ইনকা ট্রেইলে কেচোয়া সম্প্রদায়ের শ্যামান
সেকালে ইনকা সভ্যতায় অক্ষরের ব্যবহার না করে ‘কোপু’ নামে একধরনের বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে চলত যোগাযোগ। এই ভ্রমণকাহিনিতে লেখক লিখেছেন কোপু ব্যবস্থার আদ্যোপান্ত
আন্দিজ পর্বতমালার দিকে গড়িয়ে যাওয়া প্রান্তরে অপরাহ্ণের পুরোটা সময় বুনো ফুল ও প্রজাপতি দেখে ফিরে আসি নীরবতায় সুনসান হয়ে পড়ে থাকা ইনকা ট্রেইলের ক্যাম্প সাইটটিতে। ছাউনির কোথাও কোনো তৎপরতা দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আঙুলের আঁকে হিসাব করি, ট্রেইলে ট্রেকিং করে কাটাতে হবে আরও দুটি রাত। গন্তব্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে চলে আসি নিজস্ব তাঁবুর নিরিবিলি পরিসরে। সন্ধ্যা হতে তেমন দেরি নেই।
আমার হাতে পড়ে আছে একটি আনফিনিশড টাস্ক। ভাবি, এখনই কাজে হাত দিতে হয়। তাঁবুতে বিছানার পাশে রাখা আছে ব্যাটারিওয়ালা হারিকেন, নীরবে তা জ্বালি। নোটবুক হাতে নিয়ে এ মুহূর্তের অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে আবার একটু ভাবি। মাস তিনেক পর সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারে, লাতিন আমেরিকায় কলম্বাসের সূত্র ধরে স্প্যানিশ সেটলারদের আগমনের আগে, আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যোগাযোগের উপায় কী ছিল, তা নিয়ে আলোচনার কথা আছে। বিষয়টি মাথায় রেখে প্রস্তুতি হিসেবে আমার ভাবনার খণ্ডাংশ বুলেট পয়েন্টে নোটবুকে টুকি।
পেরুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইনকা সাম্রাজ্য ছাড়াও প্রায় একই সময়ে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলে প্রশাসনের দায়িত্বে ছিল আজটেক কিংবা মায়ান সভ্যতার জন্য খ্যাত রাজন্যকুল। ওই দুই গোত্রের ভাষা রেখাচিত্রবহুল, সাংকেতিক চরিত্রের হলেও ছিল লিখিত। গবেষকের নিষ্ঠা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করলে আজটেক কিংবা মায়ান যুগের পাণ্ডুলিপির নমুনা জোগাড় করা কঠিন কিছু না। তবে এ ক্ষেত্রে ইনকারা ছিল ব্যতিক্রম, অক্ষরের ব্যবহার না করে তারা ‘কোপু’ নামে একধরনের বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের বিশাল সাম্রাজ্যে হামেহাল যোগাযোগ জারি রাখতে সমর্থ হয়েছিল।
আমি কোপু নামের যোগাযোগমাধ্যমের ভৌগোলিক পটভূমি নিয়ে ভাবি। সে যুগে (১৪৩৮-১৫৩৩ সাল) হাল জামানার পেরু ছাড়াও ইকুয়েডরের পুরোটা এবং চিলি, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়ার বেশ খানিকটা অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল ইনকাদের রাজত্ব। তাদের সাম্রাজ্যের আয়তন হিসেবে কোনো কোনো সূত্রমতে, ৩ হাজার ৪০০ মাইল বা ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের মতো