আপন বলেছিল, ‘আমি তো এখন দূরে থাকি, বলতে গেলে দুনিয়ার বাইরে’
আজ ১২ সেপ্টেম্বর কবি আপন মাহমুদের মৃত্যুদিন। ২০১২ সালের এই দিনে মারা গিয়েছিলেন শূন্য দশকের এই সম্ভাবনাময় কবি। কিন্তু মৃত্যুর আগে কেন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো এখন দূরে থাকি, বলতে গেলে দুনিয়ার বাইরে!’
‘কী রে...’। ওকে এই ছোট্ট বাক্য লেখার পর ওপাশ থেকে ইংরেজি হরফে বাংলা লিখে সে জানাল উত্তরসমেত টুকরো একটি কথা, ‘আছি রে...তুই কই, কেমন আছিস?’
ফেসবুকে ওর সঙ্গে ইংরেজি হরফে বাংলা বাক্য চালাচালি করতে করতে আমার আঙুল ততক্ষণে তাকে লিখছে, ‘একদিন আড্ডা মারা যায় না?’
সে বলল, ‘যায়। কিন্তু আমি তো এখন দূরে থাকি, বলতে গেলে দুনিয়ার বাইরে। শাহবাগে যাওয়া হয় না।’
২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এভাবে আমাদের কথা চলছিল আঙুল মারফত। কেননা, একই শহরের বাসিন্দা হলেও কারোরই এখন আর সময় মেলে না। যার যার ভুবনে ব্যস্ত থাকা আমাদের দেখা হয় না দীর্ঘদিন। অগত্যা তাই ফেসবুক চ্যাটিংয়ে আঙুল দাপিয়ে কথার লেজে কথা জুড়ে দিয়ে বলি, ‘একদিন অনেক আড্ডা মারব। দেখা হবে। ভালো থাকিস।’
এরপর আবার দিনের কর্মব্যস্ততা; তারপর শেষ রাতে ঘুম—হেরফের না হওয়া প্রতিদিনের মুখস্থ রুটিন।
প্রাত্যহিক অভ্যাসমতো শেষ রাতের দিকে ঘুমাতে গিয়েছিলাম ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বরেও। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। পরদিন বুধবার ঘুম থেকে জাগতেই মুঠোফোনে কবি বন্ধুদের বেশ কয়েকটি মিসডকল—তারিক ঈমাম, সফেদ ফরাজী, মেহেদী উল্লাহ। মনে আছে, ফিরতি ফোন করলাম তারিককে। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘নয়ন, আপন নেই।’ সফেদকে ফোন করলাম, ও জানাল, ‘হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে...আজ ভোর ছয়টায়।’ সফেদের কণ্ঠও ভেজা।
আমার তখন কী অবস্থা? মনে হলো, সদ্য ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দুঃস্বপ্ন দেখছি নাকি! আমাদের বন্ধু কবি আপন মাহমুদ, মাত্র কদিন আগে নানা কথাচ্ছলে যে আমাকে লিখেছিল, ‘আমি তো এখন দূরে থাকি, বলতে গেলে দুনিয়ার বাইরে;’ সে নেই! তাহলে ১২ সেপ্টেম্বর সত্যি সত্যিই দুনিয়ার বাইরে চলে গেছে আপন!
১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম। সেই হিসাবে ও যখন মারা যায়, তখন ওর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৬ বছর। সে সময় আমরাও কেউ মাঝবয়সে পৌঁছাইনি। তবু ওই সময় থেকেই আমাদের আপনের স্মৃতিকথা লেখার শুরু, আর এত বছর ধরে লিখেই চলেছি! এখনো আমরা স্মৃতি হাতড়াই। এরপর যখন ওর কবিতা পড়ি, দেখি যে ও লিখেছে, ‘বিকেলে আমি না–ও থাকতে পারি, নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়তে পারি অযথাই—ঘোষণা ছাড়াই ছড়িয়ে পড়তে পারি দূরে অতীতে।’
আপন তবে আজ অতীত? অকস্মাৎ সবাইকে এতটা অপ্রস্তুত করলি কেন তুই?
