শ্র দ্ধা: শহীদ আখন্দ
তাঁর গল্পের ভুবন
৪ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক শহীদ আখন্দ। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখায় চোখ ফেরানো হয়েছে তাঁর গল্পের জায়গাজমির দিকে
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ বাংলা সাহিত্যের জগৎ হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাস নিয়ে মাতোয়ারা ছিল। ইত্যবসরে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখের সজোর প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। তাঁরা হুমায়ূন আহমেদের প্রতাপশালী অস্তিত্ব পাশ কাটিয়ে নিজস্বতার শক্তিশালী পরিসর তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে আমরা কয়েকটি নাম ভুলে গেছি, যাঁরা স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে কথাসাহিত্যের শিলান্যাসকারীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বশীর আল্হেলাল, আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, শহীদ আখন্দ, ফিউরী খন্দকার প্রমুখ। ১৯৭০-৮০–এর দশকে পত্রিকার সাহিত্যের পাতা খুললেই তাঁদের কারও না কারও গল্প পড়া হয়ে যেত। একই সময়ে ইমদাদুল হক মিলনের আবির্ভাব এবং সজোর উত্থান। প্রায় অভিন্ন সময়ে কবি আল মাহমুদ তাঁর বিস্ময়কর গল্পগুলো লিখেছেন।
এসব ইতিহাস সর্বজনবিদিত হলেও বাংলা কথাসাহিত্যের অনেককে আর আমরা মনে করি না। তাঁদের বই পাওয়াও দুষ্কর। বিস্মরণের এই দায় পাঠকের নয়; বরং তা সাহিত্যসমালোচক ও পুস্তক প্রকাশকদের ওপর সমানভাবে বর্তায়। সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক শহীদ আখন্দ এমনই একজন। ইবনে ইসহাক বিরচিত সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) অনুবাদ করে খ্যাতিমান হয়েছিলেন তিনি।
শহীদ আখন্দের জন্ম ১৯৩৫ সালে। ৪ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেছেন। জীবিকাসূত্রে তিনি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, অবসর নিয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ পড়ার সময় সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, গীতিকার মনিরুজ্জামান, হাসনা বেগম ও রাজিয়া খাতুনকে। তাঁর পুরো নাম মোহাম্মদ আবদুস শহীদ আখন্দ। তবে ‘শহীদ আখন্দ’ নামে লিখতে শুরু করেন ষাটের দশকে।
দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন তিনি; কিন্তু অসুস্থতা তাঁকে মৃত্যুর পূর্বাবধি প্রায় তিন দশক নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। ২০২৪ সালের বইমেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনা সংস্থা একটি গল্প সংগ্রহ প্রকাশ করে, যার প্রচ্ছদ–শিরোনাম প্রিয় ১৫ গল্প। সম্ভবত লেখকের নিজেরই বাছাই করা গল্পগুলো এই সংকলনে নেওয়া হয়েছে।
প্রথম গল্পের নাম ‘ভাসমান’, যার শুরুতেই আছে স্থান–কালের নিশানা: অক্টোবর ১৯৭৪, ঢাকা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরবর্তী কয়েক বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ছিল অস্থির। ওই সময়ের সামাজিক পরিস্থিতির সূক্ষ্ম চিত্র এই গল্প। একই সঙ্গে বোঝা যায়, শহীদ আখন্দ নাটকীয় ভঙ্গিতে গল্প শেষ করেন পাঠকের জন্য চমক সৃষ্টি করে। লক্ষ করা যায়, মানুষের জীবনের অসহায়ত্ব তাঁর লেখার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। সমসাময়িক প্রতিবেশ ও অভিজ্ঞতা তাঁর গল্প-উপন্যাসের উপজীব্য। বিভিন্ন পরিবেশে নিঃস্ব বা নিঃসহায় মানুষের কাহিনি তিনি উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে।
