শুধু একটা দিনের অপেক্ষা, সাগর উদ্দিন ভাবে। কিন্তু সেই দিনটা কোন দিন? তার অস্থির লাগে, মন হাঁসফাঁস করে। কালকে বেলাল ভাই আল্লাহর দান হোটেলে বিরিয়ানি খেয়ে দাঁত খিলাল করতে করতে বলল, ‘ভাল্লাগে না বুঝলেন, চাকরিডা ছাইড়া দিলাম। ব্যবসা করমু, স্বাধীন পেশা।’
‘টাকা পাইলেন কই?’
‘আরে আমার শ্বশুর, হাড়কিপ্টা লোক ছিল। মইরা গেল বুড়া। শাশুড়িডা ভালো। কালকা দুই কেজি রসমালাই নিয়া গ্যালাম বাসায়।’
সাগর উদ্দিনের মন খারাপ লাগে। সে শুনতে থাকে।
‘যাইয়া বললাম, আম্মাজান, দ্যাশ-দুনিয়ার অবস্থা তো বুঝেন। ত্যালের লিটার দুই শ টাকা হইয়া যাইব। চাকরি কইর্যা পোষায় না।’
‘পরে কী কইল আপনার শাশুড়ি?’
‘সহজে কি মানে। চাইলাম ১০ লাখ টাকা।’
‘আরে কী কন? এত টাকা আছে ওনার কাছে?’
‘আছে, আমার শ্বশুরের ফিক্সড ডিপোজিট করা টাকা আছে।’
‘উঠাইতে দিব বউয়ের ভাইয়েরা?’
‘ভাই একটা পাগল, কাজ-কাম নাই, বউ নাই। বাপের টেকার সুদ খায়। আরেকটা ছোট, ইন্টারে পড়ে।’
‘ওহ।’ সাগর উদ্দিনের বিষণ্ন লাগে। তার শ্বশুরও এমন হতে পারত।
‘রড-সিমেন্টের ব্যবসা দিমু। আরও কিছু লাগব। ধারদেনা কইরা ম্যানেজ দিয়া লাগব।’
বেলালের কথা সাগরের মাথায় আর ঢোকে না। সে উদাস হয়ে যায়। বেলাল সেটা খেয়াল করে আরও রসিয়ে বলতে থাকে।
একপর্যায়ে সাগর বলে, ‘চলেন উঠি।’
‘আরে কই যাইবেন? পুরান ঢাকা চলেন। আপনেরে আগুন–পান খাওয়াই।’
বুকের মধ্যে আগুন নিয়ে আগুন–পান খেতে চলে গেল সাগর উদ্দিন। আর বেলালের শত রকমের চাপাবাজি হজম করতে লাগল। তার মনে পড়ল স্ত্রী সাদিয়ার কথা। ইচ্ছা হলো এখনই গিয়ে পারলে গলাটা চেপে ধরে।
দুই
রাত হয়ে গেছে অনেক। সাগর উদ্দিন শুয়ে আছে বিছানায়। গার্মেন্টস সুপারভাইজার সে। গাজীপুরে অফিস আর বাসা হলো মুগদায়। প্রতিদিন মুগদা থেকে গাজীপুর যেতে যেতে হাঁপিয়ে ওঠে। রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়। বেতন মাস গেলে ৩৫ হাজার, তাতে দুই বাচ্চা নিয়ে সংসার চলে না, বাড়িতে অসুস্থ মা, ডিভোর্সি বোনের খোরপোশ তো আছেই। সবকিছুই সমাধান হতে পারত যদি সাদিয়া নরম হতো। সাদিয়ার বাবা বরিশালের লোক, অতি ধুরন্ধর, ঠিকাদারি করে টাকার পাহাড় গড়েছে। সমানে ওড়াচ্ছে। বাড়িতে গেলে প্রতিবেলায় মুরগি, গরু, খাসি, ইলিশ, চিংড়ি, আইড় মাছ—সব রান্না করে। নানা রকমের পিঠা তো আছেই। সেসব সাগরের গলা দিয়ে নামে না। অভাবে থাকতে থাকতে অন্যের প্রাচুর্য দেখে তার ঘৃণা হয়, শরীর কাঁপতে থাকে, নিজেকে ছোট মনে হয়। প্রেম করে সাদিয়াকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। সাদিয়ার পরিবার তাদের বিয়ে মেনে নেয়নি দুই বছর। তাদের কথা, সাগর উদ্দিন গরিব ছেলে, চালচুলো নেই।
শেষে গিয়ে যখন মেনে নিল, তখন শুরু হলো নিজেদের বড়লোকি দেখানোর আয়োজন। বাড়িতে গেলে নানা রকম আদর-আপ্যায়নের মধ্যে প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়—সাগর উদ্দিন একজন ছোটলোক, গরিব। এই বাড়ির মেয়েকে স্পর্শ করার যোগ্যতা তার নেই। এই পিশাচ শ্বশুর কি ব্যবসা করতে টাকা দেবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাগর। এদিকে-ওদিকে তাকায়। দুই রুমের ছোট বাসা তার। অন্য রুম থেকে সাদিয়া আর দুই বাচ্চার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। তাদের এখন নুডলস বানিয়ে দিতে হবে। ছোটখাটো চড়ের আওয়াজ শোনা গেল। বড় ছেলে আয়ান কান্না শুরু করল, তার দেখাদেখি ছোট মেয়েটাও।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সাগরের। সে উঠে চলে গেল ওই রুমে। সাদিয়া দরদর করে ঘামছে। দুই ছেলেমেয়ে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে।
