সন্ধ্যাবাহিত
শেষ রাতের দিকে ফার্মের মুরগি আর সবজিবোঝাই ট্রাকগুলো এগারো নম্বর বাজারের মোড়ে থামিয়ে আনলোড করে ওরা। ট্রাকের চাকা, আধমরা পাখিগুলোর ডাকাডাকি আর সবজিঅলাদের মৃদু কথাবার্তায় একটা অব্যর্থ শোরগোল মহল্লার অনেকেরই ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। মইনুদ্দিন চিশতী নিজেও এই দলের। তবে আজ ঘুম ভাঙলেও সে চোখ মেলে তাকাতে পারল না। প্রথমে অস্থির লাগল, তারপর ভয়। বিছানায় উঠে বসে সে বোঝে, ভারী পিচুটি জমেছে, চোখের পাতা দুটো যেন সেলাই করে দিয়েছে কেউ। খাটের কিনারা ধরে নিচে নামতে গিয়ে হুসনার কথা মনে পড়ল। সে থাকলে এত কষ্ট তাকে করতে হতো না। হুসনা মারা গেছে অনেক বছর।
বহুক্ষণ হাতড়েও সুইচবোর্ডটা খুঁজে পায় না মইনুদ্দিন। তখন বাধ্য হয়েই গলা চড়িয়ে ডাকতে হয়, ‘ইকবাল, ওই ইকবাল।’
ইকবাল মইনুদ্দিন চিশতীর একমাত্র সন্তান। পাশের ঘরেই সে থাকে তার বউকে নিয়ে। কয়েকবার ডাকতেই ইকবাল টলতে টলতে উঠে এল। ডিসেম্বরের শুরু এখন, ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে বাপের অন্ধকার ঘরটার দিকে তাকালে একটু বেশিই যেন শীত লাগে। এগোতে ইচ্ছা করে না, তবু সে জবাব দিল, ‘এই শেষ রাত্তিরি ডাকেন কেন আব্বা, কী হইছে?’
‘এট্টু লাইটখান জ্বালাই দিয়ে যা। চোখ উঠিছে মনে কয়। গরম পানি দিয়ে ধুতি হবে। তা পারবি এট্টু গরম পানি কইরে দিতি?’
‘সকালে দিবানি। এহনে মুখ ধুয়ার কী দরকার?’
‘কুথায় কী আছে দেখতি পাচ্ছিনে, পাইখানায় যাব কী কইরে?’
বাপের ঘরে এসে আলো জ্বালায় ইকবাল। বিরক্ত কণ্ঠে বলে, ‘কী জ্বালাতন শুরু করলেন। বসেন। গরম পানি আইনে দিচ্ছি।’
উষ্ণ পানিতে পরিষ্কার করার পর একটু আরাম লাগছে চোখে। যদিও কেমন কড়েকড়ে একটা অনুভূতি ভার করে রেখেছে মাথা। আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাল মইনুদ্দিন চিশতী। বলিরেখার সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। চুল–দাড়ি যা আছে, সব ধবধবে সাদা। চোখ দুটোয় যেন বা রক্ত জমেছে। হাতে–পায়ে তেমন জোর পায় না আজকাল, তাই আবার দেয়াল ধরেই সে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে, আস্তে করে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বাজারের মোড় এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। ট্রাকগুলো নেই আর। কিন্তু আধো অন্ধকারে একদল মানুষ নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে, বড় একটা মিছিলের মতো। ওরা কি আন্দোলনে যায়?
