হারিকেন

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

হারিকেন কীভাবে জ্বালায়?

রোকেয়ার প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল সাব্বির।

আষাঢ় মাসের গরম। বৃষ্টির দেখা নেই। অন্ধকারে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে ছিল। শরীর ঘামছে দরদর করে। একটাই মোমবাতি ছিল ঘরে। সেটা শেষের দিকে। তাদের একমাত্র সন্তান অনিম এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ছাত্রদের আন্দোলনের জন্য পরীক্ষা বন্ধ। ছেলেটা ছটফট করছে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য। রোকেয়ার কড়া পাহারার জন্য পারছে না। মোমবাতি দিয়ে তাকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে রেখেছে।

 সত্যি, রোকেয়া একটা পুরোনো হারিকেন হাতে বসে আছে বিছানার নিচে, ফ্লোরে। অনিম দীর্ঘক্ষণ ধরে রাগ করে আছে। যাকে যাকে সে চেনে, সবাই একবার হলেও আন্দোলনে গিয়েছে, ওকে ডেকেছেও। কতজন মারা গেল বলে খবর পাচ্ছে, আর সে বাসায় বসে আছে। তাকে তার মা–বাবা একবারও যেতে দেয়নি। ঠিক করে রেখেছিল, আর কথা বলবে না বাসায়। হারিকেন দেখে রাগ ধরে রাখতে পারল না। বলল, হারিকেনের কথা শুনেছি অনেক। এই প্রথম দেখলাম।

ছেলেকে কথা বলতে শুনে রোকেয়ার চোখ চকচক করে উঠল। অন্ধকারে আরও স্পষ্ট করে বোঝা গেল। বলল, হারিকেন দেখিস নাই, জীবনে আর কী দেখলি? এই হারিকেন দিয়ে আমরা পড়তাম ছোটবেলায়। ডাইনিং টেবিলে বসে তিন বোন মিলে পড়তাম। অনেক সময় হারিকেনের সলতে একদিকে বেশি জ্বলত, অন্যদিকে কম। যেদিক বেশি জ্বলত, সেই পাশটা ঘোলা হয়ে যেত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় হারিকেন প্রস্তুত করতে হতো। যেদিন আমার দায়িত্ব পড়ত, মনে হতো হারিকেনটা ভেঙে ফেলি।

অনিম আগ্রহ নিয়ে মায়ের কথা শুনল। একটু থেমে বলল, তুমি যে বললা, জীবনে আর কী দেখলি? দেখার জন্য কিছু করতে দিছো?

চুপ, বেয়াদব!

আড়মোড়া ভেঙে উঠে সাব্বির বলল, এটা তুমি বের করলে কীভাবে? কোথায় ছিল? দেখে মনে হচ্ছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, এখনই জিন বের হবে।

আমি পুরোনো জিনিস ফেলে দিই না। জানোই তো। কিন্তু হারিকেন কীভাবে জ্বালায়, সেটা মনে নাই। কত দিন পর হাতে নিলাম।

অনিম পাশে আগ্রহ নিয়ে বসল। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। এই ধরিস না, ধরিস না। ময়লা।

সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নিয়ে রোকেয়া হারিকেনটা পরিষ্কার করতে বসল। বাবার কথাটা অনিমের মনে একটা সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করায় সে তাকিয়ে রইল, চোখ দুটো বড় বড় করে—সত্যি সত্যি যদি এখন জিন বের হয়ে আসে! তবে সবার আগে সে চাইবে, আন্দোলনে যাওয়ার একটা সুযোগ। আরেকটু বড় হলে হয়তো চাইত, রক্ত যে ঝরছে, সেই রক্ত যেন বন্ধ করে দেয় জিনটা। কিন্তু অনিমের কাছে এখন এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে খানিক মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই।

রোকেয়া বলল, মোমবাতি আর একটাও নাই। হারিকেনটা তাই জ্বালানো দরকার।

হারিকনের চিমনিটা খুলে ভেতরে সলতেটা দেখতে দেখতে চিমনিটাও পরিষ্কার করে ফেলল রোকেয়া। তাতে খুব একটা লাভ হলো না। যেমন ময়লা, তেমন ময়লাই রয়ে গেল।

