একজন আনিসুজ্জামান!
‘আমি কোথায় পাব তারে!’
আমার বাবা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর তো বটেই, জীবদ্দশাতেই আমার তাঁকে ঘিরে সব সময় এই প্রশ্নটা মনে হতো বারবার। বাবা আনিসুজ্জামানকে আমি এবং আমার বোনেরা সারা জীবন খুঁজেই বেড়িয়েছি, কিন্তু তাঁকে আমাদের করে আমরা কখনোই পাইনি; পেয়েছি অনেক মানুষের ভিড়ে—কখনো মঞ্চে, কখনো আন্দোলনে। তাঁকে জেনেছি তাঁর লেখা পড়ে অথবা অন্যের সম্ভাষণে।
তাই আব্বা সম্পর্কে লিখতে বসে একধরনের অস্বস্তি কাজ করছে। সবার উৎসাহে যখন লিখতে বসেছি, হাত যে খুব সহজে চলছে তা নয়! বন্ধুদের বললাম, বাবা-ছেলের তেমন গল্প তো নেই যে লিখব। তারা বলল, এটাই তো একটা গল্প! আমি সেই গল্প লিখতে বসেছি। এই লেখার শিরোনাম দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ আছে—ছেলে লিখছে বাবা সম্পর্কে? অনেক চিন্তা করে দেখেছি, মনের সঙ্গে কথা বলেছি, আমার কাছে তাঁর বাবা সত্তার চেয়ে ড. আনিসুজ্জামান সত্তাই বেশি বড়।
নিঃসন্দেহে আমাদের সম্পর্কের একটা বোঝাপড়া ছিল। তবে গতানুগতিক পিতা-পুত্র সম্পর্কের যে একটা আলাদা রসায়ন বা মাত্রা থাকে, সেটা কখনো পরিপূর্ণভাবে আস্বাদন করতে পারিনি; কেননা আব্বা সব সময় ছিলেন সবার। আমরাও তাই কখনো তাঁকে নিজের বা একার করে ভাবতে পারিনি বা পাইনি। যেটুকু আলাপচারিতা, তা–ও ছিল দেশ নিয়ে, সমকালীন রাজনীতি নিয়ে। সে কথায় পরে আসছি।
সবচেয়ে বড় কথা আব্বার দায়িত্ববোধ ছিল খুব প্রখর, বিশেষ করে বাইরের জগতের ব্যাপারে। ভালোবাসতেন মানুষের হয়ে, দেশের হয়ে কাজ করতে; তাঁর ভাবনার জগৎজুড়ে কেবলই ছিল গবেষণা, জ্ঞানচর্চা, দেশপ্রেম, মানবকল্যাণ আর মানুষের সাহচর্য, সংস্পর্শ এবং নিবিড় ভালোবাসা। এর বাইরে খুব কম জিনিস নিয়েই তিনি সময় ব্যয় করতেন।
আমার মা–ও আমাদের ছোটবেলা থেকে বুঝিয়েছিলেন আমার বাবার চিন্তার গণ্ডি কতটা বড়, দেশ আর তাঁর আদর্শের প্রতি তিনি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই আমরাও সে পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াইনি। ফলে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদার বিষয়গুলো মায়ের আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাবার সঙ্গে খুব কমই আমাদের দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো আলোচিত হতো। আব্বা অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে আম্মা সংসারের সব দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে আরও বেশি কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আর আমরাও তাঁকে বেশি বিরক্ত করিনি।
আমরা তিন ভাইবোন সব সময়ই মনে করেছি, আব্বা খুব আলাদা করে আমাদের নিয়ে ভাবেন না। কখনো দুঃখ করে, কখনো মজা করে বলেছি—আমরা বোধ হয় আব্বাকে সবচেয়ে কম চিনি, কম জানি আর কম সময় কাছে পেয়েছি। আসলে সমষ্টির চিন্তাই তাঁকে সব সময় ছেয়ে রেখেছিল। তাঁর কাছে নিজের পরিবার ছিল বাংলাদেশের অন্য যেকোনো একটি পরিবারের মতো। এতে আমাদের মধ্যে একটা দুঃখবোধ কাজ করত, পরবর্তী সময়ে হতো গৌরববোধ—একটা মানুষ কীভাবে এত বড় পরিসরে চিন্তা করতে পারেন, যেখানে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো গৌণ, পরিবারের চাওয়াগুলো ক্ষুদ্র? আব্বার কারণে আমরা কোথাও কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই, সেটাও তিনি কখনোই চাইতেন না। এই লেখা প্রকাশের মাধ্যমে হয়তো তাঁর সেই নীতির প্রতি একটা ব্যত্যয় ঘটল।
আশির দশকে আমরা যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, আম্মারা তখন বাচ্চাদের একটা স্কুল চালাতেন। একটা সময় আর্থিক কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হলেন। আম্মা ঘুরে ঘুরে সব প্রশাসনিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে বোঝালেন, স্কুলের জন্য কেন অর্থ প্রয়োজন। যথাসময়ে যখন প্রশাসনিক ব্যক্তিরা সভায় বসলেন এবং স্কুলের অর্থ বরাদ্দ প্রায় চূড়ান্ত, তখন যিনি বাদ সাধলেন, তিনি হলেন আব্বা! বললেন, এভাবে কোনো সুষ্ঠু ও যথাযথ কারণ না দেখিয়ে বরাদ্দ দিলে এটা একটা খারাপ উদাহরণ তৈরি করবে এবং পরবর্তী সময়ে অনেকেই এভাবে প্রশাসনের অর্থ চাইতে পারে। অনেক পরে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, যথাযথ কারণ দেখিয়ে সেই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে প্রথম সভা শেষে আম্মাকে সবাই বলেছিলেন, আমরা তো সবাই বরাদ্দ করেই দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে তো দেখলাম ঘরের শত্রু বিভীষণ!
