দেখা না–দেখার শহীদ মুনীর চৌধুরী
আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এদিনে ঘাতকেরা একে একে ধরে নিয়ে যায় দেশের সূর্যসন্তানদের। শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এই লেখায় আছে দেখা না–দেখা এক মুনীর চৌধুরীর অবয়ব।
তাঁকে আমি দেখেছি, কিন্তু তাঁকে আমার দেখা হয়নি। আমার কিশোর বয়সের একেবারে প্রারম্ভে, খুব সম্ভবত গত শতকের পঞ্চাশের দশকের একদম প্রান্তসীমায় আমি তাঁকে প্রথম দেখেছি। তারপর তাঁকে দেখেছি ষাটের দশকের একেবারে শেষ দিকে, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলাম। বৈবাহিক সূত্রে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতে পারত, তার ঠিক চার বছর আগেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে খুনি ঘাতকেরা তাঁর জীবন কেড়ে নেয়। আমার দেখা না–দেখার সে মানুষটি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
সম্ভবত ১৯৫৯–৬০ সালের কথা। আমার প্রয়াত শিক্ষক পিতা বরিশাল থেকে ঢাকায় এলেন পরীক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষার খাতা তুলতে। সঙ্গে নিয়ে এলেন তাঁর কিশোর পুত্রটিকে, প্রথমবারের মতো ঢাকা শহর দেখাবেন বলে। কত–কী সব দ্রষ্টব্য বস্তু যে তিনি দেখিয়েছিলেন, চিনিয়েছিলেন ও বুঝিয়েছিলেন, বাল্যকালের প্রখর স্মৃতির কারণে তা আজও মনে আছে। ঢাকা তাঁর যৌবনের শহর—সুতরাং এর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আমার পিতার আবেগ অন্তহীন।
এর মাঝে একদিন এক ভরদুপুরে তিনি আমাকে নিয়ে চললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে, যা কিনা তখন জগন্নাথ হলের আদি ভবনে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মনে আছে, একটি বড় দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর একটি বড় অতিথি হলঘর, যার নানান পাশে চেয়ার-বেঞ্চ ছড়ানো। ওই ঘরের শেষ মাথায় একটি লোহার টানাক্ষম দরজা। সব পরীক্ষককে ওটা পেরিয়ে নিজ নিজ বরাদ্দের খাতা নিয়ে আসতে হবে। ওখানে বহিরাগতের প্রবেশাধিকার নেই।
তাই আমার চিন্তিত পিতা যখন ভাবছেন, আমাকে কোথায় রেখে যাবেন, তখন সদর দরজা দিয়ে আরেকজন ভদ্রলোক ঢুকলেন। লম্বা মতন, এলোমেলো চুল, পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি আর পায়ে চটি। আগন্তুক ও আমার পিতা একে অপরকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন একে অন্যকে। বোঝা গেল তাঁরা পরস্পরের পূর্বপরিচিত এবং বন্ধুও বটে। আমার পিতা আমাকে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তিনি সস্নেহে আমার মাথার চুল নেড়ে দিলেন। জানলাম, আগন্তুকের নাম অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
অতএব আমার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমার পিতা ভেতরে চলে গেলেন আর অধ্যাপক চৌধুরী একটি চেয়ার টেনে নিয়ে আমাকে তাঁর বাঁ হাঁটুতে বসিয়ে বাঁ হাত দিয়ে আমাকে বেড়িয়ে ধরে রাখলেন। লক্ষ করলাম, তিনি একটু একটু করে পা নাচিয়ে আমাকে দোল দিচ্ছেন। আরও দেখলাম যে তাঁর ডান হাতে একটু উঁচু করে ধরা একটি বই, যেটি তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। বলতে দ্বিধা নেই যে সবকিছুর মধ্যে তাঁর ওই গ্রন্থপাঠই আমার বালকমনে সবচেয়ে বড় দাগ কেটেছিল।
পরে আমার পিতা আমাকে বলেছিলেন যে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং তিনি সতীর্থ ও সহপাঠী—যদিও ভিন্নতর বিষয়ে। একত্রে সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাসে নির্বাচন করেছেন। সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাসের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে মুনীর চৌধুরীর নেতৃত্বের দলটি প্রয়াত আমলা শফিউল আজমের দলটির কাছে সহসভাপতির পদসহ সব কয়েকটি আসন খুইয়েছিল, শুধু মিলনায়তন সম্পাদকের পদটি ছাড়া—এই পদে আমার পিতা প্রার্থী ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে তাঁরা দুজনেই চাকরির জন্য দক্ষিণবঙ্গে গিয়েছিলেন একই দিনে—মুনীর চৌধুরী খুলনার বি এল কলেজ, আর আমার পিতা বরিশালের বি এম কলেজে। একই স্টিমারে তাঁদের দেখা হয়েছিল বলেও শুনেছি।
পরবর্তী সময়ে আমি বেনুকে (আমার প্রয়াত স্ত্রী) প্রায়ই সগর্বে বলতাম যে তার প্রয়াত পিতৃব্যের কোলে আমি চড়েছিলাম আমার বালককালে। প্রথম বলার পরে সে তা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি এবং এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সে তার শ্বশ্রূপিতার দ্বারস্থ হয়েছিল। ঘটনার সত্যতা জানার পরে তার চোখে-মুখে কোনো পরাজয়ের ছাপ দেখিনি, বরং একটা গর্বের মায়াময় আভা দেখেছি বলে মনে পড়ে।
ষাটের দশকের প্রথম দিকে বেতারে প্রচারিত নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা নাটক ‘সারেং’ শুনেছিলাম মনে আছে। স্মৃতি যদি আমার সঙ্গে প্রতারণা না করে, তাহলে সারেং চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। অনেক স্মৃতি হাতড়েও বের করতে পারছি না ঢাকা বেতারের সে সময়কার শক্তিময়ী অভিনেত্রী লিলি চৌধুরী সে নাটকে অভিনয় করেছিলেন কি না।
