কুয়া
আমি একটা কুয়ার মধ্যে থাকি। কুয়াটা এত গভীর যে কুয়ার পাদদেশ থেকে আকাশ দেখা যায় কি যায় না। আকাশ যেন টিনের বেড়ায় ছোট্ট একটা ফুটো। অন্ধকার ঘরে যেমন তিরের মতো একটু করে ফুটো দিয়ে আলো ঢোকে, আমার কুয়ায় সূর্য ঢোকে ঠিক অতটুক। কুয়ার দেয়ালে, এখানে-ওখানে চারদিকেই আমার ভাঙা নখ গেঁথে আছে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। চারদিকে নখ গুনে গুনে সাতাশটা, সবচেয়ে ওপরেরটা বোধ করি তলদেশ থেকে ছয়–সাত হাত ওপরে হবে। টলমলে চোখের মতো নক্ষত্রদের চোখের পানি কিছুটা আমার কুয়ায় ঢুকে সোঁদা সোঁদা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তৈরি করে। গন্ধটা ভালো লাগে।
ঠিক করছি, এখন আর আমি কোথাও যাব না। কোথাও যাওয়ার তাড়া নাই আমার, যাওয়ার বাসনাও নাই। বাসনাই যেহেতু সব দুঃখের মূল, আমি তাই দুঃখের মূলোৎপাটন করে ফেলি। তার মানে এই না যে আমার মাকে দেখার ইচ্ছা হয় না কিংবা হয় না তুষার দেখার শখ। আমারও ইচ্ছা হয় ওসব। আমারও তো ইচ্ছা করে, তুষার দেখি আমি। বস্তুত আমার গল্পটা তো শুরুই হয় তুষার দেখার শখ থেকে। কিন্তু আমি তুষারের স্বপ্ন দেখেই ক্ষ্যান্ত দিই, ছোঁয়ার স্পর্ধা করি না।
তুষার দেখার উদ্দেশ্যে আমি বাড়ি ছেড়ে রওনা হইছিলাম অনেক বছর আগে—আদিমকালে। তখনো প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক নিদর্শন ছিল অক্ষত, আমার সময়কালের চেতনাবোধ তখনো লুপ্ত হয় নাই। তখনো আমার ইচ্ছা ছিল তুষার দেখার। অনেক ছোটবেলায়, তখনো আমার আব্বা আম্মারে কোপ দেয় নাই, আম্মা তখনো মারা যায় নাই, আব্বাও যায় নাই জেলে; তখন আমাদের বাড়িতে এক ভিনদেশি লোক আসছিল। সে এসে বসছিল উঠানে, আর বলছিল, আমি নাকি দেখতে তাদের দেশের লোকেদের মতো—ফরসা ফরসা, লাল গাল। তার দেশ কোথায় জিগাইলে সে আমারে বলে, সে থাকে বরফের দেশে। নিজেকে বরফের দেশের অধিবাসী কল্পনা করে আমার আনন্দ হয়। কিন্তু বরফ তো আমি দেখছি, দেখছি বরফ কত ঠান্ডা আর পিচ্ছিল। তাই ঠাহর করতে মুশকিল হয়, অমন দেশ কীভাবে হয়! কীভাবে মানুষ বরফের ওপরে হাঁটে। তখন সে উত্তর দেয়, এই বরফ অন্য রকম, এগুলোরে বরফ বলে না, বলে তুষার। তুলার মতো সেই বরফ ভাসতে ভাসতে আসমান থেকে নামে আর পুরা দুনিয়াটারে বানায়ে ফেলে ধলা।
তখনই আমি ঠিক করছিলাম, একদিন তুষার দেখব। তুষার দেখাই হয়ে গেছিল আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। যখনই কেউ আমারে বকত, মন চলে যাইত তুষারের দেশে। নিজেরে মনে হইত বরফের দেশের বাসিন্দা। মনে হইতো, আমি জন্ম নিছি ভুল সময়ে, ভুল দেশে। একদিন—যেদিন আমার কোনো পিছুটান থাকবে না, সেদিন আমি রওনা হব উত্তরের উদ্দেশে। তুষারের দেশে ছোট্ট একটা ঘর বাঁধব। থাকব একা একা।
কিন্তু তখনো আম্মা বেঁচে ছিলেন, আব্বাও জেলে যান নাই। তাই আমার তুষার দেখার অভিযানে তখন গাট্টি বান্ধায় ইস্তফা দিতে হইতো। খুব বেশি হইলে উঠানের সীমানা পার হইছি, এরপরই তাঁদের মায়া টেনে ধরছে আমারে। কিন্তু যেদিন ঘটনাটা ঘটল, সেদিন তো আর কোনো পিছুটান রইল না, আমি পাকঘর থেকে ভেসে আসা রক্ত দেখে একদৌড়ে বের হয়ে গেছিলাম বাড়ি থেকে। সেই যে দৌড় দিছিলাম নাক-মুখ বুইজা, সে দৌড় আর থামাই নাই। দিন নাই, রাত নাই খালি দৌড়াইছি—প্রান্তরের পর প্রান্তর, দিগন্তের পর দিগন্ত, নদীর পর নদী। যতবারই আয়োজন করে রওনা হইতে চাইছি, ভবিষ্যৎ চিন্তা আমার সমস্ত আয়োজনে পানি ঢেলে দিছে। এইবার তাই একবারও পেছনে ফিরে তাকাই নাই পর্যন্ত।
মাঝিরে বলি, মাঝি, আমারে নিয়ে যাও তুষারের দেশে।
সে আমারে নদী পার করে দেয়।
বুড়িরে জিগাই, বুড়ি, তুষার কোনদিকে বলতে পারো?