শুধু আম্মা বা আমাদের না, নিজের জন্যও কখনো কিছু চাননি তিনি। তারপরও তাঁর সৌভাগ্য, পেয়েছেন অনেক। ‘এ দেশে জীবদ্দশায় গুণীর কদর হয় না’—এই কথাটা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সবচেয়ে বেশি যা পেয়েছেন, তা হলো মানুষের ভালোবাসা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আব্বা যখন, ১৯৮৫ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন, তখন আমাদের বাসার সামনে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের মিলিত প্রতিবাদ ও অভূতপূর্ব অবস্থান ধর্মঘট হয়েছিল। পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সম্মান, সঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক প্রাপ্তিও। সেসবের আনন্দও তিনি ভাগ করে নিয়েছিলেন সবার সঙ্গে। বলতেন, এত মানুষের খুশি দেখে তাঁর প্রাপ্তির আনন্দ আরও বেড়ে গেছে।
আমার সব সময় মনে হয়েছে আব্বার দর্শনটি ছিল একেবারে ভিন্ন। তাঁর বিশ্বাস ছিল সমষ্টিতে, ব্যক্তির বিষয়গুলো তাঁর কাছে ছিল গৌণ। ভাবতেন বহুত্ব নিয়ে, আকৃষ্ট হতেন বিশালত্বে।
বাহাত্তরে আব্বা যখন এ দেশের সংবিধান রচনার সঙ্গে জড়িত হন, তখন আমি মায়ের গর্ভে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি। সংবিধানকে তাই আমি বলি আমার যমজ সহোদর—আমাদের জন্ম নয় সপ্তাহের ব্যবধানে! সে সময় চট্টগ্রাম থেকে, বেশ কয়েকবারই আব্বাকে পুরো পরিবার নিয়ে, নিজেকে গাড়ি চালিয়ে, ঢাকাতে আসতে হয়েছিল। তখন আমার দুই বোনের বয়স ছিল আট আর আড়াই। পার হতে হতো তিন-চারটা ফেরি। কোনো কিছুই তাঁকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি।
আগেই বলেছি, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে ছিলেন আব্বা। আমার ধারণা, যাঁরা নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া–পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাঁদের সংকীর্ণ মনের অধিকারী বলে ভাবতেন। যে মানুষটাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি কখনো কখনো ‘মুরব্বি’ ডাকতেন, সেই মানুষটার ঢাকা শহরে বা পৃথিবীর কোথাও কোনো বাড়ি নেই—এটা ভাবা যায়? শেষ জীবনে এসে আমার পীড়াপীড়িতে আব্বা একটি সরকারি জমির জন্য আবেদন করতে বাধ্য হন। আমি নিশ্চিত আমার সংকীর্ণতায়, রাজউকের আবাসনের এক খণ্ড জমি নিজের নামে লিখে নেওয়ায় তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন।
আব্বার ব্যাপারে ভাবলে যে কথা প্রথমে মনে হয়, তিনি প্রকৃত মানুষ ছিলেন। মানুষে মানুষে পার্থক্য করে এমন কিছুই তাঁর পছন্দ ছিল না। তাই অর্থবিত্তের ব্যাপারে ছিলেন নিরাসক্ত, ধর্মীয় আচারের ব্যাপারেও ছিলেন নিরুৎসাহী। তবে তাঁর কথায়-কর্মে ধর্মের মূল নির্যাসের অনুসরণ দেখেছি, যা অনেক ধর্ম পালনকারীর মধ্যেও অনুপস্থিত। আমরা অনেকেই দাবি করি শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ-বয়সনির্বিশেষে আমরা সবাইকে গ্রহণ করি; অনেকে চেষ্টাও করি কিন্তু এর সত্যিকারের অনুশীলন আমি আব্বার মধ্যে দেখেছি।
দেখেছি, বাইরে থেকে বাসায় এসে ক্রিকেট খেলার আপডেট নিতেন। বাংলাদেশ যদি জিতে যেত, তাহলে প্রথমেই তাঁর গাড়িচালক ও গানম্যানকে ফোন করতেন। বুঝতাম, যেহেতু আসার পথে গাড়িতে তাঁদের সঙ্গে খেলা শুনতে শুনতে আসতেন, তাই খেলা শেষে প্রথমেই তাঁদের সঙ্গে জয়ের আনন্দটা ভাগাভাগি করে নিতে চাইতেন।
