-লা

‘লা’ অন্ত্যাক্ষর নামের ডজনখানেক প্রেমসম্ভবা বালিকা তখন বরিশালে। আদ্যক্ষর? ‘আপনার মনের মাধুরী মিশায়ে’ ইলা, শীলা, প্রমীলা, জামিলা ইত্যাদি থেকে যেকোনো কিছু জুড়ে দিতে পারেন। এমনই এক আগুনকিশোরীর জন্য কীভাবে ‘হৃদয়কুমার’ হয়েছিলাম, সেই কাহিনিই বলছি। তাতে, জীবনের এই প্রান্তে, শ্রীকান্তের মতো ‘কত কথাই না মনে পড়িতেছে’। 

বরিশাল কেবল স্বাধীন হয়েছে। বাতাসে মুক্তির মাদকতা। ঢাকায় থাকা বন্ধু নিয়াজও এসেছে। সময় কাটাতে দুজন একসঙ্গে হাঁটতে বের হই। বিভিন্ন পাড়া–মহল্লায় নিরুদ্দিষ্ট ভ্রমণ। যেদিকে দুপা যায়। একদিন হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে গেল ওর এক বন্ধুর বাসায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল বন্ধুটি আছে, কিন্তু একটু অপেক্ষা করতে বলল। আমরা দুজন সামনের এক টুকরো মাঠের পাশে নারকেলগাছের নিচে দাঁড়ালাম। শীত তেমন পড়েনি। এক সোয়েটারেই চলে যায়। তার ওপর সকালের মিঠে রোদ। বেশ লাগছিল। 

বন্ধুদের বাড়িটার সামনে দুই পাট কাঠের কবাট, ঘন সবুজ। তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে পাশাপাশি দুজন ওই দরজায় পৌঁছাতে পারে। সিঁড়ির পাশে শানবাঁধানো বসার রোয়াক। তখন এবং তারপর আরও কিছুদিন ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি ওইখানে বন্ধুদের নিয়ে একসময় আমি বসে থাকব। 

বন্ধুটি বের হয়ে আমাদের ভেতরে যেতে ডাকল। অপরিচিতের বাসায় ঢোকার অস্বচ্ছন্দ পায়ে ঘরে ঢুকলাম। একতলা হলুদ দালানটির সামনের ঘরটাই বসার ঘর। সম্মুখদেয়ালে দরজাটির পাশে দুটি আর পাশের দুই দেয়ালে আরও দুটি জানালা। একটি জানালার পাশে পড়ার টেবিল, তিন দিকে গোটা চারেক চেয়ার। ওই ঘরের চতুর্থ দেয়ালে দুই দরজা, ভেতরের দুটি ঘরে যাওয়ার। তার একটি টেবিলটির ঠিক পেছনে। দরজা–জানালার অবস্থানগুলো বিস্তারিত বলতে হচ্ছে, গল্পের ভবিষ্যতে সেগুলো ব্যবহার করা হতে পারে।

ওই ঘরে সাত–আটজন ভদ্রবেশী লোক দাঁড়িয়ে—বসে কথা বলছেন। ভেতরের দরজার দিকে পিঠ দিয়ে চেয়ারে বসা একজন। তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। একটু পরেই যে মেয়েটি ট্রেতে পেয়ালাভর্তি চা নিয়ে ঘরে ঢুকবে, ভদ্রলোক তাকে গান শেখায়। নতুন দুই যুবককে দেখেও মেয়েটি আড়ষ্ট নয়। কারণ, বাড়িটায় স্ফূর্তির আমেজ, গানের মাস্টার বিয়ে করতে যাচ্ছেন। বরযাত্রীরা সেখান থেকে রওনা করবে। 

-লা পরেছে সাদা বেল বটম পায়জামা, বেগুনি, গোলাপি ও আরও কয়েকটি রং মিশিয়ে ফ্যাশনদুরস্ত একটু খাটো কামিজ, সাদা ওড়না। ঘুরে ঘুরে চা বিতরণ করছে। আমাদের পালা আসবে কেবল। তখনই মেয়েটি আর কারও হাতে ট্রেটা তুলে দিয়ে চলে গেল ভেতরে। অপরিচিতার হাত থেকে চা নেওয়ার বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচলাম। নামটি জানতে আরও কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল।  

