রাস্তাটা ঠিক যেন একটা জ্যান্ত অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে। বিশাল হা করে গিলতে আসছে গোলকান্দাইল, মিরেরটেক, শিরাবো, আমবাগ পেরিয়ে নয়াপুর বাজার। ধুলা উড়িয়ে, বাড়িঘর দোকানপাট, ঝোপঝাড়, মসজিদ, মাদ্রাসা সামনে যা পড়ছে সব গুঁড়িয়ে দিয়ে, বটগাছ, তালগাছ উপড়ে ফেলে, সে এখন খেতে আসছে টিন দিয়ে বানানো একরামউল্লাহর ছোট্ট দোকানটাকে। কী দরকার বাপু এমন বুক চিতানো পিচঢালা কালো রাস্তা বানানোর? ছোট্টবেলায় তো তারা গ্রামের মধ্যে লাল মাটির রাস্তাই দেখেছে! তখন বর্ষায় পা গেড়ে যেত থকথকে আঠালো কাদায়, তাতে পিছলে পড়ে বুড়োদের লুঙ্গি সরে যেত আর তাদের টিকটিকির মতো ঝুলতে থাকা পুরুষাঙ্গ দেখে বাচ্চারা তাদের পোকা খাওয়া দাঁত বের করে হি হি করে হাসত। শুকনার দিনে আবার শক্ত খটখটে মাটি, যেন পাথর।
কয়েকটা লক্কড়ঝক্কড় রিকশা চলত গ্রামের বউ–ঝিদের নিয়ে! নকুল মাস্টারের নড়বড়ে সাইকেলের পাশ দিয়ে ভোশ করে বেরিয়ে যেত চেয়ারম্যানের মেজ ছেলের মোটরসাইকেল। একরামের দাদার আমলে এখানে নাকি একটা রেললাইন ছিল। দিনে দুইবার ঘটর ঘটর শব্দ তুলে হেলেদুলে বন্দর থেকে এসে মদনপুর হয়ে নরসিংদী যেত সেই লাল রঙের ট্রেন। এলাকার লোকজন বিনা টিকিটেই ট্রেনে উঠে সকাল-বিকেল নরসিংদীতে হাটবাজার করতে যেত। এতই আস্তে গদাই লস্করি চালে চলত সেই ট্রেন যে প্যাসেঞ্জাররা যে যেখানে ইচ্ছা সেখানে নেমে যেতে পারত।
’৭৭ সালের দিকে সেই ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল। কিছুদিন রেললাইনটা মড়ার মতো নিঃশব্দে পড়ে রইল। তারপর একদিন রাস্তার রেললাইন তুলে কাবিখা করে মাটি কেটে সমান করে একটা কাঁচা রাস্তা হলো। কয়েক মাস পর সেই মাটির ওপর তেছড়া করে ইটের পর ইট বসিয়ে সোলিং করে দেওয়া হলো। রাস্তায় তখন রিকশা আরও কয়েকটা বাড়ল ঠিকই, কিন্তু রিকশা আরোহীদের ঠেকনা খেতে খেতে পাছার অবস্থা শেষ। বুড়ো–বুড়িদের প্রায় কোমর ভাঙার জোগাড়। বুদ্ধিমানরা তাই পায়ে হেঁটেই চলাচল করত। তেমনটা থাকল কিছুদিন। তারপর জায়গায় জায়গায় ইট ক্ষয়ে গেল, এবড়োখেবড়ো গর্ত হলো, বৃষ্টিতে সেসব গর্তে পানি জমে রইল। মানুষের ঝাঁকানি খাওয়া তখন আরও বাড়ল। অনেক রিকশাযাত্রীসহ হুমড়ি খেয়ে পড়ল গর্তে।
তার পরে যখন এরশাদের আমলে এলাকার মেয়ে সাবিরা ভূঁইয়া মন্ত্রী হলেন, তখন তাঁর মোষের মতো বিশাল কালো জিপ গাড়ি বাড়ির উঠান পর্যন্ত আনতে তিনি রাতারাতি সরকারি মহলে বলেকয়ে কালো পিচের আস্তর দিয়ে একটা ঝকঝকে রাস্তা বানিয়ে ফেললেন। তখন মানুষেরও বেশ আরাম হলো, সবাই সাবিরা ভূঁইয়ার খুব সুনাম করল। বলল, ‘বাপের বেটি সাবিরা!’ কিন্তু মানুষ এত নিমক হারাম! উপকারীকে তারা আর মনে রাখে না! এত সুন্দর পিচঢালা রাস্তা বানানোর পরেও এরশাদ সরকারকে সবাই মিলে খেদিয়ে দিল তারা।
