প্রয়াত প্রখ্যাত কবি এমরান আল হামিদির পঁয়ষট্টিতম জন্মদিন বসুন্ধরায় নিজের বাসভবনে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন কবিপত্নী স্থপতি শামারোজ খন্দকার। একই সঙ্গে শামারোজের প্রথম প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। তার যমজ দুই মেয়ে বিদেশ থেকে এসেছে বলে তারাই এ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা। প্রচুর খাবারে টেবিল বর্ণিল।
শামারোজের নামে বাড়ির নাম রোজ গার্ডেন। রোজ গার্ডেনের পঁচিশ বছরের পরিচারিকা সাবাসি খাতুন হাতের কাজ শেষ করে ড্রয়িং রুমের দরজার আড়ালে একটা চেয়ার নিয়ে বসে যদ্দুর পারা যায় অতিথিদের পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। সাবাসিকে এ বাড়ির সদস্যের মতোই দেখে সবাই। ড্রাইভার, মালিও যথেষ্ট সমীহ করে। এ সংসারে সাবাসির অবদান অনস্বীকার্য। শামারোজের দুই মেয়ে একটু পরপরই ‘সবাসি খালা, জাগে আরও বরফ দাও, ওখানে আর দুটো টিস্যু বক্স রাখো, টেবিলে জুস পড়ে গেছে মুছে দিয়ে যাও’—এসব বলতেই থাকে। ওখান থেকে তার নড়ার উপায় নেই। যদিও ড্রাইভার আর মালি তদারকিতে আছে। রোজ ম্যাডামের আজ বেশ পরিমিত আচরণ। কেমন একটু ভারাক্রান্ত চেহারা। দুই মেয়েই অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। কোমল-কঠিন সব পানীয়রই ব্যবস্থা আছে। সাবাসি ওসব দেখে অভ্যস্ত। ‘হামিদ স্যারে বাঁইচা থাকতে সকাল–সন্ধ্যা স্যারের লেখনের টেবিলে বুতোল, গ্যালাস, বরফ সাজাইয়া দেওন লাগতো।’
সেই প্রথম প্রথম ‘কে বেল বাজায় দেখ তো সাবাসি’—শামারোজ ভেতর থেকে বললে সাবাসি এসে জানাত, ‘এক ব্যাডা খাড়াইয়া আছে।’
‘ওহ আবার ব্যাডা! বলবি একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। কী চান?’
‘হামিদ স্যারের লগে দেহা করবার চায়।’
‘হামিদ নয় সাবাসি, ওনার নাম হামিদি।’
‘হামিদা তো মাইয়াগোর নাম।’
সাবাসি এমরান আল হামিদির গ্রামের মেয়ে। দূরসম্পর্কের আত্মীয়। সাবাসিকে হামিদির মা জেবুন্নেসা ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন যখন, শামারোজ ম্যাডামের যমজ মেয়ের জন্ম হয়ে গেছে তখন। সাবাসির তেমন পিছুটান ছিল না। পরপর দুটো মেয়ের জন্মের পর তারা আঁতুড়েই মারা গেলে স্বামী সাবাসিকে বের করে দিয়ে আবার বিয়ে করে। ভাইয়ের বউ উঠতে–বসতে গঞ্জনা দিত। শেষ পর্যন্ত এমরান আল হামিদির মা জেবুন্নেসা একটা চিঠি লিখে দেন সাবাসির হাতে। পঞ্চম শ্রেণি পাস সাবাসি ঠিকানা পড়ে, ‘হামিদুল এসলাম, ১২/৩/সি বাসাবো লেন, ঢাকা’। ‘হামিদি কইলেই আমারে বুজান যাইবো!’