এ সংকলনের আরেকটি গল্প ‘সেই লোকটা’। গল্পটি ১৯৭১ সালের ঘটনা নিয়ে, বলদর্পী মানুষের কাছে শক্তিহীন মানুষের পরাজয় নিয়ে। গল্পটির শুরুতে সেলুনে চুল কাটাচ্ছে গল্পের নায়ক। আয়নায় চোখে পড়ে পাশের চেয়ারে বসে থাকা আরেকজন মানুষের মুখাবয়ব। সে–ও এসেছে চুল কাটাতে। এই মুখ নায়কের পরিচিত। কয়েকবার তাকিয়ে নায়ক নিশ্চিত হয়, লোকটিকে সে যথাযথভাবে চিনতে সক্ষম হয়েছে। এই সেই লোক, যার কাছে ধর্ষিত হয়েছিল তার প্রেমিকা নাসিমা। নাসিমাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিল। নায়ক ওর খোঁজে আসে। বাসায় নাসিমা একা। নায়ক দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে নাসিমার পাশে থাকে। লোকটি টের পেয়ে গিয়েছিল, এ অন্ধকার বাসায় কেউ থাকে। তারপর একদিন রাতে সে আসে। লাথি খেয়ে নায়ক বাইরে ছিটকে পড়ে। নাসিমা ছুটে দরজা দিয়ে পালাতে গেলে লোকটি তাকে ধরে নিয়ে আসে।
এ ঘটনার পর পাঠক দেখে, চুল কাটা শেষ হলে লোকটি সেলুন থেকে বের হয়ে গিয়ে গাড়িতে ওঠে। নায়কের উঠতে একটু দেরি হয়। তার নাকের ডগা দিয়ে ধর্ষক ব্যক্তিটির গাড়ি ছুটে চলে যায়। স্বাধীন দেশেও নায়ক কিছু করতে পারে না।
‘অসুস্থ দরোজা’ একটি আধুনিক গল্প। গল্পটি ট্রেনের বগির দরজা নিয়ে। ট্রেনে উঠতেই কেউ একজন বিশ্রী চিৎকারের ভাষায় বলে উঠল, ‘দরজা বন্ধ করবেন না। খবরদার, দরজা বন্ধ করবেন না। দরজা বন্ধ করবেন না, দরজা...’
ট্রেনের দরজা কেন বন্ধ করা যাবে না? সবার মনে এ প্রশ্ন জেগে ওঠে।
পরের স্টেশনে বেশ কয়েকজন যাত্রী হুড়মুড় করে উঠে পড়ে বগিতে। তাদের একজন বলে, ‘দরজাটা বন্ধ করে দিই, ঝড় আসবে।’
আবার সেই কণ্ঠ, ‘খবরদার, দরজা বন্ধ করবেন না।’
নবাগত যাত্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
উত্তর আসে, ‘বললাম তো। দরজা বন্ধ করবেন না।’
কেন? কারণটা বলতে পারেন না?
একজন যাত্রী গল্পের কথকের দিকে ঝুঁকে পড়ে কানে কানে বলে, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো? দরজার সঙ্গে বোমাটোমা বাঁধা আছে নাকি যে বন্ধ করলেই ফেটে যাবে?’
বললাম, কী জানি!
আপনি জানেন না?
না।
তো বন্ধ করতে নিষেধ করলেন কেন?
সবাই বলছে তাই।
একপর্যায়ে এক যাত্রী জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা বলুন তো দরজাটা বন্ধ করতে প্রথমে কে বারণ করল?’
অন্যদিক থেকে উত্তর আসে, ‘দরজা বন্ধ করার জন্য আপনি এত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন মশাই, সেটা বলুন না আগে! আপনার ব্যাগভর্তি টাকা বুঝি? চোর–ডাকাতের ভয়?’
এভাবে যাত্রীদের মধ্যে নানা কথাবার্তা ও মত–দ্বিমত চলে এবং একটা রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তখন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, বয়স কত হবে সেই মেয়েটির—১৬ কি ১৭। কী সুন্দর চেহারা। ভরা যৌবন। নজরকাড়া স্বাস্থ্য। চোখ ফেরানো যায় না মুখের ওপর থেকে। মাত্র বিয়ে হয়েছে বোধ হয়, ফিরতি বারে যাচ্ছিল স্বামীর ঘরে। চোখেমুখে তৃপ্তির ছাপ। মেয়েটির গন্তব্য স্টেশনে এসে ট্রেন অল্পক্ষণ থামবে; কিন্তু দরজা বন্ধ। চাবি দিয়ে আটকানো। একদম বন্ধ। এখন কী করবে সে? বগির অন্যদিকে গেল। ওদিকেও তা–ই। দরজা বন্ধ। তালা মারা। অথচ ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। অস্থির হয়ে গেল মেয়েটি। তখন সঙ্গের লোকটি বলল, ‘জানালা দিয়ে বের হয়ে নেমে যাও। জানালা দিয়ে বের হও; আর কোনো উপায় নেই।’ সে মেয়েটিকে একটু তুলে ধরল; কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। মেয়েটি চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর ছিটকে পড়ল। একমুহূর্তে তার রক্তে প্ল্যাটফর্মের সুরকি–কাঁকর লাল হয়ে গেল। দ্বিখণ্ডিত মাথার খুলি থেকে বেরিয়ে এল লালচে সাদা মগজ।
আশ্চর্য! যিনি এই ব্যাখ্যা দিলেন, তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নন, সাক্ষীও নন।