দৈর্ঘ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশাল ওই দেশে হরেক গোত্রের মোট ৩০টি আলাদা ভাষা প্রচলিত ছিল। ইনকারা প্রশাসন ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে তৈরি করেছিল মোট ২৫ হাজার মাইল বা ৪০ হাজার ২৩৫ কিলোমিটারের মতো শানবাঁধানো রাজপথ। ইনকা যুগে গাড়ি কিংবা ঘোড়ার প্রচলন ছিল না। সে কারণে পার্বত্য টেরেইনে দৌড়ে দক্ষ চাকসি বা রোডরানাররা এক চৌকি থেকে অন্য চৌকিতে ডাকহরকরার মতো কোপু-বাহিত বার্তা পৌঁছে দিত।
ট্রেকিং গাইড এলিয়াসিন কথা দিয়েছে, আজ রাতে ডিনারের পর একজন শ্যামান এসে আমাদের কোপু সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবহিত করবেন। গিট্টু দেওয়া সুতলি দিয়ে তৈরি কোপু বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানি না, তবে এ ট্রিপে নানা জায়গায় বার তিনেক তিনটি ভিন্ন ধরনের কোপু চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়েছে। পয়লাবার আমি যখন পেরুর রাজধানী লিমা নগরীতে ওয়ারি গোত্রের পিরামিড দেখতে গিয়েছিলাম, তখন লাগোয়া রেস্তোরাঁর দেয়ালে ঝুলে থাকা একটি কোপুর নমুনা দেখতে পাই। আমার কৌতূহলের জবাবে সে সময়কার গাইড জানিয়েছিলেন, ওটি রেপ্লিকা বিশেষ, প্রায় পাঁচ শ বছরের পুরোনো আসল কিপুটি রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী আলভারেজ পরিবারের ভিলায় লোহার সিন্দুকে সযত্নে সংরক্ষিত আছে।
সাম্রাজ্য বিস্তারের শেষ দিকে লিমা অঞ্চল ইনকা সম্রাটদের করতলগত হয়। তখন প্রশাসনিক প্রয়োজনে এই কোপুর মাধ্যমে সম্রাটের আদেশ-নির্দেশসংবলিত ফরমান প্রতীকী ভাষায় জানানো হয়েছিল। কেবল দক্ষ শ্যামানরা এসব প্রতীকের তরজমা করতে পারে। এথনিক ডেকোরেশেনের মতো দেখতে, চারটি ওয়াল-প্লেটের তলায় কোপু নামকের যোগাযোগের বস্তুটিকে আমি বিপুল আগ্রহ নিয়ে চাক্ষুষ করেছিলাম আর নীরবে ভাবছিলাম, যে তথ্য পেলাম, তা কি নির্ভরযোগ্য? না, নিশ্চিত হতে পারিনি। তাই কোপুর ফটোগ্রাফ নিতে নিতে ভেবেছি, যদি এ যোগাযোগমাধ্যমের সংকেত ব্যাখ্যায় দক্ষ কোনো শ্যামানের সঙ্গে কখনো সাক্ষাৎ হয়, এ নিয়ে আবার অনুসন্ধান করব।
দ্বিতীয়বার আমি মাত্র পলক কয়েকের জন্য একটি কোপু দেখার সুযোগ পাই পবিত্র উপত্যকার মোরাই শহরে। ইনকাদের কৃষিবিষয়ক নিরীক্ষার জন্য নির্মিত সার্কুলার টেরাস প্রভৃতি পরিদর্শন শেষে ছোট্ট শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। এথনিক মোটিফের লোহিত বর্ণ পোশাকে সুসজ্জিত এক চাকসি বা রোডরানার পুরুষ কোপুর ডান্ডাটি ঝান্ডার মতো ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রীতিমতো ছুটছিলেন। স্ন্যাপশট নিয়ে ছবিটি তৎকালীন গাইডকে দেখিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, গিট্টু দেওয়া রঙিন সুতোয় বিধৃত বার্তাটির মর্মার্থ কী?
