ঘরের ভেতর হাতি

তিনি তাঁর ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে মহিলার হাতে দিয়ে বললেন, দেখতেই পারছেন আমাদের অফিস এখান থেকে চলে যাচ্ছে। আমাদের নতুন ঠিকানা হবে এটা। হাত দিয়ে লেখা আছে।

হাতিটা একইভাবে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাঁকে দেখছে। বেশ একটা অগ্রাহ্য করার ভঙ্গি, যেন নড়বে না তার পছন্দমতো কিছু একটা না হলে, এ কথা বলতে চায়। হাতির স্মৃতিশক্তি প্রখর, কিছুই ভোলে না তারা যত পুরোনো হোক। সময় বুঝে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে তোলে ওপরে আছাড় মারার জন্য। কিংবা মাটিতে ফেলে এক পা তুলে পিষে মারতে চায়। এই হাতি সেই স্বভাবের না, তা কে বলতে পারে?

হাতিটার সঙ্গে তাঁর রোজ দেখা হয়, যেন এটা তার স্থায়ী থাকার জায়গা। সে যেন বলতে চায়, যত দিন তিনি এখানে বসে অফিস করবেন, সে–ও থাকবে একইভাবে দাঁড়িয়ে অনড়, অচল হয়ে। যদি এমন হয় তাঁর আর অফিস করার দরকার নেই, তখন হাতিটাও এখানে থাকবে না। তিনি অফিসে এই হাতির উপস্থিতি দেখে এমন অভ্যস্ত যে এখন আর অবাক হন না।

দুই

একে একে সব ঘরের আসবাব নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি তাঁর অফিস রুমে বসে হাতিটার দিকে তাকিয়ে আছেন, সে–ও তাঁকে দেখছে। সেই আগের মতো তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি। অফিসের সব ঘর খালি করে দেওয়া হচ্ছে, এই ঘরের আসবাব নেওয়া হবে সবশেষে। অন্য ঘরের আসবাব সরিয়ে নেওয়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে। কিছু ধুলাও এসে পড়ছে উড়ে, শোনা যাচ্ছে নানা রকমের শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কথাবার্তা হচ্ছে জোরে জোরে। দেয়ালে ধাক্কা লাগার শব্দ হচ্ছে। বাড়িওয়ালার কেয়ারটেকার সতর্ক করে দিচ্ছে শ্রমিকদের সাবধানে আসবাব নামানোর জন্য।

তাঁর সামনে কয়েকটা কার্টন এনে রাখা হয়েছে। আলমারি থেকে ফাইলগুলো বের করে বাছাই করা হচ্ছে কোনটা কোন কার্টনে রাখা হবে। এই সব ফাইলের সব তথ্য অবশ্য কম্পিউটারে আছে। তবু হার্ড কপিগুলো সংরক্ষিত হয়েছে ইমার্জেন্সির জন্য। কম্পিউটারের তথ্য মুছে গেলেও হার্ড কপি দেখে কপি করা যাবে। কম্পিউটার নিজে থেকেই মুছবে না, যা রেকর্ড করা হয়েছে। বাইরে থেকে কেউ হ্যাক করে মুছে দিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এখন অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। এনক্রিপ্টেড হলেও ডেটা সংরক্ষণ করা যাবে, এটা বলা যাচ্ছে না।

তিনি প্রতিটি ফাইল তাঁর সামনে রাখা ডেস্কটপ কম্পিউটারে দেখে বলছেন কোনটা কোন কার্টনে রাখতে হবে। এ, বি, সি—এভাবে গুরুত্ব অনুযায়ী ফাইলগুলো গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। তিনি জানেন এর কোনো মানে হয় না। সব ফাইলের কেইসই গুরুত্বপূর্ণ, যতক্ষণ না সেসব নিষ্পত্তি হয়। তাঁর এই অফিসের কাজই হলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কেইসগুলো অনুসরণ করা। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর সমস্যার সমাধান না হলে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। বেশ সময়সাপেক্ষ এই পদ্ধতি আর প্রক্রিয়া।

কার্টনগুলোতে ফাইল রাখার জন্য যে নিয়ম অনুসরণ করছে তার স্টাফ সেটা যুক্তিসংগত আবার যুক্তিহীন, দুটোই বলা যায়। যাদের ১০ বছরের ওপর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের সি শ্রেণিতে আর যারা পাঁচ থেকে দশ বছর হলো নিখোঁজ, তাদের বি শ্রেণিভুক্ত করার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে? এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত যাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তারাই–বা এ শ্রেণিতে পড়ে কোন যুক্তিতে? এই আরবিট্রারি বিভক্তিকরণের চেয়েও যা বেশি অনৈতিক তা হলো এই নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিকটজনদের কাছে এটা গোপন রাখা। সি শ্রেণির নিখোঁজদের নিকটজনকে বলা হচ্ছে না যে তাদের কেইস এখন অগ্রাধিকার তালিকার নিচে নেমে গেছে। সরাসরি জানানো হচ্ছে না যে তাদের প্রিয়জনের খোঁজ পাওয়ার আশা নেই। এই সত্যভাষণে তারা আঘাত পাবে, কিন্তু মিথ্যা আশা নিয়ে না থেকে ধীরে ধীরে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মনোবল খুঁজে পাবে। এটা জেনেও অপ্রিয় সত্য তাঁরা লুকিয়ে রাখছেন নিখোঁজদের শ্রেণি বিভাগ করে। তিনি জানেন এমন ব্যবহার করা অনৈতিক। কিন্তু তারপরও তাঁকে করতে হচ্ছে। মানুষকে আশা দিয়ে রাখা হচ্ছে।

