জন্মশতবর্ষে সুলতান
জন্মদিনে বিড়াল লাফ দিল এস এম সুলতানের ঘাড়ে!
আজ ১০ আগস্ট শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মদিন। ১৯২৩ সালে নড়াইলে জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি চিত্রকরের আজ জন্মশতবর্ষ। ভিন্নধর্মী ছবি আঁকা ও জীবনযাপন—সব মিলিয়ে মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি। তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে সুলতান ধরা পড়ে আছেন বাংলার কৃষিপদ্ধতির আদি জীবনব্যবস্থায়। এই মহান শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখায় ধরা থাকল এস এম সুলতানের বৈচিত্র্যময় এক জন্মোৎসব উদ্যাপনের স্মৃতি, যেখানে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে সারা দিনরাত ধরে শুধু সানাই বেজেছিল।
সারা রাত সানাই বেজেছে। সারা রাত সানাইয়ের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছে। মাছিমদিয়া তো বটেই, নিশিনাথতলা, চিত্রার শতবর্ষী বাঁধাঘাটের জলমগ্ন সিঁড়ি, রূপগঞ্জ ভিক্টোরিয়া কলেজের মাঠেও ঘুরে ঘুরে হেঁটেছি আমরা, শুনেছি সানাই। আমরা কি সানাই শুনতেই নড়াইলে এসেছি? না। আমরা কি চিত্রায় ভেসে যাওয়া জলে ভাসতে এসেছি? না। আমরা কি কোনো বিয়েবাড়িতে এসেছি? তা-ও না। তাহলে?
আমরা এসেছি একটি জন্মদিনের উৎসবে। কিন্তু এ রকম জন্মদিন আগে কোনো দিন হতে দেখিনি, বইয়েও পড়িনি এমন কোথাও হয়। যদিও এমনই হচ্ছিল, আমাদের চোখের সামনে। সানাই বাজছে সারা রাত—এ-ও হয়? হচ্ছিল তখন। মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া কাকে বলে? পড়ি তো তখন প্রাক্-বিএফএ, খুলনা আর্ট কলেজে। বন্ধুরা দল বেঁধে নড়াইলে এসেছি। উদ্দেশ্য, জন্মদিনের উৎসব দেখা। কাকুর জন্মদিন। দুলালদা তাঁকে ‘কাকু’ নামে ডাকেন বলে আমরাও কাকু বলেই ডাকি। কে এই কাকু?
শেখ মোহাম্মদ সুলতান। এস এম সুলতান নামেই বেশি পরিচিত তিনি। ডাকনাম লাল মিয়া।
খাবার টেবিলে একসঙ্গে কাকুর সঙ্গে খেতে বসেছি। বাড়িতে অনেক বিড়াল। একটা বিড়াল লাফ দিয়ে উঠে গেল কাকুর ঘাড়ে। কাকু একটি মাছ দিলেন টেবিলের ওপরে, বিড়াল খেতে শুরু করল। কাকু বললেন, ‘এর নাম জাহাঙ্গীর। ওই বিড়ালের নাম দারাশিকো। ওইটা শাজাহান। ওইটা বাবর। আর ওই বিড়াল আওরঙ্গজেব।’ সব বিড়ালের নামই মোগল বাদশাহদের নামে। বাহ! আমি তাহলে মোগল বাদশাহর বাড়িতেই এসেছি? সুলতান কাকুর বাড়ি কি মোগল বাদশাহর বাড়ি?