গাইড নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে আদিবাসী কেচোয়া গোত্রের মানুষ হলেও কোপুর ভাষা সম্পর্কে তার তেমন জ্ঞান ছিল না। তবে ওর মন্তব্য থেকে জেনেছিলাম, ঐতিহ্যপ্রিয় কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ রকমের উৎসব বা গ্রামীণ পালাপার্বণের উদ্যাপনবিষয়ক বার্তা প্রচারের জন্য আজ অব্দি কোপুর ব্যবহার প্রচলিত আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এক গ্রামের অধিবাসীরা তাদের পরবে অন্য গ্রামের শ্যামান প্রমুখকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রণের জন্যও কোপু ব্যবহার করেন।
তৃতীয়বার আমি কোপু চাক্ষুষ করি ইনকা ট্রেইলে ঢোকার মুখে করিওয়োচিনা নামক একটি গ্রামে। সড়কের পাশে প্লেকার্ডের মতো করে কোপু হাতে দাঁড়িয়েছিলেন কেচোয়া গোত্রের আইকোনিক মাথাইল মাথায় একজন নারী। গাইড এলিয়াসিন জানিয়েছিল, হরতালের মাধ্যমে ইনকা ট্রেইলে ট্রেকিং বন্ধ করে কেচোয়া গোত্রের পর্যটন-কর্মীরা বেশ কিছু দিন আন্দোলনে নেমেছিল। প্রচুর নেগোসিয়েশনের পর কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু দাবিদাওয়া মেনে নিলে ট্রেইল খুলে দিয়ে ঝিমিয়ে পড়া পর্যটনকে ফের চাঙা করা হয়। মাথাইল-মাথায় মহিলাটি নাকি কোপু মাধ্যমে আবার জোরেশোরে পর্যটনী তৎপরতা চালুর আহ্বান-সংবলিত বার্তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাঁবুর বাইরে থেকে ভেসে আসে কেচোয়া ভাষায় কথাবার্তা এবং উচ্চ রোলের বাগ্বিতণ্ডাও। প্রখর আলোর কিছু রোশনি ছিটকে এসে পড়ে তাঁবুর দেয়ালে। ঘটনা কী, হদিস করতে নোটবুক বন্ধ করে বেরিয়ে আসি। কাটা গাছের বিরাট এক গুঁড়ির ওপর রাখা হ্যাজাক বাতি থেকে শোঁ শোঁ আওয়াজে ছড়িয়ে পড়ছে আলো। উজ্জ্বলতার বৃত্তটি ঘিরে জমে উঠছে ক্যাম্পসাইট-কর্মীদের তৎপরতা। পাতা হচ্ছে প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার। পিপার মতো দেখতে একটি চুল্লিতে দুদিক থেকে দুই নওজোয়ান ফুচরুঙ্গির নলে ফুঁ দিয়ে উসকাচ্ছেন অঙ্গারের আগুন। দেখতে দেখতে রই রই করে বাঁকে ঝুলিয়ে নিয়ে আসা হয় দাঁত-মুখ খিঁচানো মৃত এক শূকর। আমি প্রমাদ গুনি। আগুনে ঝলসানো এ জানোয়ারের মাংস ভক্ষণে পরকালে যেমন দোজখবাস অবধারিত, তেমনি ইহকালে নিষিদ্ধ আমিষ পরিপাকের পর কবিতা আবৃত্তির চেষ্টা করলে, মুখ দিয়ে মাতৃভাষার পরিবর্তে বেরোবে স্রেফ ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ।
ধোঁয়ার গন্ধে অর্ধভোজনের সম্ভাবনা থেকে আত্মরক্ষা করতে পেনসিল-টর্চের ওপর ভরসা করে আস্তে-ধীরে হেঁটে সরে আসতে শুরু করি শূকর-ঝলসানোর এপিসেন্টার থেকে। আধো অন্ধকারেও পায়ে চলার পথরেখাটি বালুকায় পসর হয়ে আছে। পায়চারি করতে তেমন অসুবিধা হয় না।