বুড়ি আঙুল তাক করে আমারে তুষার দেখায়া দেয়। আবার শ্লোকও শোনায়: ভূত-ভবিষ্যতের মধ্যি বাজান গেল ফাঁসি/ আম যাব, ছালাও যাব, বাজান যাবে ভাসি।
বুড়ির প্রলাপ গায়ে মাখি না। এই প্রলাপ যে প্রলাপ না, তা আমি টের পাব অনেক বছর পরে, কুয়ার দেয়ালে আমার ভাঙা নখ গুনতে গুনতে। কিন্তু তখন, বুড়ি যখন আমারে শ্লোকটা শোনায়, আমি তা শুনেও না শোনার ভং ধরে বুড়ির তাক করা আঙুল বরাবর হেঁটে যাইতে থাকি। পথিমধ্যে মহাকাল পার হই, ইতিহাস আমার সাক্ষী হয়, যুদ্ধবিগ্রহ, মহামারি—কোনো কিছুই নজর এড়ায় না আমার। দেখি চাকার আবিষ্কার, আর্য নাগরিকদের এ ভূখণ্ডে বিচরণ, মৌর্য সম্রাট, সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত, প্রাকৃত থেকে পালি, পালি থেকে বাংলা-হিন্দি-ফারসি, মোগল সুলতান; দেখি পর্তুগিজ–ওলন্দাজ–ইংরেজদের আগমন, দেখি দস্যু দল জ্বালায়া–পোড়ায়া ছারখার করে দিছে প্রাচীনকালের সব স্থাপত্য। আবার শুনি, যেসব গ্রাম পার হয়ে আসছি, সেখানে কলেরায় মানুষও নাকি মরছে। কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল, এসবের কোনো কিছুই আমার দেখার বিষয় না, আমার গন্তব্য অন্য কথাও, আমি দেখতে চাই তুষার।
আমি যে বালুকণাগুলা পাড়ায়ে আসি, সেই কণাগুলা তো তৈরিই হইছিল আমি যাব বইলাই; যে নদী বরাবর হেঁটে যাই, সেগুলো তুষার গলে বয়ে বয়ে আসে তো আমারে পথ দেখানোর জন্যই; যে চাঁদ-সূর্যের আলো আমার গায়ে লাগে, সেগুলোর একমাত্র কর্তব্য তো আমার পথে আলো ফেলাই।
কিন্তু উত্তরে, নদী ধরে যাইতে যাইতে একসময় থমকে দাঁড়াই। অনন্ত মহাকালে হেঁটেও আমি দেখি তুষার নাই, আছে শুধু আধিভৌতিক ধু ধু মরু। এমন মরু যেখানে সূর্য গলে গলে পড়ে আসমান থেকে। আমি এমন এক জায়গায় পৌঁছাই, যেখানে কোনো বসতি নাই। এখানে নদীরা ফুরায়ে যায়। বালুরা পায়ের তলা পোড়ায়ে ফেলে। মাইল দুই পরপর একেকটা গাছ; আর আছে আমার মতোই কিছু পথিক, যারা বালুঝড়ে দোলপাক খায়; তাদের উদ্দেশ্য আমার মতোই তুষার দেখা হয়তো। কিন্তু তুষার তো তারা দেখতে পায় না, কিছু পথিক বছরের পর বছর এখানেই থাকে, তাঁবু গাড়ে; কিছু যায় ফিরে। বহু বছর এখানে থাকতে থাকতে এদের অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। মরুর বালু এদের ফুসফুস খাবলে ধরে, খুকখুক কাশির সঙ্গে বের হয় বালু।
ক্লান্ত আমি এক পা এক পা টেনে এই পথিকদের কাছে যাই। পিপাসায় আমার গলাটা কাঠ হয়ে থাকে, আসমানের মাঝখানে দাঁড়ানো সূর্য আমার থেকে রস চুষে খায়, একফোঁটা পানির জন্য আমি ছটফটাই।
পথিকরে বলি, পথিক, একটু পানি হবে তোমার কাছে?