নড়াইলরেই কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা ‘লাল বাউল’ সম্প্রদায় সারা রাত সানাই বাজিয়েছে। লাল বাউলের বাদক-শিল্পীরাও এস এম সুলতানকে কাকু নামেই ডাকছিল। আমাদের তখন তুমুল অপেক্ষা, সকালে কী হয়! আর্ট কলেজের ছাত্র হওয়াতে অবশ্য উৎসাহ একটু বেশিই, নইলে জন্মদিনের আগের দিনই খুলনা থেকে নড়াইল চলে আসি নাকি? শুধু কি আমরাই এসেছি বাইরে থেকে? সকালবেলায় দেখলাম বাড়িভর্তি লোক। বাড়ি বলতে সুলতান কাকুর বাড়ি। বাড়িতে থাকেন নীহার বালা দেবী। নীহার বালা দেবী সুলতান কাকুর পালিতা কন্যা। নীহার বালাই সুলতানের দেখাশোনা করেন, জানতাম, নিজের চোখেও দেখলাম। এই নীহার বালা দেবীর দুই কন্যা—পদ্ম ও বাসনা। তাঁদের সুডৌল স্তনের দিকে তখন তাকিয়েছি। সুলতানের ক্যানভাসেও সে রকম পুরুষ্টু স্তনের জেলেনি-কিষানি দেখি আমরা। নীহার বালা দেবীর এক পুত্র—দুলাল। তিনি পড়তেন খুলনা আর্ট কলেজে, আমাদের দুই ক্লাস সিনিয়র। দুলাল আর চিত্রাপাড়ের শিল্পী সমীর মজুমদার বা কাজল মুখার্জি—তাঁরা বন্ধু। নড়াইল থেকে আসতেন খুলনায়।
খুলনা আর্ট কলেজের পাশেই একটি বাড়িতে তাঁরা ভাড়া থাকতেন। কাজল মুখার্জি ছবি আঁকার পাশাপাশি চমৎকার তবলা বাজাতেন। মাটির মানুষ। সমীর মজুমদার ধোপা-লন্ড্রির পারিবারিক কাজে সময় দিলেও দারুশিল্পে অসাধারণ ভাষা তৈরি করেছেন। কাঠ তাঁর হাতে কথা কয়। দুলাল ক্যানভাসে কাজ করেন বেশি, সুলতান কাকুর ক্যানভাস তৈরিতে সহযোগিতা করেন। ব্রাশ-প্যালেট পরিষ্কার করা, তারপিন তেল ঢেলে দেওয়া, রং ঢেলে দেওয়া—এসবে দুলালদা বলা চলে সুলতান কাকুর সহকারীও বটে। তাঁরা সবাই সুলতানের মর্মপুত্র। দুর্ভাগ্য, দুলাল ও কাজল মুখার্জি অতিদ্রুত মারা গেলেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমরা কত ঘনিষ্ঠ—আজও স্মৃতির মধ্যে জেগে আছেন। তো কাজল মুখার্জি, সমীর মজুমদার ও দুলাল—সুলতান-সান্নিধ্যের এই তিন তরুণ শিল্পী খুলনা আর্ট কলেজের ছাত্র, আমিও ছাত্র।
অনেকটা সেই সূত্রেই নড়াইলে বেশি যাওয়া-আসা ছিল আমাদের বা আমার। তাই গতকাল নড়াইলে এসেছি। সুলতান কাকুর জন্মদিন, সুলতান কাকুর বাড়িতেই উঠেছি গতকালও, আগেও যেমন উঠেছি।
সারা রাত বন্ধু মোর্তোজার সঙ্গে ঘুরেছি ভিক্টোরিয়া কলেজের মাঠ, চিত্রার বাঁধাঘাট, নিশিনাথতলার আশপাশের ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে। আমরা কি তখন সন্ধ্যার পর জোনাকি হতে পারতাম? নইলে সারা রাত ঘুরতাম কী করে? ঝিনাইদহ সেই শহর, যেখানে আমি সারা রাত রাস্তায় ঘুরতাম। খুলনা সেই শহর, যেখানে সারা রাত ঘরে ফিরতাম না। ঢাকায় আসার পর আর অত রাতজাগানিয়া থাকা যায়নি। রাত জাগা পড়ে, তবে তা ঘরের ভেতরে। বাইরে বা রাস্তায় শুধু শুধু ঘুরে বেড়ানোর কোনো মানে আছে? আছে। যারা জোনাকি, তারা জানে। যারা নিশিপক্ষী, তারা জানে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, একদিন জোনাকি ছিলাম, একদিন নিশিপক্ষী ছিলাম।
বাড়ি তো নয়, একটা মিনি চিড়িয়াখানা। সুলতান কাকু পশুপাখি পুষতেন। মফস্সলে কারও বাড়িতে আমি সে রকম পশুপাখি পুষতে দেখিনি। সবই কেমন নতুন নতুন, জীবনে প্রথম দেখা পড়ছে। আমি কি ১৯৯২ সালের কথা বলছি এখন? তখনকার বাংলাদেশ, তখনকার নড়াইল, তখনকার মাছিমাদিয়া বা চিত্রা কেমন ছিল? সুলতান কাকু কেমন ছিলেন? আমার দেখাটাই–বা কেমন ছিল?
