কোমা
আমিই এই পৃথিবীর শেষ জীবিত প্রাণী। আমার এই জগতে নেই কোনো অভিভাবক, কোনো বন্ধু, নেই কোনো পোষা প্রাণী বা প্রেমের গল্প। আমার শহরটা নিস্তব্ধ কোলাহলহীন, আমার রাস্তাগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা গাড়ির গ্যারেজ। নগরায়ণ প্রকল্পে ধ্বংস হওয়া প্রকৃতির জন্য আর্তনাদ করে না কোনো পাখি, কোনো কাঠবিড়ালি। অসমাপ্ত কনস্ট্রাকশন সাইটগুলো আমার শহর দেখার কেন্দ্র। অলিতে-গলিতে জনশূন্য টংগুলো আমার সিগারেটের প্যাকেটের নিষ্ক্রিয় ফ্যাক্টরি। বিদ্যুৎবিহীন ঘরে সিগারেটের ধোঁয়াই আমার সঙ্গী এবং মৃত্যুর পথে আরেক কদম এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী। অপেক্ষা শুধু শেষ ডাকের—যত তাড়াতাড়ি, তত উত্তম।
প্রতিদিন আমি হেঁটে বেড়াই ক্যাম্পাসে। কত অজস্র স্মৃতি মেখে আছে টিএসসি, কলাভবন, শ্যাডো আর মলচত্বরের দেয়ালে দেয়ালে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই নীলক্ষেত, হাতিরপুল, বাংলামোটর, মগবাজার। মগবাজারের চিরচেনা ‘ঘরনা হোটেল’ অন্ধকার হয়ে পড়ে থাকতে দেখি প্রতিদিন। মৌচাক এসে পৌঁছালে ফল-ফুল ও অন্যান্য হকারের দোকানগুলো চোখে পড়ে। মার্কেটের গেট সব সময়ই খোলা, কিন্তু নেই কোনো ক্রেতা। একটু ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় স্বর্ণের খনি, কোটি কোটি টাকার সোনার দাম এখন এ পৃথিবীতে শূন্য। অথচ একসময়ে স্যুট-টাই, টুপি-জোব্বা পরা লোকেরা ভিড় জমাত এই সোনার দোকানগুলোয়। কিনতে না কিনতেই সেসব স্বর্ণের হয়তো পাখা গজাত, উড়ে যেত কোনো দূরদেশে—ডাকাতেরা খোঁজ করেও পেত না আর তাদের।
প্রতিদিন আমি হেঁটে বেড়াই ক্যাম্পাসে। কত অজস্র স্মৃতি মেখে আছে টিএসসি, কলাভবন, শ্যাডো আর মলচত্বরের দেয়ালে দেয়ালে।
চিরপরিচিত মালিবাগ ও শান্তিনগর মোড় এখন বড্ড অচেনা, কোলাহলমুক্ত। শান্তিনগরের মধুমিতায় প্রতিনিয়ত পরোটা পড়ে থাকতে দেখি। ভেতরেই এককালের অতি পছন্দের হালুয়া ও সবজি, যা এখন আর খাওয়ার রুচিও জাগে না আমার। চোখে কোনো খাদ্যবস্তু দেখলে শরীরের ভেতরে কেমন যেন গুলিয়ে আসে, মুখে চলে আসে একটিই শব্দ—‘ওয়াক...’। ওয়াক করতেই বুকে চিনচিন ব্যথা উঠে যায়। কারণ অজানা। এই পৃথিবীতে ভালো-মন্দ কোনো ডাক্তার নেই, যার পরামর্শ নেব আমি। একজন হাতুড়ে ডাক্তার থাকলেও রোগমুক্তির কিছুটা সুযোগ তো থাকত! তবে অতিরিক্ত ধূমপানের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে আমার শরীরের এই অস্বস্তি। আর কোনো উপায়ও নেই, সিগারেট ছাড়া আর কোনো কিছুই নিতে পারি না আমি।
