বারুদমাখা বাতাস

গুমোট গরম আর থেকে থেকে বৃষ্টির ভেতর মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল রুদাবার। ঘুম এখন আসেই-বা কখন! কয়েক দিন ধরে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। রুদাবা কখনো কারফিউ দেখেনি, শুধু বইয়ে পড়েছে। তবে কারফিউ নিয়ে সে খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়, যতটা উদ্বিগ্ন নেট না থাকা নিয়ে। কী হচ্ছে দেশে, সে কিছুই জানতে পারছে না! অফিস বন্ধ। এ অবস্থায় রুদাবা বাইরে না গেলেও তার স্বামী মঈন যাচ্ছে। মঈনকে আটকাবে, সাধ্য কার! 

পানির পিপাসা পেয়েছে খুব, অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খাটের সাইড টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে নেয় সে। বিদ্যুৎ নেই গত রাত থেকে। কার্ডের লিমিট শেষ হয়ে যাওয়ার পর লোন নেওয়া হয়েছিল, তা-ও শেষ। নেট বন্ধ থাকায় রিচার্জ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কখন নেট আসবে, কখন সবকিছু স্বাভাবিক হবে, বুঝতে পারছে না কেউ। বাসায় কেবল লাইন নেই। টিভি, সেটাও চলে নেটে। আর এখন তো বিদ্যুৎই নেই। খবর জানার উপায় একমাত্র রেডিও। মোবাইলের রেডিওতে অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর ঢুকতে পেরেছিল সে, যদি খবরটা শোনা যায়! কখন নেট আসবে, কারফিউ ছাড়বে বা অফিস খুলবে—এই খবর জানার চেষ্টা। বিশেষ করে বিদ্যুতের সমাধান কীভাবে হবে! অথচ অবাক কাণ্ড, প্রতিটা রেডিওতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওরা শুধু গান বাজাচ্ছে! সঙ্গে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনগুলো খুব অশ্লীল লাগছে এখন। দেশের এ রকম পরিস্থিতিতে জরুরি ঘোষণাগুলো কোথায় পাওয়া যাবে, কে জানে! বেসরকারি চ্যানেলগুলোর যখন এই অবস্থা, তখন বাংলাদেশ বেতার কী খবর দেবে আর! যদিও-বা ধরা যায়, তাদের খবরের পরিধি তিন কি চার মিনিট। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, আজও কারফিউ বলবৎ থাকবে, উন্নয়নকে ধ্বংস করা হচ্ছে বলে দু-চারজন মন্ত্রীর ধমকধামকের পর ভারী ও মাঝারি বৃষ্টির খবরে এর পরিসমাপ্তি!

এই কয়েক দিনে রেডিওর মতিগতি মুখস্থ হয়ে গেছে রুদাবার। তারপরও হেডফোন কানে লাগিয়ে ক্রমাগত স্ক্রল করে যায়। জীবনে প্রথমবারের মতো হাসিনার দেওয়া ভাষণও পুরোটা শুনেছে সে। মহিলার অভিনয়প্রতিভার কথা কে না জানে! তবে উচ্চারণবিভ্রাট না থাকলে তার অভিনয় বেশ উপভোগ্য হতে পারত।

২.

এক দিন অপেক্ষার পর ঘোষণা এসেছে, বিদ্যুতের অফিসগুলোয় গিয়ে কার্ড রিচার্জ করিয়ে আনতে হবে।

মঈন যেতে পারবে না, সে জরুরি কাজ আছে বলে দুদ্দাড় করে সকালবেলায় বেরিয়ে গেল।

বছিলার ওদিকে পরিস্থিতি জটিল বিধায় বুয়া কাজে আসতে পারেনি। গতকাল কাজে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছিল, থানার কাছে তিনটা লাশ পড়ে থাকতে দেখেছে। রুদাবার বিশ্বাস হয়নি। বুয়া কি বাড়িয়ে বলছে? এ কীভাবে সম্ভব! দেশে কি যুদ্ধাবস্থা চলছে! স্বাধীন দেশ, নিজের দেশের মানুষকে কেন এভাবে মেরে ফেলতে হবে?