সাব্বির বিরক্তি নিয়ে বলল, মোমবাতি নাই, সন্ধ্যার আগে বলবা না? কেরোসিন আছে? কেরোসিন লাগবে তো।

কেরোসিন নেই বাসায়। ওদিকে মোমবাতিও শেষের দিকে। অনিম এবার একটা সুযোগ পেয়ে নিজ থেকেই বলল, আমি যাই, কেরোসিন নিয়ে আসি।

খবরদার, কোনো চালাকি চলবে না। তুই বের হবি না।

সাব্বির বলল, আমি যাচ্ছি। নিয়ে আসি। আলো তো লাগবেই। হারিকেন যেহেতু বের করলা, কেরোসিনটা আনি, সঙ্গে মোমবাতি নিয়ে আসি এক ডজন। কারেন্ট কখন আসবে কেউ জানে না।

একমুহূর্তের ভেতরে রোকেয়া যেন প্রায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। বাথরুমের দরজা খোলা, তার মানে অনিম সেখানে নেই, অন্য ঘরেও নেই। সাব্বির বুঝতে পারল, কোনো এক ফাঁকে অনিম বের হয়ে গেছে রাস্তায়।

অনিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার পড়ার টেবিলে বসল। যদিও পড়ার দিকে তার কোনো মন নেই। সাব্বির ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও কিছু বলল না। বাচ্চাটার জন্য কত সংগ্রাম! রোকেয়ার বাচ্চার এত শখ ছিল। বিয়ের আগে বলত, এক ডজন বাচ্চা নেবে। হলো আর কই? আর অনিমের জন্য কম ধকল পোহাতে হয়েছে ওদের এই ভারত যাও, এই দেশে আসো, এই টেস্ট করো, ওই টেস্ট করো, সঞ্চয় যা ছিল ওখানেই সব শেষ। এটা বুঝতে পারে সাব্বির, রোকেয়া প্রয়োজনের চেয়ে ছেলেটাকে আটকে রাখে বেশি, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলতে গেলেও দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। এ জন্য অনিম মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সেই অনিমকে এ রকম একটা আন্দোলনে যেতে দেবে, যেখানে লাশ পড়ছে, এটা সম্ভবত অনিম নিজেও বিশ্বাস করে না। নেহাত ছেলেটা ভদ্র ও চুপচাপ দেখে অত হইহল্লা করে না।

 সাতটা বেজেছে কেবল। এর বেশি দেরি হলে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

অনিম কিছু খেতে চাও?

অনিম কোনো উত্তর দিল না।

২.

রাস্তায় বের হয়ে এত ধাক্কা খেল সাব্বির, বলার মতো না। একটা মানুষও কোথাও নেই। উঁচু ভবনগুলো না থাকলে গ্রামের কোনো ভুতুড়ে পথের মতো মনে হতো। আকাশের খানিকটা চাঁদ পরিবেশের সঙ্গে বেমানান হলেও দেখায় জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া জুতা, শার্ট, স্কুলব্যাগ আর রক্তের দাগ। এত তাণ্ডব কখন হলো? সাব্বির নিজের কাছে জানতে চায়, কারণ জানতে চাওয়ার মতো অন্য কাউকে পায় না। কারেন্ট যাওয়ার আগে টিভিতে দেখছিল, প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক আছে। গন্ডগোলের কারণে বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, এ খবরটা দেখার সময়ই কারেন্টটা গেল। জেনারেটর চলছে কিছু বাড়িতে। সেখান থেকেও আলো আসছে। একটু একটু করে পথ এগোয় সাব্বির আর বুকের ভেতর টের পায় ঘোড়ার খুরের শব্দ। যা ভেবেছিল তা–ই, মুদিদোকানটা খোলা নেই। এখন সে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবল। সারাটা রাত হয়তো তাহলে অন্ধকারে কাটাতে হবে। রোকেয়া রেগে যেতে পারে ভেবে সে হাঁটতে শুরু করল। কনফেকশনারির দোকান বন্ধ। ফুডকোর্টগুলো যেখানে বসত, সেখানে ধু ধু শূন্যতা। এই ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়ার উপায় থাকত না। এখানকার একটা দোকানে মোমো অনিমের খুব পছন্দ। ওদের বাসার কাছেই থানা। দেখতে দেখতেই পার হলো থানা।