কিন্তু আন্দোলন তো শেষ। আগের স্বৈরাচারী সরকার পড়ে গেছে। দল বেঁধে এত এত মানুষ নেমেছিল রাস্তায়। নামবে না? পুলিশ যেভাবে মেরে মিসমার করল নিজের দেশের মানুষজনকে। রোজ এখানে দাঁড়িয়ে সে দেখত অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের, মূল সড়কের ওদিক থেকে প্রতিদিন কানে আসত গোলাগুলি আর টিয়ারশেলের আওয়াজ। অন্ধকারে অপস্রিয়মাণ নিঃশব্দ মিছিলটির দিকে তাকিয়ে মইনুদ্দিন চিশতীর লালচে চোখে কেমন একটা ভাবালুতা ফুটে ওঠে। আন্দোলন সে-ও করেছিল এক বয়সে। আজকাল স্মৃতি খুব প্রতারণা করে, ছাড়া ছাড়া কিছু ছবির মতো যুদ্ধের কথা মনে পড়ে তার, এর বেশি কিছু নয়। এহসানুল্লাহ যত দিন ছিল, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অনেক কথা বের করে আনত তার ভেতর থেকে। কত বছর হয়ে গেল এহসানুল্লাহও স্মৃতি হয়ে গেছে।
যুদ্ধ, হ্যাঁ, যুদ্ধে সে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল, এর ধরাবাঁধা উত্তরও একসময় সে দিতে পারত। মাতৃভূমি আক্রান্ত, শত্রুপক্ষকে নিধন করতে হবে। বিপ্লবী ছিল না চিশতী, ফিদেল কাস্ত্রোকে চিনত না। তাই ‘জন্মভূমি অথবা মৃত্যু’ কখনো সে আওড়ায়নি। যুদ্ধে গিয়েছিল কারণ, একটা ক্রোধ আর উত্তেজনা ছিল। দেশের মানুষকে পশুপাখির মতো খুন করছিল পাকিস্তানি মিলিটারি—ওদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে এর বেশি কী কারণ লাগত? কিন্তু কোন সেক্টরে সে যুদ্ধ করেছিল? চিশতীকে এখন কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না, বড়জোর সে বলতে পারে এহসানুল্লাহর কথা; বছরখানেক আগে নিউজ চ্যানেল থেকে একজন এসেছিল তার ইন্টারভিউ করতে, চিশতী মাথা চুলকে বলেছিল, ‘এত সব খিয়াল নাই, তবে এহসানুল্লাহ সব জানে বুঝিছেন, ওরে সব কইছি একসুমায়, ওর সব মুখস্ত। হই, আড়ংঘাটায় একবার মুখোমুখি হইছিলাম হানাদারের বিরুদ্ধে, হেভি ফাইট দিছিলাম, আমার বন্ধু ইউসুপের কান্ধে গুলি লাগিছিল।’
‘আর কিছু মনে পড়ে না?’
‘হই। পড়ে তো। আপনারা কী জানতি চান?’
‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলেন।’
‘বাংলাদেশ হইছে। ফাইন দেশ। এই দেশের জন্যিই তো যুদ্ধ করিছি। হেভি ফাইট দিছিলাম। এই তো। তারপর আবার জুটমিলি ঢুইকে গেলাম। আমি খাইটে খাওয়া লোক বুঝিছেন? এহসানুল্লাহ আমার সব কাহিনি জানে।’
‘উনি কে?’
‘কিডা?’
‘এহসানুল্লাহ।’
‘আমার নাতি, আমার এখ্যানই নাতি।’
‘ওহ আচ্ছা। উনি কোথায়?’
এহসানুল্লাহ যে কোথায়, সেটা আর বলার উপায় ছিল না মইনুদ্দিন চিশতীর। খুনখুনে শব্দ করে কেঁদেছিল সে সাংবাদিকের সামনে। তার সেই সাক্ষাৎকার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালও হয়েছিল। শেষ রাতের শীতল হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে অনেক দিন পর এহসানুল্লাহর ভাবনা আবার আক্রান্ত করল তাকে। জোয়ান ছেলে, হাট্টাকাট্টা শরীর। খুব টান ছিল, সারা দিন সঙ্গে লেগে থাকবে, ‘দাদা, যুদ্ধে যখন জিতলা, কিরাম লাগিছিল তুমার কউ দেখি।’
‘সেইডে এখ্যান বিষয়ই ছেলো। মাটিতি গড়ায়ে কান্দিছিলাম আমরা।’
‘তারপর?’