তাই রাস্তায় রাস্তায় টংদোকান খুঁজে বেড়াই। শান্তিনগর বাজারের পাইকারি দোকানগুলোর সিগারেট শেষ করেছি গত দুই সপ্তাহে। দোকানিরা থাকলে এত দিনে দাম ১০ গুণ বাড়িয়ে ছাড়ত। অবশ্য তারাও সর্বশক্তিমান পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। তাদেরই-বা কী করার আছে? পুরো বাজার খুঁজেও আর সিগারেট পাওয়া যাবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আজ তাই হেঁটে চলছি সেগুনবাগিচার পথে। শিল্পকলা একাডেমির পাশেই বেশ অনেকগুলো টংদোকান। আজ একটা টংদোকানের সমস্ত সিগারেট বাসায় নিয়ে আসব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শিল্পকলা একাডেমির ওখানেই একটি ভ্যানে করে ভাজাপোড়া বিক্রি হতো। এই দোকানেই ভিড় জমাত রিকশাচালকেরা, থাকত অফিস-বাসার গার্ড ও অন্যান্য সহায়হীন মানুষ। এমন দু-চারটা দোকান না থাকলে তারা ক্ষুধায় মারা পড়ত। মালিকেরা খাবার বাবদ তাদের ৫০ টাকা দিত। তা-ই দিয়ে নাশতা হতো লোকগুলোর।
সেখানে এখনো পড়ে রয়েছে পেঁয়াজু-বেগুনি-চপ। দেখেই শরীর গুলিয়ে উঠল। যথাসম্ভব চোখ এড়িয়ে পাশের টংদোকানের তালা ভাঙার জন্য ভ্যানের চাকা আটকানোর ইটের টুকরা দিয়ে বাড়ি মারতে থাকলাম। তালা খুলে গেলেই চোখে পড়ল সব ব্র্যান্ডের সিগারেট। কম দামের সিগারেটগুলো রেখে বাকিগুলো নিয়ে রওনা হলাম বাসার দিকে। সুযোগে এই এক বদভ্যাস করেছি। পকেটের হিসাব না রাখতে হলে দামি-কম দামি সিগারেটের কথা আর ভাবতে হয় না।
মালিবাগ জামে মসজিদের পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা লাল বেনসন জ্বালালাম বাবার সঙ্গে আমার একটা স্মৃতির কথা মনে করে। বাবার টেবিলের ড্রয়ারে সব সময়ই তিন-চারটা সিগারেটের প্যাকেট থাকত। বছর চারেক আগে লকডাউনের বন্দিদশায় সেখান থেকে মাঝেমধ্যে চুরি করতাম আমি। একদিন চুরি করার সময় বাবার আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত পালিয়েছিলাম। তারপরই ভেবেছিলাম, আর চুরি করে সিগারেট খাব না।
বাবার কথা মনে হতেই তার কিছু কথা মনে পড়ল। প্রায়ই বাবা বলত, ‘পৃথিবী এত জটিল হয়ে গেছে যে তা আর সম্পূর্ণভাবে শোষণমুক্ত করা সম্ভব নয়।’
বাবা আজ জীবিত থাকলে তাকে আমি দেখাতাম, আমার এই পৃথিবীতে আর শোষণের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নেই কোনো দুর্নীতি। এই পৃথিবীতে লেজুড় নেই। এখানে আর ক্ষমতা বা অর্থের জন্য কেউ অন্ধ নয়, আমিও নই। এই পৃথিবীতে চুরি নেই, ডাকাতি নেই। কোনো অন্যায়-অবিচারও নেই। এখানে গোলাবারুদে আহত-নিহত হয় না কেউ। আর যুদ্ধ তো নেই-ই।
নিরাপত্তাহীনতা নেই। মধ্যরাতে দৈত্যদানবের আক্রমণের ভয় নেই। এই দুনিয়ায় অন্ধকারেও সাপের কামড়ে মারা যাওয়ার ভয় নেই। ঘুমের মধ্যে বোবা ধরার ভয় নেই। দৈহিক বা মানসিক নির্যাতনের ভয় নেই। আমার এই পৃথিবী এখন সম্পূর্ণ মুক্ত, স্বাধীন।
হ্যাঁ, আমার এই পৃথিবী কঠিন। এখানে টিকে থাকার লড়াই নিজেকেই করতে হয়। বাড়ির দারোয়ানকে দুই প্যাকেট সিগারেট কিনতে দোকানে পাঠানো যায় না। দুই মিনিট দেরি করলে তাকে চোখ গরম করে শাসানো যায় না। ঘর পরিষ্কার করতে কাজের মেয়ে আসে না এখানে, এক কোণে ধুলো জমে থাকলে তাকে ধমক দেওয়া যায় না। এই পৃথিবীতে আমার ভার টেনে রিকশা চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কেউ নেই। এই পৃথিবীতে সব নিজের জোরেই করতে হয়। তবু এই দুনিয়া সুন্দর।
