কালে কালে নারীবাদের ঢেউ
নারীবাদ কী? নারীবাদ কি একটি আন্দোলন, মতাদর্শ, নাকি এটি ‘ক্রিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’?
‘নারীবাদ কী?’ ১৯১৬ সালে এ প্রশ্নের জবাবে গোটা একটি নিবন্ধ লিখে ফেলেন মার্কিন লেখিকা ও মানবতাবাদী শার্লট পারকিন্স গিলম্যান। আটলান্টা কনস্টিটিউশন-এ ছাপা সেই নিবন্ধের মুখবন্ধে শার্লটের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল ‘সবচেয়ে জনপ্রিয় নারীবাদী’ হিসেবে। আর তাঁর নিবন্ধকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘আধুনিক নারীর লক্ষ্য ও অনাগত জীবনের ভবিষ্যদ্বাণীর একটি বিশ্লেষণ’রূপে।
এই নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার চার দশকের বেশি সময় আগে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে প্রথম আবির্ভাব ঘটে ‘ফেমিনিজমে’ ও ‘ফেমিনিজ্টে’—শব্দ দুটির। আর যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফেমিনিজম’ শব্দটি পৌঁছায় ১৯১০ সালে। ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’র মতে, ‘ফেমিনিজম’ শব্দ এবং এর অর্থ ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে ১৮৯৫ সালে।
ওপরের তথ্যগুলো মনে রেখে আবারও ফেরা যাক শার্লট পারকিন্স গিলম্যানের কথায়, নারীবাদ প্রসঙ্গটি খোলাসা করতে গিয়ে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কী লিখেছিলেন এই নারীবাদী?
তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘সত্যিকার অর্থে নারীবাদ হলো দুনিয়ার সব নারীর এক সামাজিক জাগরণ। এটা সেই মহান আন্দোলন, যা আংশিক সচেতন এবং বৃহত্তর অংশে অবচেতন, যা মানবজীবনে মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্রকে পাল্টে দিচ্ছে। এত দিন আমরা একটি পুরুষনির্মিত বিশ্বে বাস করছিলাম, যেখানে নারী লিঙ্গ হিসেবে ভালোবাসা, মা হিসেবে স্বীকৃতি এবং চাকর হিসেবে শোষিত হয়েছে। ভালোবাসা, স্বীকৃতি ও শোষণের বাইরে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না…“নারীবাদ” তাদেরই উত্থান।’
চতুর্থ নারীবাদী ঢেউ জোর দিয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর। রুখে দাঁড়িয়েছে নারীকে পণ্যায়ন করা এবং লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
‘ফেমিনিজম’ বা ‘নারীবাদ’ শব্দটি খুব পুরোনো নয়। এমনকি ‘নারীবাদ’কে তত্ত্বের ছাঁচে ফেলার যে ঘটনা, তা-ও ঘটেছে বেশ পরে, বলা চলে সাম্প্রতিক সময়ে। বেশ কয়েকটি ‘ওয়েভ’ বা ‘ঢেউ’য়ের মধ্য দিয়ে দিনে দিনে সংহতি পাওয়া ‘নারীবাদ’ নামের এই বিশেষ প্রপঞ্চ কি আন্দোলন, মতাদর্শ, নাকি এটি একটি ‘ক্রিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’?
