রাসকলনিকভ, আমি ও এক টুকরো হলুদ
এক–টুকরো হলুদ আলুথালুভাবে ছড়িয়ে আছে ঘরে। পা ফেললেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে, এই ভয়ে খাটেই পা তুলে বসে আছি। এভাবে ১৮ দিন কেটেছে। একই বিছানায়। খাটের এক–কোনায়। রোদ আসছে, রোদ যাচ্ছে, তবু নামছি না। নামলেই যেন শেষ হয়ে যাবে সব খেলা। তাই বসেই আছি। এখনো নামার অনুমতি আসেনি। অনুমতির আশায় এদিক-সেদিক তাকাই। যদিও অনুমতি কে দেবে, জানি না। আদৌ কখনো অনুমতি আসবে কি না, তা-ও জানি না।
প্রতিদিন সকাল হলেই বুয়া আসে। হলুদটুকু এড়িয়েই সব কাজ করে যায় সে। দিয়ে যায় দিনের খাবারও। সেসব খেয়েই বেঁচে আছি। সারা দিন প্রায় একই ধরনের খাবার। দুই স্লাইস রুটি, একটা সেদ্ধ ডিম আর ফ্লাস্কভর্তি চা। বুয়াও অবশ্য নীরবে অংশ নিয়েছে এ খেলায়। কোনো কোনো দিন ফ্লাস্কে চায়ের বদলে থাকে গরম পানি। আবার কোনো দিন ডিম ছাড়াই রুটি। কিছুই বলি না। মাঝেমধ্যে ভাবি যে এমন বন্দিত্ব নিয়ে বাঁচার চেয়ে হয়তো মরে যাওয়াই ভালো। বলা যায়, এক–রকম মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে আছি।
আজ প্রায় মরতেই বসেছিলাম। অনেক দিন ধরে নষ্ট সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম ফাঁসির দড়িও। ঠিক দুপুর ১২টা। হলুদটা তখন রীতিমতো সূর্যের মতো আলো ঠিকরে যাচ্ছিল। পুরো ঘরটা সেই আলোয় আলোকিত। খাটের পাশে থাকা টুলটা খাটে তুলে নিয়ে তার ওপর দাঁড়িয়ে যখন ঝুলতে যাব, তখনই ‘সুপ্রভাত’ বলে ঘরে প্রবেশ করে লোকটা। পা পর্যন্ত ছড়ানো ওভারকোট আর মাথায় কাউবয় হ্যাট। ঘরে ঢুকেই উচ্চস্বরে বলে ওঠে, ‘সুপ্রভাত। মনে হয় বড্ড ভুল সময়ে এসে পড়েছি।’
ফাঁসির দড়ি তখনো গলায়। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। দড়ি খুলে লোকটার সঙ্গে কুশল বিনিময় করব নাকি যা করতে যাচ্ছি, তা-ই করে যাব! আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই সে হয়তো বলল, ‘মরতে যাচ্ছেন, সেটা ঠিক আছে। তবে একজন মানুষকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে দুম করে মরে যাওয়া নিশ্চয়ই শোভন নয়। তার চেয়ে কিছুক্ষণ গল্প করি আসুন। তারপর নাহয় আরাম করে মরবেন।’
তার কথা শুনে দড়ি থেকে বের করে আনি মাথাটা। পুরো বিষয়টা হজম করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলাম। তারপর কোনো সম্বোধন ছাড়াই জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কে?’
খেয়াল করি, লোকটা তখন দাঁড়িয়ে আছে হলুদটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। মনে মনে এত দিন যে ভয় পাচ্ছিলাম, সেটাই যেন সত্যি হলো। তার ওভারকোটে প্রতিফলিত হয়ে হলুদটা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘরে। বিরক্তিটা এখন রাগে রূপান্তরিত হলো। একটু কড়া গলায়ই বললাম, ‘কে আপনি? কী চান? এখানে কেন এসেছেন?’
লোকটা সেই রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘আমি জানতাম আপনি বিশ্বাস করবেন না। একটি ফিকশনাল চরিত্রকে বিশ্বাস করার ক�োনো কারণ নেই। কিন্তু আপনি কীভাবে ভাবছেন যে আপনিও বাস্তব?