এলাকায় নতুন এমপি এল। সে কিনা আবার বিরোধী দল করে। তাই সেবার এলাকার জন্য বিশেষ কিছু আর করতে পারলেন না তিনি। শুধু একটা স্পিনিং মিল বানালেন, সেখানে গ্রামের কিছু লোকের চাকরি হলো। এখন যিনি এমপি তিনি আবার সরকারি দলের, খুব দিলদরিয়া, খোশমেজাজি লোক। এমপি সাহেব একদিন জানালেন, ‘সরকারি পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই ছিল। সেই মোতাবেক দুই লেনের রাস্তা এবার চওড়া হয়ে আট লেনের রাস্তা হতে যাচ্ছে। এতে সবার জন্যই মঙ্গল হবে। তোমাদের এলাকার উন্নতি হবে।’
জাকিরের চোখে অধরা স্বপ্নরা ঝিলমিল করে। দোকান সরানোর জন্য আগে লিখিত চিঠি এসেছে এবার কন্ট্রাক্টরের লোক এসে মৌখিকভাবে নোটিশ দিয়ে গেছে।
উন্নতির কথা শুনেও একরামউল্লাহর মুখ বেজার।
‘রাস্তা হইলে চাইরোদিকে গাড়িগুড়ি ছুটব, গাড়িঅলাগো সুবিধা হইব। আমরা তো লোকাল, আমাগো কী? যাও একটু ব্যবসা কইরা খাইতাম তা–ও বন্ধ!’
‘আরে মিয়া, কী কও! ভাঙলে তোমার একার দোকান ভাঙব নাকি? সবারটিই ভাঙা পড়ব। জমির দলিল থাকলে ক্ষতিপূরণও পাইবা।’
কিন্তু একরামের তো দলিল নাই। তার দোকান পড়ছে রেলওয়ের জায়গায়। দোকান গেল তো তার সব গেল। চেয়ারম্যানের কাছে গেল একরাম, যদি একটা আশ্বাস বা নিদেনপক্ষে সান্ত্বনা মেলে! চেয়ারম্যান তার কারুকাজ করা কাঠের চেয়ারে বসে পান চিবাতে চিবাতে বলল, ‘তুই বেটা অবৈধ। তোর আবার উন্নতি কি আর অবনতিই–বা কী? এত দিন যে করে কর্মে খাইছিস, এই তো বেশি!’
সন্ধ্যাবেলা বাতেনের চায়ের দোকানে হামিদ মেম্বারের চোখ লোভে চকচক করে। সে জানে রাস্তাটা হয়ে গেলে পকেটভর্তি কাঁচা টাকা নিয়ে শহর থেকে টাকাওয়ালা পার্টিরা শিকারি কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলে আসবে জমি কিনতে। চায়ের কাপে সুড়ুৎ করে চুমুক দিয়ে সাঙ্গপাঙ্গদের উদ্দেশে বলে সে, ‘জমির দাম তো অখনে লাফ দিয়া, দিয়া বাড়ব। বড় বড় কোম্পানি আসব। হাউজিং বানাইব। ঠিকমতো দালালি করতে পারলেও একেকজন লালে লাল শাহজালাল হইয়া যাবি।’
মাত্র দুই মাস আগে মারা যাওয়া বাপের কথা মনে পড়ে একরামের। বুড়ার আধা কানি খেতি জমি আগের এমপির দেওয়া স্পিনিং মিলের কেমিক্যালে নষ্ট হয়ে গেছিল। কতখানে ঘূর্ণা দিছে সে, কত জায়গায় ধরনা ধরছে কোনো বিচার পায় নাই। বাপে বলত, ‘রাস্তা বড় হইলে তো ভালোই। অনেক বড় বড় গাড়ি আসে। ওই গাড়ির সঙ্গে আরও আসে টাউটামি, বাটপারি, রংবাজি, ঠকবাজি। গাড়ি তো চক্ষে দেখো, বাকি জিনিসগুলা চক্ষে দেখবা না। বুজবা খালি।’
একরামের আঠারো বছর বয়সী ছেলে জাকির অবশ্য দাদার কথার প্রতিবাদ করত, ‘নাহ্, দাদা। রাস্তা দিয়া গাড়ির সাথে টেকাও আসে, শিক্ষা আসে, ব্যবসা আসে...এইগুলার কথা কও না ক্যান? রাস্তা বড় হইলে আমার শহরে যাইতে সুবিধা হইব। ভালো কলেজে পড়তে পারুম।’
‘এই রাস্তা ধইরা তো তুই মা বাপ ছাইড়া শহরেও যাইতেগা পারবি...’