আব্বাকে জানার আমাদের বেশি সুযোগ হয় ২০১৪ সালে, ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মভূষণ পাওয়ার পর বিভিন্ন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন মানুষের বক্তৃতা শুনে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মুখে শুনেছি, ২০১১ সালে আমার ছোট দুলাভাই মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন সান্ত্বনা দিতে। তার পরপরই ২৫ বছরের বেশি সময় আগে ফেলে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রহরী আব্বাকে ফোন করে সান্ত্বনা দেন। তিনি তখন বলেন, স্যারের বিচরণ সমাজের সব পর্যায়ে; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ থেকে তৃণমূলে।
ডা. সারোয়ার আলী বলেছিলেন, ষাটের দশকের শেষের দিকে একদিন আমাদের বাসায় এসে দেখলেন ড্রয়িং রুমে এক অতি সাধারণ মানুষ বসা। আব্বা তাঁর সঙ্গে সারোয়ার আলী চাচার পরিচয় করিয়ে দিলেন এই বলে যে আমরা দুজন একসঙ্গে ভাষা আন্দোলন করেছি। আমি তখন ছাত্র ছিলাম আর উনি রিকশাচালক সমিতির সভাপতি। আজ এত বছর পর, আমাদের দুজনেরই পদোন্নতি হয়েছে, আমি হয়েছি শিক্ষক আর উনি বেবিট্যাক্সি চালক সমিতির সভাপতি। মানুষ যতই সাধারণ হোক, আব্বা পেছনের কোনো মানুষকেই, জীবনে চলার পথে ফেলে আসেননি!
মানুষকে আসলে আব্বা মনের ভেতর থেকে ভালোবাসতেন, মানুষজনকেও দেখেছি সেভাবেই প্রতিদান দিতে। একবার বাংলা একাডেমির বইমেলায় দেখেছি কোলের শিশুকে নামিয়ে এক প্রাক্তন ছাত্রী হুমড়ি খেয়ে পড়ে আব্বার পায়ে সালাম করল। অবাক হয়ে তাকিয়ে বাচ্চাটা পরে জিজ্ঞেস করল, মা, উনি কি তোমার শিক্ষক? মা উত্তর দিলেন, উনি আমার শিক্ষকদের শিক্ষক!
একবার আমার এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক এক শিক্ষকের সঙ্গে আমার তর্ক বেধে গেল! সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সঙ্গে বেশির ভাগ শিক্ষকের ব্যবহার পুরোপুরি সৌজন্যমূলক ছিল না। আমার এই মন্তব্যে তিনি আহত হয়ে বললেন, তোমার তা কেন মনে হলো? আমি বললাম, কারণ আমার বাবা একজন শিক্ষক এবং আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তিনি কী আচরণ করেন। আমার কাছে এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সম্পূর্ণ অপরিচিত। এরপরে আর খুব বেশি কিছু বলতে হয়নি।
অনেক সময় কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর আচরণও দেখেছি আড়ষ্ট। হয়তো আব্বাসহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ বসে আছেন এবং নানা মানুষ তাঁদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলছেন। দূর থেকেও খেয়াল করতাম, এই সাধারণ মানুষগুলোর সঙ্গে, সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন আব্বা এবং সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে কথা বলছেন। অনুষ্ঠান শেষে আমি হয়তো আব্বার কাছে গেছি, এমনকি আমাকে চেনার পরও অন্যরা সেই আগের মতোই ভাবলেশহীন, নির্বিকার। তখনই মনে হতো আব্বাকে মানুষ কেন এত বেশি শ্রদ্ধা করে, আলাদা করে একটা স্থান দেয়।
একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বাসার বারান্দায় আব্বা দাঁড়িয়েছিলেন। রাস্তায় দেখলেন একজন অপরিচিত লোক একে-ওকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করছেন। আব্বা ওপর থেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কিছু খুঁজছেন? তিনি কোনো একজন শিক্ষকের বাসার কথা বললে আব্বা বললেন, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি খুঁজে দিচ্ছি। ঘরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরিতে সেই শিক্ষকের ফোন নম্বর বের করে, তাঁকে ফোন করে, তাঁর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে সেই অপরিচিত লোককে জানালেন।
আরেকবার এক মজার ঘটনা ঘটল। আব্বার কোনো এক বক্তৃতা একজন টাইপিস্টকে দিয়েছিলেন টাইপ করে দেওয়ার জন্য। একটা বানান নিয়ে তাঁর খটকা লাগলে তিনি আব্বাকে ফোন করেন। ফোন শেষে আব্বা আমাকে ডেকে দুটি অভিধান ও একটি বই হাতে দিয়ে বললেন, এগুলো নিয়ে ওকে একটু দেখিয়ে আসো। আমি বললাম, ফোনে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে হয় না? আব্বা বললেন, আমি বুঝিয়ে দিয়েছি, কিন্তু তার মনে যেহেতু একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে সুতরাং শুধু আমার কথাতেই না, বানানটা যে দুরকমই হয়, সেটাও তাকে দেখানো দরকার। আর তৃতীয় বইটা তাকে বুঝতে সাহায্য করবে যে আমার বানানের ব্যবহারটাও ঠিক আছে। আমি বেশ বিরক্তির সঙ্গে বই তিনটা নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলাম। তিনি প্রথমে আমাকে দেখে হতভম্ব। তারপর আমি যেটুকু বোঝানোর বোঝালাম, কিন্তু আমি নিশ্চিত হলাম তাঁর মাথায় তখন কিছুই ঢুকছে না। একজন বাংলার অধ্যাপকের বাংলা বানানের ভুল ধরার ধৃষ্টতা তাঁর কীভাবে হলো, এই চিন্তা করেই তাঁর সময় যাচ্ছিল! আমি নিশ্চিত এই অভিজ্ঞতার পর তিনি আর কোনো দিন কারও বানান নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি!
জীবন এবং মৃত্যু—কোনোটা নিয়েই আব্বার তেমন কোনো চিন্তা ছিল না। যেহেতু সঞ্চয়ী ছিলেন না, অনেকে প্রশ্ন করতেন, আপনার বা আপনার পরিবারের কারও কখনো জরুরি প্রয়োজনে বা বড় ধরনের চিকিৎসা সাহায্য লাগলে কী করতেন? আব্বা নির্বিকারভাবে তিন শব্দে উত্তর দিতেন, ‘চিকিৎসা হতো না!’ একজন আব্বাকে একদিন বললেন, স্যার, আপনার ড্রয়িং রুম দেখলেই বোঝা যায় আপনি জীবনে কিছু করেননি!
মৃত্যু নিয়েও আব্বার বিশেষ কোনো চিন্তা ছিল না। মানুষ যেখানে কবরের জায়গা কিনে রাখে, সেখানে মৃত্যু নিয়েও তাঁর চিন্তা ছিল খুবই স্বাভাবিক। আব্বার ৭৫তম জন্মদিন বেশ ঘটা করেই উদযাপন করা হয়েছিল, চারুকলার বকুলতলায়। একজন সে কথা বলতেই আব্বা বললেন, ফুল বুকে নেওয়ার সময় হয়ে গেছে; যেহেতু বেঁচে আছি, তাই লোকে হাতে এসে দিয়ে গেল!
আব্বার রসবোধ খুব সূক্ষ্ম আর তীক্ষ্ণ ছিল। একবার আম্মা আব্বাকে বললেন, ওপরতলার ভদ্রমহিলা প্রতিবছর তাঁর স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের খাবার পাঠান। আমার কখনোই তাঁকে খাবার পাঠানো হয় না। আব্বা বললেন, তুমি এখন কেন খাবার পাঠাবে? আমি তো এখনো বেঁচে আছি!
বেশি রাত করে, দাওয়াত থেকে বাড়িতে ফিরলে আম্মা মাঝেমধ্যে চিন্তিত হতেন। একবার বললেন, এত রাত করে ফিরলে? তোমার বয়সী কেউ কি ওখানে ছিল? আব্বা বললেন, ওরা ওখানে থাকবে কীভাবে? বেশির ভাগই তো মারা গেছে!
