আবু মনসুর দাকিকি ‘শাহনামা’র যে আদিকবির প্রাণ গিয়েছিল আততায়ীর হাতে
পারস্যের কবি আবু মনসুর দাকিকি সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে, আবুল কাশেম ফেরদৌসি যদি মহাকাব্য শাহনামায় তাঁর উল্লেখ না করতেন, তাহলে তাঁকে পরবর্তীকালে কেউ আর চিনত না। কথাটা পুরোপুরি সত্য না হলেও একেবারে মিথ্যাও নয়। কেননা বিশ্বসাহিত্যের একসময়কার অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকই তো আজ নানা কারণে বিস্মৃত। কিন্তু ৬০ হাজার পঙ্ক্তির যে মহাকাব্য শাহনামা বহুদিন আগে থেকেই ধ্রুপদি মর্যাদায় স্বীকৃত এবং দেশে দেশে যার পাঠ ও পরিচিতি বাড়ছে বৈ কমছে না, সেটি তো ফেরদৌসির স্বতন্ত্র ও স্বভাবী রচনা নয় শুধু, তার ‘বীজসূত্র’ ছিল দাকিকির এক হাজার পঙ্ক্তির রচনা আদি শাহনামা। বাংলা ভাষায় শাহনামার অনুবাদক মনিরউদ্দীন ইউসুফও তাঁর ভূমিকায় এর উল্লেখ করেছেন। ‘বীজসূত্র’ শব্দবন্ধটিও তাঁর। তিনি এ কথাও বলেছেন যে দাকিকির রচনায় বিশেষরূপে প্রভাবিত ছিলেন ফেরদৌসি। তারপরও দাকিকি কেন যে এতটা বিস্মৃত রয়ে গেলেন, তার খোঁজ করাটা জরুরি।
শুধু মনিরউদ্দীন ইউসুফই নন, সমালোচকদের বিচারেও দাকিকি দুই কারণে পারস্য সাহিত্যে মশহুর—এক. পারস্য ঐতিহ্যের ঐশ্বর্য লালন করে কাব্যচর্চা; দুই. তিনি ছিলেন শাহনামার সেই অগ্রজ লেখক, যিনি প্রথমে সহস্র পঙ্ক্তি মতান্তরে সহস্র দ্বিপদী রচনা করে বীজাধার তৈরি করে গিয়েছিলেন। এই মত এ কারণেই অস্বীকার করা যায় না যে অষ্টম শতকে আরবি ভাষা প্রভাব বিস্তার করার পরও তাঁরই অনুসারী ফেরদৌসি মূলত ফারসি শব্দভান্ডারের ওপর ভিত্তি করেই শাহনামা রচনা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। তবে তাঁর সম্পর্কে যে কথা প্রচলিত যে শাহনামায় উল্লেখ না থাকলে তিনি হারিয়ে যেতেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। একে তো ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মহাকাব্য লেখা শুরু করে জরথুস্ত্রকাল পর্যন্ত এসে মৃত্যুর কারণে যাঁকে সহস্র পঙ্ক্তি রচনা করেও থেমে যেতে হয়েছিল, তাঁর সম্পর্কে এ কথা উচ্চারণ করা অশোভন নয় শুধু, অযৌক্তিকও। কারণ, এর আগে থেকেই গজল রচনায় তাঁর কবিখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়েছিল। আর সে জন্যই আমির আবুল মোজাফরের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা সত্ত্বেও সম্রাট নূর বিন মনসুর (শাসনকাল ৯৬১ থেকে ৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁকে সভাকবির মর্যাদা দিয়ে তাঁর ওপর শাহনামা রচনার গুরুভার ন্যস্ত করেন।
আবু মনসুর দাকিকির জন্ম আনুমানিক ৯৩৫ সালে তৎকালীন খোরাসান প্রদেশের তুস নগরে। মাত্র ৪২ বছর বয়সে একই স্থানে ৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। দাকিকির লেখায় প্রকৃতি ও পরম সত্তার প্রতি আকুলতা প্রকাশ পেলেও নারীর রূপ–বর্ণনাসম্পর্কিত গজলগুলোই ছিল বেশি জনপ্রিয়। তাঁর একটি গজলের কিছু পঙ্ক্তি পড়লে এর পরিচয় মিলতে পারে:
‘এই রাত্রি তোমার চুলের মতো কালো
আর দিন তোমার মুখের মতো উজ্জ্বল
তোমার ওষ্ঠ ও অধর যেন
নিপুণ শিল্পীর কারুকার্যময় মুক্তোদানা।
হরিণীর মতো তোমার অপরূপ দুচোখে
কত শত সর্বনাশ লেখা!’
দাকিকির অন্য একটি গজলে খেয়াল করি, প্রেম, প্রকৃতি, নারী প্রভৃতি একাকার করে দিয়ে তাঁর আত্মপরিচয়ের বার্তাটিকেও সেখানে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই গজলে প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা দেওয়ার পর দাকিকি বলেন, পৃথিবীতে চারটি জিনিস তাঁর প্রিয়—ইয়াকুতের মতো ঠোঁট, বীণার আওয়াজ, লাল রঙের মদ এবং জরথুস্ত্র ধর্ম।
দাকিকির পরে এবং শেখ সাদির আগে আবদুল ওয়ারেস আল জবলি ও আফজল উদ্দিন ইবরাহিম বিন আলি শেরওয়ান খাকানিসহ খ্যাত-অখ্যাত আরও কয়েকজন কবি গজল রচনা করলেও সেগুলো রসিক গবেষকের মনে ধরেনি। কিন্তু কথা হলো, পারস্য সাহিত্যের আদিপ্রতিভা রুদাকি (৮৫৯ থেকে ৯৪১ সাল) কিংবা শাহনামার প্রথমাংশের আদিকবি দাকিকিকেই–বা কতটুকু মনে রেখেছে মানুষ?
রুদাকির কবিতার মধ্যে সামান্য কিছু যেমন উদ্ধার হয়েছে। সামানীয় শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত রুদাকিকে যেভাবে বোখারা থেকে পালিয়ে গিয়ে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে শেষ জীবন কাটাতে হয়েছে, দাকিকির অন্তিম পরিণতি ছিল তার চেয়ে করুণ। জানা যায়, দাকিকিকে তাঁরই এক প্রিয় ভৃত্য হত্যা করেছিলেন। কিন্তু কেন? ভৃত্যের হাতে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, সেটা যে শুধু ভৃত্যের বিরাগের কারণে ঘটতে পারে তা নয়, তা কোনো না কোনো ষড়যন্ত্রেরও ইঙ্গিত দেয়। এমনিতে শাহনামায় স্বপ্নের যে বিবরণ দিয়েছেন ফেরদৌসি, তাতে বোঝা যায়, দাকিকি যেন জানতেনই যে তাঁর দিন শেষ হয়ে আসছে। এই অলীক বার্তাকে মনে রাখলে এই মৃত্যু এবং একই সঙ্গে রুদাকি ও দাকিকির রচনা—বিশেষত তাঁদের অপূর্ব গজলগুলো যথামর্যাদায় সংকলিত না হওয়ার পেছনে দুটি কারণ পাওয়া যায়। তাঁরা দুজনই কমবেশি জরথুস্ত্রবাদী এবং দুজনই কাব্যচর্চায় তাঁদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার পক্ষপাতী।
পরবর্তীকালে আরবি লিপি, ভাষা এবং এর ব্যাপক প্রভাব যখন সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তখন শেখ সাদি ও অন্যদের আবির্ভাবে নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। আর ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের চোখে এই যুগই বড় হয়ে দেখা দেয়। আমরা শুধু বাইরের ঐতিহাসিকদের কথাই-বা বলি কেন, আমাদের এখানে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্র বহুলপঠিত পারস্য প্রতিভায়ও তো দেখি, বইটি শুরু হয়েছে ফেরদৌসির মাধ্যমে, সেখানে রুদাকি বা দাকিকির আলোচনা নেই। তিনি বরং বইয়ের ভূমিকায়ই উল্লেখ করেছেন, ষষ্ঠ শতকে আরবে যে নতুন ধর্মের জন্ম হয়, তার প্রভাবে পরবর্তী শতকে পারস্যের জাতীয় জীবন বদলে যায়। আর সে সময় যাঁরা তাঁদের ধর্ম বিসর্জন দিতে চাননি, তাঁরা জন্মভূমি ত্যাগ করে হিন্দুকুশে গিয়ে নতুন জনপদ প্রতিষ্ঠা করেন। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্র কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সেখানে আর কেউই রইল না। তারপর, তাঁর মতে, ৬৩৬ সালে হজরত উমরের (রা.) শাসনকালে কাদিশিয়ার যুদ্ধে যেদিন পারস্যের পরাজয় ঘটে, ‘সেই দিন সেই শোণিত-ক্ষেত্রে পারসিকদের প্রাচীন সাহিত্যেরও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদিত হয়’।