আগে কোনো একদিন এই ট্রেনে এই কম্পার্টমেন্টে ভ্রমণ করার সময় তাকে একজন সহযাত্রী এই দায়িত্ব দিয়েছিল, তিনি যেন কাউকে দরজা বন্ধ করতে না দেন। সে দায়িত্ব তিনি পালন করে যাচ্ছেন।
এভাবেই চলছে। এই ট্রেনের নিয়মিত যাত্রীরা ঘটনাটা জানে। কেউ প্রত্যক্ষদর্শী নয়; কিন্তু স্টেশনে গাড়ি থামলে কারও যাতে নামতে সমস্যা না হয়, সে জন্য কেউ না কেউ চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘হুঁশিয়ার, দরজা বন্ধ করবেন না।’
‘অসুস্থ দরোজা’ শিরোনামের উপর্যুক্ত গল্পটি বিশ্বমানের একটি গল্প। যদিও কাহিনি গঠনে ও ধারাবর্ণনায় আরও সচেতন হওয়ার সুযোগ ছিল, প্রয়োজন ছিল বাক্যগুলো আরও সুগঠিত করার, তবু এ গল্পের আবেদন অনস্বীকার্য। শহীদ আখন্দ সত্তরের বেশি বই অনুবাদ করেছেন। তাঁর গল্প ইংরেজিতে অনুবাদের দাবি রাখে।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে যাঁরা আলোচনা-সমলোচনা করেন, তাঁদের প্রতিন্যাসে প্রত্যক্ষ হয় বিশ্বসাহিত্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগ। বিশ্বসাহিত্যের প্রতি অনুরক্তি কোনো অপরাধ নয়; কিংবা দোষের কিছু নয়; কিন্তু তার বিনিময়ে দেশের সাহিত্য অবহেলিত হয়ে পড়বে, এটা প্রত্যাশিত নয়। বলা দরকার, সাহিত্য শুধু বিনোদনের উৎস নয়, দেশ ও সমাজের প্রতিফলনও বটে। সমসাময়িক কালের মর্মগাথা রচিত হয় দেশেরই লেখকদের কলম থেকে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অবক্ষয়ের শিকার সমাজ ও মানুষের যে আচার-আচরণ আমরা লক্ষ করেছি, শহীদ আখন্দ ও সমসাময়িক কথাসাহিতি৵কদের রচনায় সেগুলো কখনো স্পষ্টভাবে, কখনো আকারে–ইঙ্গিতে ফুটে উঠেছে। তাঁদের সাহিত্যসত্তা প্রেম ও দ্রোহের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। এটাও পর্যবেক্ষণ করার মতো বিষয় যে শহীদ আখন্দের লেখায় আমরা বিদেশি সাহিত্যের অনুরণন প্রত্যক্ষ করি না। অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীতে জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে অনেক কথাসাহিত্যিক জেমস জয়েস, ফ্রানৎস কাফকা, আলবেয়ার কামু, গার্সিয়া মার্কেস প্রমুখের দ্বারা নিবিড়ভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন।
এ–ও লক্ষণীয় যে শহীদ আখন্দকে প্রভাবান্বিত করেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিজস্ব একটি লেখনীশৈলী ছিল, গল্প বলার বিশেষ একটি ঢং ছিল, যা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। তাঁর গল্পগুলো ঘটনাকেন্দ্রিক; কিন্তু তার মধ্য দিয়েও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের চরিত্র ও আচরণের বৈশিষ্ট্যাবলি। চারপাশের জীবন থেকেই তিনি সংগ্রহ করেছেন কাহিনির উপাদান।
উপন্যাসের অবারিত পরিসরে একজন মানুষের চালচরিত্রের নানা স্তর উন্মোচনের অবকাশ রয়েছে। নায়কের চিন্তা ও প্রতিচিন্তার মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার মানবসত্তার জটিলতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলা যায়। ছোটগল্পের সীমিত পরিসরে কোনো গূঢ় বিষয় বিশদ করে বলা যায় না, হয়তো ইঙ্গিত করাযায় মাত্র। তবু শহীদ আখন্দের গল্পে আমরা পাই মানবজীবনের অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতার স্পর্শ। শওকত ওসমান, আবু রুশদ, শাহেদ আলী, আবু ইসহাক, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, জহির রায়হান, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ হায়দার প্রমুখের হাতে ষাটের দশকের মধ্যে বাংলা কথাসাহিত্য একটি বিশেষ অবয়ব লাভ করেছিল। শহীদ আখন্দ তাঁদের অব্যবহিত উত্তরসূরি। তাঁদের আলোচনা ছাড়া বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারে না।