‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি কি আমেরিকাকে দায়মুক্ত করতে চেয়েছে

ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সরব অনেকেই। কিন্তু কেন হলিউডের এ চলচ্চিত্র নিয়ে এত আগ্রহ মানুষের?

‘ওপেনহাইমার’ ছবির পোস্টারে কিলিয়ান মারফিছবি: সংগৃহীত

‘নাউ আই অ্যাম বিকাম ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অব ওয়ার্ল্ডস—আমি এখন যমদূত, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসকারী।’)—বিষ্ণুর এ উক্তি বেশ কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে দেখছি। না, হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে সবাই হিন্দু দর্শনের বোদ্ধা হয়ে যাননি। এ উক্তির হঠাৎ বিস্তারের কারণ, পারমাণবিক বোমার জনক জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমারের জীবনী নিয়ে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত জগদ্বিখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমা। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই যেদিন প্রথমবারের মতো ওপেনহাইমার ‘ট্রিনিটি’খ্যাত পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ স্বচক্ষে দেখেছিলেন, তখন এই লাইনগুলোই তাঁর মাথায় খেলছিল। পবিত্র গীতায় বর্ণিত এবং অর্জুনকে সাহস দেওয়ার জন্য বিষ্ণুর বলা এ উক্তি তখন পরিণত হয়েছিল ওপেনহাইমারের জীবনের বাস্তবতায়।

সিনেমার দৃশ্যে ফ্লোরেন্স পিউ ও কিলিয়ান মারফি
ছবি: সংগৃহীত

ক্রিস্টোফার নোলান পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত পরিচালক। তাঁর সিনেমার খবর পেলেই বিশ্বব্যাপী সিনেমাপ্রেমীদের মন আনন্দে উছলে ওঠে। চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে আইএমডিবির ‘অল টাইম বেস্ট’-এর তালিকায় প্রথম দশে থাকা সিনেমার নির্মাতা, কী অর্জন করেননি তিনি! প্রতিবারই নিজেকে ছাড়িয়ে যান নোলান, তৈরি করেন নির্মাণের নতুন মাত্রা। এমিলি ব্লান্ট, রামি মালেক, ফ্লোরেন্স পিউয়ের মতো বড় মাপের তারকারা খুবই অল্প সময়ের এবং তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমায়। আর প্রযোজক যে অর্থ ব্যয়ে কোনো কার্পণ্য করেননি, তা সিনেমা নির্মাণের ব্যাপকতায় স্পষ্ট। এই সবকিছুই প্রমাণ করে হলিউড পাড়ায় নোলানের দাপট কত বেশি!

‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি নিয়ে ইন্টারনেটে হাঁকডাক চলছে বছরখানেক ধরে। এ সিনেমার জন্য এত সহজে যে টিকিট মিলবে না, তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। বহু কষ্টে বাসা থেকে বেশ দূরের একটি সিনেমা হলে একদম সামনের দিকে কিছু সিট পেলাম। টিকিট পাওয়ামাত্র এটি নিয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি, যত দ্রুত সম্ভব কিনে ফেলেছি। ‘দ্য ডার্ক নাইট’, ‘ইনসেপশন’, ‘টেনেট’, ‘ইন্টাস্টেলার’ ও ‘দ্য প্রেস্টিজ’-এর মতো সিনেমাগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে এ ছবি নিয়েও আশা বেশ ভালোই ছিল, অন্য দর্শকদের মধ্যেও এমন ভাবই দেখছিলাম। সিনেমাটির একটি বিশেষ দিক হলো, ক্রিস্টোফার নোলান এখানে কোনো কম্পিউটারে তৈরি ছবি, অর্থাৎ ‘সিজিআই’ ব্যবহার করেননি। বেশির ভাগ দৃশ্যই তিনি বাস্তবে তৈরি করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এডিট করিয়েছেন।

