অসমাপ্ত দিন পূর্ণ হোক

কলকাতা বইমেলায় হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে সংবর্ধনা। ছবি: সংগৃহীত
কলকাতা বইমেলায় হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে সংবর্ধনা। ছবি: সংগৃহীত

গেল ফেব্রুয়ারিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হয়ে গেল কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। ১০ ফেব্রুয়ারি ছিল ‘বাংলাদেশ দিবস’। কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে সেখানে গিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তাঁর সেই সফরের খণ্ড খণ্ড স্মৃতি ধরা আছে কাব্যিক এই গদ্যে।

আরম্ভ কথা
‘যাও বাজারে যাও, বাজারথন জুতা কিন্যা আনো! সেই জুতা দিয়া তোমার বাম গালে দুইডা বাড়ি মারমু।’—ঠিক এ রকম একটা বচনের মধ্য দিয়ে যখন সিঁড়িগুলো অতিক্রম করছিলাম, তখন হঠাৎ মনে হলো ত্রিশ বছর আগের জবা-চন্দনের কথা। বাক্য ও বিষয়ের হেরফের সত্ত্বেও কেন যে সেই চিত্রটিই জাগরুক হলো, বুঝতে পারছি না! জবা—সুন্দরী, চটুল, অভিনয়শিল্পী; এবং নিজ স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বদা সজাগ। চন্দন—প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন চৌকস ছাত্র; বেকার থাকতে এবং পান করতে পছন্দ করে। তবে মাঝেমধ্যে টিউশনের ঝোঁকও আছে। এহেন জবা-চন্দন যখন সপ্রেম জুটিবদ্ধ, তখন দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্কে কোনো এক সন্ধ্যার আমোদে ভেতর থেকে ভেসে এল: ‘যাও, বাজারে যাও—বড় মাংস কিনে আনো! সেই মাংস দিয়ে কিমা বানিয়ে তোমাকে খাওয়াব।’ বড় মাংস মানে গোমাংস বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও কথার ওজন ধরতে পারলাম। কখনো-কখনো আমার ম্লান থাকলেও ম্রিয়মাণ তো হতে চাই না। তাই এই সব অনুসঙ্গের ভেতর দিয়ে যখন ঢাকা-কলকাতা ভ্রমণ করি, তখন আপন হিসেবে মাংস ও চামড়া কখনো খাদ্য, আবার কখনো জুতা হয়ে আমাদের আক্রান্ত করে, বুঝিবা পরাজিতও করে।

দুই.
‘দাঁড়াবার জায়গা’ নিয়ে লড়াই করে জিততে হয়। এবং সে জেতার জন্য সাহস লাগে, লাগে মেধা-সমন্বয়। একদল তরুণের দুর্দান্ত প্রচেষ্টা যখন সাহিত্য-শিল্পের কাছে ন্যস্ত হয়, তখন ঠাঁইটি হয় মজবুত, আর অবতরণের স্থলটি রূপ পায় আশ্রয়ের। কবিদের জন্য, বিশেষভাবে যৌবন-উন্মোচিত কবিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি নতুন মাত্রায় প্রকাশিত হলে বদলে যায় ভাষারূপ, অঙ্গবিভা থেকে সময়দর্শন। অঙ্গীকারের মোহনায় ‘দাঁড়াবার জায়গা’ তৈরি করে অভিযানের পথ। আর সে পথেরই তো যাত্রী সুদীপ চক্রবর্তী, দিব্যেন্দু ঘোষ, তন্ময় চক্রবর্তী প্রমুখ। কবিতা নিয়ে অনুষ্ঠান এবং পায়েল সেনগুপ্তকে ‘দাঁড়াবার জায়গা’ পুরস্কার দিয়ে সে আয়োজন সমাপ্ত হলো কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০১৯-এ। আনন্দময় অনুষ্ঠানের শরিকানা থেকে বাদ গেলেন না সুবোধ সরকার, শ্রীজাত, শিবাশিস মুখোপাধ্যায় থেকে অংশুমান কর। সুতোগুলো লাল-নীলে গিঁট বাঁধা, এবং গিঁট গুনে গুনেই আমরা তা খোলার চেষ্টায় রত।

তিন.
বাংলা নিয়ে কথা, ভাষা নিয়ে কথা। কথা দেশ নিয়ে, রাজপথে রক্ত ঢালা নিয়ে। আমাদের কথারা ‘তাহাদের’ কথার সঙ্গে মেলে না। তবে মেলার কথা ছিল, কিন্তু টুঁটে তো গেছে সেই উনিশ শ সাতচল্লিশে। জোড়া লাগানোর বুলিতে কি আর আঠা আছে যে এক হয়ে যাবে? তবে হ্যাঁ, ভাষা আছে, বাংলা ভাষা আছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ ‘মা’ ডাকে সাড়া দেয়। এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার ৯ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে দেশ ও ভাষা নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্রীজাত, আবুল মোমেন, প্রচেত গুপ্তের সঙ্গে একই মঞ্চ থেকে আমিও বলতে পারলাম, ‘চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’

চার.
ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো কখনো কখনো ঘন হলে আমরা আপ্লুত হই একটি বিন্দুকে স্পর্শ করতে পারব বলে। এবং সে স্পর্শের সূত্র যদি কবিতা হয়, তখন ভালো লাগা পায় নতুন মাত্রা। একে অন্যের সমাজচিত্র যেন বাহ্যিক সীমাবন্ধনী ছিন্ন করে মানবমিত্রে রূপ নেয়।
বীথি চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের ছোটকাগজ প্রথম আলো। কবিতাপাঠ, সংবর্ধনা এবং বইমেলা সংখ্যার প্রকাশ নিয়ে আয়োজন ছিল এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। শুভাপ্রসন্ন বললেন, কবিতাপাঠ করলেন তারিক সুজাত, জামাল হোসেন প্রমুখ। শেষ সন্ধ্যার আকাশে মোহরের মাধুর্য এবং তরুণের অন্তরঙ্গতা লেগে থাকল।

অতঃপর শেষ কথা
যত কাছে থাকি, কিংবা যত দূরেই যাই—আকাশ সঙ্গে থাকে, হাওয়া থাকে, থাকে সমুদ্রের স্বর। কিন্তু যত কাড়াকাড়ি মাটি নিয়ে, তত বাড়াবাড়ি ভাষা নিয়ে। ভাষাচরিত্র বদল হচ্ছে; পুবের সঙ্গে পশ্চিমের নুন-লবণ হোঁচট খাচ্ছে—আর আমরা যুক্ত হওয়ার এক মহা-অভিনয়ে ব্যস্ত আছি ‘জাদু’ হয়ে। এই জাদু একসময় কথিত বর্তমানকে (!) পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সামনে তুলে দিলে তা বাস্তব হয়। এবং বাস্তব হওয়ার মুহূর্ত নিয়ে আমরা দিকশূন্য হই। তাই বলি: আমাদের অসমাপ্ত দিন পূর্ণ হোক মিলনরেখার শীর্ষদেশে।