বন্ধুরা সবাই তখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকছে। আমার এইম ইন লাইফ অন্ধকার। সকাল–বিকেল টিউশনি করি আর রাত দশটার পর ভিসিডি বা ডিভিডি ভাড়া করে একটার পর একটা হলিউড-বলিউডের সিনেমা দেখি। এভাবেই কাটছিল দিন।
যে দোকান থেকে ডিভিডি ভাড়া আনতাম, সেই দোকানের মালিকের সঙ্গে খাতির জমে গেল। নাম সহদেব মহাজন। একদিন ভরা দোকানে সবার মাঝখান থেকে তিনি হাত ধরে আমাকে তাঁর কাউন্টারের ভেতরে নিয়ে গেলেন। চাঁটগাইয়া ভাষায় বললেন ‘কী আজেবাজে ছবি দেখে সময় নষ্ট করিস, ভালো কিছু দ্যাখ।’ এই বলে একটা ছোট্ট কার্টনের দিকে ইশারা করলেন। খুলে দেখলাম সব উদ্ভট বিদেশি ভাষার ছবি। ভাড়া করে এইসব ছবি তো আমি দেখবই না। তিনি বললেন, ‘ভাড়া লাগবে না, নিয়ে দ্যাখ। ঢাকা থেকে তোর জন্য নিয়ে আসছি।’
দেখা শুরু করলাম। প্রথম ছবিটা ছিল সিনেমা পারাডিসো। তারপর দেখলাম সেই সময়ে সদ্য মুক্তি পাওয়া ইনারিতুর ছবি আমেরোস পেরোস। এরপর ব্রেথলেস, সিনস ফ্রম আ ম্যারেজ, টেস্ট অব চেরি, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ইভানস চাইল্ডহুড, ই তু মামা তাম্বিয়েন, মেঘে ঢাকা তারা। নেশা ধরিয়ে দিল এইসব ওয়ার্ল্ড সিনেমা। আমার ছবি দেখার টেস্ট বদলে গেল। সহাদেবদাও শুধু আমার জন্যই ঢাকা গেলে এসব ছবি নিয়ে আসতেন। দেখতে দেখতেই টের পেলাম, আমি আসলে চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চাই। মাথায় এই পোকা হয়তো জ্ঞানত অথবা অজান্তেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন সহাদেব দা। তিনি আজ বেঁচে নেই। কলেরায় মাত্র ৩৭ বছর বয়সে অকালমৃত্যু হয় তাঁর।
নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও জানতাম এই স্বপ্ন আকাশকুসুম। অদম্য ইচ্ছা থাকলেও তখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে ফিল্মমেকিং শেখার বা করার কোনো রাস্তা আমার জানা নাই। আমার বংশে ফিল্মমেকার তো দূর, সংস্কৃতিচর্চা করেন এমন কেউ নেই। বন্ধুরা চাকরিবাকরি করে উন্নতি করছে, মা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তখনো সন্দিহান।
এমতাবস্থায় একদিন দেয়ালে একটা পোস্টার দেখলাম। ঢাকা থেকে স্ক্রিপ্টরাইটিং ও ফিল্মমেকিংয়ের দুই দিনব্যাপী কর্মশালা করাতে আসবেন সেই সময়ের টিভি ফিকশনের তুমুল জনপ্রিয় জুটি—আনিসুল হক ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফারুকী ভাই তখনো তাঁর প্রথম সিনেমা ব্যাচেলর বানাননি। আসনসংখ্যা সীমিত। ৫০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। দুরুদুরু বুকে খাতা–কলম নিয়ে হাজির হলাম চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে।
১০টায় শুরু হওয়ার কথা। ১১টা পর্যন্ত তাঁদের কোনো খবর নেই। সঙ্গে থাকা অন্যরা যারপরনাই বিরক্ত। কানাঘুষা চলতে লাগল, এসব ওয়ার্কশপ আসলে ফাউ। কোনো লাভ হয় না এসব করে।
আমি ধৈর্য হারালাম না। অবশেষে তাঁরা এলেন। আশা করেছিলাম খদ্দরের পাঞ্জাবি–পাজামা পরা কোনো লেখককে। আনিসুল হক এলেন জিনস, টি–শার্ট পরে। আর ফারুকী সাহেব একটা শার্ট আর বাসায় পরার ট্রাউজার।
শুরু হলো ওয়ার্কশপ। আনিসুল হক স্ক্রিপ্টরাইটিংয়ের সকালের সেশন কোনোরকমে শেষ করলেও মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর ফারুকী সাহেবের দেখা নেই। জানা গেল, তিনি ফয়’স লেকে বেড়াতে চলে গেছেন। সবাই মহা বিরক্ত। দেরি করে এসে ফারুকী ভাই আব্বাস কিয়ারোস্তামির একটা ছবি চালিয়ে দিয়ে আবার উধাও। আমার তখন ফিল্ম মেকিংয়ের জীবন–মরণ আশা শেষ হওয়ার ঝুঁকিতে। সাহস করে প্রথম দিন শেষে আয়োজকদের অভিযোগ করলাম। এই অভিযোগের ভিত্তিতে কি না জানি না, পরদিন দুর্দান্ত ওয়ার্কশপ করালেন আনিসুল হক ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এত দিন ছবি দেখে যা যা ভাবতাম, সেটারই বহুমাত্রিক ব্যবচ্ছেদ করে দেখালেন তাঁরা। মনে হলো ফিল্মমেকিংয়ের নার্সারি থেকে একেবারে ক্লাস থ্রিতে উঠে গেলাম।
কর্মশালা শেষে শিল্পকলার মাঠে আড্ডা দিচ্ছিলেন আনিসুল হক, ফারুকী ভাই। সবাই গিয়ে তাঁদের নানা জ্ঞানগর্ভ প্রশ্ন করছেন, তাঁরাও উত্তর দিচ্ছেন। আমি আর একটা ছেলে দূরে দাঁড়িয়ে আছি সংকোচে। জেলা শহরের সংকোচ। ছেলেটা আর কেউ না। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন সাধু। কোনোমতে সাহস সঞ্চয় করে একাই গেলাম সামনে। আনিসুল হকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে করতে নিজেকে সাহস দেওয়ার জন্যই কি না জানি না, অতি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে ফেললাম, ‘একদিন আপনি আমাকে চিনবেন।’ ফারুকী ভাইয়ের সঙ্গে হাত মেলানোর সাহস হলো না। শুধু কাছে গিয়ে বললাম, ‘একদিন আমিও আপনার মতো ফিল্মমেকার হব।’ হয়তো ভাবলেন পাগলের প্রলাপ। তা-ও বিনয়ের সঙ্গে ফারুকী ভাই বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই।’ তখনো কি আর দুজনের কেউই জানতাম, পরের ৫ বছর ঢাকায় একই ছাদের নিচে আরও কিছু তরুণ, উদ্যমী ছেলের সঙ্গে আমিও থাকব তাঁর সঙ্গে, তাঁর ছবিয়াল টিমের একজন হয়ে, এবং তাঁরই প্রযোজনায় নিজের প্রথম টিভি ফিকশন বানিয়ে?