পরদিন নিয়াজ আবার রানীমহলমুখী, মানে বন্ধুদের বাড়িটির দিকে। আমরা সরাসরি বসার ঘরে ঢোকার সুযোগ পেলাম। একটু পর সেই মেয়েটি বাইরে থেকে ফিরল। সাধারণ পোশাকেই। পাড়ার কোনো বাড়িতে গিয়েছিল হয়তো। নিয়াজ বেশ মনোযোগী দর্শক মেয়েটির। দশ পা ফেলে ঘরটা পেরোনো যায়। ওটুকু সময়ের মধ্যেই নিয়াজের ভাবান্তর লক্ষ করেছিলাম। সেটা আমার বিভ্রান্তিও হতে পারে। মেয়েটার ভাই বের হয়ে এলে আমরা হাঁটতে বের হলাম। তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হলো, সিনেমা, গান, বই, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ইত্যাদি নিয়ে।

নিয়াজ আবার এল পরদিন, ওই বন্ধুর বাড়িতে যাবে। একটু বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলাম, আগ্রহটা কী? নিয়াজ হেসে জবাব দিল, ঢাকায় একজনের সঙ্গে ওর ইটিশ–পিটিশ চলছে। আর ওই বাড়িতে যাওয়ার কারণ বরিশালে ওর অন্য কোনো বন্ধু নেই। 

কদিন পরে নিয়াজ চলে গেল। আমারও আর রানীমহলে যাওয়া হয় না। যাওয়ার কোনো ভদ্রস্থ কারণ বা আগ্রহের জন্ম হয়নি।

একদিন নিয়াজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে, পাশের দোকানে চা খেয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। বিদায়ের সময় সে তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে গেল। 

রাতে স্বপ্নে দেখলাম একটি মেয়েকে। মনে হলো সেই মেয়েটাই—-লা। কিন্তু বাস্তবের মুখটা ভালো করে দেখিনি বলে স্বপ্নে দেখা কন্যার চেহারার সঙ্গে ঠিকঠাক মেলাতে পারছিলাম না। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভাবছিলাম, মেয়েটাকে কেন দেখলাম। সারাটা দিন কাটল সেই ঘোরে। বিকেলে বের হয়ে একসময় দেখলাম রানীমহলের সামনে আমি। নিয়াজের বন্ধুর সঙ্গে গল্পটল্প হলো। রাতে আমার আর ঘুম আসে না। স্বপ্নে দেখা মুখ ভাসছে চোখে। আমি ডুবলাম। 

পরের রাতে অজানা আবেগে লিখে ফেললাম ছোট–বড় ৪০টি কবিতা। কবি হয়ে কন্যার মন পাওয়া যাবে কি? জীবনানন্দের কবিতার বই খুলে মিলিয়ে দেখতে চাইলাম আমার কবিতাগুলো কত ভালো হয়েছে। হতাশ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আর যা–ই হোক, কবিতা লেখা আমার কাজ নয়। 

ভাবতে ভাবতেই ভালো লেগে গেছে মেয়েটাকে। কিন্তু কিছুতেই যোগাযোগের আশা করতে পারছি না। তার ভাইকে তো আর বলা যায় না, ওকে আমার ভালো লেগেছে, পরিচয় করিয়ে দিন। 

তাই সাহায্য চাইলাম ‘নারী অভিধান’ খেতাব পাওয়া বন্ধুর। শহরের কোনো উঠতি বয়সের মেয়ে বা ছেলে কার কাছে কে মন সঁপেছে, সেসবের নির্ভরযোগ্য খবর থাকে ওর কাছে। ও-ই জানাল, মেয়েটির নাম –লা। পাঁচ ভাইয়ের ছোট বোন। তখনো কারও কাছে বাঁধা পড়েনি। রানীমহলের সামনে দিয়ে ঘন ঘন যাওয়া–আসা করে, এমন কোনো ছেলেরও খোঁজ পাওয়া গেল না। 