‘আর কী, দেশ স্বাধীন হইয়ে গেল। লোকে খুব দাম দেতো বুঝিছিস। ভালো লাগত তখনে। ঐ পন্তিকই। তোর দাদির সাতে বিয়ে হলো। তোর আব্বার জন্ম হলো। পুবপাড়া ছাইড়ে আর কুথাও তো যাইনি এরপর।’
‘জাতি ইচ্ছা করে না? দেশটা ঘুইরে দেকতি ইচ্ছা করে না?’
‘দেশ দেখিছি, যা দেখার যুদ্ধের সুমায়। আর কী দ্যাখপো।’
একে একে ফজরের আজান শুরু হলো মসজিদগুলোয়। ঘরে ঢুকে মাটির দলাটা হাতে নিয়ে তাইমুম করল মইনুদ্দিন চিশতী। এত শীত লাগছে, পানি দিয়ে ওজু করতে কষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু নামাজে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতিহা ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ল না। অনেকটা সময় জায়নামাজে দাঁড়িয়ে থেকে একসময় সে বিড়বিড় করে বলল, ‘খুদা, মাফ কইরে দেও, ক্ষমা কইরে দেও।’ বিছানায় আসার পর বুঝল চোখ দুটো আবার জোড়া লেগে গেছে পিচুটিতে। এই শীতকালটা হয়তো খুব ভোগাবে।
মইনুদ্দিনের ঘুম ভাঙল অনেকটা বেলায়। শনিবার, ইকবালের অফিস নেই আজ। রান্নাঘরে সবজি কুটছে মাহমুদা। দুপুরের রান্নায় দেরি হবে, গ্যাস ছিল না সকাল থেকে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল, নিউজ চ্যানেল চলছে। চিশতীর অবশ্য দেখার উপায় নেই, সবকিছুই ঘোলাটে দেখছে সে, ইকবাল পুরোনো একটা সানগ্লাস এনে চোখে পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এইটে খুলবা না, ঘরে সবার চোখ উঠলি তো বিপদ হবে।’
‘তা যা বলিছিস। একাত্তরে কিন্তু একবার এমন হলো, ইন্ডিয়ায় টেরনিংয়ে রইছি—এই সুমায় চোখ উঠার ব্যারাম শুরু হলো ক্যাম্পে সবার।’
‘হই, এই গল্প কতো করিছো আগে!’
ওদের কথাবার্তায় ছেদ পড়ল টিভির একটা খবরে। প্রথমে সবার ভ্রু কুঁচকে উঠল, এরপর বিস্ময়, শেষে উৎকণ্ঠা। সরকার পতনের পর অনেক হারিয়ে যাওয়া লোকজন নাকি ফিরে আসছে। বয়সে ইকবালের চেয়ে কিছু কম হবে এমন এক লোক বসে আছে তার নিজের ঘরের বিছানায়, রুগ্ন ভাঙা চেহারা। ক্যামেরার পেছন থেকে তাকে কেউ প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি এত দিন জেলে ছিলেন?’
‘জি। নিশ্চিত কইতে পারি না। তয় বন্দী আছিলাম।’
‘ছাড়া পেলেন কবে?’
‘গত পরশু দিন।’
‘কারা আপনাকে বাসায় রেখে গেছে?’
‘উনাদের চিনি না।’
উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে না পেরে দুর্বল দেহ নিয়েই সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মইনুদ্দিন চিশতী, ‘ইকবাল, আমাইগে এহসানুল্লাহও মনে হই গিরামের বাসায় ফিরে আসিছে, এখ্যান কল দে তো। কল দিয়ে খোঁজ নে।’ মাহমুদা ততক্ষণে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে। ইকবাল একটা যন্ত্রের মতো ফোন হাতে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কল দেয়। সেখানে তার চাচাতো ভাইয়েরা থাকে। কিন্তু আশার কথা কিছু শোনা যায় না। ইকবাল বলে, ‘না আব্বা, ওইখেনে এইরাম কিছু তো কেউ শুনে নাই।’
মাহমুদা কিছুটা আর্তস্বরে ইকবালের কাছে প্রস্তাব করে, ‘পুবপাড়ায় যাবা? চলো যাই। আমার ছুয়ালডা যদি বাসায় আইসে আমাইগে কাউরে না দেখতি পায়?’