একবার আমি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গেছি, তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। আব্বার আমাকে প্রয়োজন পড়লে আম্মার ডায়েরি ঘেঁটে কিছুতেই সেই বন্ধুর নম্বর বের করতে পারলেন না। আম্মা ফিরে আসার পর আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, আমার বন্ধুর নম্বর ডায়েরিতে আছে কি না। আম্মা A-এর ঘরে, ‘Ananda's friends’ শিরোনামের নিচে আমার সব বন্ধুর নামের মাঝে তার নম্বরটা দেখিয়ে দিলেন। আব্বা বললেন, এত জটিলভাবে মানুষের নাম লেখার দরকার কী? যার নাম তার আদ্যক্ষরের ঘরে লিখলেই তো হয়! তারপর আম্মাকে আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, আমার নাম-নম্বর কোথায় লিখেছ? H–এর ঘরে? ‘Husbands’–এর নিচে?
পারিবারিক সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন ঠিকই, তবে কখনো কখনো পেরে উঠতেন না। আমার ছেলে, সাম্যর, ১০ বছরের জন্মদিনে, এক মাস আগে সময় ঠিক করে রেখেও, নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হতে পারেননি! আব্বার মৃত্যুর পর ও একদিন মন খারাপ করে বলল, দাদার সাথে আমার আলাদা কোনো ছবি নেই। আমি বললাম, আমারও বোধ হয় নেই! আমার মেয়ে, সখ্য, অবশ্য বেশ কিছু ছবি তুলে রেখেছে। তাদের নিয়ে, বিশেষ করে দেশের বাইরে থাকা নাতি-নাতনিদের নিয়ে একসঙ্গে খেতে যাওয়া তাঁর কাছে একটা খুশির উপলক্ষ ছিল। সেই সময়টা তাঁর কাটত বেশ আনন্দেই।
যেকোনো বিষয়ে আব্বার আদর্শিক অবস্থান খুব স্পষ্ট ও শক্ত ছিল। অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল একবার বলেছিলেন, ছয় দশক ধরে আনিস ভাইকে চিনি, কিন্তু তিনি কখনো তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সত্যবাদিতা ছিল তাঁর চরিত্রের আরেকটা দিক।
একবার আমি গেছি এক ব্যাংকের ইন্টারভিউ দিতে। ছোট কর্মকর্তা আমাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন, বড় কর্মকর্তা যে প্রশ্ন করবেন, আমি যেন ‘হ্যাঁ’–সূচক উত্তর দিই। দুটো প্রশ্নে কোনো সমস্যাই হলো না। তৃতীয় প্রশ্নে এসে আমি আব্বার শেখানোর সত্যবাদিতা অবলম্বন করে ‘না’–সূচক উত্তর দিলাম। বড় কর্তা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেন আর ছোট কর্মকর্তা আমার হতবুদ্ধিতে বিস্মিত হলেন। একফাঁকে আমাকে বললেনও, আপনার তো এত সত্যবাদী হওয়ার দরকার ছিল না। বাসায় আসার পর সব শুনে আব্বা বললেন, ঠিকই করেছ। মিথ্যা কথা বলে চাকরি পাওয়ার দরকার নেই!
সত্যবাদী হওয়ার পাশাপাশি আমাদের আর একটাই উপদেশ দিতেন—সেটা ছিল ভালো মানুষ হওয়ার। ছোটবেলা থেকে শুনতাম, পেশা হিসেবে কী বেছে নেবে, তা তোমার ব্যাপার; কিন্তু আমি চাই তোমরা ভালো মানুষ হও। ভালো মানুষের সংজ্ঞাও খুব সহজ করে দিয়েছিলেন—মানুষের ভালো যদি তোমাকে হাসায় আর মানুষের দুঃখ যদি তোমাকে কাঁদায়, তবেই বুঝবে তুমি ভালো মানুষ।
মানবিকতা ছাড়াও আব্বার মধ্যে যেসব গুণ দেখেছি তা হলো, পরিশীলিত জীবনাচরণ, সৌজন্যপরায়ণতা, তীক্ষ্ণ রসবোধ, কঠোর সময়ানুবর্তিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদারতা, অনাড়ম্বর জীবনযাপন, সত্যবাদিতা, দায়িত্ববোধ, অন্যের প্রতি খেয়াল, দেশপ্রেম; কখনো কখনো দেশপ্রেমের ঊর্ধ্বে আন্তর্জাতিকতা।
ইন্টারভিউ দিতে গেছি আরেক ব্যাংকে। বসে আছি আমার বন্ধুর ঘরে। একটু পরে সে আমাকে জানাল, আজ সকালে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে! যিনি ইন্টারভিউ নেবেন, তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে নাকি প্রসঙ্গক্রমে, আমার সিভিতে আব্বার নাম দেখে, বলেছিলেন, আজ ড. আনিসুজ্জামানের ছেলে আসবে ইন্টারভিউ দিতে। ভদ্রলোক প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ড. আনিসুজ্জামান কে? এ কথা শুনেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাকি খুব চটে গিয়েছিলেন। আমি আমার বন্ধুকে, কিছুটা সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কিছুটা যুক্তিতে ভর করে, বললাম, তিনি এত চটে গেলেন কেন? ভদ্রলোক তো ব্যাংকার—তাঁর তো আব্বার জগতের সঙ্গে সংযোগ বেশি না–ও থাকতে পারে। আমার বাবা না হলে আমিও হয়তো তাঁকে চিনতাম না! পরবর্তীকালে, অসংখ্যবার, নির্বিকারভাবে আব্বা এই গল্প সবাইকে বলে বেড়াতেন, আমাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে। একজন উদার মানুষই বোধ হয় এমন গল্প বলতে পারেন!