কবিতা লিখতে লিখতে লক্ষ্মীপুরের কড়ইতলা গ্রাম থেকে এসেছিল। একইভাবে গ্রামীণ মফস্সল ভেঙে এসেছিলাম আমরাও। ঢাকার মোকামে বুঝি সোনালি জীবন আছে—এই মোহে এ শহরে এসে দেখা হলো সবার। এরপর উত্তাল বন্ধুত্ব আর হালকা-পাতলা শত্রুতাও। সেই বন্ধুত্ব ও শত্রুতার মাত্রা এতই গাঢ় যে পরস্পরকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে আপনি-তুমি নয়, খুব দ্রুতই আমরা ‘তুই’তে পৌঁছে গেলাম। আপন আমার কয়েক বছরের বড়, কিন্তু ওর সঙ্গে আমার তুই-তোকারি সম্পর্ক। আমাদের সবার তখন একটাই পরিচয়—কবি।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে লিটল ম্যাগাজিনের তুখোড় আড্ডা, পিজি হাসপাতালের বহির্বিভাগে দাঁড়িয়ে তর্ক-বিতর্ক, নতুন কবিতার উত্তেজনা এবং বাংলা কবিতার গতিপথ নির্ধারণ—সে সময় এসবই আমাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। আর সমুদয় কর্মকাণ্ড শেষে এক কাপ চায়ে দু-তিনজনের ভাগাভাগি চুমুক। ২০০০ সালের প্রথম দিকে, সে সময় আমি তো বটেই, আমাদের বেশ কয়েকজন তখনো ছাত্র এবং বেকার। যে কজন কর্মজীবী ছিল, আপন তাদের অন্যতম। চা ও অন্যান্য খানাপিনার ক্ষেত্রে ওদের ভূমিকাই ষোলো আনা। তবে এই খানাপিনার বিল মেটাতে অন্যদের চেয়ে আপন আবার এককাঠি বেশি সরেস। হয়তো কিছুক্ষণ আগে দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ এঁকে বলেছে, কী যে করি, বাড়িতে টাকা পাঠানো দরকার। এখনো বেতন হয়নি। তারপরও খাবারের বিলটা তাকে মেটাতেই হবে, আমরা না-না করি, তাতে কী! জীবনকে কুড়িয়ে আর উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই যেন ওর আনন্দ।
বন্ধুদের কবিতা শুনে বলত, ‘আমার হবে না। তোরা প্রত্যেকেই আমার চেয়ে ভালো লিখিস।’ বলা সারা, তো ওমনি আনমনে একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলল। আমরা কখনো ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি সেই দীর্ঘশ্বাসের মর্ম। ওই দীর্ঘশ্বাস কি ওর দূরবাসী মা-বাবার জন্য, ওর অসুস্থ ভাইয়ের চিকিত্সার জন্য, নাকি স্বতঃস্ফূর্ত একটি নিটল কবিতার জন্য? এ রকম তাড়নায়ই বুঝি ও লিখতে পেরেছে অসংখ্য অনবদ্য কবিতা।
এবার আপনের কবিতায় চোখ বোলাই। ‘মা প্রজাপ্রতি ও অনান্য ছায়া’ নামে একটি সিরিজ কবিতা লিখেছিল আপন। এই কবিতার অংশে অংশে নিজের মাকে সে এঁকেছে নানা রূপে। মফস্সল থেকে ঢাকাবাসী হওয়া ছেলেমেয়েরা তাদের মায়েদের কীভাবে অনুভব করে, তা–ই আছে আপনের এই কবিতায়। কবিতাগুলো এত আর্দ্র, এত আপন আর এত হৃদয়মথিত যে পড়লে মনে হয়, এ তো আমারই মায়ের কথা! আমার মায়ের বেদনা কীভাবে বুঝেছিল আপন! চলুন, মাকে নিয়ে আপন মাহমুদের মর্মছেঁড়া কবিতাগুলো এই অবসরে পড়ে নেওয়া যাক:
মা প্রজাপ্রতি ও অনান্য ছায়া
‘মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে
শুনেছি, সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিল
পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি
মা, পৃথিবীর যেকোনো নারী থেকে যাকে কখনোই আলাদা করা
যায় না—তাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত—কান্ত—বিভ্রান্ত সেই প্রজাপতিটার
ডানা থেকে যখন টুপটাপ ঝরে পড়ছিল রঙের আকুতি—রঙের
সেই অপচয় ঘোচাতেই সম্ভবত জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর আর
সব প্রজাপতির
মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে! অথচ, তার মুখের দিকে
তাকিয়ে কখনোই মনে হয়নি—জীবনে একটাও প্রজাপতি তার
খোঁপায় বসেছে।
দুই.
গোলাপ অথবা চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল
জানি না—তবে কোনো এক শীতসকালে ঘরের পেছনে অকারণে
ফুটে থাকা কিছু ঘাসফুলের সঙ্গে মা আমার আলাপ করে দিয়ে
বলেছিলেন, ‘জীবনের যত কফ-থুথু আর উড়াল হারানোর
বেদনা আমি জমা রেখেছি এই ঘাসফুলের কাছে, এমনকি প্রসববেদনাও’—
সেই থেকে যেকোনো নীল ঘাসফুলই আমার মায়ের
প্রতিনিধিত্ব করে—যার আজও কোনো বাজার মূল্য নেই
এখনো শীত আসে পৃথিবীতে, আসে বসন্ত—গোলাপ অথবা
চন্দ্রমল্লিকারাও এখনো আলতা পরে পায়ে—তবু পৃথিবীর যত
খুন, প্রতারণা আর ব্যর্থ প্রেমের কবিতা নিয়ে আমি সেই
ঘাসফুলের কাছেই যাই।
চোখ বন্ধ করে একটু দাঁড়াই...