এরপর মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্ তাঁর বইয়ে কোনো কবির নাম উল্লেখ না করলেও স্বীকার করেছেন, সাসানীয় বংশের রাজত্বকালে তাদের নির্দেশে লিখিত ‘দুই–চারটি কবিতা’ ছাড়া আর কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। তাঁর মতে, পারস্যের অন্তর্বিপ্লব যেমন মুসলমানদের বিজয়কে সহজ করেছিল, তেমনি তাদের প্রাচীন সাহিত্য ধ্বংসের কারণও হয়েছিল। এতটুকু বলার পরও তিনি গীবনের সূত্র উল্লেখ করে জানাচ্ছেন যে মুসলমানরা বিজয়ী হওয়ার পরও পারস্যের প্রাচীন সাহিত্য ধ্বংস করেনি।
মুসলমানরা ধ্বংস না করলেও কেউ না কেউ তো ধ্বংস করেছিল। কোনো না কোনোভাবে ধ্বংস না হলে এ কথাই–বা উঠছে কেন? মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্র ভাষায়, ‘পারস্যে আরবীয় শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হইবার পরও প্রায় তিন শত বৎসর এই নব শাসক সম্প্রদায় পারস্যের সাহিত্য সমৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করিতে পারে নাই।’ তাঁর পরোক্ষ মত, কেউ ধ্বংস করেনি কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই ধারা স্তিমিত হয়েছিল।
তবে আরবরা আসার পর এবং দুই ভাষা ও সাহিত্যের মিলনের পর পারস্য সাহিত্যের স্বর্ণযুগের যে সৃষ্টি হয়েছিল, এ বিষয়ে সবাই–ই একমত। কিন্তু, তাই বলে প্রাচীন পারস্য সাহিত্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তা ঠিক নয়। রুদাকি ও দাকিকি তো পারস্য ঐতিহ্যেরই অনুসারী এবং জরথুস্ত্রপন্থীও; সাফল্যের পরও পারস্য ঐতিহ্যের অনুসরণ এবং ধর্মের প্রতি বাহ্যিক অনুরাগ দেখাতে পারেননি বলে শুরুতে জানাজার জন্য ফেরদৌসির লাশের খাটিয়া নামাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন ধর্মশাস্ত্রীরা। অথচ এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে রুদাকি, দাকিকি আর ফেরদৌসির যোগসূত্র অঙ্গীকার করেই পরবর্তীকালের স্বর্ণযুগের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কথা হলো, তাঁদের অধিকাংশ সৃষ্টিকর্ম সংকলিত না হওয়ার কারণ কী? জরথুস্ত্রপন্থী বলে? যদি তা-ই হয়, তাহলে তার দায়ভার কে নেবে? যে মত বা চিন্তা জরথুস্ত্রের সঙ্গে মিলেছে অথবা প্রভাব বিস্তার করেছে, সেই মতের অনুসারীদের ওপর তার দায়ভার পড়ে কি না, তা–ও ভেবে দেখার বিষয়। এ ছাড়া ভৃত্যের হাতে, মতান্তরে আততায়ীর হাতে, দাকিকির মৃত্যুই-বা কেন হলো?
এরপরও পূর্বের ধারাবাহিকতায় যে নতুন যুগের সৃষ্টি হলো, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ দাকিকির সঙ্গে ফেরদৌসির যোগসূত্র। অকালমৃত্যুর কারণে তাঁর এক হাজার পঙ্ক্তি গ্রহণ করে তাঁরই মতো প্রায় ফারসি ভাষায়ই শাহনামা রচনার অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ফেরদৌসি। তাঁর এই অমর কীর্তির জন্য তাঁর নিজের গজলসহ অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম যেখানে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, সেখানে দাকিকির আদি রচনা ও গজলগুলো আর কে মনে রাখবে? তবে এরপর শেখ সাদি ও হাফিজের মাধ্যমে পারস্যে সার্থক গজল লেখার স্বর্ণযুগ যে শুরু হবে, তার নেপথ্যে দাকিকির সেই সময়কার বিখ্যাত গজলগুলোর অবদান কে অস্বীকার করবে?