হিম্মতে বুক বেঁধে আগুয়ান হই একটি আলোকিত টেন্টের দিকে। টেবিল পেতে গুছিয়ে বসেছেন ঘণ্টাখানেক আগে প্রান্তরে মাইন্ডফুলি হাঁটাহাঁটি করা নাদুসনুদুস, তাঁর ভাষায় ‘সুপার ফ্যাট গাই’ মানুষটি। মহাশয় ব্লোফিশ বা পটকা মাছের আকৃতিতে তৈরি গোলগাল একটি ইনফ্ল্যাটেবোল স্টুলে বসে স্কেচ খাতায় রংতুলিতে আঁকছেন ছবি। আমাকে দেখে হাঁসফাঁস করে জানান, পিকচার-জার্নালটি তৈরি করছেন তাঁর এক্স গার্লফ্রেন্ডের জন্য। স্কুল-ব্যাগ ঝোলানো এক বালকের অহংকারে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আমাকে দেখান পাহাড়-পর্বত, ট্রেইলের রেখা, বৃক্ষ, লামা ও তাঁবু প্রভৃতিতে পরিপূর্ণ জলরঙের রঙিন স্কেচরাজি। তাঁর ধারণা, পিকচার-জার্নালের সওগাত পেলে হয়তো মেয়েটি ফের ডেট করতে আগ্রহী হবে, তখন প্রথমবারের প্রচেষ্টায় যে ভুলত্রুটি ছিল তা শুধরে দৃঢ়প্রত্যয়ে আবার প্রণয়ের উদ্যোগ নেবেন। আমি সিনসিয়ারলি তাঁর কামিয়াবি কামনা করে ‘গুডনাইট’ বলি।
হাঁটি ফের, মোটাসোটা চিত্রকরের সফলতা সম্পর্কে ঠিক নিশ্চিত হতে পারি না। আমার ধারণা, এক্সরা পকেটের ফুটো দিয়ে ট্রেইলে পড়ে যাওয়া সিকি–আধুলির মতো বস্তু খোঁজাখুঁজি করাটা পণ্ডশ্রম বিশেষ। যাহোক, সমস্যাটা আমার না, ও নিয়ে অধিক মাত্রায় ভাবিত হওয়া পরচর্চার শামিল।
কিন্তু তুমল খিদা জানান দিলে ফিরে আসতে হয় ক্যাম্পসাইটের হরেক অ্যাকটিভিটিতে সরগরম অকুস্থলে। শূকর ঝলসানোর চুল্লি থেকে নিরাপদ দূরত্বে শুধু আমাদের জন্য পাতা হয়েছে টেবিল-চেয়ার। আমার সহযাত্রী আরও তিন বয়োবৃদ্ধ ট্রেকারের জন্য সার্ভ করা হয় ভেজিটারিয়ান ডিনার।
ফিঙ্গার ফুডের পালা সাঙ্গ হওয়ার আগেই পরিবেশিত হয় বারকোষভর্তি পাস্তা, কেসো-ফ্রেসকো বলে একধরনের চিজ ও এক হাঁড়ি চিয়া সিড ভেজানো মধুর যৎসামান্য মিশেল দেওয়া শরবত। আধপোড়া শূকর খেতে হচ্ছে না বলে আমরা যেমন স্বস্তি বোধ করি, তেমনি পাস্তার পরিমাণ দেখেও বিব্রত হওয়ার দশা হয়। এ খাবার দিয়ে ভূরিভোজনে বিগতভাবে পারঙ্গম আরও জনা কয়েককে অনায়াসে সন্তুষ্ট করা যায়, এমনকি বেশ কিছু খাবার পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন প্রাতে পান্তা-পাস্তা দিয়ে প্রাতরাশও সারা যায়। খুঞ্চায় করে ডজনখানেক পটেটো পেন-কেইক নিয়ে এবার হাজির হন আরেক কেচোয়া নওজোয়ান। খাবারের এ আইটেমের ফাঁকফোকরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে শিকড়-বাকড়সুদ্ধ একধরনের পত্রবহুল সবজি; ভাবি, এ ঘটনাকে ‘বোঝার ওপর শাঁকের আঁটি’ হিসেবে বর্ণনা করলে অতিশয়োক্তি হয় না।
