মাথাটা ধরে ছিল। নানান কাজের ফাঁকেও ছবিটা মাথা থেকে সরছিল না। কারওরই সরে না। আমার মতো সবাই-ই চেষ্টা করে রাগ, অসহায়ত্ব ভুলে থাকার। লোক দুজন বয়স্ক। সাদা দাড়ি, কোচকানো জামা। মুখে কমদামি মাস্ক। একজন দুর্বল হাতে নুুন ছিটাচ্ছেন ভাতের থালায়, অন্যজন টেবিলে দুহাত জোড় বেধে বসে। সাদা ভাতের প্লেটে তখনো এক টুকরো লেবু ছাড়া কিছু নেই। কুষ্টিয়ার এক উপজেলা থেকে পাবনায় এসেছিলেন কাজের খোঁজে। এখন বাড়ি ফেরার টাকা নেই, ভাত খাওয়ার টাকা নেই। দুদিন ধরে সাহায্য চেয়ে চেয়ে ঘুরছেন। অবশেষে একজন এনে বসিয়েছে তাদের এই ভাতের হোটেলে। আহারে ভাত!
আহারে ভাত! শব্দ দুটো মাথা থেকে যেতে চায় না। তবু রুটিন কাজ ঠিকঠাক চলে। ভাত গলা দিয়ে নামানো হয়। গলিতে গাড়ির আনাগোনা বেড়েছে। আগে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। এখান দাঁড়িয়ে থাকে চারটি। নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের শ্রমিকরা সবাই চলে এসেছে। দিনে প্রচণ্ড শব্দে হাতুড়ি দিয়ে কাজ করে তারা। রাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমায়। নীল মশারি। হাড়িপাতিল, দড়িতে ঝুলানো একটা মলিন শার্ট, ছেঁড়া প্যান্ট, গামছা বাতাসে দোলে। 'মাথার ভেতর কোন এক বোধ খেলা করে!' অনেক দিন পর বন্ধুর ফোন, জানায়, তার বাবা আর বেঁচে নেই।
অনেকেই বেঁচে নেই। দেশের চিকিৎসায় অবদান রাখতে বিদেশে সুযোগ থাকার পরও ফিরে এসেছিলেন যে চিকিৎসকেরা, কয়েকদিন ধরে তাঁদের মৃত্যুর সংবাদ পাই। আর কেউ কেউ মৃত্যু এড়াতে দেশ ফেলে দৌড়ে যাচ্ছেন। এখানে মরতেও এসব 'বিশ্বনাগরিক'দের অরুচি। থেমে নেই কিছুই। থেমে নেই জুনের বাজেট। সিগারেটের দাম বেড়েছে বলে কেউ কেউ বিরক্ত। তার মাঝখানে 'কী করছেন? একটা গল্প পড়ুন, দেখুন কী দারুণ লেখে!' বলে একজন একটা গল্প পড়তে বললেন। পড়লাম। সামাজিক মাধ্যমে। টানটান উত্তেজনার গল্প। আশ্চর্য, এমন চেনা চেনা লাগছে কেন! কোথায় পেয়েছি এই চরিত্রদের? এই বিশ্লেষণ? এত চেনা! একটু একটু মনে পড়ে যায়, আরে আশ্চর্য, মিসির আলীর গল্প মেরে দিয়েছে? হাজার হাজার লোক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলছে, চমৎকার! ব্যাটা প্রতিভা বটে।
বিকেলও সেই দুজনের ভাতের প্লেটের ছবি মাথা থেকে যায়নি। সকালেই পড়েছিলাম চীনে এক ক্ষুদ্র ভাস্কর্য আবিষ্কারের কথা। অনেক পুরনো শিল্পকর্ম—সাড়ে তেরো হাজার বছর আগের। সমকালের ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যগুলোর থেকে এর ধরণ নাকি একটু আলাদা। ভাস্কর এটি গড়েছিলেন কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর হাড় পুড়িয়ে। চারটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল: খোদাই, কর্তন, চাছা, ঘর্ষণ। ভাস্কররা বলতে পারবেন সঠিক শব্দগুলো। চীনের ওই প্রাচীন ভাস্করের ভারসাম্যের অসাধারণ জ্ঞান ছিল। ছোট্ট পাখিমূর্তির লেজটাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু ভারী করেছিলেন, যাতে সেটাকে ঠিকঠাক বসিয়ে রাখা যায়। হয়তো এমন করেই খুব কষ্টের একটা দিন কাটানোর পর, খাবার যোগানোর পর সেই মানুষটি পাখিটা বানিয়েছিলেন।
>আহারে ভাত! শব্দ দুটো মাথা থেকে যেতে চায় না। তবু রুটিন কাজ ঠিকঠাক চলে। ভাত গলা দিয়ে নামানো হয়। গলিতে গাড়ির আনাগোনা বেড়েছে। আগে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। এখান দাঁড়িয়ে থাকে চারটি। নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের শ্রমিকরা সবাই চলে এসেছে। দিনে প্রচণ্ড শব্দে হাতুড়ি দিয়ে কাজ করে তারা। রাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমায়। নীল মশারি। হাড়িপাতিল, দড়িতে ঝুলানো একটা মলিন শার্ট, ছেঁড়া প্যান্ট, গামছা বাতাসে দোলে। 'মাথার ভেতর কোন এক বোধ খেলা করে!' অনেক দিন পর বন্ধুর ফোন, জানায়, তার বাবা আর বেঁচে নেই।
যে সময়ে জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটানোই এত কঠিন, উপকরণ অপ্রতুল, তখন কেন তিনি গড়েছিলেন ওই ছোট্ট পাখির অবয়ব? মাঝেমধ্যে ভাবি, অন্যরাও বলে, কী দরকার শিল্পের? যেখানে খাবার জুটছে না, মানুষ মরছে। সে উত্তরের তত্ত্ব অনেক থাকলেও ঠিক উত্তরটা জানা নেই। কিন্তু এই স্থবির সময়ে ভাবছিলাম, গুহাবাসী মানুষ কেন এঁকেছিল ছবি দেয়ালে? কেন হাজার হাজার বছর আগে ছোট্ট একটা ফেলনা হাড় পুড়িয়ে শিল্পীকে বানাতে হয়েছিল ভাস্কর্য? কিংবা জলের পাড়ে ফুটে থাকা ফুলকে নিয়ে বানাতে হয়েছিল নার্সিসাসের উৎসুক কাহিনি? কেন চাঁদের বুড়ি নেই জেনেও আজও চরকা কাটার গল্প বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকে মানুষের অবিরত সৃষ্টি। কে দেবে এসব প্রয়োজনের হিসাব?
আজকাল চারপাশে প্রচুর মানুষ থাকা সত্ত্বেও, বহুতল ভবনের বহুর মধ্যে এক হয়েও নিজেদেরকে মনে হয় কীটসের রুথ অথবা জীবনান্দের বেহুলা। চারপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত কিংবা ক্ষুব্ধ জলরাশির মতোই শূন্যতা। নবজাতকেরা যে পৃথিবীতে আসছে, আমরা আসিনি তেমন পৃথিবীতে। সারি সারি জানালাগুলোর দিকে চেয়ে ভাবছিলাম। আমার কন্যা, যে রবীন্দ্রনাথের মিনির মতোই একদণ্ড চুপ থাকতে পারে না এবং প্রায়ই 'আমার আব্বু তোমার কে হয়?' বলে বিপদে ফেলে দেয়, এসে বলল, 'দ্যাখো, দ্যাখো, কী সুন্দর মেঘ! ছবি তোলো! ছবি তোলো!'
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]