থানার ভেতরে আলো। কোনো মানুষ সেখানে নেই। কী আশ্চর্য! সবাই কোথায় গেল? আচমকাই একটা ভয় জাপটে ধরে সাব্বিরকে। এমন কি হতে পারে, শুধু ওরাই বেঁচে আছে, আর সবাই মরে গেছে? ধুর! কী যে ভাবি, নিজেকেই প্রবোধ দিল। পাশের রাস্তায় গেলে নিশ্চয়ই মুদির দোকানটা খোলা পাওয়া যাবে। প্রবোধ দিতে দিতে এগোল। পাশের রাস্তায়ও একই অবস্থা। এখানে অবস্থা আরও বেশি সঙিন।

একটা বাড়িতে আগুন জ্বলছে। লাল হয়ে থাকা আগুনের আলোয় দেখতে পেল একটা সরকারি অফিসের ভবন। দ্রুত সে রাস্তাটা থেকে বের হলো। হাঁটতে হাঁটতে যেন পার হলো এক ক্রোশ পথ। অবশেষে দেখা মিলল কিছু মানুষের এবং একটা দোকানের। এদিকের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক।

ভাইজান, কোন পথে এলেন?

ওই তো ওদিকে।

ওদিকে? ওদিকে কী অবস্থা? আমরা শুনছি সব নাকি মেরে সাফ।

জানি না ভাই।

কী কী দেখেছে, সেগুলো বলল সাব্বির।

লোকটা কিংবা লোকগুলো খেপে উঠল। আপনার মহল্লায় এত কিছু ঘইটা গেল, আর আপনি টের পান নাই? পাগল নাকি?

সাব্বির নিজেও বুঝতে পারে না কী বলবে। পাগল? সে তা নয়। তাহলে কেন সে কিছুই বুঝতে পারল না?

তাড়াতাড়ি যা দরকার কিনে বাসায় যান। নেটওয়ার্ক নাই। কারেন্ট নাই। পরে বিপদে পড়বেন। এমনিতেও আপনারে দেখে স্বাভাবিক লাগতেছে না। এদিকেও অবস্থা খারাপ হইতে পারে।

লোকটার তাড়া খেয়ে অর্ধেক শাটার নামানো দোকান থেকে মোমবাতি চাইলে দোকানদার বলল, এত পরে মোমবাতি খুঁজতে এলে হবে?

আসলেই তো। নিশ্চয়ই সবাই কিনে ফেলেছে।

তাহলে কেরোসিন আছে?

তা দেওয়া যাবে।

কেরোসিন হাতে নিয়ে সাব্বির উড়ন্ত গতিতে বাড়ি ফেরে।

৩.

ঘরে ফিরে দেখে হারিকেনটা ঘষেমেজে প্রায় নতুনের মতো করে ফেলেছে রোকেয়া। জম্বির মতো চেয়ারেই বসে আছে অনিম। কী দেখেছে, সেটা অনিমের সামনে বলা ঠিক কি না, চিন্তা করতে করতেই বলল পুরো পথটায় সে কী কী দেখে এসেছে।

আজকে তো বৃহস্পতিবার না, বন্ধুদের সাথে দেখাও করো নাই। নেশাটা করলা কখন?

ছেলের সামনে রোকেয়ার এমন কাটকাট কথায় তার লজ্জাই লাগে। মাঝেমধ্যে এমন সব কথা বলে ফেলে! তবে কথাটা শুনে জম্বি অনিম ফিক করে হেসে ফেলে। সে জানে, বাবাকেও তার মতো কিছু অত্যাচার সহ্য করতে হয়।

রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসে, ম্যাচ তো পাইতেছি না। লাইটার দাও।

তন্ন তন্ন করে খুঁজেও লাইটার পেল না সাব্বির। এতক্ষণ কি দোকানটা খোলা আছে? রোকেয়া বেশি চেঁচামেচি করার আগে চট করে গিয়ে আনতে পারবে?

কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফের রাস্তায় নামল সাব্বির। পথ ধরল আগের সেই দোকানের। তবে থানার সামনে পথ আটকাল এক পুলিশ। এখনো ভেতরে মনে হচ্ছে ফাঁকাই।

কই যান?

সাব্বির নিজের দরকারটা বুঝিয়ে বললে, পুলিশ নিজের পকেট থেকে ম্যাচের বক্স বের করে দিয়ে বলল, বাড়ি যান ভাই। অবস্থা ভালো না।

সাব্বির খুশিমনে ম্যাচটা নিয়ে বাসায় ফিরল।

এসে দেখে রোকেয়া হারিকেনটা কোলে নিয়ে বসে আছে। কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে কেরোসিন ভরে ফেলেছে।

চিমনিটা উঁচু করে সলতে জ্বালানোর চেষ্টা করতে থাকে রোকেয়া। কত দিন না ব্যবহারে জীর্ণ সলতেটা কোনোভাবেই জ্বলতে চাইল না। একের পর এক ম্যাচের কাঠি শেষ হচ্ছে। মোমবাতিটাও হয়তো আর মিনিট দশেক থাকবে। এরপর মোবাইল চার্জ যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ খানিকটা আলো পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টা।

জ্বলবে না মনে হয়।

তোমার খালি বাজে কথা। অনিম, তুই আয় তো।

অনিমকে ঘরে দেখা গেল না। অনিম? অনিম? অনিম?

একমুহূর্তের ভেতরে রোকেয়া যেন প্রায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। বাথরুমের দরজা খোলা, তার মানে অনিম সেখানে নেই, অন্য ঘরেও নেই।

সাব্বির বুঝতে পারল, কোনো এক ফাঁকে অনিম বের হয়ে গেছে রাস্তায়।

মূর্ছা গেল রোকেয়া।

রোকেয়াকে কোনোমতে বিছানায় রেখে ড্রয়ার থেকে অনিমের বন্ধুদের ঠিকানাসংবলিত একটা ডায়েরি বের করল।

মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। ঠিকানা ধরে বন্ধুদের বাসায় যাবে নাকি আগে থানায় গিয়ে বলবে? বেশিক্ষণ হয়নি বের হয়েছে, নিশ্চয়ই আশপাশে পাওয়া যাবে।

রাস্তায় নেমে একবার পূর্ব দিকে ছোটে সাব্বির, একবার পশ্চিম দিকে, একবার উত্তরে যায়, একবার দক্ষিণে। অনিমের দেখা কোথাও মেলে না। সবচেয়ে কাছে যে বন্ধুর বাড়ি, সেই বাড়িতে গিয়ে দেখে বন্ধুটা মারা গেছে গতকাল। পুরো পরিবার গ্রামে চলে গেছে।

ঘুরতে ঘুরতে তালগোল পাকিয়ে পুলিশের সামনে এসে পড়ল সাব্বির।

এই, আপনি কে? কী চান? এই রাতে বাইরে কেন?

কাঁপতে কাঁপতে সাব্বির বলল, আমার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না।

আন্দোলনে পাঠাইছিলেন নাকি? তাইলে হাসপাতালের মর্গে খোঁজ করেন।

সব খুলে বলার পর থানায় যেতে বলায় সাব্বির থানায় এল। বাইরে থেকে দেখে মানুষ নেই মনে হলেও ভেতরে মানুষ আছে। খুব শান্ত পরিবেশ, যেন কোথাও কিছু ঘটেনি।

যা যা করতে বলা হলো, সাব্বির করল। থানার লোক ছবি চাইলে বলল, এখনই এনে দিচ্ছি।

বাড়ি ফিরে দেখে মোমবাতি নিভে গেছে। মোবাইল জ্বালিয়ে দেখে, বিছানায় রেখে যাওয়া রোকেয়া কোথাও নেই। হারিকেনটা তখন একা একাই জ্বলে উঠল।