তিন

তিনি কার্টনে ফাইল রাখা তদারক করছেন, এই সময় বাড়িওয়ালা এলেন। সব দেখে বললেন, আজকের মধ্যে সব সরিয়ে ফেলতে পারবেন তো? আগামীকাল থেকে নতুন ভাড়াটে আসবে।

তিনি তাঁকে বললেন, আশা করি পারা যাবে। আসবাব সরাতে তো সময় নিচ্ছে না। অফিসের ডকুমেন্ট সরানোর কাজ একটু আস্তে আস্তে না করে উপায় নেই। তারপর বলেন, এসবের জন্যই তো অফিস, এদের নিয়েই তো আমাদের কাজ।

বাড়িওয়ালা নিজেই একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, আচ্ছা এই কাজ না করলেই নয়? এত ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী?

তিনি বললেন, এই কাজ কাউকে না কাউকে তো করতে হবে। এতগুলো মানুষের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিকটজন উদ্বিগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু না করলে কী করে চলে?

বাড়িওয়ালা বললেন, এর জন্য থানা-পুলিশ আছে। আদালত আছে। আপনাকে অফিস খুলে বসতে হবে কেন?

তিনি বললেন, তা আছে। সেখানে তাঁরা যাচ্ছেন। আমরা শুধু তাঁদের বাড়তি সাহায্য করছি।

বাড়িওয়ালা বললেন, বেশ। বাড়তি সাহায্য করেন। কিন্তু আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে আমাকে বিপদে ফেললেন কেন?

তিনি বললেন, এ কথা আপনি আগেও বলেছেন। আপনার বিপদে পড়ার বিষয়টা আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়নি।

বাড়িওয়ালা বললেন, সবকিছু কি পরিষ্কার করে বলা যায়? আভাস–ইঙ্গিত তাহলে রয়েছে কেন? আমি বলেছি, এত লোক আপনার অফিসে যাওয়া-আসা করে। এতে আশপাশের মানুষ বিরক্ত হয়। আমার কাছে অভিযোগ করে।

হ্যাঁ। তা বলেছেন। উত্তরে আমি বলেছি, যাঁরা আসেন, তাঁরা একসঙ্গে দল বেঁধে আসেন না। তাঁরা হইচইও করেন না। প্রতিবেশীদের আপত্তির কোনো কারণই থাকতে পারে না। আপনি মিছেমিছি আমাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলেন।

বাড়িওয়ালা স্বর নামিয়ে বললেন, বুঝতে পারছেন না কেন? চাপ, আমার ওপর দারুণ চাপ ছিল। না হলে আপনাকে নোটিশ দিতে যাব কেন? নিয়মিত ভাড়া দিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা রিপেয়ার, সেটা লাগানো, এই সব বলে বিরক্ত করেননি। তবু কেন নোটিশ দিতে হলো তা আপনাকে বুঝতে হবে। এত দিনে যে বোঝেননি, এতে আমি বেশ অবাক হচ্ছি।

তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন, চাপের কথা বলেননি। এখন বুঝতে পারছি। এ কথা আগে বললেই হতো। তাহলে আপনার সম্বন্ধে আমি খারাপ কিছু ভাবতাম না।

কী খারাপ ভেবেছেন? বাড়িওয়ালা ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞাসা করেন।

ভেবেছি আপনি বেশি ভাড়ার লোভে অন্য কাউকে এই ফ্ল্যাট দিতে চাইছেন।

বাড়িওয়ালা দাঁত দিয়ে জিব কেটে খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, ছি ছি ছি। তাই ভাবলেন আপনি আমার সম্বন্ধে?

তিনি বললেন, ভাবতে বাধ্য হলাম। অন্য কেউ হলে একই কথা ভাবত।

বাড়িওয়ালা মন খারাপ করে বলেন, হ্যাঁ, তা ভাবত। তেমন ভাবারই কথা। কেন ভাববে না?

