‘শো অফ’-এর দুনিয়ায় আমি লেখক নই বলে তুমি পাঠক হবে না কেন?
একসময় সমরেশ মজুমদারের লেখায় আচ্ছন্ন হয়েছিল যেসব প্রজন্ম, এখন তাঁরা কীভাবে অনুভব করেন এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে?
দেখনদারি বা ‘শো অফ’-এর দুনিয়ায় যখন কোনো লেখক, নায়ক, কবি, নেতা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য মারা যান বা তাঁদের জন্মদিন আসে অথবা তাঁরা কোনো অর্জন করেন, তখন সবাই তাঁর সঙ্গে তোলা ছবি খুঁজতে থাকেন। তারপর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। সেই ছবিতে আমরা দেখি ৩১২ জনের দলে লেখক উত্তরে আর পোস্টদাতা দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে কোনোমতে তাঁর দেহখানা তুলে ধরেছেন। আর সেই ছবির সঙ্গে ক্যাপশনে লেখা আছে, ‘সেদিন একান্তে বিকেলে অমুকের সঙ্গে।’
আমরা স্বাভাবিকভাবেই খুব আপ্লুত হই, ‘হ্যাডম দেখেছিস! অমুকের সঙ্গে ছবি আছে।’
আর কোনো সাহিত্যিক মারা গেলে তো কথাই থাকে না। ‘নিখিল বাংলা সাহিত্য পরিষদ’-এর (স্বঘোষিত এবং প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কমিটি আছে। সেন্ট্রাল কমিটির বালাই নেই) সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হন। প্রয়াত সাহিত্যিক কত বড় ছিলেন, জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণের চেষ্টা থাকে এক দলের। আর অন্য দলের সাহিত্যবোদ্ধারা ওই সাহিত্যিক যে কিছুই ছিলেন না এবং তিনিসহ তাঁর পাঠকগোষ্ঠী কত ‘বলদ’, তা প্রমাণের চেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে শোকের আয়ু ক্ষণস্থায়ী। তাই এসব শোক, তোষামোদ, অতিপ্রশংসা—সবকিছুরই জোয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টা টেকে। এরপর বেঁচে থাকে শুধু সেই লেখকের লেখাটুকু। যদি বেঁচে থাকার মতো হয় আরকি।
ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে বসেছি সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে। সদ্য প্রয়াত এই লেখক এই বাংলার পাঠকের কাছে বড়ই আপনজন ছিলেন। আমরা যাঁরা ‘নাইনটিজ কিডস’ বলে পরিচিত, শিশুকালে সাদা-কালো টিভি, সল্টেজ বিস্কুট আর হজমি গোলা খেয়ে বড় হয়েছি, তাঁদের কাছে তিনজন লেখক অবশ্যপাঠ্য ছিলেন—সুনীল, শীর্ষেন্দু আর সমরেশ। এর আগের প্রজন্ম তাঁদের তারুণ্যে পড়েছেন। আমার ধারণা, ২০১০ সালের পর কেউ সমরেশ, শীর্ষেন্দু বা সুনীল পড়েননি। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ধারণা। কার বই কত পড়া হচ্ছে, সেই বিষয়ে জরিপ হচ্ছে না বলে বিষয়টি জানার বাইরেই রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক কোনো পাঠকের কাছে আমি এই লেখকত্রয় নিয়ে আলোচনা শুনিনি। তাঁরা সাইফাই, থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার কিংবা ক্রাইম জনরার লেখা পড়তেই বেশি অভ্যস্ত বলে আমার আপাতধারণা। এরপরের জনরায় আছে প্রেমের উপন্যাস। একটু বিপ্লব, একটু প্রেম, একটু শ্রেণিসংগ্রাম, শোষণের তালগোল পাকানো উপন্যাস এখন কেউই নিতে চায় না। ওসবের পাঠ আমাদের শিশুকালেই চুকে গেছে।
