জেমস আজও কেন তুমুল জনপ্রিয়
জেমস—এই নাম শুনলেই এখনো নেচে ওঠে সংগীতপ্রেমী মানুষেরা। দীর্ঘদিন ধরে সেভাবে নতুন কোনো গান না করলেও তাঁর পুরোনো গানগুলো নিয়েই মানুষের উন্মাদনার শেষ নেই। কেন আজও তুমুল জনপ্রিয় এই রকস্টার, আজ ২ অক্টোবর তাঁর জন্মদিনে এই প্রশ্নের সুলক সন্ধান।
‘গুরু’ শব্দটির সঙ্গে শিষ্যেরও সংযোগ আছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটি অনেক সময় শুধু জ্ঞান চর্চায় সীমাবদ্ধ থাকে না। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে আজ পর্যন্ত শুধু দুজন গুরু সম্বোধন পেয়েছেন—পপসম্রাট আজম খান ও রকস্টার জেমস। বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ডসংগীতের একজন পথপ্রদর্শক বলায় যায় আজম খানকে। এমন এক গুরু জীবিত থাকাকালীন ব্যান্ডসংগীতে আরেকজন গুরুর উদয় কীভাবে হলো? জেমসকে কী শুধু ভক্তরায় ভালোবেসে গুরু ডাকে? নাকি তিনি এমন উচ্চতার আসনে উঠতে পেরেছেন?
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কোনো অ্যালবাম প্রকাশ হয়নি। বসুন্ধরা ডিজিটালের ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে গত দুই চাঁদরাতে ‘আই লাভ ইউ’ ও ‘সবই ভুল’ নামে যে দুটি গান গেয়েছেন, সেখানে পাওয়া যায়নি পুরোনো জেমসকে। তারপরও কেন জেমস আজও প্রাসঙ্গিক এবং তুমুল জনপ্রিয়? ৬০ ছুঁই ছুঁই বয়সেও কেন তিনি এখনো মঞ্চে উঠলে একসঙ্গে নেচে ওঠে তরুণ থেকে কিশোর? এই কয়েকটা প্রশ্ন তোলা থাকল বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীদের জন্য, বিশেষ করে রক মিউজিক যাঁরা ভালোবাসেন।
জেমস আসলে ভাঙাগড়ার টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া একজন পোড়খাওয়া মানুষ। পাথরকে মূর্তি বানানোর মতো নিজেকে বহুবার ছেনে ছেনে গড়েছেন। গানের জন্য ঘর পালানো, প্রেমের জন্য জেলে যাওয়া, খেয়ালখুশিমতো চলা—জেমসের জীবনটায় এমন রোমাঞ্চ ও নাটকীয়তায় ভরপুর। গত শতকের আশির শেষার্ধ থেকে প্রথম দশকের শুরু পর্যন্ত গিটার হাতে ঢোলা পাঞ্জাবির সঙ্গে ব্লু জিনস ও লম্বা চুল মাথায় মঞ্চ মাতানো একজন রকস্টারের যে ইমেজ পাওয়া যায়, সেটা বাঙালি আগে কখনো দেখেনি। পাঞ্জাবি পরা বাউল তারা দেখেছে, দেখেছে গিটার হাতে এলভিস প্রিসলির মতো ফ্যাশন সচেতন ও এরিক ক্ল্যাপটন-মার্ক নফলারের ন্যায় সাদাসিধে কিন্তু দুর্দান্ত গিটারিস্টকে। তবে জেমস ছিলেন এ সবকিছুর সমন্বিত ককটেল।
বুকের বোতামখোলা শার্টের সঙ্গে ঘাড় অব্দি এলোমেলো চুল ছেড়ে জেমস যেভাবে বেরিয়ে এসে ডাক দিলেন, ‘এসো চুল খুলে পথে নামি/এসো উল্লাস করি’—সেই উল্লাসের আনন্দে ভেসেছে লাখো তরুণের বিরহকাতর হৃদয়। ১৯৮৭ সালে ‘ফিলিংস’–এর হয়ে প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোডে’ ও দুই বছর পর একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’য় যে টিপিক্যাল সুরেলা গলা ছিল জেমসের, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা ছিল তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন কণ্ঠে ১৯৯৩ সালে ফিলিংসের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘জেল থেকে বলছি’তে হাজির হয়েছিলেন। লেওনার্দ কোহেনের গমগমে পুরুষালি স্বর, নফলারের মতো ক্ল্যাসিক্যাল ব্যারিটোন ও গিটার প্লেয়িংয়ের যেন সন্নিবেশ ঘটেছিল জেমসের মধ্যে। তার মধ্যে গম্ভীর-রাগী চাদরে ঢাকা এক মুখ, সাধারণ মানুষের জীবন থেকে নেওয়া গানের কথা, পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে বাউলিয়ানার মিশ্রণ—বিভিন্ন দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ’৯০ দশকের প্রজন্ম যে নতুনত্বের সন্ধানে ছিল, সেটি তারা পেয়েছিল জেমসের মধ্যে। দীর্ঘ আন্দোলনের পর এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন পতনের পর নতুন উদ্যমতা ও তীব্রতা খুঁজছিল বাঙালি। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। বাঙালির অস্থিতিশীল সময়ে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ও নাটক সাধারণ মধ্যবিত্তদের বাঁচার আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। তেমনি স্বপ্ন হারিয়ে বসা অসংখ্য যুবকের দুদণ্ড শান্তির আশ্রয় হয় ফিতা ক্যাসেটে জেমসের গান। চিৎকার দিয়ে তাঁদের বলতে না পারা কথাগুলো গানে গানে বলেছিলেন জেমস। অবশ্য ওসব নতুন সমাজ গড়া বা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির সাময়িক প্রতিবাদ নয়, অনেকটা ব্যক্তির চিরন্তন গোঙানি।
চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন কণ্ঠে ১৯৯৩ সালে ফিলিংসের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘জেল থেকে বলছি’তে হাজির হয়েছিলেন। লেওনার্দ কোহেনের গমগমে পুরুষালি স্বর, নফলারের মতো ক্ল্যাসিক্যাল ব্যারিটোন ও গিটার প্লেয়িংয়ের যেন সন্নিবেশ ঘটেছিল জেমসের মধ্যে। তাঁর মধ্যে গম্ভীর-রাগী চাদরে ঢাকা এক মুখ, সাধারণ মানুষের জীবন থেকে নেওয়া গানের কথা, পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে বাউলিয়ানার মিশ্রণ—বিভিন্ন দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ’৯০ দশকের প্রজন্ম যে নতুনত্বের সন্ধানে ছিলেন, সেটি তাঁরা পেয়েছিলেন জেমসের মধ্যে। দীর্ঘ আন্দোলনের পর এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন পতনের পর নতুন উদ্যমতা ও তীব্রতা খুঁজছিল বাঙালি। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। বাঙালির অস্থিতিশীল সময়ে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ও নাটক সাধারণ মধ্যবিত্তদের বাঁচার আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। তেমনি স্বপ্ন হারিয়ে বসা অসংখ্য যুবকের দুদণ্ড শান্তির আশ্রয় হয় ফিতা ক্যাসেটে জেমসের গান।
’৮০ থেকে ’৯০ দশক পর্যন্ত বাংলার ‘রক সিনারিও’তে যে দৃশ্য আমরা দেখি, সেখানে ‘এলআরবি’র আইয়ুব বাচ্চু, ‘আর্ক’–এর হাসান, ‘ফিলিংস’ ও পরবর্তী সময়ে ‘নগর বাউল’–এর জেমস আছেন বিশাল ক্যানভাসজুড়ে। গিটারে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে তাঁর পরোক্ষ প্রতিযোগিতা এবং হাসানের ইউনিক ভয়েসের সঙ্গে জেমসের একটা অদৃশ্য লড়াইও কি ছিল না? তার সঙ্গে তরুণদের ওপর আজম খানের প্রভাববিস্তারী জনপ্রিয়তা—এ সবকিছুর চাপ সামলে ফারুক মাহফুজ আনামের ‘জেমস’ হয়ে ওঠা, ভক্তদের কাছে ‘গুরু’ সম্বোধন পাওয়া মোটেও সহজ ছিল না। ‘বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো’ কিশোরটির পাশে যেন জেমস আবুল হাসানের কবিতার মতো আশ্রয় হয়ে আছেন এই বলে, ‘গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম।’
তাহলে জেমসের জাদু এখন আর দেখা যায় না কেন? গান দিয়ে ভারত জয়ের পর তাঁকে সেভাবে আর গানে পাওয়া যায়নি। সামান্য যে কয়েকটা গেয়েছেন, সেসবের লিরিক ও সুর মোটেও ‘জেমসীয়’ নয়। কিন্তু জেমস বলেই ওসব কিছুটা গান হয়ে উঠেছে। এমনও কথা আছে, জেমসকে যদি একটি আস্ত রচনা দেওয়া হয় লিরিকের মতো সাজিয়ে, তিনি তাতে সুর বসিয়ে নিজের মতো গেয়ে যাবেন। কিন্তু কখনো কখনো এসব কিছু বড় মাপের শিল্পীর কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মারজুক রাসেল, প্রিন্স মাহমুদ, দেহলভী, লতিফুল ইসলাম শিবলী, আনন্দ যেসব লিরিক লিখেছিলেন জেমসের জন্য, সেসব আজ মুখে মুখে ফেরে। তবে এখন কি জেমস অমন কালজয়ী লিরিক আর পাচ্ছেন না? অবশ্য নতুন গান না করলেও বাংলা গানে জেমসের নাম রয়ে যাবে অনন্তকাল। বাঙালির হৃদয়ে মা-বাবার প্রতি ভক্তি ও দেশাত্মবোধের যে চিন্তা সেখানে তাঁর ‘মা’, ‘বাবা’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’র আবেদন কখনো ফুরোবে না।
সাইকেডেলিক রক দিয়ে জেমসের উত্থান, গুরুখ্যাতি—ওসব অবশ্য কখনো মুছে যাওয়ার নয়। এখানে ‘গুরু’ শব্দটি ব্যক্তিপূজা বা গুরু-শিষ্য পরম্পরার নয়, বরং গুরু-ভক্তের। যদি জেমসের গান ওষুধ হিসেবে হাজারও হৃদয় শুশ্রূষা করে, তবে ভক্তরা তাঁকে গুরু ডাকতেই পারে।