খাবারদাবারের পালা সাঙ্গ হলে থার্মসে করে নিয়ে আসা হয় গরম জল। আমরা জিনজার টি বানানোর আয়োজন করছি। মশালের আলোয় পায়ে-চলার পথরেখাটিতে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে রীতিমতো রই রই করে আমাদের পরিসরে এসে পৌঁছান আজ রাতে কোপু-বিষয়ক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতিশ্রুত পণ্ডিত, কেচোয়াদের বনিয়াদি বেশভূষায় সজ্জিত রাশভারী গোছের একজন শ্যামান। পোর্টারদের মধ্যে তোড়জোড় পড়ে যায়। এলিয়াসিন যেভাবে মাথাটি ঝুঁকিয়ে বিনম্র ভঙ্গিতে তাঁকে ‘রিমাকুইয়াকি’ বা ‘হ্যালো’ বলে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, তাতে বয়োবৃদ্ধ মানুষটি যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক পুরোহিত, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ থাকে না।
একা আসেননি শ্যামান, তাঁর সঙ্গে এসেছে মশালধারী চার তরুণ এবং একটি ত্যক্তবিরক্ত লামাও। লামাটি বয়ে এনেছে কোপু নামক বার্তা আদান-প্রদানের পশমে বোনা ছোটখাটো ব্যানারের মতো বস্ত্রগুলো।
কেচোয়া গোত্রের তরুণ চারটি মাটিতে মশালের দণ্ড পুঁতে দিয়ে কাঁধঝোলা থেকে বের করে বাঁশরি ও আরও তিনটি নাম না-জানা বাদ্যযন্ত্র। শ্যামান মশাই স্বয়ং ফোঁকেন শঙ্খ। হাঁটু গেড়ে এলিয়াসিন তাঁর হাতে তুলে দেয় ‘মাপাচা’ বলে বিশেষ ধরনের তামাক। হাড়ের পাইপে তা ফুঁকে, ঘুরে ঘুরে প্রতিটি দিক নিশানা করে ধোঁয়া ছুড়ে তিনি শুদ্ধ করে নেন তাঁর নিশ্বাস-প্রশ্বাস।
দুজন তরুণ মেলে ধরে অনেকগুলো সরু সুতলির সামাহারে তৈরি নীলচে-সবুজাভ একটি কোপু। তাদের সাথি অন্য দুটি যুবক বাজাচ্ছে বাঁশরি ও অন্য একটি বাদ্যযন্ত্র। তাল-লয় বজায় রেখে ছেলে দুটি মৃদু মৃদু দোলায় কোপুটি, এতে তৈরি হয় সমুদ্রের আকৃতি, তাতে ওঠে তরঙ্গ। শ্যামানমশাই সুরেলা কণ্ঠে ধারাবর্ণনার মতো কিছু বলে যান। একপর্যায়ে তিনি বিরতি নিলে নীরব হয়ে আসে বাদ্যবাজনা। এ সুযোগে এলিয়াসিন ব্যাখ্যা করে: কয়েক শ বছরের পুরোনো কোপুটিতে বিধৃত আছে, এল নিনো বা প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ স্রোতোধারা সৃষ্টির ফলে কমে যাবে বৃষ্টিপাত; তবে ঝড়ঝাপটা, হারিকেন প্রভৃতি বৃদ্ধি পাবে। জানতে পারি, অনেক অনেক বছর আগে, প্রয়াত কোন ইনকা সম্রাট এ কোপুর মাধ্যমে প্রজাকুলকে শুধু এল নিনো বিষয়ে সতর্ক করেননি, ফসল সংরক্ষণ করে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতেও তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন।