‘হ, চাকরিবাকরি করলে যাওন তো লাগবই! তোমার মতো একখানে ঝিম মাইরা বইস্যা থাকলে চলব? পড়ালেখা করতাছি কি আব্বার মতো দোকানদারি করার জন্য? একদিন ওই রাস্তা দিয়া নিজের গাড়ি চালায়া বাড়িতে আসুম!’
জাকিরের চোখে অধরা স্বপ্নরা ঝিলমিল করে।
দোকান সরানোর জন্য আগে লিখিত চিঠি এসেছে এবার কন্ট্রাক্টরের লোক এসে মৌখিকভাবে নোটিশ দিয়ে গেছে। নিজে নিজে সরে না গেলে যেকোনো দিন বুলডোজার নিয়ে এসে দোকান উচ্ছেদ করা হবে। এরই মধ্যে সাইদ খন্দকারের মতো নেতা মানুষ রাস্তার পাশে তার ডেইরি ফার্ম আর আগরবাতির ফ্যাক্টরি পর্যন্ত সরিয়ে নিয়েছে। একরাম তো কোন ছার!
চেয়ারম্যান বলে, ‘আমি তোমাগো লাইগ্যা হাতে পায়ে ধইরা এক মাসের সময় আনছি, এর মধ্যে যা করার করো! নাইলে আমি কিছু জানি না!’
ভেতরের দিকে রতন মার্কেটের কাছে একটা দোকানের খবর পাওয়া গেল প্রতিমা জুয়েলারির মালিক বিজয় কর্মকারের কাছে। বিজয় নিজেও একটা দোকান নিয়েছে, সেখানে এখন একরাম যদি নিতে চায় তাহলে কথাবার্তা বলে দেখতে পারে।
কথাবার্তা বলতে গিয়ে একরাম বুঝতে পারে, সুযোগ পেয়ে দোকানের মালিকও এখন বেশি দর হাঁকাচ্ছে। কিন্তু কী আর করা! ছেলে পরামর্শ দেয়, ‘আব্বা নামার জমিগুলান বেইচ্যা দেন। দাদায় নাই, এহন ওই সব জমি দেখাশোনাই বা করব কে?’
একরামের কপালে ভাঁজ পড়ে। বুকের মধ্যে খচখচ করে। দাদা পরদাদার আমলের জমি, নিজে চাষাবাদ না করলেও ওই জমির প্রতি তার একটা মায়া তো আছেই! ওই জমির ধুলা-মাটি গায়ে মেখে, ওই মাটির ধান-চাল খেয়েই তো এত বড় হয়েছে সে!
‘মায়া কইরা লাভ নাই আব্বা, এখন কি আপনে ব্যবসা ছাইড়া কৃষিকাজ করতে পারবেন? আপনের পক্ষে সম্ভব?’
সম্ভব যে না, সেটা তো একরাম ভালোই বোঝে। সারা জীবন তো সে গেরস্তির কাজ করেনি। বাপেই যত দিন সামর্থ্য ছিল করেছে। বাজারে কয়েকজন জমির দালালকে গিয়ে ধরল একরামউল্লাহ।
‘ভালা দর দিব, এমন একটা খদ্দের আইন্যা দেও। এক কানি ধানী জমি বেইচ্যা দিমু।’
একরামের কাছ থেকে জমির দরদাম শুনল দালালেরা। খারিজ করা আছে কি না, খাজনা হালনাগাদ করা কি না, ওয়ারিশের ঝামেলা আছে কি না, সেসবেরও খোঁজ নিল তারা। একজন দালাল তার থুতনির গোটা কতক সাদা–কালো দাড়ি নাড়িয়ে বলল, ‘অহন জমি ছাইড়ো না ভাই, আমার কথা শুনো, আর কয়টা দিন সবুর করো, রাস্তাটা হইলে জমির ভালো দাম পাইবা! অহন তো দাম উঠত না!’