সমরেশই বাঙালি পাঠককে বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছিলেন জলপাইগুড়িতে স্বর্গছেঁড়া নামে একটা চা-বাগান আছে। ডুয়ার্সের জঙ্গলের অনবদ্য সৌন্দর্য খুঁজতে পরিব্রাজকেরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এই সমরেশের লেখার কল্যাণেই কিন্তু।
আমাদের বাড়িতে পড়ালেখার একটু উল্টো চল ছিল বলে কেউ শিশু আমাকে জানায়নি যে সমরেশ মজুমদারের শিশুতোষ লেখা ‘অর্জুন’ সিরিজ আগে পড়তে হবে, এরপর বড়দের বই। আমি আগে ‘কালবেলা’ই পড়েছিলাম। এরপর অনিমেষের জন্য হেঁচকি তুলে কেঁদেছিও। তখনো বিপ্লব, নকশালবাড়ি আন্দোলন, নারীর স্বাধীনতা, মাওবাদ—এই সবকিছু নিয়ে কোনো ধারণা হয়নি বলে সরল মনে পড়ে গেছি আর এক নায়কের দুঃখে চিরদুঃখী হয়েছি। নিজেকে সেই শিশুকালে মাধবীলতা ভাবার মতো হইনি বলেই সে-যাত্রা অনিমেষ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। অবশ্য ‘কালপুরুষে’ মাধবীলতার অস্বাভাবিক সংগ্রাম আমাকে সেই অনিমেষ মোহ দূর করে দিয়েছিল। ‘উত্তরাধিকার’ তো আমার মতে বঞ্চনার ইতিহাস, মাধবীলতা আর অর্কের প্রতি হওয়া বঞ্চনা।
বাংলা সিনেমার নিয়ম মেনে নায়ককে দায়িত্বশীল হতে হবে, লড়াই করে জিতে শত্রুদের পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। নায়ক কেন ব্যর্থ বিপ্লবী হবে—এই ধারণা থেকে সমরেশ মজুমদারের ওপর ‘গরিব পাঠক’ আমার খুব রাগ ছিল। ‘বুনো হাঁসের পালক’ উপন্যাসে যখন প্লেন ভর্তি রিলসহ বরফের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিল, তখন রাগে-দুঃখে বই ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।
‘আট কুঠুরি নয় দরজা’-এর আকাশ যখন অপারেশনের পর স্মৃতি হারিয়ে ফেলল, তখন ক্রোধটা আরও বেড়েছে।
‘অগ্নিরথ’ বইটার নাম আমাদের বাসায় নাম ছিল ‘হুতাশন চ্যারিয়ট’। আমরা বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে নামটা রেখেছিলাম। উপন্যাসটি সবচেয়ে প্রিয় হতে পারত যদি না সায়নকে আগুনে পুড়িয়ে মারতেন লেখক।
তবে সায়নের মৃত্যুর যে সরল বর্ণনা সমরেশ দিয়েছেন, এখানেই মুনশিয়ানা।
‘তখন চরাচরে বিষণ্ন আলো। সূর্যদেব বিদায় নিচ্ছেন। তবু রাতের চেয়ে বড় আতঙ্ক সামনে দেখে পাখিরা বোবা হয়ে গেল। জ্বলন্ত অবস্থায় সায়ন কোনোমতে ম্যাডামের পা স্পর্শ করতে পারল। জ্বলন্ত পা।
‘জ্বলন্ত আগুনের সেই রথ ক্রমশ আকাশ অধিকার করতে ওপরে, আরও ওপরে উঠে যাচ্ছিল। ঈশ্বর বলে কেউ যদি কোথাও থাকেন তাহলে তিনি বিপন্ন বোধ করছিলেন অবশ্যই। এই আগুন যদি আরও দীর্ঘতর হয় তাহলে তাঁর স্বর্গের অস্তিত্ব লোপ পাবে।
‘নিরাপদে ফিরে গিয়ে ছেলে চারটে মশগুল ছিল। ছিনতাই করা একটা জিপ তাদের আড়াল করতে অনেক গল্প সাজাবে। ওরা কেউ পেছনে তাকায়নি তাই অগ্নিরথ দেখতে পায়নি। ওরা কেউ সামনে তাকাবে না তাই লক্ষ লক্ষ অগ্নিরথের অস্তিত্ব টের পাবে না।’
এই পৃথিবীর পথেঘাটে যেমন করে নায়কেরা মার খায়। ভিলেনরা জিতে যায়। কিছু যায়-আসে না, সে রকম করেই সায়ন মরে গিয়েছিল। আর হত্যাকাণ্ডের বর্ণনাটা খেয়াল করুন—আগুনে পুড়িয়ে মারার মতো নির্মম কাণ্ডের কী নির্মোহ বর্ণনা। এমন বর্ণনা দিয়েই মন জিতেছেন তিনি। নইলে ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসের উদ্দাম-মাতাল তরুণ দলটিকে একটা আদিবাসী গ্রামে নির্বাসিত করার মতো আজগুবি ইতি টানার পরও কেন বইটি সবচেয়ে জনপ্রিয় কেউ ভেবেছেন?