বাড়িওয়ালার মন খারাপ হতে দেখে তিনি বললেন, এখন আর আপনার সম্বন্ধে খারাপ ভাবছি না।

ভাবছেন না? বাহ্​! বড় ভালো মানুষ আপনি। মাসে মাসে নির্দিষ্ট তারিখে ভাড়া দিয়েছেন। এটা-সেটা করার জন্য বায়নাক্কা করেননি। আপনাকে ভাড়াটে রাখতে পারলাম না, এটা আমার জন্য দুঃখের ব্যাপার হয়ে থাকল। তারপর কী ভেবে বললেন, আপনাকে এখনো ভাড়া দিতে পারি, যদি একটা কাজ করেন।

এখন কী করে তা সম্ভব? আসবাব অর্ধেক সরানো হয়েছে। তবু বলুন দেখি কী কাজ করলে আমাকে আবার ভাড়া দেবেন?

কাজটা হলো আপনি এখন অফিস খুলে যা করছেন, সেটা বাদ দিয়ে অন্য কিছু করবেন।

যেমন? তিনি কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকেন।

বাড়িওয়ালা বলেন, যেমন ম্যারেজ কাউন্সেলিং। আজকাল অনেক বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। দশ বছর, বিশ বছরের বিয়েও টিকছে না। ম্যারেজ কাউন্সেলিং খুব ভালো পেশা হতে পারে।

শুনে তিনি হেসে বললেন, তা হতে পারে। কিন্তু আমি যে কাজটা করছি, সেটাও তো কাউকে না কাউকে করতে হবে?

বাড়িওয়ালা মুখ শুকনো করে বললেন, আপনার এই কাজের একটা বড় অসুবিধা কী জানেন?

কী?

আপনাকে ঘন ঘন অফিস বদলাতে হবে। খুব ঝামেলার না সেটা?

তিনি সামনে ঝুঁকে টেবিলে হাত রেখে বললেন, চা খাবেন? ফ্লাস্কে গরম পানি আছে। প্যাকেটে টেটলির চায়ের ব্যাগ।

বাড়িওয়ালাকে চা খেতে দিয়ে তিনি বললেন, আপনি ধীরেসুস্থে চা খান। আমি এর মধ্যে অফিস সহকারীকে বলছি কোন কার্টনে কোন ফাইল রাখতে হবে। দুপুরের মধ্যে কাজ শেষ করে বিকেলে বাসা হ্যান্ডওভার করব আমি।

এই বলে তিনি স্থগিত রাখা কাজ আবার শুরু করলেন। এ, বি, সি লেখা কার্টনে দ্রুত ফাইলগুলো রাখতে থাকল তাঁর সহকারী। তিনি কম্পিউটারে একনজরে দেখেই বলে যেতে থাকলেন কোন ফাইল কোন কার্টনে যাবে।

কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এই সময় পিয়ন এসে বলল, এক মহিলা দেখা করতে চান।

তিনি কাজ থামিয়ে একবার বাড়িওয়ালার দিকে তাকালেন, তারপর পিয়নকে বললেন, আসতে বলো।

কিছুক্ষণ পর এক মহিলা ঢুকলেন। বয়স তিরিশের ওপর হবে। চোখে-মুখে বিষণ্নতা। তাঁর সঙ্গে বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে। তাকেও বিষণ্ন দেখাচ্ছে।

ভদ্রমহিলা বসে বাড়িওয়ালাকে দেখে কিছু বলতে ইতস্তত করলেন। তাঁর ভাব দেখে তিনি বললেন, এর সামনে বলতে পারেন। তিনি জানেন আমার কাছে কেন মানুষ আসে।

ভদ্রমহিলা বললেন, গত মাসে বাড়িতে এসে কারা যেন ওর বাবাকে নিয়ে গেল। আমাকে বলল রাতেই ফিরে আসবে। এক মাস হয়ে গেল, এখনো আসেনি। তার ফোনটাও বন্ধ। এই বলে তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছলেন।

তিনি তাঁর ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে মহিলার হাতে দিয়ে বললেন, দেখতেই পারছেন আমাদের অফিস এখান থেকে চলে যাচ্ছে। আমাদের নতুন ঠিকানা হবে এটা। হাত দিয়ে লেখা আছে। দুদিন পর আমাদের অফিসে আসুন। এর মধ্যে আমরা অফিস গুছিয়ে নেব।

মহিলা বললেন, মেয়েটা তার বাবা যাওয়ার পর থেকে খাওয়াদাওয়া করে না। স্কুলে যায় না। তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার মেয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমিও তো খাও না মা।

মহিলা মুখ নিচু করে রাখলেন। একটু পরপর চোখ মুছলেন শাড়ির আঁচল তুলে।

বাড়িওয়ালা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে মহিলাকে বললেন, আপনি এখনই বলুন যা বলার। আমি উঠে যাচ্ছি।

উঠতে উঠতে তিনি তাঁর উদ্দেশে বললেন, সিনেমার মতো হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি সত্যি বলছি, আপনার অফিস এখানেই থাকবে। তারপর যেতে যেতে বললেন, জীবনে কোনো সাহসের পরিচয় দিইনি। এই শেষবেলায় একটু চেষ্টা করে দেখি। হাঁ, আপনার অফিস এখানেই থাকবে।

তিনি সামনে তাকালেন। দেয়ালে হাতিটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে একদৃষ্টে দেখছে।