আমাদের তিন ভাইবোনের নাম রেখেছিলেন রুচি, শুচি ও আনন্দ। তাঁর জীবনে এর সবগুলোই ছিল। লেখায়, আচরণে, চলাফেরায় রুচিশীল, চিন্তায় শুচি-শুভ্র আর জীবন পার করেছেন আনন্দে। সফলতার সংজ্ঞা যদি হয়, যা করতে চাই জীবনে তা করতে পারা—তবে তাঁর মতো সফল মানুষ আমি আর কাউকে দেখি না। নিজের ৮০ বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিজেও স্বীকার করেছিলেন, ‘আমার জীবনে কোনো খেদ নেই।’
আমি জানি, সন্তান হিসেবে এতগুলো স্তুতিবাক্য দেখলে আব্বা নিজেও অপ্রস্তুত হতেন। তাঁর প্রশংসাসূচক বক্তৃতা শোনার পরে তিনি একবার বলেছিলেন, সবগুলো কথা সত্যি না হলেও কথাগুলো প্রশংসাসূচক। তাই এর প্রতিবাদ করলাম না। তবে আমার বিরুদ্ধবাদীরা আমার সম্পর্কে এ রকম একটা সভায় বলতে পারলে, আমার জীবনের পুরো দিকটা হয়তো আপনাদের সামনে ধরা দিত!
আব্বা কখনো সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হননি, তবে তাঁর একটা রাজনৈতিক দর্শন ছিল। কোনো দলে যুক্ত হননি, কিন্তু তিনি রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে রাজপথে ছিলেন সব সময়। কোনো দলের প্রতি অন্ধ, অকুণ্ঠ সমর্থন কখনো দেননি। রাজনৈতিক দলের সমাবেশ সাধারণত এড়িয়ে চলেছেন। খুব অবাক করে দিয়ে একবার চলে গেলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক সভায়। সেটা ছিল ছিটমহলের সমাধান হওয়ায়, প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সমাবেশ। পরে জানতে পারলাম, ছিটমহল সমস্যার সমাধান যেদিন হয়, সেদিন আব্বা সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন! এত বছরের, এত মানুষের কষ্টের সমাধানের আনন্দ তাঁকে সারা রাত ঘুমাতে দেয়নি।
তাঁর জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ত্রিশের দশকের শেষের দিকে জন্ম নেওয়া আব্বা, তাঁর পরবর্তী আটটি দশকে দেখেছেন এ দেশের জাতিসত্তার উন্মেষ; ভূমিকাও রেখেছেন—কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে। চল্লিশের দশকে দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশ বিভাগ, হয়েছিলেন দেশান্তরি। পঞ্চাশের দশকে জড়িয়েছিলেন ভাষার আন্দোলনে, নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন বাঙালি সত্তার বিকাশে। ষাটের দশকে ভূমিকা রেখেছেন বাঙালির সংস্কৃতির আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থানে। সত্তর দশকে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধে, ভূমিকা রাখেন সংবিধান রচনায়; কিছুটা স্বপ্নভঙ্গ হয় এই দশকে। আশির দশকে নিবেদিত ছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। নব্বইয়ের দশকে সক্রিয় ছিলেন গণ–আদালত গঠনে, ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিকাশে। নতুন শতাব্দীর শুরুতে এসে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা এবং গণতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে নিজেকে সক্রিয় রাখেন। আর জীবনের শেষ দশকে যুক্ত হন যুদ্ধাপরাধের বিচারে আর অবস্থান নেন ধর্মান্ধতার বিপক্ষে।
তাই একজন লিখেছেন, ‘তাঁর জীবন এই ভূখণ্ডের ইতিহাস’। বাংলার যেকোনো কিছুতেই দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য—সবকিছুর বিকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এমন মানুষ পাওয়া আসলে সত্যিই দুর্লভ; এবার বলা যায়, আমরা কোথায় পাব তাঁরে?