এখন স্মৃতিলগ্ন মনের নৌকায় চড়ে আমি অবলীলায় চলে যেতে পারছি সেই দিনে। দারুণ ব্যাপার! তো সকালে কী দেখলাম? দেখলাম, আহমদ ছফা বসে আছেন সুলতানের বাড়িতে। আহমদ ছফা ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছেন জার্মান দূতকে। সঙ্গে এক ওয়াগনভর্তি রং-তুলি-রংপেনসিল, পেপার। ওগুলো সুলতান কাকুর স্বপ্নের স্কুল ‘শিশুস্বর্গ’-এর বাচ্চাদের জন্য। ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির আবাসিক শিল্পী পদমর্যাদায় সুলতান কাকু তখন মাসে মাসে মাইনে পাচ্ছেন। শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক সুবীর চৌধুরী এসেছেন। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার এসেছেন। নড়াইলের জেলা প্রশাসক আছেন। আমরা আছি আর্ট কলেজের কিছু ছাত্র। দেখলাম, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আহমদ ছফার মতো দীপাদিও সিঙ্গেল। এই দুই সিঙ্গেল গুণী মানুষকে সুলতানের বাড়িতে একসঙ্গে দেখে আমার ভালো লাগছিল সেদিন। তখনো যেহেতু আমি ঢাকায় স্থায়ী হইনি, তাই ছফার সঙ্গে পরে যে খাতির হলো, সেদিন তা ছিল না। লোকজনে জমে উঠেছে সুলতানের বাড়ি। আমরা ছোটরা সেই মানুষ দেখে বেড়াচ্ছি। নড়াইলের বাইরে যশোর থেকে এসেছে লোকজন। ঝিনেদা থেকে এসেছে কবি, তবলাবাদক ও নৃত্যশিল্পী অশোক ধর। ঢাকা থেকে এসেছে বন্ধু নূরুল আলম আতিক, শরীফ শাহরিয়ার...আর কে কে যেন।
বিকেলের নরম আলোয় সুলতান কাকু এসে দাঁড়ালেন চিত্রার ঘাটে। এবার কী ঘটল? যা ঘটল, তা আমি কল্পনা করিনি কোনো দিন। চিত্রার দুই পাড়ে অগণন নারী অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়েছিলেন সুলতানের জন্য। কাকু দাঁড়ালেন নদীপাড়ে, অমনি শত শত নারীর সমস্বর উলুধ্বনিতে মুখর হলো চারপাশ। ঢাকঢোল বেজে উঠল একসঙ্গে। বাজল সানাই। আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি সেই বাস্তবতা। এ রকম মিথ হয়ে যাওয়া শিল্পী তো এ দেশে দ্বিতীয়টা নেই।
সুলতানকে উঠানে স্নান করিয়ে দিয়ে তাঁর ধুতি-আলোয়ান পরিয়ে দিচ্ছেন নীহার বালা দিদি। দিদি কাকুর পায়ে সিঁদুর মাখিয়ে দিলেন। এ দৃশ্য আমার জন্য অভূতপূর্ব! সানাইবাদকেরা খেতে বসেছেন। বাঁশি বাজছে তখন। বাঁশি কে বাজাচ্ছেন, জানি না। সুলতান কাকুও বাঁশি বাজাতেন। নাসির আলী মামুনের ছবিতে ধরা পড়েছে সেসব। তারেক মাসুদের ছবি ‘আদম সুরাত’–এও ধরা আছে। আর সুলতান ধরা পড়ে আছেন বাংলার কৃষিপদ্ধতির আদি জীবনব্যবস্থায়। জেলে, কামার-কুমারদের তিনি ক্যানভাসে তুলে এনেছেন। দিনে দিনে