সে কথা কি আর জানে না একরামউল্লাহ! খুব ভালো করেই জানে! কিন্তু রাস্তার জন্য অপেক্ষা করার সময় তার কই? বলতে গেলে, এই রাস্তার জন্যই তো তাকে দোকান সরাতে হচ্ছে আর নতুন দোকান কেনার জন্যই বাধ্য হয়ে তাকে জমি বিক্রি করতে হচ্ছে। জমি ধরে রাখার তো কোনো উপায় নাই! না বেচলে এখন কোথায় পাবে সে নগদ টাকা? কেমন করে নেবে নতুন দোকান?
‘আইচ্ছা দেখি! একজন আছে! সৌদি থাকে। কইছিল বলে ভালো জমি পাইলে কিনব!’
‘দেখো না ভাই! আমার তো জরুরি ভিত্তিতে টেকা লাগব।’
কদিন পর দালাল জমির যে দাম বলল, তা শুনে তো একরামের মাথায় হাত!
‘এ তো এক্কেবারে পানির দর কইতাছো ভাই! এত ভালো তিন ফসলি জমি...বিপদে না পড়লে কি হাতছাড়া করি...’
‘আগেই তো কইছি তোমারে অহন বেইচ্যো না, এই দরের বেশি কিনোইন্যা মানুষ দেশে নাই...’
দালালের সাফ কথা। ‘বেচলে বেচো, না বেচলে নাই।’
জাকির বুদ্ধি দিল, ‘আব্বা, সমিতি থেইক্যা লোন নেন।’
ধারদেনা করতে বরাবরই ভয় পায় একরামউল্লাহ। ঋণের বোঝা একবার মাথায় চাপলে সিন্দাবাদের বুড়ার মতো সহজে তাকে নামানো যায় না। তারপরও এত কম দামে জমি বেচার চাইতে ঋণ করাটাই ভালো মনে হলো একরামের। পরে যদি কখনো জমির দাম বাড়ে তাহলে না হয় জমি বিক্রি করে সেই টাকায় ঋণ শোধ করা যাবে।
ঋণ নেওয়ার জন্য পায়ের স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় করে কয়েক দিন এনজিও অফিস আর বাজার সমিতিতে ঘুর ঘুর করল সে। নিয়মকানুন বুঝল। কিন্তু সুদের হার যে রকম চড়া! ঋণের কিস্তি দিতে দিতেই তো ফতুর হওয়ার দশা হবে। একরামউল্লাহর নিজেকে বড় অসহায় লাগে। বাপে কইত, ‘যার কোনো ঋণ নাই, যে নিজের ভিটাতে বইসা শান্তি মতো দুইটা শাক ভাত খাইতে পারে, সে–ই হইল দুনিয়ার মধ্যে সুখী মানুষ।’
তা সেই সুখী মানুষ হওয়া একরামউল্লাহর কপালে নেই। ভারবাহী পশুর মতো তাকে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি টানতে হবে। এনজিও অফিসে গিয়ে কয়েক জায়গায় সই-সাবুদ করে ছেলেকে নিয়ে ঋণের টাকা তুলে আনে একরামউল্লাহ।
‘কিস্তি কিন্তু মিস দিয়েন না ভাই। মিস দিলে জরিমানা। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়ব।’ এনজিওর লোকটা টাকার বান্ডিলটা হাতে তুলে দিয়ে একরামউল্লাহকে সাবধান করে।
বাড়ি ফেরার পথে একরাম দেখে বড় বড় ট্রাক ভর্তি করে মাটি এনে রাস্তার পাশের খাদগুলো ভরাট করা হচ্ছে। হলুদ রঙের বিরাট বিরাট দৈত্যের মতো ভেকু মেশিন, রোলার মেশিন তো আছেই, আরও কত নাম না জানা মেশিন এনে রাখা হচ্ছে রাস্তার কাজ করার জন্য। মেশিনগুলার যান্ত্রিক হাত খাবলা খাবলা মাটি তুলে এনে ঘুরে ঘুরে ডানে–বাঁয়ে ফেলছে। রোলারগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে নরম মাটি সমান করছে। একপাশে পাহাড়ের মতো স্তূপ করে কালো পাথরের কুচি জমা করা হচ্ছে।
হুম, রাস্তাটা সত্যিই অনেক, অনেক বড় হচ্ছে।