ফিরে আসি আব্বার রাজনৈতিক দর্শনে। সুবিধাবাদের রাজনীতি একেবারেই মেনে নেননি—সে মানুষই হোক আর দল। সকালে আব্বার একটা অভ্যাস ছিল নাশতার টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়া; কখনো কখনো দেখতাম কাগজ পড়ে কাউকে কাউকে ফোন করছেন। একবার বিভাগের একজন শিক্ষককে বললেন, খবরের কাগজে তোমার এই বক্তব্য দেখলাম, তুমি কি এই কথা বলেছ? হ্যাঁ–সূচক উত্তর আসতেই আব্বা বললেন, তোমার এই বক্তব্য শহিদ মিনারের মূল নির্যাসের বিপক্ষে গেছে, আগামীবার বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষে কথা বললেও আমি আশ্চর্য হব না!
ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী দলের ধর্মীয় গোষ্ঠীর নৈকট্য, আশ্রয়-প্রশ্রয়, চাওয়া-পাওয়া, লেনদেন তাঁকে নিরাশ করত। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, ধর্মান্ধতার আগ্রাসন, ধর্মাশ্রয়ী দলের রাজনীতিতে প্রভাব দেখে উৎকণ্ঠিত হতেন। ব্লগার হত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করতেন, ধর্মান্ধদের দ্বারা প্রগতিশীলদের কণ্ঠরোধের চেষ্টার প্রতিবাদ করতেন। দীপনসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে সবার মধ্যে যখন চাপা ক্ষোভ, কিন্তু কণ্ঠ মৃদু; তখন আব্বা স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ধর্ম মানার পাশাপাশি, ধর্ম না মানার স্বাধীনতা দিতে হবে।’ বলাবাহুল্য, একপর্যায়ে জীবননাশের হুমকিও পেলেন।
দীপনের মৃত্যুর পরের আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল। দীপনের বাবা ফজলুল হক চাচা পত্রিকায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, খুব সম্ভবত এই হত্যার বিচার চান না—এমন একটা বক্তব্য দিয়ে। পরদিন আব্বা এসব কিছু নিয়েই তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। সেটাতে ফজলুল হক চাচার সঙ্গে একটা মতান্তর হলো। তিনি তা প্রকাশও করলেন। আমি সাহস নিয়ে আব্বাকে বললাম, আমার তো মনে হয়েছে ফজলুল হক চাচার তোমার লেখায় কষ্ট পাওয়ার একটা সুযোগ আছে। আব্বা উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, আমি হয়তো একটু অন্যভাবে লিখতে পারতাম। আমি আরেকবার আব্বার পরমতসহিষ্ণুতা ও উদারতার পরিচয় পেলাম।
বিংশ শতাব্দীর, সমঝোতা করে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের, আমি যখন কোনো রাজনৈতিক দলের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পক্ষে ওকালতি করেছি, তখন তিনি বলেছেন, মানুষকে সঠিকটা বোঝানো রাজনৈতিক দলের কাজ। বলতেন, নেতা যা ঠিক বিবেচনা করবেন, যা চাইবেন, তা মানুষকে বোঝানো তাঁদের দায়িত্ব; আগের নেতারা তা–ই করতেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলো আগে বোঝার চেষ্টা করে মানুষ কী গ্রহণ করবে এবং সেই পথে নিজেকে পরিচালিত করে, কখনো কখনো তাঁর ও দলের আদর্শকে পাশ কাটিয়ে। আমি আব্বাকে কৌশলের রাজনীতি বোঝাতে ব্যর্থ হই!
এ ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ দিতেন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমদের। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর হৃদয়ে। সারা জীবন বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়িয়ে, কতটা দৃঢ়ভাবে নিজের আদর্শ মানুষকে বুঝিয়ে, তাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন, সেই উদাহরণই দিতেন বারবার। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কখনো কখনো অতি বাড়াবাড়ি দেখলে বিরক্ত হতেন। একবার বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এমনিতেই অনেক বড় মাপের মানুষ, তাঁকে আরও বড় বানাতে গিয়ে আমরা যেন ছোট না করি।’
তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাপারেও ছিল আব্বার অগাধ শ্রদ্ধা। তাঁর বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা আর বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষার ওপর দখল আব্বাকে মুগ্ধ করেছিল। বলতেন, তাজউদ্দীনের যা প্রাপ্য ছিল, আমরা তা দিইনি; আর যা দিয়েছি, তা তাঁর প্রাপ্য ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সে সময়ের মন্ত্রিসভার সদস্য না হয়েও, বহুদিন রাজনীতির বাইরে থেকেও মরণে তাঁর সঙ্গী হওয়ায় আব্বা বলেছিলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষেরা তাজউদ্দীনকে পুরোপুরি চিনতে না পারলেও আমাদের বিরোধীরা তাঁকে ঠিকই চিনেছিল!
