্ত গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। ওষুধের আবিষ্কারক নিজেই একদিন ঘটনাটি তার বন্ধু নারায়ণ কবিরাজ মহাশয়ের নিকট ব্যক্ত করেন। নারায়ণবাবুর ছেলে পুলক ছিল আমারই সহপাঠী। নারায়ণবাবুও আমার বাবার দেখাদেখি পুলককে ষাঁড়ের মূত্র পান করানোর চেষ্টা করেন এবং আমার নাম করে বলেন যে আমি নিয়মিত তা পান করি। পুলক মহাপুলকে ওই ঘটনার কথা রাষ্ট্র করে দেয়। ক্লাসের গণ্ডি অতিক্রম করে প্রথমে স্কুলে, পরে স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করে মুখরোচক সংবাদটি সারা বারহাট্টায় ছড়িয়ে পড়ে। লজ্জায় আমার পক্ষে স্কুলে যাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন বাবার প্রতি খুব রুষ্ট হলেও পরে আমি বাবার দূরদৃষ্টির প্রশংসা করতে বাধ্য হই।