প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে শার্লটের নিবন্ধে পুনরায় চোখ বোলানো যাক। নিবন্ধে এই নারীবাদী প্রাসঙ্গিকভাবে এনেছেন নারীবাদের প্রথম ঢেউয়ের (১৮৪৮-১৯২০) কথা, যার ভিত্তি গড়ে উঠেছে মানুষ হিসেবে নারীর সম-অধিকার অর্জনের ওপর জোর দিয়ে। তবে সেই সময় এটিকে কেউ ‘ঢেউ’ হিসেবে চিহ্নিত করেননি।
মূলত প্রথম ঢেউয়ের সময় থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে নারীরা তাঁদের ওপর পদ্ধতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেন। ভোটাধিকার, সম্পত্তির অংশীদারত্ব, অভিভাবকত্বের আইনি অধিকার এবং শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামেন তাঁরা। আন্দোলনরত নারীরা এ সময় উপলব্ধি করেন, সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে নারীর আর্থরাজনৈতিক অবস্থান চিহ্নিত করা এবং সে বিষয়ে তাদের সচেতন করা ছাড়া এ আন্দোলন সফল হবে না। কাজেই বৃহত্তর সমাজের মনোভঙ্গির পরিবর্তনে বাড়তে থাকে তৎপরতা।
চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, ‘ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজম’ বা ‘নারীবাদের প্রথম ঢেউ’-এর অস্তিত্ব প্রকাশ পায়, যখন ১৯৬৮ সালে সাংবাদিক মার্থা লিয়ার নিউইয়র্ক টাইমস-এর জন্য একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘দ্বিতীয় নারীবাদী ঢেউ: এই নারীরা কী চায়?’ তিনি লেখেন, ‘প্রবক্তারা এর নাম দিয়েছেন দ্বিতীয় নারীবাদী ঢেউ। এই দ্বিতীয় নারীবাদী ঢেউ তখনই এসেছে, যখন ভোটাধিকার আদায়ের মহিমান্বিত বিজয়ের পর প্রথম ঢেউয়ে ভাটা পড়ল এবং শেষতক তা “মৈত্রী”র বালুতটে হারিয়ে গেল।’
এই ধাপে অর্থাৎ দ্বিতীয় ঢেউয়ের (১৯৬০-১৯৮০) সময়ে এসেই নারীবাদ ধীরে ধীরে মতাদর্শ হয়ে উঠতে শুরু করে, যার মূল চেতনা ছিল পুরুষ ও নারীর সমতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি পদ্ধতিগত বৈষম্য দূর করার চেষ্টা ছিল এ পর্যায়ে। কর্মস্থল, পরিবার, দাম্পত্য, যৌনতা, সন্তান জন্মদান—সব ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান ও অধিকার সমান কি না, প্রশ্নটি সামনে রেখে নারীর প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন নারীবাদীরা। তবে এ সময়ের নারীবাদীদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, হয়েছে সমালোচনাও। বলা হয়ে থাকে, নারীদের মধ্যেই দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণভেদে যে পার্থক্য আছে, তা এ সময় আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে অনেক গবেষকের এমন মত যে বৃহত্তর বাস্তবতাকে না ছুঁয়ে ‘দ্বিতীয় নারীবাদী ঢেউ’ শেষাবধি কেবল পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ নারীর মতাদর্শিক অবস্থানই হয়েই রয়ে গেছে।
এরপরে এল আরেকটি ঢেউ, যাকে বলা হলো ‘তৃতীয় নারীবাদী ঢেউ’ (১৯৯০-২০১০)। এই পর্বে আদতে নারীর বৈচিত্র্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেওয়া হলো। নারীবাদী তাত্ত্বিক এলিজাবেথ ইভান্সের মতে, ‘তৃতীয় নারীবাদী ঢেউয়ের মূল উপাত্তকে ঘিরে যে বিভ্রান্তি, তা-ই আবার এর মূল বৈশিষ্ট্যও বটে।’
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ওঠা এ ঢেউ গৎবাঁধা লৈঙ্গিক ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। পাশাপাশি ভাঙার চেষ্টা করেছে নারীর ‘স্টেরিওটাইপড’ ভূমিকা।