আব্বা সব সময় নিজের মত বলতেন, তবে চাপাতেন না। অপছন্দ হলে বলতেন, কিন্তু আঘাত করতেন না। অভিব্যক্তি দিয়েও তাঁর মত বা অমত, বুঝিয়ে দিতেন কখনো কখনো। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যখন তৈরি হয়, তখন ‘নির্মূল’ শব্দটা নিয়ে আব্বা আপত্তি তুলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও আব্বা ফাঁসির দাবিতে নিজস্ব বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন, বলেছিলেন, ফাঁসি নয়, আমি বিচার চাওয়াটাই উপযুক্ত মনে করি। যুদ্ধাপরাধের দণ্ডে প্রথমজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর আব্বা প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, অবস্থানগতভাবে আমি ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা ফাঁসির বিপক্ষে, তবে তাদের যে অপরাধ, তাতে দেশের প্রচলিত সর্বোচ্চ শাস্তি তাঁদের প্রাপ্য।
এতৎসত্ত্বেও খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আব্বার মৃত্যুর পর দেশের প্রায় সব কটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ব্যক্তিরা শোকবার্তা পাঠালেন। বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক দল, এমনকি তাঁর আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দলও জানাল শেষ শ্রদ্ধা।
২০১৩ সালে একবার আওয়ামী লীগের এক নেতা ফোন করে তাঁর স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য আব্বাকে সুপারিশ করতে বললেন। আব্বা তাঁকে বললেন, আমি তো নিজেই স্বাধীনতা পুরস্কার পাইনি, তোমাকে কীভাবে সুপারিশ করব? তখন তিনি অবাক হয়ে বললেন, আমাদের সরকার এত দিন ক্ষমতায় আর আপনি স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি? আব্বা বললেন, দেশে আমার এখন পর্যন্ত যে বড় দুই প্রাপ্তি তাঁর একটা হলো প্রফেসর ইমেরিটাস—সেটা পেয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং বিএনপি মনোনীত ভাইস চ্যান্সেলরের মাধ্যমে। আর একুশে পদক পেয়েছি এরশাদ সরকারের কাছ থেকে।
ঘটনাচক্রে এর পরের বছরই ভারত সরকার আব্বাকে পদ্মভূষণ দেয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে আব্বা স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। আর ২০১৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক করে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয়বারের মতো তাঁকে জাতীয় সম্মাননা প্রদান করে।
জাতীয় অধ্যাপক হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় আব্বা বলেছিলেন, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হব, সেটাই আশা করিনি, কারণ আমাদের সময় প্রফেসর ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো বিদ্বান মানুষ। আর এখন ন্যাশনাল প্রফেসর হয়ে গেছি! দেশকে আমি যা দিয়েছি, তাঁর থেকে অনেক বেশি দেশ আমাকে দিয়েছে।
আব্বা সব সময় High thinking, simple living–এ বিশ্বাসী ছিলেন। মৃত্যুতেও চেয়েছিলেন তা–ই। আমাদের বলেছিলেন, যত কম আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বিদায় দেওয়া যায়, ততই ভালো। অস্থায়ী কবরে তাঁকে দাফনের পরামর্শও দিয়েছিলেন। আবেগের কারণে আমরা তাঁর এই অনুরোধ রাখতে পারিনি। তবে প্রকৃতির খেয়ালে তাঁর বিদায় হলো বেশ সাদামাটাভাবেই, তাঁর যেমন ইচ্ছে ছিল।
আব্বা আর আমি থাকতাম একই বাড়িতে, পাশাপাশি ঘরে। একবার দুপুরবেলা অফিস থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা, তুমি রাতে কখন বাড়ি ফিরবে? আব্বা উত্তর দিলেন, আমি তো চট্টগ্রামে! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কখন গেলে? আব্বা উত্তর দিলেন, আজ। ফিরব আগামীকাল।
এখন আর কোনো সংশয় নেই। আব্বা কোথায় তা আমি নিশ্চিতভাবে জানি। আব্বা, তুমি কি আগের মতোই আছ? আমাদের নিয়ে ভাবার সময় কি তোমার হয়েছে? নাকি সবার চিন্তায় এখনো মগ্ন তুমি?
* সৌজন্য: কালি ও কলম, আষাঢ় শ্রাবণ ১৪২৭, আনিসুজ্জামান শ্রদ্ধাঞ্জলি সংখ্যা