তিন
শুক্রবার। বিকেল। বাচ্চারা খেলতে গেছে পাশের ফ্ল্যাটে। সাদিয়া শুয়ে আছে সাগরের পাশেই। সাগর নজর করে দেখে সাদিয়াকে, এই মেয়েকে প্রথম দেখেছিল স্কুল ড্রেসে। সে তখন বরিশাল শহরে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করে। দোকানে দোকানে পণ্য সাপ্লাই দেওয়ার কাজ। সাদিয়া তার বান্ধবীদের সঙ্গে ফিরছিল। ঘামে ভেজা মুখ, মুখে সামান্য বসন্তের দাগ, শ্যামা চেহারা। চোখ দুটো ছোট ছোট। এমন আহামরি সুন্দরী নয়। কিন্তু সাগরের চোখ আটকে গেল। প্রতিদিন কাজ ফাঁকি দিয়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত সে। এতে করে চাকরিও চলে গেল তার। তবে তাতে কি আর প্রেম থেমে থাকে, সাদিয়ার কম বয়স, প্রেমিক বা জামাইয়ের চাকরি না থাকলে কিছু হয় না—এটা সে সিনেমা থেকে জেনেছে। আসলে ভালোবাসাটাই আসল। কারণ, সিনেমার ভিলেনরা সব টাকাওয়ালাই হয়। এরপরই সাগর উদ্দিনের হাত ধরে পালিয়ে আসা। তারপর আজ নিয়ে আট বছরের সংসার।
‘বাচ্চারা দই খাইতে চায়। আজকে বাইরে গেলে দই আইনো।’ সাদিয়ার কথায় ভাবনায় বাধা পড়ে সাগরের।
‘মাসের শেষ, টাকা নাই।’
‘তোমার তো মাসের শুরুও যা, শেষও তা। কখনো কইছ টাকা আছে?’
‘কী কইতে চাও তুমি?’
‘সব টাকা মা-বইনরে খাওয়ায়ে দিলে পোলাপাইনে খাইব কী?’
সাগরের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সে সাদিয়াকে শোয়া অবস্থাতেই থাপ্পড় মারে। উঠে বসে চুপ করে থাকে সাদিয়া।
সাগরের খারাপ লাগে। মায়ের অসুখ তাই বেশি টাকা পাঠাতে হয়েছে। কিন্তু এভাবে বলার কী আছে? সে মিনমিন করে সাদিয়ার পাশ ঘেঁষে বসে, ‘চাকরি কইরা তো কুলায় না।’
সাদিয়া উঠে চলে যায় রান্নাঘরে। সাগর ফেসবুক অন করে রিল দেখতে থাকে। মানুষের হাতে কত টাকা, সবাই কত জায়গায় খেতে যায়, শুধু সে–ই পারে না কিছু। বাচ্চাদের দই কিনে দিতেও পারে না। মনটা ভালো লাগছিল না, তাই লিস্টে থাকা কয়েকটা মেয়েকে নক দেয় সাগর। অনলাইন দেখাচ্ছে কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছে না দুজন। একজন ‘হ্যালো’ বলে কোথায় যে হারিয়ে গেল! একজনকে পাওয়া গেল, নুসরাত জাহান। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে পড়ে। যদিও খুব ভালোভাবে রিপ্লাই দিচ্ছে না, তবে প্রথম দিন হিসেবে ঠিক আছে।
চার
নুসরাত দেখা করতে চায়। পনেরো দিনের কথায় ভালোই খাতির জমেছে। কিন্তু সাগরের হাতে টাকাপয়সা নেই। তার মেজাজ খারাপ হতে থাকে। আজ অফিসে হাফ ডে ছিল। বাসায় এসে খেতে বসে। সাদিয়া বাসায় নেই। টেবিলে দেখে আলু তরকারি আর ডাল রাখা। মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় তার। সংসারে যা টাকা দেয়, কোথায় যায় বোঝে না, বাচ্চারা নুডলস খেতে চায়, দই খেতে চায়—সেসব আবদারেই চলে যায় মনে হয়। সাদিয়ার এখনো বুদ্ধিশুদ্ধি হলো না। সে না খেয়ে শুয়ে থাকে। সাদিয়াকে ফোন দেয়।
‘আমি একটু জান্নাত আপার বাসায় আসছি। তুমি খাইয়া নাও।’
সাগর কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়। নুসরাত নক দিল মনে হয়। ছবি দিয়েছে। লাল শাড়ি পরা ছবি।
‘শাড়িটা কেমন হইছে বলো তো?’