১৯৯০ সালে জুডিথ বাটলার প্রকাশ করেন তাঁর বই জেন্ডার ট্রাবল: ফেমিনিজম অ্যান্ড দ্য সাবভার্সন অব আইডেন্টিটি, যা সমকালীন নারীবাদী তত্ত্বের অন্যতম প্রভাবশালী কাজ হিসেবে বিবেচিত। এখানে বাটলারের ভাষ্য হলো, ‘নারী’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা আসলে একটি সামাজিক নির্মাণ এবং এই নির্মাণটি নারীবাদের মধ্যেও প্রোথিত।’ তিনি বলেন, ‘লৈঙ্গিক পরিচয় আদতে একধরনের প্রদর্শনী এবং সাধারণত একে যৌনতা থেকে আলাদা করা হয় না। একটি শিশু কখনো নারী বা পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না, জন্মানোর পর যৌনাঙ্গের ভিত্তিতে তার লিঙ্গ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এরপর সে অনুযায়ী সরবরাহ করা হয় প্রথাগত ও সাংস্কৃতিক তথ্য। পরে এসব তথ্যের ভিত্তিতেই সে নারী বা পুরুষের চিহ্নগুলো বুঝে নিয়ে নিজেকে প্রদর্শন করে।’
এ পর্যায়েই ‘ইন্টারসেকশনালিটি’র বিস্তার ঘটে। ইন্টারসেকশনালিটি হলো এমন একটি সামাজিক বিশ্লেষণ-কাঠামো, যা বোঝার চেষ্টা করে কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় বিদ্বেষ বা বিশেষ সুবিধার অনন্য সংমিশ্রণ তৈরি করে। আদতে এটি একটি চক্র, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, যৌনতা, ওজন, দৈর্ঘ্য, বয়স, এমনকি শারীরিক উপস্থাপন—নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিচয় একে অন্যকে অতিক্রম ও অধিক্রমণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায়ন ও শোষণ—দুই-ই ঘটাতে পারে। যেমন শ্বেতাঙ্গ হওয়ার কারণে মার্কিন মুলুকে কোনো নারী সুবিধাপ্রাপ্ত হন, তেমনি কালো বা বাদামি হওয়ার ফলে কেউ কেউ বঞ্চনারও শিকার হতে পারেন—তৃতীয় ঢেউয়ে নারীর এই বিষয়গুলোও সামনে এসেছে।
নারীবাদের চতুর্থ ঢেউয়ের আগমন ২০১০ সালের গোড়ায় এবং ক্ষীণভাবে হলেও তা এখনো চলমান।
অন্তর্জাল তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যখন সুলভ হলো, মূলত তখন থেকেই আছড়ে পড়তে শুরু করল এই ‘ওয়েভ’। এই চতুর্থ নারীবাদী ঢেউ জোর দিয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর। বিপরীতে রুখে দাঁড়িয়েছে নারীকে পণ্যায়ন করা এবং লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে। অনেকে অবশ্য এই পর্বকে ‘উত্তর-নারীবাদী পর্যায়’ বলেও অভিহিত করতে চান। এ বিষয়ে তাদের যুক্তি হলো, নারী-পুরুষের সমতা অর্জিত হয়ে গেছে। এ পর্যায় ‘মি টু মুভমেন্ট’-এর জন্যও পরিচিত, যা নারীর প্রতি পদ্ধতিগত যৌন সহিংসতার মুখোশ উন্মোচন করে।
শেষে আবারও সেই শুরুর প্রশ্নে ফেরত যাই—নারীবাদ কী? নারীবাদ কি একটি আন্দোলন, মতাদর্শ, নাকি এটি ‘ক্রিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’?
এখনো বিশ্বের নানা প্রান্তে শুধু নারী হওয়ায় শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয় মেয়েদের, দুনিয়ার প্রতি তিনজনে একজন নারী শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হন, পুরুষের সমান মজুরি পাওয়ার জন্য এখনো লড়তে হয় নারীকে। ফলে আন্দোলন, মতাদর্শ, তাত্ত্বিক কাঠামো—নারীবাদ এগুলোর মধ্যে একটি বা সব কটিও হতে পারে। এটি নারীকে যেমন অধিকারসচেতন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহ জোগায়, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতায় জীবন বিশ্লেষণের জন্য এটি একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ বা কাঠামোও হতে পারে।