ঘরের জরুরি কিছু কাজ সেরে বিদ্যুৎ অফিসে যেতে একটু দেরিই হয়ে গেল রুদাবার। 

সেই কখন থেকে বিদ্যুৎ অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে রুদাবা। লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মধ্যে চাপা ক্ষোভ স্পষ্ট। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলে মধ্যবয়স্ক একজন বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, বুঝলেন, কোনো স্বাধীন দেশে এ রকম সম্ভব?’

তার কথায় সায় দেয় অনেকে। নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল ছোড়ার মতো একটা ঢেউ উঠে আবার তা অচিরেই মিলিয়ে যায়। কয়েক প্লাটুন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কড়া পাহারায়। এ রকম চলছে সেই সাত জানুয়ারি নির্বাচনের আগে থেকেই। যেখানেই জনসমাগম, সেখানেই কড়া পাহারা।

দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে চাপা অস্থিরতা। কেউ ঘন ঘন নেট চেক করছে, কেউ সময় দেখছে। পেছন থেকে চাপা গুঞ্জন উঠেছে, ‘তিনটা তো প্রায় বেজে গেল, আজ আর রিচার্জ করা যাবে না? আজও অন্ধকারে কাটিয়ে দিতে হবে!’

কিন্তু মানুষের দীর্ঘ লাইনটা যেন রেললাইনের মতো স্থির।

একদুপুর ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কাজটা না হওয়ায় যতটা হতাশ রুদাবা, তার চেয়ে বেশি হতাশ হয় কারফিউর সময় ঘনিয়ে আসায়। রাস্তায় কী তুমুল ব্যস্ততা তখন সবার মধ্যে! মানুষ যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে ঘরের দিকে। কেউ কারও দিকে তাকানোরও ফুরসত নেই। রাস্তায় যানবাহন কম। রুদাবা কীভাবে ঘরে ফিরবে, বুঝে উঠতে পারছে না। একটা খালি রিকশা নেই, সিএনজি তো স্বপ্ন! এত দিন গলিতে চলা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো এখন মেইন রোডে উঠে এসেছে, কিন্তু খালি নেই একটাও। একেকটায় চার-পাঁচজন উঠে বসেছে। লেগুনাগুলো কোথায় যায়, কোথা থেকে ছাড়ে, জানে না সে। একটা বাসে উঠতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু রাস্তায় বাস এত কম! দু-একটা যা আসে, সাঁই সাঁই করে ছুটে যায়। অগত্যা হাঁটতে শুরু করে রুদাবা। মাথার ওপর বিকট শব্দে উড়ছে হেলিকপ্টার। রুদাবা ভয়ে ভয়ে একবার আকাশের দিকে তাকায়। খবরে শুনেছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়ে মেরে ফেলা হয়েছে অনেককে। নেট না থাকায় মনে হচ্ছে, জগৎ কেমন থমকে আছে। মিডিয়া যতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলার চেষ্টা করুক! রুদাবা বুঝতে পারে, কোনো কিছু স্বাভাবিক নেই। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে রুদাবার মনে পড়ল মোমবাতির কথা। মোড়ের দোকানগুলো শাটার টেনে দিয়েছে এরই মধ্যে। রুদাবা প্রায় ছুটে গিয়ে দ্বিগুণ দামে চারটা মোমবাতি কিনে বাড়ি ফেরে।

মঈন তখনো ফেরেনি। রুদাবা ফোন করে তাকে। একবার, দুবার—বারবার, কিন্তু ফোন ধরে না মঈন!

সারা দিনের ক্লান্তির সঙ্গে সঙ্গে ততক্ষণে তার মনে ভর করেছে উদ্বেগ। এই যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে মঈন কোথায় আটকাল? তার কাছে কি কারফিউ পাস আছে!