‘নিখোঁজ সংবাদ: মোহাম্মদ এহসানুল্লাহ, বয়স ১৯। পিতা: মোহাম্মদ ইকবাল, মাতা: মোছা. মাহমুদা আক্তার, দাদা: বীর মুক্তিযোদ্ধা মইনুদ্দিন চিশতী। গত রবিবার, ২৩শে অক্টোবর ২০১৩ সন, পুবপাড়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। এর পর থেকে তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না...’
পুবপাড়ায় ওরা তিনজনই ফিরে আসে। একদিন যেভাবে চলে গিয়েছিল, এ ঠিক তার উল্টো, এবার কোথাও যেন একটা আশা জেগে আছে। এক দিন–দুই দিন, এভাবে সপ্তাহখানেক কেটে যায়। পুরোনো পত্রিকা থেকে কেটে রাখা নিখোঁজ সংবাদটা নিজের তেলচিটে পড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগের এক চিপা থেকে বের করে পুত্রের হাতে দেয় মইনুদ্দিন চিশতী, ‘তুই কি এইডে ফেসবুকি দিবি? দে না, যদি কাজ হই।’ ইকবাল কিছু বলে না। অনেক দিন পর বুকটা এত ফাঁকা লাগে। নিজেকে প্রবোধ দিতে সে বিড়বিড় করে, ‘কাজের ক্ষতি হচ্ছে, ঢাকাই যাওয়া দরকার…’
এহসানুল্লাহকে গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে পুলিশ পরিচয়ে একদল লোক ধরে নিয়ে গিয়েছিল, এটুকুই শুধু তারা জানতে পারে সেই সব দিনে। কিন্তু এই ভাসা ভাসা খবরে কেসকামারিও বা কীভাবে করা চলত? মইনুদ্দিন চিশতী তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টা যতভাবে সম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল জীবনে প্রথমবার। থানায় গিয়ে বসে থাকত। একসময় তো তাকে দেখলেই তেড়ে আসত ওরা, ‘মুরুব্বি, কী এমন আইসে সুমায় নষ্ট করেন। যান তো, প্রমাণ ছাড়া আপনি কেস করতি পারবেন নানে।’ একই কাজ সে আর ইকবাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়েও করে। স্মারকলিপি দেয়। পুলিশ জিডি নেওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই করতে রাজি হয় না। আর কয়েক বছর এভাবে কেটে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারে, তার চিন্তাভাবনার সুতো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, কোনো কিছুই যেন ঠিকঠাক সে আর মনে করতে পারছে না। তার নাতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল, ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল পুবপাড়া থেকে। এমন সোনার ছেলে স্রেফ হারিয়ে গেল। কত দিন হলো? এক যুগের মতো কি? তবে, এখন নিশ্চয়ই ফিরবে। এই নতুন দেশে, অন্যায়ভাবে কেউ নিশ্চয়ই আর বন্দী থাকবে না কোথাও। নতুন দেশ না? সবাই তো তা–ই বলে।
ডিসেম্বরের কড়া শীতে নিজের ভেতরে আরও সেঁধিয়ে যায় মইনুদ্দিন চিশতী। পুত্রবধূ মাহমুদা কোনো কোনো দিন তাকে ধরে উঠোনের মাঝখানে রাখা ইজিচেয়ারে বসতে সাহায্য করে। দুপুর বিকেলে গড়ায়, মোলায়েম রোদ নরম হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যার মুখে নামা পাতলা কুয়াশা বড় দ্রুতই ঘন হতে থাকে। সেই কুয়াশার মধ্যে এক যুবকের শরীর যেকোনো সময় প্রকট হবে, এ রকম মনে হয় তার।