কৃষিপদ্ধতির বদল ঘটে যাচ্ছে প্রযুক্তির বদৌলতে, কিন্তু বাংলার আদি কৃষিজীবন কেমন ছিল, তা দেখতে একদিন আমাদের সুলতানের ছবির দিকেই তাকাতে হবে। সুলতান কাকুর বাড়ির পেছনেও একটি দরজা ছিল। সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই চিত্রা নদীর ঘাট। ঘাটে একটি নির্মাণাধীন বড় নৌকা বাঁধা। সুলতানের নৌকা। নৌকার নামও ‘শিশুস্বর্গ’।
এই শিশুস্বর্গ নৌকাতেই সুলতান কাকু শিশুদের নিয়ে চিত্রা ছাড়িয়ে ভৈরব, রূপসা হয়ে সুন্দরবনে যাবেন, এমনটাই শুনলাম সেদিন। শিশুরা বাঘ ও হরিণ দেখতে চায়। পশুপাখি দেখতে চায়। খাবার টেবিলে একসঙ্গে কাকুর সঙ্গে খেতে বসেছি।
বাড়িতে অনেক বিড়াল। একটা বিড়াল লাফ দিয়ে উঠে গেল কাকুর ঘাড়ে। কাকু একটি মাছ দিলেন টেবিলের ওপরে, বিড়াল খেতে শুরু করল। কাকু বললেন, ‘এর নাম জাহাঙ্গীর। ওই বিড়ালটার নাম দারাশিকো। ওইটা সাজাহান। ওইটা বাবর। আর ওই বিড়ালটা আওরঙ্গজেব।’ সব বিড়ালের নামই মোগল বাদশাহদের নামে। বাহ! আমি তাহলে মোগল বাদশাহর বাড়িতেই এসেছি? সুলতান কাকুর বাড়ি কি মোগল বাদশাহর বাড়ি?
বিকেলের নরম আলোয় সুলতান কাকু এসে দাঁড়ালেন চিত্রার ঘাটে। এবার কী ঘটল? যা ঘটল, তা আমি কল্পনা করিনি কোনো দিন। চিত্রার দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে অগণন নারী অপেক্ষা করছিলেন সুলতানের জন্য। কাকু দাঁড়ালেন নদীপাড়ে, অমনি শত শত নারীর সমস্বর উলুধ্বনিতে মুখর হলো চারপাশ। ঢাকঢোল বেজে উঠল একসঙ্গে। বাজল সানাই। আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি সেই বাস্তবতা। এ রকম মিথ হয়ে যাওয়া শিল্পী তো এ দেশে দ্বিতীয়জন নেই।
চিত্রাপাড়ে সন্ধ্যা নামছে। শাঁখ বাজছে। দূরের কোনো মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আমি তো থ, এ রকম জন্মদিন পালন কোনো শিল্পীর হয়? আমার জানা নেই। খুলনায় সুলতান কাকু আমাদের আর্ট কলেজে গেছেন, আমাদের সঙ্গে থেকেছেন কয়েক দিন। ঢাকায়ও তাঁকে পেয়েছি আমি। কিন্তু তাঁরই বাড়িতে, চিত্রা নদীর পাড়ে এ রকম জন্মদিন পালিত হয় বা সুলতান কাকুর জন্য পালিত হচ্ছে, তা আমার ধারণায় ছিল না।
চিত্রা বয়ে চলে। সন্ধ্যার আলো জ্বলে ওঠে চারপাশে। মন্ত্রমুগ্ধ বালকের মতো এ যেন দেখছি কোনো জাদু। আদতে জাদু নয়, শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মোৎসব। মহাপ্রাণ তিনি। আজ কাকুর জন্মদিন। আজ সুলতান কাকুর শততম জন্মদিন। সালাম জানাই এই শিল্পীকে, এ রকম জীবদ্দশাতেই মিথ হয়ে যাওয়া শিল্পীমানুষ বাংলা বা ভূভারতে আর কে আছেন!