সিনেটের মুখোমুখি লুইস স্ট্রস চরিত্রে রবার্ট ডাউনি জুনিয়র
ছবি: সংগৃহীত

সিনেমাটিতে আমার মতো সবারই মন কেড়ে নিয়েছেন ‘পিকি ব্লাইন্ডার্স’খ্যাত অভিনেতা কিলিয়ান মারফি। আমার মতে, এ সিনেমায় অভিনয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কিলিয়ান মারফির ‘নীল চোখ’। অভিনেতা হিসেবে মারফি বহু আগে থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে ‘ওপেনহাইমার’-এ তিনি চরিত্রের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবেগ-অনুভূতি নিজের চোখে-মুখে সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমনটা বলে শুরু করেছিলাম, ‘এখন আমি হয়েছি মৃত্যু, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসকারী।’ উক্তিটি দেখেই বোঝা যায়, ওপেনহাইমারের পারমাণবিক বোমা তৈরি-পরবর্তী অনুভূতি কেমন ছিল। পেশাজীবনে প্রচণ্ড মেধাবী বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল, অনুতাপকারী, করুণ-ভঙ্গুর এক সত্তা। পারমাণবিক বোমা তৈরির সময় তাঁর সম্ভাব্য বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে শঙ্কা, নির্মাণ-পরবর্তী ব্যক্তিগত অনুতাপ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতার পুরোটা সময়ই ছিল চরম আবেগপূর্ণ ঘটনাবহুল অবস্থা। এই জটিল ও বিমূর্ত বিষয়গুলো কিলিয়ান মারফি অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ক্লান্ত নীল চোখ, দুশ্চিন্তায় থাকা কপালের ভাঁজ, কাঁপা কাঁপা হাতের আঙুল, কোন ইন্দ্রিয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি সিনেমাটিতে!

ক্রিস্টোফার নোলান ও কিলিয়ান মারফি, ইউনিভার্সাল পিকচারের লন্ডন প্রটোকলে
ছবি: সংগৃহীত

পুরো সিনেমায় ম্যাট ডেমনস, এমিলি ব্লান্ট, রামি মালেকসহ প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রী দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তবে আলাদা করে কিলিয়ান মারফির প্রশংসা করলে সঙ্গে আর যে একটি চরিত্রের প্রশংসা না করে পারা যায় না, তিনি হলেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান লুইস স্ট্রস চরিত্রে অভিনয় করা রবার্ট ডাউনি নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙে নতুনভাবে তৈরি করেছেন এ সিনেমায়। ‘আয়রনম্যান’ চরিত্রের জন্য বিশ্ববিখ্যাত এই অভিনেতা এখানে দেখিয়েছেন, সুপারহিরো সিনেমার বাইরেও তাঁর অভিনয়ের কারিশমা। নিজের ব্যক্তিজীবনের আপদগ্রস্ততা, উচ্চাভিলাষ ও ভয়ংকর রাজনৈতিক লালসাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ কীভাবে মেধাবী একজন বিজ্ঞানীর জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াতে পারেন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল এই লুইস স্ট্রস চরিত্র।

আর একটি বিষয় জানানোর লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটিতে আইনস্টাইন ও নিলস বোরের চরিত্রও রয়েছে। জগতের এই বিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর সঙ্গে ওপেনহাইমারের তৎকালীন মিথস্ক্রিয়া কেমন ছিল, তার অসাধারণ দৃশ্যায়ন হয়েছে সিনেমাটিতে।

‘ওপেনহাইমার’ ছবিতে কিলিয়ান মারফি
ছবি: সংগৃহীত

ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমাভক্তদের একটি বৃহৎ অংশ বিজ্ঞানপ্রেমী। আর নোলান কখনোই তাঁর এই বিজ্ঞানপ্রেমী দর্শকদের নিরাশ করেন না। কারণ, তাঁর সিনেমা সব সময়ই ‘মোর দ্যান সায়েন্স ফিকশন’। বিজ্ঞানের বাস্তব ও যুক্তিসংগত ভিত্তির ওপরেই তিনি সব সময় সিনেমা নির্মাণ করেন। এ ছবিতেও বিজ্ঞানের কমতি নেই।

পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয় ‘কোয়ান্টাম মেকানিকস’ তিনি সময় নিয়ে বুঝিয়েছেন। দেখিয়েছেন পারমাণবিক ফিশন ও ফিউশন প্রক্রিয়া। ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়ামের মাধ্যমে কীভাবে পারমাণবিক শক্তি লাভ করা যায়, তা–ও বেশ বিস্তারিতভাবেই দেখা গিয়েছে। তবে সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার প্রায় সব কটি দৃশ্যতেই ছিল একদৃষ্টে চেয়ে থাকার মতো দুর্দান্ত ভিজ্যুয়াল।

আমরা এই পুরো বিষয়কে ‘রাজনীতির অন্ধকার দিককার উচ্চাভিলাষী ও লালসাপূর্ণ মানুষেরাই এমন বিধ্বংসী সিদ্ধান্তের জন্য মূলত দায়ী’—এ ধরনের বয়ান তৈরির মাধ্যমে সার্বিকভাবে আমেরিকার দায়মুক্তির একটি চেষ্টা হিসেবে দেখতে পারি। কেননা, পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তী ভয়াবহতার দিকটি দৃশ্যায়ন না করে কেবল সে-সম্পর্কিত ব্যক্তি ওপেনহাইমারের আক্ষেপ, অনুতাপ ও মানসিক জটিলতার দিকটি দৃশ্যায়ন করা হলো এখানে। এটি কেন করা হয়েছে?

ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমা নিয়ে মানুষ খুব কমই সমালোচনা করেন। তবে এ সিনেমার এত এত ভালো লাগার দিক থাকলেও সিনেমাটি প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলাই যায়। ছবিটির সাউন্ড স্কোর বেশ ভালো হলেও সংলাপ বেশ দীর্ঘ সময়জুড়ে ছিল অস্পষ্ট। বেশ কিছু সময় ধরে বোঝাই যাচ্ছিল না স্ক্রিনে কী নিয়ে কথা হচ্ছে!
আরেকটি বড় আক্ষেপের বিষয় হলো, এতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অনুপস্থিতি। পারমাণবিক বোমাটি হিরোশিমায় নিক্ষেপের মতো বিশ্বকে বদলে দেওয়া এত বড় একটি সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রশাসন কীভাবে এল, অন্যান্য মিত্রশক্তির দেশগুলোর সঙ্গে এ–সম্পর্কিত কূটনৈতিক বিষয়গুলো ঠিক কীভাবে ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছিল, তার প্রায় কিছুই সিনেমায় দেখানো হয়নি। এমনকি সিনেমাটিতে মূল পারমাণবিক বোমা, অর্থাৎ ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’-এর নিক্ষেপ–সম্পর্কিত কোনো দৃশ্যই নেই! এ ছবির ক্ষেত্রে এ বিষয় নিয়ে বড় অভিযোগ তোলাই যায়।

‘ওপেনহাইমার’ ছবির শুটিংয়ে পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান ও ওপেনহাইমার চরিত্রের অভিনেতা‘ কিলিয়ান মারফির ‘কেমিস্ট্রি’
ছবি: সংগৃহীত

হলিউডের এ ধরনের ইতিহাস ও রাজনীতিবিষয়ক সিনেমাগুলোকে দায়মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। ক্রিস্টোফার নোলানও আমাদের দৃষ্টিতে সে পথেই হেঁটেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা দুটি নিক্ষেপের পরবর্তী সময়ে জাপানে এর ভয়াবহতা ও আমেরিকার চরম বিধ্বংসী অবস্থানের বিপরীতে এ সিনেমায় দেখা গেছে ওপেনহাইমারের এই ঘটনা-পরবর্তী আবেগ-অনুভূতি ও অন্যান্য অনুতাপ বরণের দৃশ্য। সিনেটের টান টান উত্তেজনা আর ওয়াশিংটনের বদ্ধ ঘরে ওপেনহাইমারকে জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যগুলো রাজনীতির অভ্যন্তরীণ অন্ধকার দিকটি তুলে ধরেছে। আমরা এই পুরো বিষয়কে ‘রাজনীতির অন্ধকার দিককার উচ্চাভিলাষী ও লালসাপূর্ণ মানুষেরাই এমন বিধ্বংসী সিদ্ধান্তের জন্য মূলত দায়ী’—এ ধরনের বয়ান তৈরি মাধ্যমে সার্বিকভাবে আমেরিকার দায়মুক্তির একটি চেষ্টা হিসেবে দেখতে পারি।

কেননা, পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তী ভয়াবহতার দিকটি দৃশ্যায়ন না করে কেবল সে–সম্পর্কিত ব্যক্তি ওপেনহাইমারের আক্ষেপ, অনুতাপ ও মানসিক জটিলতার দিকটি দৃশ্যায়ন করা হলো এখানে। এটি কেন করা হয়েছে? এখন কোনো দর্শক যদি বলতে চান, সিনেমাটি রাজনৈতিক ন্যারেটিভ বা বয়ান নির্মাণের জন্য নির্মিত হয়নি, বরং এখানে সবকিছু ছাপিয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ব্যক্তি ওপেনহাইমারের জীবনী, তাঁর আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ, সে ক্ষেত্রেও এ প্রশ্নগুলোকে অস্বীকারের সুযোগ নেই। কারণ, এ ছবিতে কেবল ব্যক্তি নন, দেখানো হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য।

ব্যক্তি ওপেনহাইমারকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে নোলান নিঃসন্দেহে শতভাগ সফল! তার জন্য তাঁকে বাহবাও দেওয়া যায়। তবে হলিউড যে তার চিরাচরিত রূপ থেকে এ সিনেমায়ও বের হতে পারল না এবং সিনেমাটিকেও আমেরিকার দায়মুক্তির হাতিয়ার করে তুলল, এ বিষয় যেমন সিনেমাটি দেখার সময় আমাদের মনে পড়ে, তেমনি কেন হলিউড এমন করে, তা নিয়েও ভাবনা আসে।