সাহিত্যের দায়িত্ব কি ‘সুশীল’ হওয়া
যে সময় ‘মিসোজিনি’ কিংবা ‘জেনোফোবিয়া’র মতো শব্দগুলোই আবিষ্কৃত হয়নি, সেই সময়ের কোনো সাহিত্যকে কি আমরা একবিংশ শতাব্দীর বাটখারায় মাপতে পারি? কোনো লেখক কি সব সময় ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ বা রাজনৈতিকভাবে সঠিক থেকে সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা করতে পারেন? এ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক।
যে সময় ‘মিসোজিনি’ কিংবা ‘জেনোফোবিয়া’র মতো শব্দগুলোই আবিষ্কৃত হয়নি, সেই সময়ের কোনো সাহিত্যকে কি আমরা একবিংশ শতাব্দীর বাটখারায় মাপতে পারি? কোনো লেখক কি সব সময় ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ বা রাজনৈতিকভাবে সঠিক থেকে সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা করতে পারেন? এ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক।
ইদানীং শিশুরা বই পড়তে চায় না—এটা খুব সাধারণ অভিযোগ সবার। আমাদের ছোটবেলায় বিনোদনের এত মাধ্যম ছিল না, এখন শিশুদের হাতে অনেক কিছুই আছে বলে স্বভাবতই তারা বই কম পড়ে। আমি আবার বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আশপাশের শিশুদের বই উপহার দিতে পছন্দ করি। খুব উৎসাহের সঙ্গে বিখ্যাত লেখক রোয়াল্ড ডালের বেশ কিছু বই কিনে ফেলেছিলাম নীলক্ষেত থেকে, আমার ভাগনে-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজিদের মধ্যে বিলানোর জন্য। শিশুরা অনেকেই চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি, মাটিল্ডা কিংবা উইচেস চলচ্চিত্র দেখে ফেলেছে বলে পড়তে অতটা আগ্রহী হয়নি। মনে মনে আফসোস করেছি, আহা, এত সুন্দর বই এরা পড়ছে না! আমার মনে হয়েছে, আমি কেন ছোটবেলায় রোয়াল্ড ডালের বইগুলো পেলাম না! কিন্তু আসলেই কি রোয়াল্ড ডাল এত ভালো কিছু, যা সবার সোনালি শৈশবের অংশ হওয়াটা কাম্য? মাটিল্ডা উপন্যাসের ভিলেন মিস ট্রাঞ্চবুলসহ প্রায়ই খিটখিটে বুড়িদের চরিত্র তৈরি করেছেন লেখক। প্রচণ্ড সরেস ভাষা হলেও সূক্ষ্ম নারীবিদ্বেষ লক্ষ করা যায় নাকি?
অবশ্য রূপকথায় নারীবিদ্বেষ নতুন ব্যাপার নয়। আমাদের দেশের ঠাকুরমার ঝুলিতে সব সময়ই দুয়োরানিরা ছিল, ছিল জাদু করে পাথর বানিয়ে দেওয়া ডাইনি বুড়িরা। এমনকি আমাদের লোকছড়াতেও বলা হয়েছে, ‘মামি এল লাঠি নিয়ে পালাই পালাই’, মামাবাড়ির আদর নষ্ট করার জন্য, দুধভাত থেকে বঞ্চিত করার জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে মামিকেই। ইউরোপীয় রূপকথাও কম যায় না, সিন্ডারেলা আর স্নো হোয়াইটের, হ্যানসেল আর গ্রেটেলের সব দুর্ভোগের জন্য দায়ী তাদের সৎমায়েরা, কখনোই বাবা নয় বা অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয় নয়। আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিন তাঁর উইমেন হেইটিং বইয়ে রূপকথা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, রূপকথার ভালো নারীরা হয় মৃত নতুবা মৃতপ্রায়। যেকোনো সাহসী, স্বনির্ভর আর নিজের ইচ্ছায় চলা নারীকেই রূপকথায় ‘ডাইনি’ হিসেবে দেখানো হয়।
