বিচিত্র
কিয়েভ টয়লেট হিস্ট্রি মিউজিয়াম
এই লেখায় রয়েছে একটি জাদুঘর দেখার অভিজ্ঞতা। সংক্ষিপ্ত পরিসরে আছে পৃথিবীর শৌচাগারের ইতিহাসও। প্রবেশ করুন এক বিচিত্র ভুবনে।
আমাদের কিয়েভ যাত্রার উদ্দেশ্য হলদোমোর গণহত্যা জাদুঘর দেখা। জাদুঘর পরিদর্শন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নানাবিধ আলোচনায় কেটে গেল কিয়েভের প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন সকালে আমার ভ্রমণসঙ্গী ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আমাকে নিয়ে গেলেন চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার স্মৃতিতে গড়ে ওঠা ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল চেরনোবিল মিউজিয়াম দেখাতে। অধ্যাপক মামুনের সঙ্গে যখনই কোনো শহরে গিয়েছি, আমরা ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছি সম্ভাব্য সব জাদুঘর, ফ্লি মার্কেট কিংবা আর্ট গ্যালারি। চেরনোবিল জাদুঘর দেখার পর মামুন বললেন, চলো তোমাকে এবার নতুন একটি জাদুঘর দেখাতে নিয়ে যাব। ফলে সেই ‘নতুন জাদুঘর’ দেখার উদ্দেশে উবার বুক করলাম আমরা। গন্তব্য: কিয়েভ টয়লেট হিস্ট্রি মিউজিয়াম।
জাদুঘরের বিষয় হিসেবে ‘শৌচাগার’ বেশ বৈচিত্র্যময়, সন্দেহ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের দিল্লিতে রয়েছে শৌচাগার জাদুঘর। আর কিয়েভের জাদুঘরটির বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিশ্বের প্রথম টয়লেট হিস্ট্রি মিউজিয়াম। আবার এটি ইউক্রেন সরকারের নথিভুক্ত সবচেয়ে বড় জাদুঘরও বটে। পাশাপাশি ২০১৬ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এটিকে ‘The largest collection of souvenir toilet-related items in the world’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্মারকের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে এই জাদুঘরের ইতিহাস।
জাদুঘরের স্মারক সংগ্রহে এই জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ঘুরে বেড়িয়েছে বিশ্বের নানা দেশে, সংগ্রহ করেছে দুঃষ্প্রাপ্য সব স্মারক। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই জাদুঘরে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শৌচাগার বা শৌচাগার–সম্পর্কিত স্মৃতি স্মারকের সংগ্রহ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঐতিহাসিক চেম্বার পট, স্কোয়াটিং প্যান ও ইউরিনাল। ২০১৩ সালে এই জাদুঘরের উদ্যোগে এর প্রতিষ্ঠাতা মেরিনা বোগদানেনকো ৫১২ পাতার একটি বই প্রকাশ করেন। History of Hygiene and toilety শিরোনামের এই বই বিশ্বের প্রথম শৌচাগারের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বই বলে জানা যায়।
জাদুঘরটি পরিদর্শনের মাধ্যমে আগত দর্শনার্থীরা পৃথিবীর শৌচকার্যের ইতিহাস জানতে পারছেন। জানতে পারছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা কীভাবে তাঁদের প্রাকৃতিক কাজ সারতেন, তাঁরা কোথায় প্রার্থনা করতেন। পৃথিবীতে প্রথম শৌচাগার কে তৈরি করেছিল? কেনই–বা প্রাচীন রোমে বিশ্বের প্রথম গণশৌচাগারগুলো এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। টয়লেট হিস্ট্রি মিউজিয়ামের স্মারকগুলো সঙ্গে দর্শনার্থীদের নিয়ে গেছে সেই রেনেসাঁর সময়ে, মধ্যযুগের ওয়ার্ডরোব টয়লেটের ইতিহাসে কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট শৌচাগারের সঙ্গেও এই জাদুঘর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে দর্শকদের।
পাশাপাশি জাদুঘরটি শৌচাগারসংক্রান্ত নানা মজাদার ইতিহাস, তথ্য, রীতিনীতি সংরক্ষণ করেছে। মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে সভ্য হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মানায় নিজেদের উন্নত করেছে, এ জাদুঘর সেটি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ২ হাজার ৫০০ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতায় প্রথম শৌচাগারের ব্যবহার দেখা যায়। নির্মিত হয়েছিল সুয়ারেজ লাইনও।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শৌচাগার ব্যবহারের বাস্তব সত্যটি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে জাদুঘরটি নির্মিত। সভ্যতার এত ক্রমবিকাশের পরও মানুষ পরিবেশ রক্ষায় সচেতন নয়। ফলে মানুষকে সচেতন করতে গড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জাদুঘর। ২০০১ সালে সিঙ্গাপুরে গড়ে উঠেছে ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজেশন, যার লক্ষ্য স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করা, গবেষণা করা ও নান্দনিকতার সঙ্গে এর সম্পর্ক গড়ে তোলা। বিষয়টার সংযোগ করা, এ ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, অনুন্নত দেশগুলোতে স্যানিটেশন সেবা বৃদ্ধিতে সহায়তা, লোকজনকে সচেতন করা।