‘সাতকাহন’ পড়ে অনেকের দীপা হতে মন চাইলেও আমার কাছে আগাগোড়া মনে হয়েছে, তিনি তীব্র নারীবিদ্বেষী, নইলে ভীষণ ক্ষোভ তার নারীদের ওপর। নইলে অমন সাড়ে চার শ পৃষ্ঠার বইয়ে এক দীপাকে জীবন নিয়ে এত খাবি খাওয়াবেন কেন? আমার সরল মনে এটাই মনে হয়েছে—এক প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক তার প্রেমিকার জীবনছক রচনা করেছেন রাগ আর ক্ষোভ দিয়ে। ভালোবাসার হাতছানি ছুটে যায়, আদর আর মায়া থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায় দীপা কেবল। তবু ‘সাতকাহন’ অনন্য, কারণ তার বর্ণনা আর চরিত্রের নির্মাণ। শমিত, অমলকুমার, বিশু, খোকন—প্রতিটি চরিত্র যেন আমার পাশের বাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এসেছে। পাঠককে এমন অনুভূতি দিতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়।
সমরেশই বাঙালি পাঠককে বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছিলেন জলপাইগুড়িতে স্বর্গছেঁড়া নামে একটা চা-বাগান আছে। ডুয়ার্সের জঙ্গলের অনবদ্য সৌন্দর্য খুঁজতে পরিব্রাজকেরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এই সমরেশের লেখার কল্যাণেই কিন্তু।
রাজনীতিক সমরেশকেই দেখুন না। নকশাল আন্দোলন, বাম আন্দোলন তো দিন শেষে ভারতে ব্যর্থই হয়েছে। কিন্তু উপন্যাসে তুলেছেন কজন। অনিমেষ, আকাশ, কল্যাণদের দল সবাই ব্যর্থ হয়ে একটা নির্বিবাদী জীবনে ডুব দিয়েছে। এই তো...
ক্লাস নাইনের উপন্যাসের সার্থকতা লিখো—এমন করে বললে সমরেশের সব কটা উপন্যাসই খারিজ হয়ে যাবে দিগ্গজদের ছুরি-কাঁচির তলে। তবে যেসব লেখক ১৯৮০-এর দশকের পরে পাঠকের মনে প্রেমের জোয়ার তুলেছিলেন, সেই তালিকায় কিন্তু সমরেশ শীর্ষে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই। তাই প্রেমিকা মানেই মাধবীলতা, মোহর, দীপা, পয়ার দাঁড়িয়েছে আমাদের চোখের সামনে।
মোহর-এর প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল এই উপন্যাস প্রকাশের সময়ের কাইজ্জা-ফ্যাসাদের কথা। পাঠক ধরেই নিলেন এ আমাদের ‘তসলিমা নাসরিন’। তবে সমরেশ একবারও মুখ খোলেননি। তসলিমা নিজে অনেক জায়গায় প্রতিবাদ লিখেছিলেন। তবে লেখক যেহেতু চুপ, সেই প্রতিবাদ আর ধোপে টেকেনি। তাই ‘দিন যায়’, ‘ভালো থেকো ভালোবাসা’, ‘আমাকে চাই’—এই ট্রিলজি মোহর নামে একটা কুসুম কুসুম প্রেমের ডকুমেন্টেশন হয়েই টিকে রইল।
এত এত লেখার পরে, পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে সিরিজ লেখক হিসেবে কিংবা জনপ্রিয় সব টিভি সিরিয়াল লেখার পরও আপনাদের জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ বলবে—সমরেশ, সুনীল, শীর্ষেন্দু তেমন জুতের কোনো লেখক নন, ওভাররেটেড। যাঁরা পাঠ করেন তাঁরা নির্বোধ, অশিক্ষিত। কিংবা যাঁরা সমালোচনা করবেন, তাঁদের ওপর অন্ধভক্ত পাঠক ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবেন, ‘আপনি একটু লেইখা দেখান দেখি।’