প্রদর্শিত হয় আরেকটি কোপু। এবারকার উপস্থাপনায় নাটকীয়তা থাকে না তেমন, তবে সুরলহরির সঙ্গে চার তরুণের কণ্ঠে যুক্ত হয় অনুচ্চ স্বরে চ্যানিটং। ধারাবর্ণনার শেষে পোশাকের আস্তিনে শ্যামান মোছেন ঠোঁটের ফেনা। মশালের আলোয় চিকচিক করে ওঠে কেচোয়া পোর্টারদের চোখের জলরেখাও। আরও জানতে পারি, অনেক অনেক বছর আগে, সম্ভবত স্মরণাতীতকালে, পবিত্র উপত্যকায় ভূমিকম্পে ওলটপালট হয়েছিল তাবৎ কিছু। ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম ঝাপটা কেটে গেলেও কিছুক্ষণ পরপর তুমুল ট্রেমারে প্রকম্পিত হচ্ছিল ধরিত্রী। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে সম্প্রদায়ের জনাকয়েক বয়োবৃদ্ধ শ্যামান জড়ো হয়ে আয়োজন করেন একটি রিচুয়ালের।
কেচোয়া গোত্রের সনাতনি প্রথা অনুযায়ী জ্বালানো হয় অগ্নিকুণ্ড, উৎসর্গ করা হয় একাধিক লামা। জপ-তপ-চ্যানিটংয়ে নিমগ্ন শ্যামানরা ধ্যান ভেঙে সামান্য বিরতি নিলে স্পষ্ট হয় একটি বিষয়: যে ডাঙায় বসে তাঁরা মেতেছিলেন আচার-অনুষ্ঠানে, তা উঠে গেছে উপত্যকা থেকে বেশ খানিকটা ঊর্ধ্বে। কপালে হাত দিয়ে বৃদ্ধ শ্যামানরা চতুর্দিকে নজর দেন, দূরে তাদের ঘরবাড়ি, ভূমিকম্পে ভাঙাচোরা লোকালয় নিয়ে তাদের চেনা জনপদকে বেশ নিচে দেখতে পান। ক্রমেই অনেক দূরে, লোকালয় ও ল্যান্ডমার্ক স্পষ্ট হয়ে উঠলে তাঁরা নিশ্চিত হন, যে ভূমিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, তা ক্রমেই উঠে যাচ্ছে ঊর্ধ্বে। এ প্রক্রিয়া জারি থাকে সন্ধ্যা অব্দি, সূর্যদেবতা অস্তাচলে গেলে শ্যামানরা নিজেদের খুঁজে পান একটি পাহাড়চুড়োয়, তাঁদের মাথার ওপর নেমে আসে অজস্র নক্ষত্রমণ্ডলে শোভিত আকাশ, তাতে ভাসছে কমলালেবু রঙের আভা ছড়ানো একটি ধূমকেতুও।
ধূমকেতু দর্শনে সতর্ক হন শ্যামানরা। ইনকা সম্রাট যুদ্ধ-বিগ্রহের আশঙ্কায় সদ্য ভূমি ফুঁড়ে জেগে ওঠা পাহাড়ে চন্দ্র-সূর্য ও পৃথিবীর তুষ্টিতে মন্দির গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। তারপর মন্দির-নগরীটিকে দুর্গের মতো সুরক্ষিত করে এমনভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন যে যদি কখনো বিপর্যয়ে পরাস্ত হয়ে রাজধানী কুসকো ছেড়ে পালাতে হয়, তাহলে ইনকাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বনানীতে যেন একটি উপাসনা কাম প্রশাসনিক কেন্দ্র সঙ্গোপন থাকে।
কোপু-বিষয়ক কাহিনি-কেসসার অভিঘাতে রীতিমতো সম্মোহিত হয়ে বসেছিলাম। শ্যামানমশাই শিঙা ফুঁকে আসরের সমাপ্তি টানেন। তারপর কোনোরকমের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া চোখমুখে নো ননসেন্স টাইপ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বিদায় সম্ভাষণের ধার না ধেরে হনহন করে রওনা হন নিজের গ্রামের অভিমুখে। অনুগত বান্দাদের মতো তাঁকে অনুসরণ করে মশালধারী চার যুবক ও কোপুবাহী পোষা লামাটি। এলিয়াসিন ও জনাকয়েক পোর্টার পেছন-পেছন রওনা হয়, আমিও সাথি হই তাদের। আমাদের মাথার ওপর অজস্র তারকা নিয়ে নীরবে প্রবাহিত হয় আকাশগঙ্গা, চলার পথে ঝরে পড়ে পরপর চারটি নক্ষত্র।