এই পৃথিবী নিঃসঙ্গও। মন খারাপ হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায় না। প্রেম জাগলে প্রেমিকাকে আলিঙ্গন করা সম্ভব নয়। কথা জমে থাকলেও কাউকে বলা যায় না। নিজের জমে থাকা চিন্তাগুলো কেবল নিজেকেই বলা যায়—অনাকাঙ্ক্ষিত গোপনীয়তা। এখানে মায়ের কোলে মাথা রেখে আদর পাওয়া যায় না। দুশ্চিন্তা হলে বাবার অভিজ্ঞ উপদেশ নেওয়া যায় না। শরীর খারাপ হলে কেউ দেখে রাখে না এখানে। আমার ক্ষুধা নিয়েও কেউ দুশ্চিন্তা করে না। তবু এই পৃথিবী সুন্দর।
বাবা হয়তোবা আমার সঙ্গে একমত হতো না। হয়তোবা বলত, মানুষ ছাড়া মানুষ বাঁচে না। কিন্তু আমিও তখন বলতে পারতাম, আমি বেঁচে আছি কীভাবে? আমি কি মানুষ নই?
বাবা, তুমি মানুষই জন্ম দিয়েছ। আমি অমানুষ নই। কিন্তু আমার এই একাকিত্বের উপলব্ধি তোমার চিন্তার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, মানুষমাত্রই লোভী, মানুষমাত্রই শোষণ করার ইচ্ছা নিয়ে জন্মায়, অন্যায় করার আকাঙ্ক্ষাও তার মজ্জাগত। কারণ, মানুষ খুব কম সময়ই নিজের বিবেককে প্রশ্ন করতে পারে। ভঙ্গুর সমাজের ভঙ্গুর মানুষেরা তাই স্বার্থের টানে নিজের মনুষ্যত্ব বিলীন করে দিতে সময় নেয় না। তাই এই মানুষই নির্যাতনের শিকার মানুষকে আরও নির্যাতন করে নিজ স্বার্থের জন্য। অস্ত্রহীনকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তারা।
কল্পনায় বাবার সঙ্গে এই আলাপচারিতা শেষ হতেই বাসায় ঢুকে পড়লাম। বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লাম মাটিতে। আরেকটা সিগারেট খেতে হবে। এখন আমার পৃথিবীর চারপাশটা বেশ শীতল। তবু কপালে আজ তাপ অনুভব করছি। জ্বর? না, এই তাপ মায়ের হাতের স্পর্শজনিত, আমার চিরপরিচিত। কপালে হাত দিয়ে মা যখন আমার ঘুম ভাঙাত, তখন এমন তাপ অনুভব করতাম। অদৃশ্য থেকে মা-ই এখন হয়তোবা আদর করতে এসেছে, আমাকে উত্তেজিত হতে মানা করছে, একদম ঠিক আগের মতোই।
কিন্তু আমার নিশ্বাস আজ আটকে আসছে। সিগারেটের ধোঁয়াও অসহ্য লাগছে। হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। তবে আমার এখন খুব আফসোসও লাগছে, আমার পৃথিবীটা এখন শোষণমুক্ত, কিন্তু রোগমুক্ত তো হলো না। তারপরেও আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, একটি শোষণহীন পৃথিবী দেখে যেতে পেরেছি আমি। যাওয়ার বেলায় আমি হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নেব। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, জ্বালানো সিগারেটটি এখনো শেষ হলো না।
‘সরি, আপনার ছেলেকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না,’ বললেন ডাক্তার।
ছেলের কপাল থেকে হাত সরিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল রূপমের মা। তার বাবা চশমা খুলে চোখ মুছতে থাকল, ‘তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থাকো, বাবা।’