তেষট্টি বছর বয়সে একদিন সকালে লেখার টেবিলে বসে হঠাৎ কাত হয়ে পড়েন কবি। একটু আগেই সাবাসি কফি রেখে গেছে। কফির পেয়ালায় চুমুকও পড়েনি মনে হয়। শামারোজ অফিসে বেরোচ্ছিলেন। লেখার সময় বিদায় বা আগমনের কোনো সম্ভাষণ কবির নাপছন্দ ছিল। কবিপত্নী একবার আড়চোখে দেখেই দ্রুত ছুটে এলেন। সোজা করে বসানোর চেষ্টা করে না পেরে চিৎকার করলেন, ‘সাবাসি সাবাসি, ড্রাইভারকে ডাক।’
‘কবি চেয়ারে বসেই মারা গেছেন’, চিকিৎসক বলেছিলেন।
জাতীয় দৈনিক, রেডিও, টিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ল। কবি–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবী–ভক্তের ভিড় সামলাতে পুলিশি সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি দেখতে এসেছিলেন বলে লোকসমাগম স্তিমিত হয়েছিল। তা ছাড়া তাঁর মেয়েরা বিদেশ থেকে আসার পর শহীদ মিনারে মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কথা শুনে কবির বিখ্যাত কবিতার লাইন লেখা প্ল্যাকার্ড নামিয়ে অনেকেই ধীরে ধীরে সরে গিয়েছিলেন।
শামারোজ খন্দকারেরও কবি পরিচিতি ভালো। একটা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে চার বছর আগে। অনুষ্ঠানের শুরুতে আমন্ত্রিত কবিদের মধ্যে একজন কবি এমরান আল হামিদির বিখ্যাত কবিতা থেকে আবৃত্তি করলেন। একজন শামারোজের কবিতা পড়ে শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন বিনীতভাবে বললেন, ‘এত চমৎকার আপনার কবিতার হাত, আর মাত্র একটি কবিতার বই কেন?’
একজন নারী কবি বলেই দিলেন, ‘আমি বইটার প্রতিটা কবিতা পড়েছি। কোনো কোনোটা আমার মতে এমরান হামিদিকেও ছাপিয়ে গেছে।’
বয়সী পুরুষ কবিরা সম্মতিসূচক মৃদু মাথা নাড়লেন। বোঝা গেল তাঁরা কেউ পড়েননি। একজন তরুণ উঠতি পুরুষ কবি বললেন, ‘আমি একমত।’
শামারোজ শরমিন্দা হলেন, ‘এটাও আপনাদের কবির অনুপ্রেরণা আর জোরাজুরিতে করা।’
সাবাসি খাতুন দরজার আড়ালে বসে সব দেখে একটু হাসল। সেদিনের কথা সে ভোলেনি। রোজ ম্যাডামের বইয়ের গাট্টি সাবাসিই সুতার গিট্টু খুলে টেবিলে রেখে এসেছিল। কিছুক্ষণ পরই সে দেখে, স্যার একটা একটা করে বই তুলে ছুড়ে ফেলছেন। কী সব বলে গর্জাচ্ছেন। ম্যাডাম মাথা নিচু করে কাউচে বসে আছেন।
‘এসব আমাকে না জানিয়ে না করলে চলছিল না?’
‘তোমাকে খামোখা বিরক্ত করতে চাইনি।’
‘আমি তো এখন বিরক্তির একশেষ! মানুষ বলবে না, কবিতাগুলো আমিই লিখে দিয়েছি?’
