ইকবাল, আপনি যেখানেই যান, ভালো থাকবেন
লিভার সিরোসিসে ভুগে আজ সকালে মারা গেছেন কবি ইকবাল আজিজ। ১৯৫৫ সালে মাতুলালয় নাটোরে জন্ম নেওয়া এই কবির পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়ায়। বেশ অনেক দিনই বন্ধু–পরিচিতজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিভৃতিকে বরণ করে নেওয়া ইকবাল আজিজ আজ চলে গেলেন অনন্ত নিভৃতিতে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ লেখা লিখেছেন প্রাবন্ধিক–গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান।
আর কোনো দিন কোথাও তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না। মাথা একটু হেলিয়ে বা ঝুঁকে আনমনে পথচলা সেই মানুষটাকে ঢাকা শহরের কোথাও আর দেখতে পাব না। অনেক কাল কোনো সভা-সেমিনার-অনুষ্ঠানে, বইপাড়ায় কিংবা হঠাৎ পথচলতি সাক্ষাৎ ও সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় ছাড়া কোথাও দুদণ্ড বসে আলোচনা বা মতবিনিময়ের সুযোগ হয়নি আমাদের। শেষবার তেমন সুযোগ হয়েছিল, যত দূর মনে পড়ছে, কয়েক বছর আগে ‘কালি ও কলম’ আয়োজিত কবি নীরেন চক্রবর্তীর সংবর্ধনা উপলক্ষে বেঙ্গল শিল্পালয়ে, অনুষ্ঠান শুরুর আগে। সেদিন বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার অবস্থা নিয়ে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। তাঁর অসন্তুষ্ট বা ক্ষুব্ধ মনের পরিচয় পেয়েছিলাম সেদিন। পরে ফেসবুকেও কখনো কখনো তিনি এ নিয়ে লিখতেন দেখেছি। মাঝেমধ্যে আমার ও অন্যদের পোস্টের নিচে ইংরেজিতে মন্তব্য করতেন।
সোহরাব হাসান, নাকি আইয়ুব হোসেন—কার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, আজ আর মনে করতে পারছি না। কিন্তু ১৯৮০–এর দশকের গোড়ায় হাতিরপুল নর্থ সার্কুলার রোডের আমাদের সেই ডেরায় ইকবালের প্রায়ই আসা এবং আড্ডার কথা মনে পড়ছে। আমার চেয়ে সোহরাব ও আইয়ুবের সঙ্গেই অবশ্য তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। এর কিছুদিন পর তো আমরা একই ভবনের ওপরে-নিচে বসবাস সূত্রে নিকট প্রতিবেশীই হয়ে যাই। সে সময়ের অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করছে আজ মনের কোনায়। বাংলা একাডেমি থেকে আমার ‘বেগম রোকেয়া: সময় ও সাহিত্য’ বইটি প্রকাশের (১৯৮২) খবর তিনিই একদিন সকালে পরোমৎসাহে আমাকে টিপু সুলতান রোডে দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ অফিসে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। তারপর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রন্থকেন্দ্রের ‘বই’ পত্রিকায় সে বইটি নিয়ে একটা আলোচনাও লিখেছিলেন তিনি। তাঁর কাছে এ আমার অপরিশোধ্য ঋণ।
তাঁর কবিতা আমি পছন্দ করতাম। পত্রপত্রিকায় কয়েকটি গল্প পড়েও ভালো লেগেছিল। সে কথা সাক্ষাতে তাঁকে জানানোতে খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। সেদিনের শিশুসুলভ সারল্যে উদ্ভাসিত তাঁর মুখটি এখনো আমার চোখে ভাসে। তিনি চেয়েছিলেন, আমি তাঁর কবিতার বই নিয়ে একটি আলোচনা লিখি। কথা দিয়েও আমি কথা রাখতে পারিনি। সে অপরাধবোধ আমাকে আজ আমাকে ভীষণভাবেই পীড়িত করছে।
তাঁর কবিতা আমি পছন্দ করতাম। পত্রপত্রিকায় কয়েকটি গল্প পড়েও ভালো লেগেছিল। সে কথা সাক্ষাতে তাঁকে জানানোতে খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। সেদিনের শিশুসুলভ সারল্যে উদ্ভাসিত তাঁর মুখটি এখনো আমার চোখে ভাসে। তিনি চেয়েছিলেন, আমি তাঁর কবিতার বই নিয়ে একটি আলোচনা লিখি। কথা দিয়েও আমি কথা রাখতে পারিনি। সে অপরাধবোধ আমাকে আজ আমাকে ভীষণভাবেই পীড়িত করছে।
গতকাল কি পরশু তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে তাঁর ছেলের দেওয়া একটা পোস্ট থেকে জানলাম, ইকবাল অসুস্থ, তিনি লিভার সিরোসিসে ভুগছেন। নিশ্চয় বেশ কিছুদিনের ব্যাপার! কিন্তু আমরা বন্ধু ও পরিচিতজনেরা কি তাঁর এই অসুস্থতা, এই সংকটাপন্ন অবস্থার কথা জানতাম?
ইকবাল, আপনি যেখানেই যান, ভালো থাকবেন। এ মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও আবার কি আমাদের দেখা হবে না? আমি তো বিশ্বাস করতে চাই, হবে।