এই বিষয়টা মজার। সাহিত্য ও রাজনীতিই ‘দুইমাত্র’ ক্ষেত্র, যেখানে আমজনতা গালভরে গলাবাজি করতে পারেন। যেখানে ছাগলনাইয়ার রিকশাচালকও বলার অধিকার রাখেন ঋষি সুনাক সত্যিই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য কি না, সমরেশের উপন্যাস হয় না। এই যে খারিজ করা বা অতিবরণের চর্চার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো মানুষ এখনো পড়ে। বা যে প্রজন্মটা এতকাল পড়ে এসেছে, তারা টিকে আছে। কেউই হারায়নি।
তবে একটু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাওয়া সত্যিই জরুরি। আলাপ পরিষ্কার হওয়া উচিত যে কেন বাংলাদেশি সাহিত্যিকেরা ওপারে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। অথচ বানের স্রোতের মতো সুনীল-সমরেশরা এসেছেন এবং আসছেন। এর কারণ বোধ হয় একটাই, ভারতের প্রকাশনা সংস্থার বহুল প্রসার ও তার সর্বজনীন বিপণন। এমন নয় যে সেই মানের লেখক-ঔপন্যাসিক আমাদের নেই। আমাদের খারিজ করার সংস্কৃতিতে আমরা ক্রমাগত আমাদের লেখকদেরই বাতিলের তালিকায় ফেলেছি। আমাদের হরেদরে ৪০০-৫০০ প্রকাশনী হয়েছে বটে, কিন্তু বিপণনব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আপনি যদি মফস্সলের বাসিন্দা হয়ে থাকেন, তাহলে ভেবে বলুন তো আপনাদের দোকানে কি শহীদুল জহির, মাহমুদুল হক, রশীদ করিম, সেলিনা হোসেন কিংবা রিজিয়া রহমান পাওয়া যেত? অথচ সুনীল, সমরেশ পেতেন ঠিকই। ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ প্রকাশনীর আধুনিকতা বা বিপণনের চূড়ান্তে থেকে আমাদের কাছে সমরেশ মজুমদারকে বিক্রি করেছেন।
অথচ গত ১০ বছরের কথা ভেবে দেখুন তো বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গীয় এই লেখকদের জোয়ার দেখেছেন? এখন সময় অরুন্ধতী, গীতাঞ্জলি শ্রী, অরুণাভ সিনহাদের। সময় ও আধুনিকতাকে পুঁজি করে যে যেভাবে এগিয়ে যেতে পারছেন, যাচ্ছেন। রবিশংকর বলের পরে খুব মনে করে একজন পশ্চিমবঙ্গীয় লেখকের নাম বলতে পারবেন, যিনি বাংলাদেশে খুব সমাদৃত হয়েছে এই একবিংশ শতাব্দীতে। সবই বাণিজ্যের খেল। আর এই খেলায় সমরেশরা সব সময় জিতেছেন। উপন্যাস সার্থক হোক বা না হোক—বাংলাদেশি পাঠকদের মন থেকে অনিমেষ, মাধবীলতা, জয়িতা, কল্যাণ, সায়ন, মোহর, পয়ারকে মুছে ফেলা খুব কঠিন। যেমন মুছতে পারবেন না শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর যবন বণিককে। হুমায়ূন আহমেদের রূপা, হিমু, মিসির আলী, চিত্রা কিংবা অরুকে। পাঠকমন বড় বিচিত্র। এই খিটমিটে মানবজীবনে প্রেম, দুঃখ-বিরহ না থাকলে জমেই না।
তাই লেখক যতই অধম হন না কেন, পাঠক আমাকে উত্তম হলেই চলবে। সমরেশ মজুমদার বেঁচে থাকবেন অনিমেষ বা অর্ক হয়ে।