রানীমহলের রাজকন্যাকে প্রেমপূর্ণ করার কাজ এখন হৃদয়কুমারের। পাতালপুরীতে সোনার কাঠি–রুপার কাঠি নিয়ে যেতে হবে। চারদিকের সব বাধা কাটিয়ে এমন অবস্থা করতে হবে, যাতে কন্যাটি প্রথম আবেদন পেয়েই সাড়া দেয়, কিংবা নিজেই গলে যায়। 

আমার তিন বন্ধু এগিয়ে এল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। পাড়ায় একজনকে বানাল স্থায়ী পাহারাদার, রানীমহলের সামনের রাস্তায় কোনো অপরিচিত ছেলেকে একাধিকবার দেখলে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেবে।  

আমিও ওদের সঙ্গে মিলে –লাদের পারিবারিক বন্ধু (!) হয়ে গেলাম। কিছুদিন পরেই ওর বড় ভাইয়ের বিয়ে হলো তিন বন্ধুর একজনের এক বোনের সঙ্গে। আশা করতে থাকলাম, ভাবি হয়তো কিছু সাহায্য করবে। কিন্তু বন্ধুটি সেই উদ্যোগ নিতে চাইল না। উটকো ঝামেলা হলো, বন্ধুটির বড় ভাই রানীমহলে যাওয়া–আসা শুরু করেছে। এবার বন্ধুটি ভাইকে সামাল দিতে পারল। –লাকে নিজেই পছন্দ করে বলে। 

বাঙালিরা কেন যে প্রেমে পড়ার মতো আনন্দকেও ব্যথায় সিক্ত করে ফেলে, বুঝি না। প্রেম নাকি মৃত্যুকে দেয় মহিমা, প্রবঞ্চিতকে দাহ। প্রবঞ্চিত নই আমি। কিন্তু দহনে ভুগছি। একটা চিরকুটে লিখলাম: 

‘অনেক কান্নার সাগর পারে, 

তোমার চোখের কোণে এসে ভিড়ে, 

আমার আহত প্রেমের জাহাজ।’ 

পাড়ার একটি ছোট ছেলেকে দিয়ে সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হলো। পরের দিন পরের দিন করে করে কয়েক মাস কেটে গেল, -লার কোনো প্রতিক্রিয়া পেলাম না। হয়তো ওটা পৌঁছায়নি। বন্ধুরা খোঁচা দিত, ‘তোর ট্র্যাজেডির নাম হবে “পাঁচ ভাই লম্বা”।’ ওর ভাইগুলো লম্বা লম্বা ছিল। 

পরীক্ষা শেষ। ঢাকায় চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আর সবকিছু গোছগাছ করে নিতে কাটল বেশ কয়েক মাস। -লাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কোনো পছন্দনীয় মেয়েকে দেখলে ওর কথা মনে হতো। তাই নতুন কারও সঙ্গে ভাব জমানোর কথা ভাবতে পারতাম না। 

কিছুদিন পরে বরিশাল গিয়েছিলাম কাজে। ওদের বাসায় গেলাম। সেখানে গিয়ে অস্পষ্ট কারণে মনে হলো, আরও আসতে হবে। ইতিমধ্যে ওদের বাসায় টেলিফোন এসেছে। 

এক সন্ধ্যায় ওদের বসার ঘরটিতে একা বসে আছি। পাশের ঘর থেকে –লার হাঁটাহাঁটির শব্দ পাচ্ছি। দরজা দুটি একটুকু ফাঁক করে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গান গাইছে। পরদিন ঢাকায় ফিরে লিখলাম চার পাতার এক চিঠি। শেষ কথা, ‘চাল ধোয়া স্নিগ্ধ হাত চাই’। আশা করলাম সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জবাব পাব। পাইনি। তাই আবার গেলাম বরিশালে। দুরু দুরু বুকে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার না হলে আর নয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওদের বাসায় গেলাম।