পাঁচ.
মায়ের কপালের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা উৎকণ্ঠাটুকু নিয়ে এসেছি
আমারও নামের পাশে লেখা যেতে পারে ‘সম্ভাবনা’—সম্ভাবনার
যে দ্বার লাঙলের খুলবার কথা—তার দরোজায় আজও বসে
আছেন বাবা—যার ঘোলাটে চোখে এখনো থকথক করছে
কাদাপানির সংশয়, আড়ষ্টতা...
আড়ষ্টতার হাত ধরে কত দূর যাবে মায়ের বোবা ছেলেগুলো!
আমারও উদ্দেশ্য ছিল দূর—অথচ, ঘরের কাছেই বুনোফুল দেখে
থমকে দাঁড়াতে হলো—দাঁড়িয়ে আছি
শুনেছি, দাঁড়াতে জানলে সকল দূরই একদিন নিকটে আসে।’
অনেক দূরকেই নিকটে নিয়ে এসেছিল আপন, ঠিক যেভাবে আমরাও ওর আপন হয়ে গিয়েছিলাম। আজ সেই আপন মাহমুদ—আমাদের বন্ধু আপনের চলে যাওয়ার দিন, আমাদের আপনহারা হওয়ার দিন। আজ আমাদের আপনহারা হওয়ার দিনে কত কিছু যে মনে পড়ছে! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার হলে রাত কাটাতে চেয়েছিল আপন। জীবন–জীবিকার চাপে ওর যাওয়া হয়নি। ও চাইত, আমি যেন পিএইচডি করি। বারবার বলত, ‘আমি তো ঠিকঠাক পড়ালেখা করতে পারিনি। তুই পিএইচডিটা করিস।’
আমি বলতাম, ‘কবির আবার পিএইচডি লাগে নাকি...!’
বলত, ‘তবুও...আমাদের বন্ধুদের ভেতর কেউ পিএইচডি করবে না, তা কি হয়!’
বছর দুয়েক আগে আমি যেদিন পিএইচডিতে ভর্তি হলাম, বারবার মনে পড়ছিল আপনের কথা। আপন নিশ্চয়ই খুশিই হতো আমি পিএইচডি করছি শুনলে।
পেশা হিসেবে আপন বেছে নিয়েছিল সাংবাদিকতা। তখন ওর আবাস ছিল বসুন্ধরা। তাই হয়তো বসুন্ধরা থেকে এত দূরের শাহবাগ যাওয়াকেই ও বুঝিয়েছিল ‘দুনিয়ার বাইরে’ হিসেবে। ওই দুনিয়ার বাইরে থাকতে থাকতে—বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকার সময়ই বেরিয়েছিল ওর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সকালের দাঁড়ি কমা’। ২০১১ সালে প্রকাশিত এই বই–ই জীবদ্দশায় বেরোনো ওর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ। ওই বছর প্রথম আলো সাহিত্য সাময়িকীর ‘নির্বাচিত ১০ তরুণ’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছিল এটি। প্রথম প্রকাশেই নতুন কবিতার সুবাস বেশ ভালোভাবেই জাগিয়েছিল আপন। ওর কবিতায় জীবন আছে, উত্তাপ আছে। পড়লে মুহূর্তেই যে কেউ হয়তো দেখে ফেলবেন ওর বাবা আবদুর রবকে। আনোয়ারা বেগম—ক্রন্দনরত ওর মায়ের মুখটিও মনে পড়বে সবার। আর আমাদের কেবলই মনে হবে, এই মেট্রোপলিটন মাল্টি ধান্দার শহরে বাবার মুখটি মনে করতে পারছি না আমরা। ক্রমাগত ভুলে যাচ্ছি নিজের মায়ের মুখ।
২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মায়ের কাছে, মাতৃভূমি লক্ষ্মীপুরে ফিরে গেছে আপন। ফিরে গেছে তার গ্রাম কড়ইতলায়। পরে কয়েক বছর আগে আপনের শোকে মারা গেছেন তার মা–ও। এখন মা–ছেলে দুজনই ঘুমিয়ে আছে কড়ইতলায়। ঢাকাই বন্ধু আমরা কখনো যাইনি সেখানে, দেখিনি সেই গ্রাম। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে, তোর প্রিয় কড়ইতলায় ঘাসফুলেরা তোর সম্মানে এখনো কি ফুটে আছে, আপন?