ষাটের দশকের প্রথম দিকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে কতবার মুনীর চৌধুরীর নামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। খবরে দেখেছি, পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে তাঁর নাটক ‘দণ্ড ও দণ্ডধর’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। তাঁর নাটক ‘জমা, খরচ ও ইজা’ পড়েছি সাপ্তাহিক ‘পাকিস্তানী খবর’-এ। দুভাইই একই নাটকের অনুবাদ করেছেন—একজন ‘রানীসাহেবার হীরে’ নামে (প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী), অন্যজন ‘গুর্গন খাঁর হীরে’ নামে (শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী)। বলতে দ্বিধা নেই, ‘গুর্গন খাঁ’ নামটি মন কেড়েছিল। মন কেড়েছিল তাঁর অন্য দুটো অনূদিত নাটকের শিরোনামও—‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ ও ‘গাড়ির নাম বাসনাপুর’।
ষাটের দশকের প্রথম দিকে বেতারে প্রচারিত নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা নাটক ‘সারেং’ শুনেছিলাম মনে আছে। স্মৃতি যদি আমার সঙ্গে প্রতারণা না করে, তাহলে সারেং চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। অনেক স্মৃতি হাতড়েও বের করতে পারছি না ঢাকা বেতারের সে সময়কার শক্তিময়ী অভিনেত্রী লিলি চৌধুরী সে নাটকে অভিনয় করেছিলেন কি না।
ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম নাটক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ‘একতলা দোতলা’। দেখিনি, কিন্তু গল্প শুনেছি কতজনের কাছে। উচ্চমাধ্যমিকে আমাদের পাঠ্য ছিল তাঁর নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘কবর’ নাটক যে কতবার পড়েছি এবং কত জায়গায় যে এর অভিনয় দেখেছি।
১৯৬৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হয়ে ঢোকার পরে আবার মুনীর চৌধুরীকে কতভাবে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বাংলা বিভাগের সামনের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একটু ঝুঁকে। তাঁর পিঠে একটা ব্যথা ছিল বলে পরে শুনেছি। কখনো দেখেছি ফুলার রোডের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তিনি ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান কথা বলছেন। কখনো দেখেছি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, পাশে লিলি চৌধুরী বসা।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঘাতকেরা তাঁকে তুলে নিয়ে গেল তাঁর পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়া’ থেকে। আর তিনি ফেরেননি। আমরা হয়তো মুনীর চৌধুরীকে সব সময়ে চিনতে পারিনি, কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারেরা তাঁকে চিনতে ভুল করেনি। একইভাবে তারা ঠিকই চিনেছিল আমাদের অন্য বুদ্ধিজীবীদের, যাঁদের নিশ্চিহ্ন করে তারা বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছিল। মনে আছে, বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে এই হারানোর অশ্রু মিশে গিয়েছিল।
একাত্তর–পরবর্তী সময়ে তিনটি লেখার মাধ্যমে শহীদ মুনীর চৌধুরীকে কিছুটা দেখা হয়ে উঠেছিল—একটি তাঁর অগ্রজ কবীর চৌধুরীর ‘স্মৃতি-তর্পণ’, দ্বিতীয়টি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লেখা ‘মুনীর চৌধুরী’ এবং তৃতীয়টি প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের একটি খোলা চিঠি—অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে উদ্দেশ করে লেখা।
১৯৭৫ সালে যখন ‘দারুল আফিয়ার’ বৃহত্তর পরিবারের সদস্য হলাম, তখন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে কত স্মৃতিমূলক ঘটনা শুনেছি তাঁর মা, ভাই, বোনদের লেখা ও কথায়। পারিবারিক আলাপ-আলোচনায় অভ্রান্তভাবে উঠে এসেছেন তিনি—তাঁর মেধা ও ব্যক্তিত্বের কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি উচ্চারিত হয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ মমতার কথা, অন্যকে সাহায্য করার জন্য তাঁর কর্মকাণ্ডের কথা। আর যখনই সবার মনে হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের কথা, তখনই একটা শীতল নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে চারদিকে, ঘন হয়ে এসেছে চারদিক।
শেষ যেবার মিশুকের (মিশুক মুনির, মুনির চৌধুরীর ছেলে) সঙ্গে দেখা হয়, তখন মিশু বলেছিল, ‘আমার মনে হয়, আব্বার সঙ্গে আপনার দেখা হলে আপনাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগত।’ কে জানে, প্রয়াত এই প্রিয় মানুষটির কথাই ঠিক কি না। কিন্তু একটা বিষয় জানি, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে যাঁরা দেখেছেন এবং তাঁর সঙ্গে যাঁদের দেখা হয়েছে, তাঁরা পরম ভাগ্যবান।
তবে এটাও তো মানি, আমার মতো যাঁরা তাঁকে দেখেছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, ভাগ্যের ভান্ডার তাঁদেরও কম পূর্ণ নয়। কারণ, কত মানুষ তাঁকে দেখেননি, দেখবেন না, তাঁর সঙ্গে দেখাও হবে না তাঁদের। আমার সৌভাগ্য যে আমি তাঁকে দেখেছি ও তাঁর কথা শুনেছি, আমার সেই সৌভাগ্য নিয়ে আজ শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করি, তাঁর কাছে নমিত হই।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]