পথিক ঘুরে আমার দিকে তাকায়। পানির থলে ধরিয়ে দেয়। আমি দেখি, পথিকদের কোনো চোখ নাই। তারা অন্ধ।
‘পথিক, তোমার চোখ কই?’
পথিক জবাব দেয় না।
‘পথিক, তুমি যাইবা কই?’
সে নিরুত্তর।
‘পথিক, তুমি আসছ কই থিকা?’
পথিক তা–ও জানে না।
আমি বুঝি, পথিকেরা কিছুই জানে না। তারা অন্ধ তো অন্ধই, বেক্কলও।
আমিও যে পথিক এবং অন্ধ; অতঃপর বেক্কল—এটা আমার সামনে উন্মোচিত হয় তখন। অতীতের বায়োস্কোপ আমার চেতনায়, অবচেতনে ঘোরা শুরু করে। আর আমি পথিকের থলে থেকে যেটুক পানি খাইছিলাম, তা আমার চোখ দিয়ে বের হয়ে মরুর তপ্ত বালুতে পড়ে বাষ্প হয়ে যায়। অতীতের সংক্রমণ আমি কোনোভাবেই এড়াতে পারি না। অতীত তার সর্বগ্রাসী থাবা দিয়ে আমারে ধরে ফেলে, জড়ায় অন্তহীন বেদনার বাহুতে। অতীত কি আমরা কখনো ছেড়ে আসতে পারি? তাকে কি কখনো ফেলে দেওয়া যায় সাপের খোলসের মতো? বর্তমান কখনো অতীতকে তালাক দিতে পারে না। অতীত না থাকলে বর্তমানের কোনো অর্থ থাকে না।
আমি তাই তুষার দেখার স্বপ্ন ছেড়ে আবার পায়ে হেঁটে রওনা দিই। বাতাস তালগাছে দোল দিতেছে হালকা, সেই গাছের নিচে আম্মা শুয়ে ঘুমায়।
কাহিনির এ পর্যায়ে এসে আমার তুষার দেখার অভিযান ফুরায়।
২.
অভিযান ফুরায় এ অর্থে না যে আমার অভিযানের ইতি ঘটে; না, ছোটাছুটি আমি থামাই না, তখনো হাঁটি, শুধু হাঁটার গতিপথ নয়া মোড় নেয়। আমার সেবারের অভিযান হয় আম্মার কবর জিয়ারতের। যাইতে যাইতে আমি আর স্বপ্ন দেখি না, স্মৃতি রোমন্থন করি। হাঁটতে হাঁটতে অন্বেষণ করি স্মৃতি–বিস্মৃতির নানা চিপাচাপা। স্মরণ করি সেদিনের কথা, যেদিন আম্মার গয়না বন্ধক রাইখা আব্বা উত্তরের বন্দের দুই শতাংশ জমি কিনছিলেন। জমি তো হাতে বুঝে পান নাই, আবার গয়নাগুলোও হাতছাড়া। তখন আম্মার মাথায় হাত বুলায়ে বলছিলাম, ‘মন খারাপ কইরো না, যখন আমি বড় হব, হবে অনেক পয়সাপাতি, সেদিন তোমারে আবার গয়নাগুলা ফেরত আইনা দিব।’
কিন্তু আমার প্রথম কামাইয়ের পয়সা গয়নাগুলা ফেরত আনতে খরচ করতে পারি নাই। টাকাগুলো গেছিল আম্মার চিকিৎসার পেছনে। আমরা বড় হই, আমাদের স্বপ্নও বড় হয়, কিন্তু আমাদের বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা–বাপেরর আয়ু যে ছোট হইতে থাকে, তা আর খেয়াল থাকে না। গয়নাগুলো এখন কই আছে, কে জানে! জেনেও তো লাভ নাই। আম্মা তো কবরে শুয়ে আছে। আম্মারে যে আর দেখতে পাব না, ভেবে কান্না আসলে পর মুহূর্তে নিজেরে সান্ত্বনা দেই এ–ই ভাইবা যে নিজেও তো মারা যাব একদিন। তখন তো আম্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবেই। আমার মনে হয়, পরকালে বিশ্বাস করলে মৃত আম্মার সঙ্গে দেখা করার আশা বেঁচে থাকে। তাই অনেক অবিশ্বাসীও পরকালে বিশ্বাস করে।