জাদুঘরটি পরিদর্শনের মাধ্যমে আগত দর্শনার্থীরা পৃথিবীর শৌচকার্যের ইতিহাস জানতে পারছেন। জানতে পারছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা কীভাবে তাঁদের প্রাকৃতিক কাজ সারতেন, তাঁরা কোথায় প্রার্থনা করতেন। পৃথিবীতে প্রথম শৌচাগার কে তৈরি করেছিল? কেনই–বা প্রাচীন রোমে বিশ্বের প্রথম গণশৌচাগারগুলো এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
পৃথিবীতে এখনো ৮৯ দশমিক ২ কোটি মানুষ খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করেন বা করতে বাধ্য হন। মুক্ত প্রকৃতিতে মলত্যাগ কেবল দৃশ্যদূষণ, বায়ুদূষণ বা দুর্গন্ধ উৎপাদন করে না; পারিপার্শ্বিক অনেকটা পরিধিজুড়ে মাটি ও জলদূষণও ঘটায়। তাই জাতিসংঘের এসডিজি-৬ বা টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষের জন্য নিরাপদ শৌচাগার ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা। প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর এই টয়লেট মিউজিয়াম ও ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে পালিত হয় বিশ্ব টয়লেট দিবস।
এতক্ষণ কিছু কিছু তথ্য তো দেওয়া গেল। এবার আবার ফিরি জাদুঘর প্রসঙ্গে। জাদুঘরটিতে মূলত দুই ধরনের প্রদর্শনী স্মারক স্থান পেয়েছে। প্রথমেই রয়েছে স্মারক টয়লেট, বেডপ্যান ও প্রসাধনী, দ্বিতীয় স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে অরিজিনাল টয়লেট, টয়লেটের নকশা, টয়লেট ব্যবহৃত শিল্পকর্ম, টয়লেট সম্পর্কিত নানা তথ্য ইত্যাদি। আর এসব স্মারকের মধ্য দিয়ে প্রাচীনকাল থেকে মানবজাতির বর্তমানের সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস জানা যাবে।
প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আজ অবধি শৌচাগার, শৌচাগার–সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় যেমন ডেসিংরুম, শৌচাগার পরিষ্কারের জন্য পরিধান করা পোশাকসহ নানাবিধ বিষয় সুবিন্যস্তভাবে সাজানো হয়েছে এখানে। স্মারকের প্রদর্শনীগুলো পর্যায়ক্রমে আদিম সমাজ, প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ, রেনেসাঁর সময়, সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী, আধুনিক সময়, আর্ট ওয়াটার ক্লজেটে বিভক্ত করে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের প্রথম শৌচাগারের প্রতিরূপ রয়েছে এই জাদুঘরে। রয়েছে দুই হাজার বছর আগে চীনে কীভাবে টয়লেট পেপার আবিষ্কৃত হয়, তার বিবরণও। তা ছাড়া এখানকার একটি প্রদর্শনীতে মধ্যযুগের দুর্গ নগরীগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলে ধরা হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে কেন এগুলোকে ওয়ার্ডরোব বলা হতো। খ্যাতিমান চিত্রকর লেওনার্দো দা ভিঞ্চির করা প্রথম ফ্লাশ টয়লেটের মডেল এখানে রয়েছে।
পৃথক একটি রুমে নানা ভাষায় শৌচাগারের ইতিহাস নিয়ে করা হয়েছে ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনী। প্রায় ৫৮০টি দুর্লভ শৌচাগারের স্মারক রয়েছে এই জাদুঘরে।
আগেই বলেছি, পৃথিবীতে শৌচাগারের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। ২৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহেঞ্জোদারোতে প্রথম শৌচাগার থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে শুধু অভিজাত শ্রেণিই এটি ব্যবহার করত। নিচের শ্রেণির লোকেরা একটি পট মাটিতে গেড়ে তার ওপর ছোট কমোডের মতো লাগিয়ে ব্যবহার করত। প্রায় ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পানি ফ্ল্যাশসহ শৌচাগার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায় স্কটল্যান্ডে। মিলোয়ান ক্রিট, ফারাওয়ের মিসর এবং প্রাচীন পারস্যে ব্যবহৃত শৌচাগারের ইতিহাসের দেখাও পাওয়া যায় এখানে।
প্রাচীন রোমান সভ্যতায় ব্যবহৃত চ্যাম্বারপটের রেপ্লিকা রয়েছে এ জাদুঘরে। এই চ্যাম্বার পটগুলো রোম ও পম্পেই নগরীর রাস্তায় বড় বড় গর্ত করে রাখা হতো। শৌচাগারের বিবর্তনের ইতিহাসে জাদুঘরটিতে এরপর তুলে ধরা হয়েছে গার্ডেরোব জাতীয় শৌচাগারের নমুনা। ১৫৯৬ সালে এর হেরিংটন নির্মিত আধুনিক ফ্লাশ শৌচাগার ও তার নির্মাণের ইতিহাস বিস্তৃতভাবে ধরা আছে এখানে।
পৃথিবীতে বহু অদ্ভুত জাদুঘরে যাওয়া হয়েছে, দেখা হয়েছে নানা দেশের শিল্প-সংস্কৃতির নানা সংগ্রহ। কিন্তু কিয়েভের এই বিচিত্র জাদুঘর তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য খুব সহজেই দর্শকদের আকর্ষিত করে। একই সঙ্গে এই জাদুঘর মানুষকে হাইজিন মানতে, নিরাপদ শৌচাগার ব্যবহারে উৎসাহিত করে।