‘ভালো হয়েছে।’ রিপ্লাই দেয় সাগর।
‘আম্মু দিল।’
‘শাড়ির ওপর দিয়া দেইখা আর কী করব?’
নুসরাত রাগের ইমোজি দেয়। সাগর বোঝে নুসরাত মোটেও রাগ করছে না। সে কথাবার্তা আরও গভীরে নিয়ে যায়। এর মধ্যেই দরজায় নকের শব্দ।
সাদিয়া এসেছে। আয়ান আর তিশাকে জান্নাত আপা নামক কোনো প্রাণীর কাছে রেখে এসেছে বলে জানায়। সাগর কিছু না বলে সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে। দুপুরে না খাওয়ার যাতনা আর নুসরাতের শাড়ি পরা ছবির সৌন্দর্য তার মনে ভেসে ওঠে। সে যেন সাদিয়াকে কুরে কুরে খায়। সাদিয়া বুঝতে পারে না হঠাৎ এই ভালোবাসার উৎস কোথায়। সে–ও গলে পড়ে। সাগরের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ভাবে, লোকটা কত যন্ত্রণাতেই না আছে। সাগর হঠাৎ থেমে যায়। মেসেঞ্জারে ভিডিও কল আসছে। সাদিয়া ফোনের দিকে তাকায়। নুসরাত ফোন দিয়েছে। ফোন কেটে দেয় সাগর।
সাদিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘কে ফোন দিল?’
‘ক্লায়েন্ট।’
সাদিয়া আর কিছু জিজ্ঞাসা করে না। পুরুষ মানুষের ব্যাপার। সে আর কী জানবে...সাগর আরও গভীরে যেতে থাকে। নুসরাতের ফোন আর বাজে না।
পাঁচ
রাতে সাগর সাদিয়াকে বলল, ‘আব্বারে একটু বলে দেখো। যদি কিছু টাকা দেয়, বাড়ি গিয়া ব্যবসা দিতাম।’
‘বাড়ি মানে তোমাগো গ্রামে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার মা–বইনের সাথে থাকা লাগবে?’
‘তোমারে আলাদা ঘর তুইলা দিমু নাহয়।’
‘নিজের মুরোদ নাই, আমার বাপের টাকা চাও। তারে ছয় মাসে একদিন ফোন দিয়া জিগাইছ, আব্বা কেমন আছেন?’
সাগর মাথা নিচু করে থাকে।
সাদিয়া কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। সাগর পাশে শুয়ে থাকা ছেলের গায়ে হাত দেয়। ছেলেটা ঘুমাচ্ছে, মায়ের মতোই দরদর করে ঘামে ছেলেটা। সারা শরীর ভিজে গেছে।
ফোন হাতে নেয়, নুসরাতকে নক দিয়ে রেখেছিল অনেক আগে, এখনো রিপ্লাই নেই। সাগরের রাগ হয়। রাগ হলেই ইদানীং তার শরীর জেগে ওঠে। সাদিয়াকে টেনে ধরে নিয়ে আসে সে। তার চুল খামচে ধরে। বাচ্চারা নড়েচড়ে শোয়।
সাদিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, আস্তে করে উঠে চলে যায় পাশের রুমে। সাগরের হতাশ লাগে। সে ভাবে, কোনো একদিন সাদিয়াকে সে খুন করবে, বাচ্চাদের কী করবে জানে না, তার শ্বশুরের অহংকার সে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। তারপর নুসরাতের কাছে চলে যাবে বা অন্য কারও কাছে। এই সংসার তার ভালো লাগে না, এই বাচ্চাদেরও তার নিজের বাচ্চা মনে হয় না। সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে। একদিন হয়তো সেই দিন আসবে। সাগর সাহস করতে পারবে, আবার কোনো দিন না–ও আসতে পারে। তবে একদিন চাইলেই সবকিছু শেষ করে দিতে পারবে ভেবে খুব আনন্দ হয়। এই আনন্দই–বা কম কিসে। নুসরাতের শাড়ি পরা ছবির থেকেও এই কল্পনা কম সুন্দর না।
মেসেঞ্জার টুন করে ওঠে। নুসরাতের মেসেজ কি এসেছে?