ফোনটা এল ঘোর সন্ধ্যাবেলায়। মঈনের ফোন। রুদাবা মঈনকে এত দেরি করে রিপ্লাই দেওয়ার জন্য কড়া কিছু কথা শোনাবে ভেবে নেয় মনে মনে। কিন্তু ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে এক অচেনা কণ্ঠস্বর খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে, ‘আপনি কি মঈন নামের কাউকে চেনেন? ভদ্রলোক গুলি খেয়েছেন। মোবাইলটা তার পকেটে ছিল। আমি তাকে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে দিয়েছি।’

রুদাবা কিছু বলার আগেই কেটে গেল ফোনটা!

৩.

হাসপাতালজুড়ে অসংখ্য মানুষ। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে। রিকশায়, ভ্যানে যে যেভাবে পারছে, আহত মানুষ নিয়ে ঢুকছে হাসপাতালে। হাসপাতাল নয়, যেন হাশরের ময়দান। ইয়া নফসি ইয়া নফসি রবে ছুটছে সবাই।

ইমার্জেন্সিতে অনেক খোঁজাখুঁজি করে মঈনকে পাওয়া গেল না। রুদাবার তখন দিশাহারা অবস্থা। এতক্ষণ সে শক্ত থাকলেও ওই মুহূর্তে মনে হলো যেন তার পা দুটো কেউ কেটে নিয়ে গেছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মঈনের বন্ধু নাফিস এসেছে তার সঙ্গে। সে তড়িঘড়ি রুদাবাকে ধরে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দেয়। রুদাবা নাফিসের হাতটা শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘নাফিস ভাই, বলেন তো, মঈন কি রাজনীতি করে? করত কখনো?’

‘না ভাবি, আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি, এখানে প্রতিবাদী হতে কি কাউকে সরাসরি রাজনীতি করতে হয়? যেকোনো সচেতন মানুষের পক্ষেই কি এখন মিছিলে যাওয়া স্বাভাবিক নয়? কোথায় আমাদের নাগরিক অধিকার, কোথায় আমাদের স্বাধীনতা! কোনো স্বাধীন দেশের সরকার তার নাগরিকের বুকে এ রকম কুকুরের মতো গুলি চালাতে পারে!’

রুদাবা রাজনীতির মারপ্যাঁচ অত বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। সে শুধু চেয়েছে মানুষের মতো বাঁচতে। সেই বাঁচতে চাওয়া তো মহার্ঘ কোনো চাওয়া নয়! কিন্তু তাকে কেন আজ এখানে বসে থাকতে হবে! এই অসংখ্য মানুষের আহাজারিতে কেন ভারী হয়ে থাকবে হাসপাতাল প্রাঙ্গণের আকাশ-বাতাস!

৪.

হাতে একটা ছোট্ট স্লিপ নিয়ে পরাজিত মানুষের মতো হেঁটে আসছিল নাফিস।

রুদাবা ছুটে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার বন্ধুকে পেলেন? তাকে কি বেডে দিয়েছে? কোথায়? নিয়ে চলেন আমাকে।’

নাফিস কোনো কথা না বলে রুদাবাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। এই হাঁটার যেন শেষ নেই।

অবশেষে নাফিস যখন মর্গের সামনে এসে থামে, রুদাবা তখন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাকে অসম্ভব ধীর ও শান্ত মনে হয়। রুদাবা যেন ধরেই নিয়েছে যে এখানে মঈনকে পাওয়া যাবে না। মঈন বেঁচে আছে, সে হয়তো প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে!

রুদাবা এর আগে কখনো মর্গে আসেনি। মর্গ, মৃত মানুষ সম্পর্কে তার আজন্ম ভয় ছিল। অথচ আজ মর্গজুড়ে যখন মানুষের ভিড়, তখন তার সব ভয়, সব শঙ্কা কোথায় যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে!