তিরস্কারের বদলে ওর মা জামাই আদরে রান্নাঘরে বসিয়ে ভাত খাইয়ে ছাড়ল। ফিরে আসতে হবে রান্নাঘর থেকে বারান্দাটা পার হয়ে একটা শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে। সেখানে দুটো খাটের মাঝখানে একটা ছোট্ট টেবিল। ফোন রাখা। ঘরে ঢুকে দেখি তার পাশে -লা দাঁড়িয়ে। সামনে বের হওয়ার দরজাটা বন্ধ। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, –লা, ‘শুনুন, আপনি আর চিঠি লিখবেন না।’ 

বুক কেঁপে উঠল। সবই বুঝি গেল।

‘কেন?’

‘বাসায় অসুবিধা হয়।’

‘তাহলে কী করব?’

‘ফোন করবেন।’

‘কখন?’

‘এখনই।’

ছুটে গিয়ে এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে ফোন করলাম। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ফোনে কথা বললাম। হৃদয়কুমার পেল ‘কইন্যার’ মন। 

তারপর অনেক ঘটনা। হাত ওর চাল ধুয়ে স্নিগ্ধ হতে পারেনি, প্রকৌশলীর হাত ধরে চলে গেল প্রবাসে।

পঞ্চাশ বছরেও কাহিনি ‘হইল না শেষ’। সেদিন আমার কাছে একটি প্রশ্ন এল, সুখে আছি নাকি, কত সুখে? জবাব দেওয়ার জন্য লিখেছি নিচের চিঠিটি:

‘-লা,

‘সুখে আছি নাকি, এর জবাব তুমি জানবে, যদি বলতে পারো দরজার আড়াল থেকে গাওয়া গানটি তুমি কবার মনে করেছ? কবার মনে করেছ, একদিন আমরা সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ফোনে কথা বলেছিলাম। মনে করতে পারো রকেট স্টিমারে সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে আমরা কতক্ষণ কী কী বলেছিলাম? মনে আছে নাকি, বাবা তোমাকে দেখতে গিয়ে কী জিজ্ঞেস করেছিল, যা শুনে তুমি খিলখিল করে হেসে উঠেছিলে। বলেছিলে, বাবাকে নাকি খুব আপন মনে হয়েছিল। মনে কি আছে, এক রাতে যে ঘরে বসেছিলাম তোমার মা তোমাকে সেখানে পাঠিয়ে দিলে কী কথা বলেছিলাম আমরা? ঢাকায় তোমাদের বাড়িওয়ালার বাসায় বসে তোমার চুল নিয়ে কী বলেছিলাম? 

‘তুমি যখন বন্দী হলে, ধানমন্ডির ওই বন্দিশালার ফোন নম্বর পেয়েছিলাম। তুমি পাঠিয়েছিলে? ওই বন্দিশালা থেকে ভাইয়ের পিছু পিছু কলাবাগানের বন্দিশালায় ফিরতে দেখেছিলাম তোমাকে, শেষবার। শাড়ি পরেছিলে।

‘জানি না, তুমি আমাকে বলি দিয়েছিলে, নাকি তোমাকেই বলি দিয়েছিল পরিবারের কেউ? কেউ কেউ কিংবা সবাই? 

‘বলিই দিলে যদি, বলে–কয়েই নাহয় দিতে। একটি মেয়ের সঙ্গী বাছাইয়ের স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা দেওয়ার মতো ইতর আমি কখনোই নই।   

‘জানতে চাইতে, কিন্তু বারবার জিজ্ঞেস করলেও তুমি বলোনি, আমার কী পেশা পছন্দ করবে। তাই নিজের পছন্দের পেশায়, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেছি। বুঝে নিয়ো, সুখে আছি নাকি!

‘এই প্রশ্ন কেন এল এত দিন পরে? তুমি অসুস্থ, তাই?

হৃদয়কুমার’