‘তোমার লেখার ধরন তো সবাই জানে। আমারটা আলাদা।’
‘আমার চোখের সামনে থেকে সরাও এসব জঞ্জাল!’ বলেছিলেন অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি এমরান আল হামিদি।
শামারোজ খন্দকারের আত্মজীবনীমূলক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবেন এমরান আল হামিদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশিষ্ট কবি আবদেল মাতিন। তিনি এসে পৌঁছাননি। সবাই ঘুরে ঘুরে খাবার নিচ্ছেন, পান করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। দু–একজন বাদে এদের সবাইকে সাবাসি খাতুন চেনে। ‘স্যারে বাঁইচা থাকনের সময় এগো লাইগ্যা চা–নাশতা বানাইতে বানাইতে হাতে কড়া পইড়া গেছে। তয় সকাল আর সইঞ্জার কোপি রুজ ম্যাডামের হাতে না খাইলে স্যারের ম্যাজাজ ঠিক তাকতো না। হ, একদিন তো কোপির কাপ ফিক মাইরা ফ্যালায় দিছিলো। কইছিল, এইডা কিচ্ছু হয় নাই। কোপি ছিটকায়া রুজ ম্যাডামের শাড়িত গিয়া পড়ছে। হ্যাসে ম্যাডাম আবার কোপি বানাইয়া শাড়ি চ্যাঞ্জ কইরা অপিসে গেছে। আবার বন্ধুগো জিয়াফত দিয়া ম্যাডামের রান্ধনের হেইরে পেশংসা! ক্যান্তক রান্ধন তো সব আমার! একবার ম্যাডাম একটা বিল্ডিংয়ের নকশা করনের জইন্যে পুরুস্কার পাইছিল। পুরুস্কার আননের দিন স্যাররে লগে যাওনের লাইগা কুতোনা উনুরোদ করছিল রুজ ম্যাডাম, স্যারে এক চুল লড়ে নাই।’
কবি আবদেল মাতিন এসে শামারোজ খন্দকারের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন। মুহুর্মুহু করতালিতে ঘর মুখর হয়ে উঠল। তাঁর অনুরোধে শামারোজ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় থেকে খানিকটা পড়তে শুরু করলেন:
‘আমার কাব্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে কবির সে কী উচ্ছ্বাস! আমাদের মেয়ে দুটোর গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে যোগ দিতে গিয়েছিলাম ইউএসএ। কবি যেতে পারেননি। ওরই মধ্যে আমার কবিতার বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। এক মাস পর যেদিন ফিরলাম, সেদিন এয়ারপোর্টে তিনি গাড়ি ভরে ফুল এনেছিলেন। আমার কবিতার বই ছিল সেই ফুলের ওপর বিছানো। আমারই কবিতার লাইন ছিল তাঁর মুখে—
‘জোনাকিরা সদলবলে ছেড়ে গেল পাতকুয়োর আঁধার,
ওরা কি জেনে গেছে আঁধার একাই স্বয়ম্ভু?’
অস্ফুটে প্রশংসার গুঞ্জনে ভরে গেল সমাবেশ।
শামারোজ নিজের আবেগ সামলাতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তাঁর মেয়ে দুটো সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে শামারোজকে আদরের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তাঁর শয়নকক্ষে নিয়ে গেল। একটু সামলে নিয়ে উনি ফিরবেন বলে জানাল তারা। সাবাসি খাতুনকে সবার দিকে নজর রাখার কথা বলে গেল।
আগত অতিথিরা খানিক নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। কেউ বললেন, ‘এমন আদর্শ জুটি এ যুগে বিরল।’ কেউ বললেন, ‘কবির পাশে এমন সঙ্গী ছিলেন বলেই তিনি খ্যাতিমান হতে পেরেছিলেন।’ নারীবাদীদের একজন ‘শামারোজ নিজেও কোনো অংশে কম নন’ বলে সদর দরজার দিকে তাকালেন। বিশাল ফুলের স্তবক নিয়ে এ সময়ের আলোচিত কবি তরঙ্গিণী চৌধুরী প্রবেশ করলেন। কবি আবদেল মাতিন প্রায় ছুটে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, ‘এতক্ষণে অনুষ্ঠানে জলতরঙ্গ ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি।’
সাবাসি এগিয়ে গিয়ে ফুলের স্তবকটি নিয়ে টেবিলে রাখল। তরঙ্গিণী চৌধুরী সাবাসিকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন এবং কানে কানে কী যেন বললেন অথবা বললেন না, ঠিক বোঝা গেল না। সাবাসির ঠোঁটে বাঁকা হাসি খেলে গেল। সে মুখে কিছু বলল না কিন্তু মনে মনে বলল, ‘আপনে নিচ্চিন্তে তাকেন। স্যারেও তো আমরারে কম দিছে না।’