অধুনা রোয়াল্ড ডাল কোম্পানি জানাল, তারা বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী (জেন্ডার ইনসেনসিটিভ) বা ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ (রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়) যেকোনো শব্দ বদলে দেবে, যেন বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠী ডালের লেখা উপভোগ করতে পারেন। এহেন সেন্সরশিপের নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই, যাঁদের মধ্যে আছেন সালমান রুশদির মতো লেখক, এমনকি কুইন কনসর্ট ক্যামিলাও। তাঁরা মনে করেন, লেখকের মৃত্যুর আগেই হোক বা পরে, এমন সম্পাদনা আসলে লেখকের বাক্স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার প্রকাশ এবং শিল্পের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। আবার একদল পাঠক এই মর্মে মত দিয়েছেন যে এত কিছু করে কোনো লাভ হবে না। রোয়াল্ড ডালের লেখায় বহু ধরনের ঘৃণা আর বিদ্বেষ সব সময়ই প্রকাশ পেয়ে এসেছে, শব্দ পাল্টে কী হবে? মূলভাব তো আর পাল্টে দেওয়া যাবে না। চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরির অগাস্টাস গ্লুপ নামের ছেলেটির বর্ণনায় তাকে ‘মোটা’র (fat) বদলে ‘বড়সড়’ (enormous) লিখে দিয়ে শেষ রক্ষা করা যাবে না। পেটুক ধরনের বাচ্চাদের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক মনোভাব লুকানোর কোনো উপায় আসলে নেই। ‘ফ্যাট শেমিং’ বা ‘বডি শেমিং’ এড়ানো অন্তত ডালের লেখায় সম্ভব হবে না। চরিত্রদের বর্ণনায় তিনি ‘তারের মতো চিকন’ কিংবা ‘ঘাসের মতো শুকনো’ ধরনের শব্দবন্ধ হামেশাই ব্যবহার করেছেন। তার ওপর ডাল তাঁর সাক্ষাৎকারেই ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ প্রকাশ করেছেন সরাসরি, ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি হিটলারের ঘৃণা আর জিঘাংসাকে একভাবে জায়েজই করেছে তাঁর ওই মত।
অ্যান্টিসেমিটিজমের প্রশ্নে ক্ষমা করা যায় না নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকেও। দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস–এর শেষ দৃশ্যে শাইলকের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে আজ পর্যন্ত সমালোচকেরা নাস্তানাবুদ হচ্ছেন, তাত্ত্বিকেরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন সর্বযুগের সেরা নাট্যকারকেই। আধুনিক মন ব্যাখ্যা দেয়, শেক্সপিয়ারের সময়কালে ইহুদিবিদ্বেষ যে পর্যায়ের ছিল, তাতে খুনের পরিকল্পনার মতো বড় অপরাধ করার পরও একজন ইহুদিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁকে ধর্মান্তরিত করতেই হতো। মহাকবি বলেই শেক্সপিয়ার শাইলকের মুখে এমন সংলাপ দিতে পেরেছিলেন যেখানে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘খ্রিষ্টানের মতো ইহুদিরও কি ব্যথার অনুভূতি নেই? খোঁচালে কি তাঁদের গা থেকে রক্ত বেরোয় না?’ কিংবা দ্য টেম্পেস্ট–এর ক্যালিবান ঔপনিবেশিক শাসকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমার শেখানো ভাষায়ই আজ আমি অভিশাপ দিই।’ তবু আমাদের তত্ত্বজ্ঞানী মন প্রশ্ন করে, ওথেলোকে কেন একজন আফ্রিকান ‘মুর’ হতে হলো? ‘সভ্য’ ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ পুরুষেরা কেউ কি এমন সন্দেহপ্রবণ হন না? ঈর্ষাকাতর হয়ে বিশ্বস্ত স্ত্রীকে হত্যা করা এই নাবিকের বুদ্ধিশুদ্ধি এত কম দেখিয়ে, ইয়াগোর ষড়যন্ত্র ধরতে না পারা এই ঈর্ষাপরায়ণ স্বামীকে কৃষ্ণাঙ্গ বানিয়ে কি শেক্সপিয়ার ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র পক্ষেই থাকলেন না? সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক মঞ্চস্থ নাটক হ্যামলেট–এ তিনি নায়কের মুখে সংলাপ দিলেন, ‘ফ্রেইলটি, দাই নেইম ইজ উয়োম্যান’ (নারীর অপর নাম দুর্বলতা)। যুগে যুগে পুরুষেরা নারীকে দুর্বল আর মানসিকভাবে ভঙ্গুর প্রমাণ করতে উদ্ধৃত করলেন এই সংলাপ, লেডি ম্যাকবেথকে দিয়ে বলালেন, স্বার্থের জন্য তিনি স্তন্যপানরত শিশুকেও মায়ের বুক থেকে কেড়ে আনতে পারেন। এগুলো কি সরাসরি নারীবিদ্বেষ নয়? কিং লিয়ার আত্মগরিমায় অন্ধ হয়ে কর্ডেলিয়াকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলেও শেষ পর্যন্ত টের পান, কোন কন্যা তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। কিন্তু প্রসপারো বাবা হিসেবে আদর্শ নয় তো বটেই, এমনকি স্নেহশীলও ছিল না। মিরান্ডাকে ব্যবহার করে নিজের প্রতিশোধ আদায়ের উপায় হিসেবে, ঔপনিবেশিক শাসক শুধু নয়, পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চার এক মূর্তিমান উদাহরণ তিনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে সময় ‘মিসোজিনি’ কিংবা ‘জেনোফোবিয়া’র মতো শব্দগুলোই আবিষ্কৃত হয়নি, সেই সময়ের কোনো সাহিত্যকে কি আমরা একবিংশ শতাব্দীর বাটখারায় মাপতে পারি? কিংবা এর প্রয়োজনীয়তা ঠিক কতটুকু? ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিনকে সমালোচকেরা বলেছিলেন ‘বর্ণবাদী’। শুধু ‘নিগার’ শব্দটি, যা আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়, সেকালেও ‘স্ল্যাং’ বা গালি হিসেবেই বিবেচিত হতো আর এখন তো রীতিমতো ট্যাবু। অপসারণ করলেই কি মার্ক টোয়েনের এই কালজয়ী সাহিত্যকর্ম বর্ণবাদের লিটমাস পরীক্ষায় পাস করে যাবে? ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন রেইলটন মনে করেন, না, যাবে না। তাঁর মতে, মার্ক টোয়েনের ভক্তরা যতই একে ‘বাস্তবসম্মত’ ব্যবহার বলে হাকের মুখে মানিয়ে যাওয়ার কথা বলুক, হাকের মধ্যে জিম নামের কৃষ্ণাঙ্গ পালিয়ে আসা দাস চরিত্রটির সঙ্গে বন্ধুত্বের ফলে সৃষ্টি হওয়া মানবিকতাবোধ জাগ্রত হওয়ার ব্যাখ্যা দিক, টোয়েন মোটের ওপর তাঁর ভাষা ও বর্ণনায় ‘রেসিস্ট স্টেরিওটাইপ’–এর ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। আমেরিকান সমাজে এই বিতর্ক এখনো চলমান। কেননা শ্রেণিকক্ষে পড়াতে হলে কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীরা যেখানে মোট ২১৯ বার ‘নিগার’ শব্দটি আছে, সেই বই পড়তে কেমন অনুভব করবেন, তা খেয়াল রাখতে হয়। শব্দ অপসারণ নয়, বরং সিলেবাস থেকেই এই উপন্যাসকে বাদ দেওয়ার পক্ষে অনেকে মত দিয়েছেন। উপন্যাসটির ১০০ বছর পূর্তিতেও কথা উঠেছে যে একসময় নিষিদ্ধ থাকা উপন্যাস, যাকে আজ ‘ক্ল্যাসিক’ বলে সমাদর করা হচ্ছে, আসলেই তা শ্রেণিকক্ষে পঠিত হওয়ার উপযুক্ত কি না। ধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ করা নিয়ে রক্ষণশীলেরা ক্ষিপ্ত ছিলেন মার্ক টোয়েনের ওপর, আবার প্রগতিশীলেরা তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন বর্ণবাদের দায়ে। পেন আমেরিকা মনে করে, এই যে শিক্ষার্থীরা পড়তে গিয়ে ‘অস্বস্তি’তে পড়ছেন বলে আমেরিকার বিভিন্ন স্কুল কমিউনিটির দাবির কাছে মাথা নুইয়ে বইটিকে সরিয়ে দিচ্ছেন, সাহিত্যপাঠের সময় এই অস্বস্তিই খুব প্রয়োজনীয়। সেকালের আমেরিকার বর্ণবাদী চরিত্র বুঝতে হলে এই অস্বস্তি অনুভব করাই জরুরি।
