‘মনোগামী’র মধ্য দিয়ে ফারুকী আসলে যা বলতে চান
চরকিতে চলছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ওয়েব ফিল্ম ‘লাস্ট ডিফেন্ডার অব মনোগামী’। চাঁদরাতে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে কী বলতে চেয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী?
‘টকিং স্টেজ’, ‘ব্রেডক্রাম্বিং’, ‘সিচুয়েশনশিপ’—সম্পর্কের নতুন নতুন অভিধা আজকাল দেখতে পাই। স্মার্টফোন পকেটে নিয়ে বেড়ে ওঠা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্কের নোঙর টানা ‘জেন-জি’রা (১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাঁদের জন্ম) প্রেমকে ‘মনোগামী’ ও ‘পলিগামী’র দ্বৈততায় আর বাঁধেন না। কিন্তু ‘বুমার’ (১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে যাঁদের জন্ম) আর ‘মিলেনিয়াল’রা (১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যাঁদের জন্ম) সম্পর্কের সূত্র মেলান একরৈখিকভাবে। সেটাই আবার মনে করিয়ে দিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁর ‘মনোগামী’তে।
‘দ্য লাস্ট ডিফেন্ডার্স অব মনোগামী’—নামের মধ্যেই ইঙ্গিত রয়েছে গেল শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকের মূল্যবোধের রক্ষকদের প্রতি। ‘ডিজাইয়ার’ বা আকাঙ্ক্ষা বরাবরই ফারুকীর প্রিয় বিষয়বস্তু। এর নানা রং নিয়ে তিনি খেলতে পছন্দ করেন। যে আকাঙ্ক্ষা মনোগামী বা এক পুরুষ/নারীর প্রতি বিশ্বস্ততার পাত্র ছলকে বেরিয়ে আসছে, সেটা নিয়ে করণীয় কী? বিতর্কিত ও জটিল অনুভূতির এ ক্ষেত্রেই ফারুকী বিচরণ করেন। টোকা দেন মানবমনের অবদমনের দরজায়। তীর্যক হাস্যরসের আড়ালে হালকা অস্বস্তিও কি তৈরি করেন?
ওটিটির যুগে চলচ্চিত্র-দর্শনের সংজ্ঞা অনেকটাই পাল্টে গেছে। বড় পর্দা থেকে ছোট পর্দার আধেয় বা ‘কনটেন্ট’-এ রূপ নিয়েছে চলচ্চিত্র, আর তা দেখার অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে আরও ব্যক্তিগত। ৮০ মিনিটের ‘মনোগামী’ তাই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বা রোজকার জীবনের চেয়ে বাড়তি কোনো অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটু বেশিই জীবনঘনিষ্ঠ। আমরা আমাদের চারপাশে অহরহই এমনটা ঘটতে দেখি, কখনো মুখ টিপে হাসি, কখনো কটাক্ষ করি, কখনো আবার চেপে যাই। কিন্তু যেটা করি না তা হলো, এর পেছনের সামাজিক অবদমন, বিচ্যুতি, বিদ্বেষ ও বেদনার বিষয়টা বোঝার চেষ্টা। একজন চল্লিশোর্ধ্ব সফল ব্যক্তি—যিনি স্বামী ও বাবা—আকাঙ্ক্ষা আর অপরাধবোধের জালে আটকে ছটফট করছেন। এই ‘আকাঙ্ক্ষা’ একজন পরনারীর প্রতি। ‘মনোগামী’ ছবির কয়েকটি দৃশ্য ও সংলাপেই ক্ষমতাকাঠামোয় কার অবস্থান কী, তা প্রতিষ্ঠিত হয়। অধীনস্ত নারী কর্মীটির চাকরি পাকা হওয়ার ভেতর দিয়েই গল্পের শুরু। সপ্রতিভ, বুদ্ধিমতী, সুশ্রী তরুণী এই কর্মী চল্লিশোর্ধ্ব বসকে নিজের ‘আইডল’ হিসেবে প্রকাশ করেন। এরপরই আচমকা বস এমন এক কাণ্ড করে বসেন, যা তাঁর দৃঢ়তার বাধ ভেঙে দিয়ে পাশার ছক উল্টে দেয়। এরপরই ক্ষমতাকাঠামোয় নারীটি ওপরে উঠে আসেন।
পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা হয় অনেক, কিন্তু সেই পথগুলো এখনো ঘোরানো-প্যাঁচানো। নারীকে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে আকর্ষণীয়, কিন্তু ‘শোভন’ভাবে উপস্থাপন করতে হবে, পুরুষের কর্তৃত্বের দায়রা ভাঙা চলবে না, পুরুষের নির্ধারিত নিয়মের গণ্ডির মধ্যেই করতে হবে ঘোরাফেরা। সেই নারীর সামনে কর্তৃত্বপরায়ণ পুরুষটি যখন নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেন, পুরুষালি গাম্ভীর্য ও দৃঢ়তা ভেঙে কান্নায় ভেঙে পড়েন, তখন সে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। হালকা ফ্লার্টেশনের বাইরে গিয়ে তার প্রতি আলাদা নৈকট্য অনুভব করেন ওই নারী। ধীরে