আমি হেঁটে যাই, ঠিক যেভাবে তুষার দেখার জন্য হেঁটে যাইতাম। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করি, কুয়াশাঘেরা অপার্থিব শূন্যতার মধ্যে আমি ছাড়া কেউ নাই। একদম একা। ফিরতি পথে এত কুয়াশা যে দুই গজ সামনের গাছও দেখা যায় না। আঁচ করতে পারতাম, এ দুনিয়া শুধুই আমার। বাকিরা কই? কলেরায় মারা গেছে হয়তো। গ্রামগুলা এতই জনমানবশুন্য, যেন আদিমকালের। যখন এখানে মানুষ থাকত, তখনকার বাড়িগুলারেও প্রকৃতি আবার জড়ায়া ধরছে শিকড়বাকড়সমেত।
এবার আর নদী পার করে দেওয়ার জন্য মাঝি নাই, দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য নাই সেই বুড়ি। আমি তাও সাঁতরাই। নিজের মতোই নদী ধরে হাঁটি। হেঁটে হেঁটে ঠিক দিকে যাই কি না, বলতে পারি না।
কিন্তু সেবার খুব ভোরবেলা, আলো ফোটে কি ফোটে নাই, এমন আলোয় দেখি নদীর ওই ধারে কালো কাফনে মোড়ানো একদল মানুষ দোল খায় নাগরদোলায়। তারা গান গায়, যে গানের সুর আসে অন্য কোনো ধরণি থেকে। সেই নাগরদোলাকে মাঝেমধ্যেই কুয়াশা এসে ঢেকে দেয়। খুব চেষ্টা করি মানুষগুলার চেহারা দেখতে। এত বছর ধরে হাঁটতেছি, অথচ এই প্রথম কোনো মানুষ দেখলাম আমি। নাগরদোলায় দোল খাওয়া চেহারাগুলার মধ্যে একটা চেহারা নজরে আসে। কালো বোরকায় আবৃত করে রেখেও সে চেহারার আলো নিভাতে পারে না—নক্ষত্র, সূর্য কোনো কিছুই সে নুরানি চেহারার আলোকে পারে না ম্লান করতে।
সে চেহারা আমার মায়ের।
খুশিতে আমি কাঁদি। চিৎকার করি। মাকে ডাকি, এমনভাবে গোঙাই যেন আমার খুব জ্বর আসছে, যাতে মা সেই ডাক ফেরাতে না পারে। কিন্তু মা শোনে না। থমথমে চেহারার কালো কাফন পরা মানুষেরা নাগরদোলায় দোল খাইতে থাকে, মা-ও তাদের মতোই উদাসীন।
আমি তাই কনকনে শীতেও সাঁতার দিই, এত পথ আসতে পারছি, এটুকু নদী আর এমন কী? সুনসান নদী দাপড়ায়ে আমি অশান্ত বানায়া ফেলি, এত জোরে সাঁতরাই, কিন্তু কালো বোরকা পরা মানুষেরা ভ্রুক্ষেপ করে না। আমি সাঁতরাইতে থাকি, কিন্তু নাগরদোলার কাছে আর যাইতে পারি না। উল্টা দূরে দূরে সইরা যাই। নদীর পানি যেন পাথর হইয়া আমারে চাপ দিয়া ধরে, আমারই তৈরি করা ঢেউ নৃত্য শুরু করে আমার চারপাশে। আর আমি ধীরে ধীরে সাঁতরানোর শক্তি হারাইয়া ফেলি। নদীরে গাইল দিই, আম্মারে আমারে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানাই, ঠিক যেমনটা জানাইছিলাম ছোট্ট শিশু থাকতে। কিন্তু নদী আমারে টাইনা ধইরা তার ভেতরে নিয়া যাইতে চায়, দম বন্ধ কইরা দেয়, টিপে ধরে গলা, ভাসায়ে নেয়—কোন অজানায়, এই কুয়ায়…।