‘জেন্ডার’ লেন্সের তলায় ধরলে অনেক কালজয়ী সাহিত্যই মার খেয়ে যাবে।
এ তো গেল ইংল্যান্ড আর আমেরিকার কথা। ব্রিটেনের প্রথম নোবেল বিজয়ী লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের কিম পড়ার সময় আমরা যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদের শিকার, আমাদের মধ্যে অনেকেই এখনো বের হতে পারি না ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ থেকে, নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হই। ‘কলোনিয়াল প্রোপাগান্ডা’ শুধু নয়, কিমকে রীতিমতো ‘ইমপেরিয়ালিজমের ম্যানিফেস্টো’ বলে মনে হয়। দ্য টেম্পেস্ট–এর ক্ষেত্রে একবিংশ শতাব্দীর দৃষ্টিভঙ্গিকে সরিয়ে রাখা গেলেও, উপন্যাস হিসেবে কিম আমাদের কাছে ব্রিটিশ কলোনিয়াল হেজিমনিরই উদাহরণ হিসেবে রয়ে যাবে।
লেখক ব্যক্তি হিসেবে যে ধরনের রাজনীতি ধারণ ও বহন করেন, লেখার সময় সেই অবস্থানের ঊর্ধ্বে ওঠা যায় না। অনেক লেখক সেই চেষ্টা করেন সচেতনভাবে, অনেকে করেনই না। শতভাগ নিরপেক্ষ হওয়া কখনো কারও পক্ষে আদৌ সম্ভব হয় কি না, সেটিও প্রশ্ন বটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তুরস্কের লেখক এলিফ শাফাকের সাড়াজাগানো উপন্যাস দ্য বাস্টার্ড অব ইস্তাম্বুল–এর কথা। শাফাক একটি পারিবারিক গল্পের মোড়কে তুলে এনেছেন তুরস্কের ইতিহাসের ভুলে যাওয়া কিংবা মুছে ফেলতে চাওয়া একটি অধ্যায়কে। আর্মেনিয়ান গণহত্যার সময় আর্মেনিয়ান পরিবারদের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ (জাতিগত নিপীড়ন) থেকে বাঁচতে পালিয়ে যাওয়ার সেই হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা। তুর্কি পরিবারের আর্মেনিয়ান এক পিতামহীর অভিজ্ঞতাকে নিরপেক্ষভাবে দেখাতে গিয়ে লেখক পড়েছেন ভীষণ বিপদে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে তাঁর নামে, বইটিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তুরস্কে। দেশের জাতীয় ভাবমূর্তিকে আহত করার দায় নিতে হয়েছে এলিফ শাফাককে, যদিও তিনি আসলে থাকতে চেয়েছিলেন ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ বা রাজনৈতিকভাবে সঠিক। কেবল তুর্কি পক্ষের গল্পটুকু না বলে আর্মেনিয়ান পক্ষের গল্পটিকেও ‘নন–বায়াসড’ বা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দেখতে আর দেখাতে চেয়েছিলেন।
লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো লেখক সব সময় যে ‘সুসামাজিক’ বা ‘সুশীল’ থেকে ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ অবস্থান মান্য করবেন, এমন না-ও হতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের খুব প্রিয় লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়েকেও অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক, এমনকি বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদের নারী চরিত্র সৃষ্টির অতি রোমান্টিক পন্থা আর নায়িকাদের বিপরীতে ক্ষ্যান্ত পিসি ধরনের খিটখিটে মা-খালা-চাচি-ফুফুদের তুলনায় নিরীহ, গোবেচারা, নিপীড়িত পুরুষ চরিত্রের আধিক্য এই সর্বজনপ্রিয় লেখকের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবায়। ইদানীং আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্তকে রীতিমতো নারীবিদ্বেষী হিসেবে আবিষ্কার করেছি। ‘জেন্ডার’ লেন্সের তলায় ধরলে অনেক কালজয়ী সাহিত্যই মার খেয়ে যাবে। তবু আমি সাহিত্যের পাঠক, শিক্ষার্থী আর শিক্ষক হিসেবে মনে করি, তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রেও আমাদের যথেষ্ট সাবধানী হওয়ার প্রয়োজন আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসের সেই বিখ্যাত সংলাপ—‘শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?’ আপাতদৃষ্টে নারীর যৌনতার সঙ্গে তার হৃদয়াবেগের তুলনা করে তাকে শরীরসর্বস্ব হীনতর প্রাণী হিসেবে দেখায়। এই সংলাপের জবাবে ‘শশীকে কুসুম’ শিরোনামের একটি কবিতাও লিখেছেন কবি নবনীতা দেবসেন, যার শুরুর লাইন—‘মনটা আবার কী জিনিস গো, ছোটবাবু?/আমরা ছোটলোক, আমাদের শরীলটুকুনই ভরসা’। মনোযোগী পাঠক হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, উপন্যাসের শেষের দিকে কুসুম নিজেই শশী ডাক্তারকে জানিয়েছিল, একসময় শশীর জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকলেও, এখন সে হাত ধরে টানলেও শশীর সঙ্গে যাবে না। ক্রমাগত উপেক্ষা আর অবহেলা প্রেমপ্রার্থিনী ‘পরানের বউ’কে যে দৃঢ়তা দিয়েছে, যে আত্মসম্মানবোধের ফলে সে ছোটবাবুকে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে, তা মানুষ হিসেবে তার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করে।
তবে সব ধরনের তত্ত্ব প্রয়োগের ফলে সাহিত্যের আনন্দ যে মাঠে মারা যায়, সেটিও সত্যি। লেখকের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকতেই পারে পাঠক, সমালোচক আর গবেষকদের। কিন্তু এটাও মনে রাখা জরুরি যে সাহিত্য সংবাদপত্র নয়, লেখকও নন সাংবাদিক। ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ তথা লেখক যদি সব সময় রাজনৈতিকভাবে ঠিক থাকতে চান অথবা তিনি যদি নিজের অবস্থানে বস্তুনিষ্ঠ থাকতে চান, তখন অনেক ক্ষেত্রে এটা তাঁর সৃজনশীল কল্পনায় বাধার সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তো ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস লেখাই বন্ধ করে দিতে হবে জগতের সব লেখককে। লেখক কোন পক্ষে যাবেন, সেটিই শুধু একমাত্র চিন্তা নয়, কোন ঐতিহাসিক চরিত্রকে কীভাবে কোন আলোতে ফেলে দেখালেন, সেই দেখানোকে কার কাছে কেমন মনে হলো, সেই চিন্তাও করতে হবে। তখন সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টির মূল প্রক্রিয়াই বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে হয়।
সম্প্রতি পরলোকে যাওয়া লেখক মিলান কুন্ডেরাকে জীবনের ৪৮টি বছর নির্বাসিত থাকতে হয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান শাসক রেজিমের মনঃপূত হয়নি বলে। লেখকের রাজনৈতিক অবস্থান—তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হোক অথবা লৈঙ্গিক ও নৃতাত্ত্বিক হোক—সব পাঠকের সঙ্গে মিলবে না, এটাই স্বাভাবিক। সে জন্য তাঁর সৃষ্টিতে ছুরি–কাঁচি চালানো, লেখা নিষিদ্ধ করা কিংবা তাঁকে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করাটা কি অন্যায় নয়?