লোকটা হাসল। তার হাসি শুরু হয়েছিল মূলত কপাল থেকে। এরপর সেটি ধীরে ধীরে চোখ, নাক, ঠোঁট হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চিবুক পর্যন্ত। স্মৃতি হাতড়ে এমন কারও হাসি বা মুখটাও মনে করতে পারলাম না। এমন অদ্ভুতদর্শন মানুষও কখনো দেখিনি। এরপর সে ধীরে ধীরে ওভারকোটটা খুলে ফেলল। তখন কোটের আড়ালে থাকা শতছিন্ন জামাকাপড় বেরিয়ে পড়ল।
পরে নীরবতাটুকু সেই আগন্তুকই ভাঙল, ‘আমার নাম রাসকলনিকভ। নিবাস সেন্ট পিটার্সবার্গ। দুজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যার অভিযোগে সাইবেরিয়ায় আমাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎই ১৯ শতকে জারের বিপক্ষে হওয়া একটা বিক্ষোভ থেকে ছিটকে এখানে এসে পড়েছি।’
তার কথা শোনার পর নিজেকে যেন আবিষ্কার করলাম এক গোলকধাঁধার ভেতর। রাসকলনিকভ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, জার—এসব মিলিয়ে যা মাথায় এল, তা হলো ফিওদর দস্তয়েভস্কি ও ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট। নিজের বিস্ময়ের ভাবটুকু গোপন করেই বললাম, ‘দেখুন, আমার অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। আপনি ভুল সময়ে কড়া না নাড়লে একটা কালো পর্দায় আমার জীবন ঢেকে যাওয়ার কথা ছিল।’
লোকটা সেই রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘আমি জানতাম আপনি বিশ্বাস করবেন না। করার কথাও নয়। একটি ফিকশনাল চরিত্রকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আপনি কীভাবে ভাবছেন যে আপনিও বাস্তব? এমনও তো হতে পারে যে আপনিও একটা ফিকশনাল চরিত্রই। যে কিনা কোনো ঔপন্যাসিকের বেখেয়ালে এই ঘরে আটকে পড়েছেন!’
‘কিন্তু আমি জানি, আপনি যা বলছেন তা সত্যি নয়।’ উত্তর দিলাম বটে, তবে আত্মবিশ্বাসের পারদটা রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে। একটু থেমে আবার বলি, ‘তো আপনার ঔপন্যাসিক কি আমাকে বাঁচাতে আপনাকে পাঠিয়েছেন? নিজের উপন্যাসে কোনো কারণ ছাড়াই তিনি একের পর এক মানুষ মারেন। এখন হঠাৎ এত মায়া?’
রাসকলনিকভ নামের আগন্তুকটি আবার হাসল, ‘কথাটা আপনি রাগের মাথায়ই বলছেন। আপনি কিন্তু আমার লেখককে পছন্দ করেন এবং তাঁর নির্বিচার মানুষ মারাও সমর্থন করেন। আপনি চাইলে এটাও ভাবতে পারেন যে তিনি নিজের একজন একনিষ্ঠ পাঠককে হারাতে চান না। তাই আমাকে পাঠিয়েছেন যেন আপনাকে বাঁচিয়ে রাখি। আমি বলছি না যে এটাই ঠিক। তবে আপনি চাইলে ভাবতে পারেন।’
‘কিন্তু তিনি আপনাকে দিয়ে যা করিয়েছেন, তা নৈতিকভাবে কতটুকু ঠিক?’ প্রশ্নটা করে নিজের ওপরই বিরক্ত লাগল। এমন ফাঁপা একটা প্রশ্ন করার কোনো কারণ ছিল না। অস্বস্তি দূর হলো লোকটার জবাবেই, ‘দেখুন, নৈতিকতা হচ্ছে একটা ঝাউগাছ। তা কখনো দুলতে দুলতে একবার এদিকে হেলে পড়ছে, আরেকবার অন্যদিকে। লেখক হয়তো আমাকে দিয়ে খুন না-ও করাতে পারতেন। কিন্তু তাতে আপনার কি মনে হয় যে পৃথিবীর একটি খুনও কমত? কমত না। বরং আমাকে অবিরাম একটি যন্ত্রণার মধ্যে রেখে তিনি মৃত্যু আর প্রতিশোধ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। মানুষের ভেতরের মানুষটাকে আলাদা করতে চেয়েছেন। নতুন জীবনের পথে একজন মানুষের রূপান্তরকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছেন এবং তাতে সফলও হয়েছেন।’
এবার আমার হাসার পালা। চেষ্টাও করলাম, যদিও তার মতো যে হলো না, তা-ও বুঝতে পারলাম। হাসি হাসি মুখভঙ্গিতেই বললাম, ‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে দস্তয়েভস্কি সাহেব সফল? শুনুন, আপনি-আমি যখন এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, তখন পৃথিবীর একটা দেশের অসংখ্য শিশু নিজ ভূমিতেই নির্বিচার প্রাণ হারাচ্ছে। তাদের মায়েরা হাতের ওপর নাম লিখে রাখছে যেন বোমার আঘাতে মৃত সন্তানকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর এই শহরেই দিনদুপুরে ক্ষমতার জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে মানুষকে। দস্তয়েভস্কি আমার পছন্দের। মানুষের ভেতরের মানুষটাকে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো একটু একটু করে খুলেছেন তিনি। মানুষ যেখানে গিয়ে মানুষ হয়েছে, সেই অবধি তিনি যেতে পেরেছেন। কিন্তু প্রথম স্তরের মানুষের তা নিয়ে কোনো আগ্রহ কখনোই ছিল না। সে শুধু নিজেকে মানে মানুষকে মারার কলই বানিয়ে গেছে। কলের ভেতর কখনো সে নিজের মাথা বসিয়েছে, কখনো বা অন্যের।’