ধীরে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মজাটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে থাকেন তিনি। এখানে ‘এমপাওয়ার্ড মিলেনিয়াল’-এর বিষয়টা চমৎকারভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন জেফার। আর কৌতুক ও হাস্যরসের ভেতর দিয়ে ফারুকী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আমাদের সামষ্টিক অবচেতনে প্রোথিত নারীবিদ্বেষের রূপ। বেকার যে তরুণের সংসার টিউশনি করে চালিয়েছে তার স্ত্রী, একই সঙ্গে করেছে সন্তান প্রতিপালনও, তার প্রতি আনুগত্য দেখালেও প্রেমটা আর আসে না। জীবনসংগ্রামে অনেকটাই জয়ী হওয়ার পর পুরুষটি নতুন প্রেমের খেলায় উত্তেজনা খোঁজে। তবে নিজেকে তার ‘ভালো মানুষ’ প্রমাণের ইচ্ছাটাও প্রবল। সেই সঙ্গে নারীর ছোট পোশাক না পরা, একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রেম, সম্পর্কে লাগাম টানা বা ব্যক্তিস্বতন্ত্রতার চর্চার মতো বিষয়গুলোকে যে বাঁকা চোখে দেখা হয়, ‘মনোগামী’তে সেটাও সুকৌশলে বুঝিয়ে দেন ফারুকী। স্বামীর বিচ্যুতি আর অজুহাতের ঝড়ের সামনে স্ত্রীর সংসারের মায়াটাই প্রবল হয়ে ওঠে। সংসার মানে তো শুধু প্রেম বা দুটি মানুষের একসঙ্গে থাকা নয়, অনেক দিনের স্মৃতি, ভালোবাসা আর বেদনার বিনিয়োগ।
তবে যাপিত জীবনের ক্লান্তি ছাপিয়ে একটু উত্তেজনা খোঁজার রাজা-উজিরের খেলায় উলুখাগড়া হয়ে পড়ে দুটি শিশু। এখানে যে পরিচালক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, তার তারিফ করতেই হয়। যে কোনো দাম্পত্য সম্পর্কের ফাটল বা সংঘাতে সন্তানদের জলদি বড় হয়ে উঠতে হয়, বড়দের মতো ভাবতে শিখতে হয়। তাদের এই সমঝদারির মধ্যে যে বেদনা লুকানো থাকে, তা সত্যিই হৃদয়বিদারক।
বলা দরকার, এ সিনেমার মাধ্যমে ফারুকী আমাদের যা দেখান, তা সমাজের বাস্তবতার বাইরের কিছু নয়। এই মহানগরে এমন ঘটনাও ঘটে থাকে। কিন্তু প্রচলিত ‘মূল্যবোধ’সহ সামাজিক নানা কারণে আমরা বিষয়গুলো সামনে আনি না। ‘মনোগামী’র মধ্য দিয়ে পরিচালক আমাদের সমাজের এসব বিষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখান, না, এ সমাজ শুধু সাদা-কালায় বিভক্ত নয়, এর বাইরেও রং আছে।
এ সিনেমার মাধ্যমে ফারুকী আমাদের যা দেখান, তা সমাজের বাস্তবতার বাইরের কিছু নয়। এই মহানগরে এমন ঘটনাও ঘটে থাকে। কিন্তু প্রচলিত ‘মূল্যবোধ’সহ সামাজিক নানা কারণে আমরা বিষয়গুলো সামনে আনি না। ‘মনোগামী’র মধ্য দিয়ে পরিচালক আমাদের সমাজের এসব বিষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখান, না, এ সমাজ শুধু সাদা-কালায় বিভক্ত নয়, এর বাইরেও রং আছে।
এবার আসি নির্মাণের প্রশ্নে। ফারুকীর সিনেমার বয়ান ও বুনন—দুই ক্ষেত্রেই নিজস্বতা রয়েছে বলে মনে করি। সেই স্বকীয়তার সম্পূর্ণ প্রকাশই এই ‘মনোগামী’ সিনেমায় ঘটেছে। একটি গোপন সম্পর্কের চিত্রায়ন তিনি এমনভাবে ঘটিয়েছেন, যেন দর্শকের মনে হয় চরিত্র দুটির চুরি ধরে ফেলেছেন তিনি। চঞ্চলের কাচে বাড়ি খাওয়া বা হোটেলকক্ষে ভিডিও কলে কথা বলার দৃশ্য দুটি চমৎকার। কিন্তু একটি ‘কালোত্তীর্ণ’ সিনেমা দেখার মনোভঙ্গি নিয়ে ‘মনোগামী’ দেখতে বসলে আপনি হতাশ হবেন। শেষে বলার কথা এই যে ‘ব্যাচেলর’-এর মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নির্মাণ যদি আপনার পছন্দ হয়ে থাকে, তবে এ সিনেমা আপনার ভালো লাগবে। কারণ, নব্বইয়ের দশকের মূল্যবোধ নিয়ে যাঁরা বড় হয়েছেন, এই ছবি তাঁদের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হবে। আর ছবিটির ‘ন্যারেটিভ’ বা বয়ান পরতে পরতে লুকানো রোজকার ক্লান্তি আর বেদনা আমাদের এতই চেনা! আগেই বলেছি, জেফারকে ভালো লেগেছে। চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে সমানতালে অভিনয় করেছেন তিনি; এবং শুদ্ধ ও রাই—দুটি চরিত্রও এত চমৎকার! সব মিলিয়ে আমার কাছে ৮০ মিনিটের ‘মনোগামী’ হলো, খেল খতম, পয়সা হজম!