মর্গ সম্পর্কে তার যেমন ধারণা ছিল, সিনেমায় যেমন দেখেছে—সারি সারি বাক্স, তার ভেতরে শোয়ানো লাশ, এই ঘরটা একদমই তেমন নয়। একটা ছোট্ট ঘরে তাকে নিয়ে ঢুকেছে নাফিস। গুমোট ঘরটায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের গা গুলানো গন্ধ এসে নাকে লাগল তার। সে শক্ত করে নাফিসের হাতটা ধরল। এই মুহূর্তে তার নিজেকে শক্ত রাখতে হবে, ভেঙে পড়া চলবে না কিছুতেই।

ঘরের ভেতরে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে নাম না জানা অনেক মানুষের লাশ। লাশেরা সারিবদ্ধ নয়, এলোমেলো। ডাক্তার মৃত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে যাকে যেভাবে পেরেছে যেন বস্তার মতো ফেলে রেখে গেছে এই ঘরে। একজনের পায়ের ওপরে পড়ে আছে আরেকজনের দেহ, কারও মাথা ছুঁয়ে আছে অন্য দেহের পা। নাম-ঠিকানাহীন সেই সব পায়ের বুড়ো আঙুলে সুতায় বাঁধা একটা নম্বর ঝুলে আছে শুধু। ঘরময় তাজা রক্ত, ছোপ ছোপ, এখনো রক্ত বইছে কোনো কোনো লাশের ক্ষত থেকে। এত রক্ত! তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে-ই কখন, এখনো এত রক্ত! সে মনে মনে শুধু বলছে, ‘হে আল্লাহ! এখানে যেন না পাওয়া যায় মঈনকে, যেন সে না থাকে এখানে!’ একই সঙ্গে তার মস্তিষ্কের ভেতরের আরেকটা অংশ বলছে, যা-ই ঘটুক, শক্ত থাকতে হবে তাকে। সামনে হয়তো অনেক কঠিন একটা সময়। পুলিশি ঝামেলা, ক্ষমতাবানদের উৎপাত, আরও কত কী!

এরই মধ্যে তার থেকে দুই কদম সামনে এগিয়ে থাকা নাফিস ডেকে ওঠে, ‘ভাবি!’

নাফিসের সেই স্বরে কী ছিল কে জানে! মুহূর্তে রুদাবার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসে! তার চোখেমুখে অবিশ্বাস! সে যেন এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে! যেখানে বাতাস বইছে না, পৃথিবী থমকে আছে।

দুঃস্বপ্নের সেই পথ দীর্ঘতর। যেন বা হাজারো বছরের নিস্তব্ধতা ভর করেছে সেখানে। রুদাবার মুখে কোনো কথা সরে না। বিলাপহীন, প্রলাপহীন নীরবতা পেরিয়ে সে পৌঁছায় মঈনের লাশের পাশে।

প্রাণহীন মঈন মেঝেতে পড়ে আছে নিতান্ত অবহেলায়। যেন মানুষ নয়, একটা বস্তার মতো ফেলে রেখে গেছে তাকে। মৃত মানুষের যে সম্মান থাকে, সেটা কি জানে না ওরা!

রুদাবা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মঈনের পাশে। তার ছড়িয়ে থাকা উষ্ণতাহীন বরফের মতো ঠান্ডা হাত দুটি সোজা করে দিয়ে, কপালের ওপর ছড়িয়ে থাকা অবিন্যাস্ত চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে অভিমান ভরা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, ‘চলে যাচ্ছো যাও, কিন্তু বাতাসে যেদিন বারুদের গন্ধ থাকবে না, সেদিন কি কেউ মনে রাখবে যে তুমি আমাদের আগামীর জন্য তোমার বর্তমানকে বিসর্জন দিয়েছ! এই কথা কি কেউ মনে রাখে?’