একনাগাড়ে অনেক দিন পর এত কথা বললাম। বুঝতে পেরে রাসকলনিকভ নিজেই বাড়িয়ে দিল পানির গ্লাস। এরপর বলতে শুরু করল, ‘মানবজাতির পুরো দায় আপনি একজন মানুষের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। জেরুজালেম কিংবা ঢাকার রাস্তায় মানুষ মারতে থাকলেই মানুষের “মানুষ”হয়ে ওঠার গল্প মিথ্যা হয়ে যায় না। যেমন মিথ্যা হয়ে যায় না এত কিছুর পর তার নতুন জীবনে ফেরার আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষাই দিন শেষে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। একটা মিরাকলের আশায়ই শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে মানুষ। এই যে ১৮ দিন ধরে এই হলুদ রোদটুকু আপনার বদ্ধ ঘরে ঢুকে পড়ছে, এটাই হচ্ছে মিরাকল। অন্ধকারের পেট চিরে বেহায়ার মতো একটা আস্ত সকাল যে প্রতিদিন একই নিয়মে হাজির হচ্ছে, সেটাই হচ্ছে মিরাকল। এমনকি একটু পর একটা পেটমোটা দুপুর নির্লজ্জের মতো এসে বলবে, “চলে এলাম।” সে–ও কিন্তু মিরাকলই। তাই নতুন জীবনের আকাঙ্ক্ষা কখনোই মিথ্যা নয়।’
‘কিন্তু সেই যাত্রার খেসারত দিতে গিয়ে যে দুটো মানুষ আপনার হাতে কোনো কারণ ছাড়া মরে গেল, তারা তো মিথ্যা হয়ে গেল, যেভাবে প্রতিদিন জেরুজালেম বা ঢাকায় মরছে; কিংবা ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যা; একটু আগে যে গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিলাম, আমিসহ সবাই তো মুহূর্তের মধ্যেই মিথ্যা হয়ে যেতাম।’ এটুকু বলার পর আমার মনে হলো, লোকটাকে খুব ভালো জব্দ করা গেল। যদিও নিজের ওপর নিজেই আস্থা রাখতে পারছিলাম না।
রাসকলনিকভকে একটু চিন্তিতই দেখাল। এবার সে কথা শুরু করল এভাবে, ‘যারা মরেছে, তাদের মৃত্যু মিথ্যা নয়। যেমন মিথ্যা নয় আধুনিক মানুষের বেঁচে থাকার সামষ্টিক যন্ত্রণাও। সেই যন্ত্রণার কারণেই আপনি আজ সবাইকে ফেলে মরতে যাচ্ছিলেন। একা একা। অথচ আপনার মৃত্যু কোনো বাস্তবতাকেই বদলাতে পারবে না। এমনকি এই শীতে ঝরতে থাকা একটা পাতার গড়িয়ে যাওয়াও আটকাবে না তাতে। ব্যক্তি আপনাকেই আমার স্রষ্টা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন বলেই কিন্তু আপনি এমন অস্তিত্বসংকট নিয়ে মরতে বসেননি; বরং আপনার এই সংকট যে তৈরি হতে যাচ্ছে, তা তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তর্কের খাতিরে হলেও মানছি, যত্রতত্র নির্বিচার মানুষ মারা তাঁর উচিত হয়নি। মানছি, তিনি হয়তো তলকুঠুরির সেই মানুষের ওপর একটু বেশিই রূঢ় হয়েছেন। কিন্তু তিনি আর কী-ই বা করতে পারতেন? মিথ্যা বলার সুযোগ তাঁর ছিল না। তাই শুধু সত্যের প্রতি সৎ থেকেছেন। আর মানুষকে তার আয়নাটা দেখিয়ে গেছেন শুধু, যে আয়নায় মানুষ প্রতিবিম্ব নয়, নিজের আসল চেহারা দেখেছে এবং এখনো দেখে যাচ্ছে।’
‘কিন্তু একই আয়না বারবার দেখার চেয়ে, তা ভেঙে নতুন আয়না বানাতে পারে না মানুষ?’
‘মানুষ কখনো নিজেকে অতিক্রম করতে পারে না, যেমন অতিক্রম করতে পারে না সময়কে।’
‘তাহলে কি আমাদের সত্যিকারের মুক্তি নেই?’
এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগেই হঠাৎ খেয়াল করলাম, ঘরের মধ্যে হলুদের তীব্রতা কমতে শুরু করেছে। রাসকলনিকভও ধূসর হয়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, গলে যেতে শুরু করেছি আমিও।
অবশিষ্ট থাকে শুধু আবছা হলুদ রোদ, তার মধ্যে কাঁপছে রাসকলনিকভ আর আমার ছায়াটুকু।