বিজয়ের পরের পঙ্ক্তিমালা
উদ্বাস্তু
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর থেকে পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। এ সময় পত্রিকাগুলোতে আলাদাভাবে সাহিত্যপাতা দেখা যায়নি, দু–একটি কবিতা যা ছাপা হয়েছে, তা মূল কাগজের ভেতরেই। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা ‘রোববারের সাহিত্য’ নামে আলাদাভাবে সাহিত্যের একটি পাতা বের করে। ১০টি কবিতার সমাহারে বিন্যস্ত এই আয়োজনের শীর্ষনাম ছিল ‘কবিতায় স্বদেশ, সংগ্রাম, স্বাধীনতা’। আর এ সংখ্যায় সূচিবদ্ধ ১০ কবি হলেন আহমদ রফিক, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ, ফরহাদ মজহার, আবুল হাসান, হুমায়ূন কবির ও শাহ নূর খান। শহীদ কাদরীর ‘নিষিদ্ধ জর্নাল থেকে’ এবং আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলি শোকের’—এই বিখ্যাত দুই কবিতা এখানেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই সংখ্যা থেকে নির্বাচিত কবিতা।
আমি কি কখনো জানতুম এত দ্রুত
শহরের চেনা দৃশ্যাবলি লুপ্ত হয়ে যাবে? একটি রাত্তিরে
আমার সারাটা মাথা বিষম রুপালি হয়ে যাবে?
কেমন বদলে গেছি অতি দ্রুত নিজেরই অজ্ঞাতে।
আমার চাদ্দিকে দরদালান কেবলই যাচ্ছে ধ্বসে,
আমার সম্মুখে
এবং পেছনে
দেয়াল পড়ছে ভেঙে একে একে, যেন
মাতাল জুয়াড়ি কেউ নিপুণ হেলায়
হাতের প্রতিটি তাস দিচ্ছে ছুড়ে। আমি
কত ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে হাঁটি
করাল বেলায়। জনসাধারণ ছিন্ন
মালার মুক্তোর মতো বিক্ষিপ্ত চৌদিকে।
সমস্ত শহর আজ ভয়াবহ শবাগার এক। কোনোমতে
দম নিই দমবন্ধ ঘরে। জমে না কোথাও আভা,
রেস্তোরাঁ নির্জন। গ্রন্থে নেই মন, আপাতত জ্ঞানার্জন বড়
অপ্রয়োজনীয় ঠেকে। ঘর ছেড়ে পথে
পা বাড়াতে ভয় পাই। যেদিকেই যাই
ডাইনে অথবা বাঁয়ে বিষণ্ন স্বদেশে বিদেশিরা
ঘোরে রাজবেশে। রেস্তোরাঁয়, পার্কে, অলিতে–গলিতে
শহরতলিতে শুধু ভিনদেশি ভাষা যাচ্ছে শোনা।
বস্তুত বিষ্ণণ্ন এ শহরে হত্যাময় শহরে
স্বদেশির চেয়ে বিদেশির সংখ্যা বেশি। নাগরিক
অধিকারহীন পথ হাঁটি, ঘাড় নিচু, ঘাড়ে মাথা
আছে কিবা নেই বোঝা দায়! এই মাথার ওপর
আততায়ী, শাসক সবার
আছে পাকাপোক্ত অধিকার। কেবল আমারই নেই।
যদিও যাইনি পরবাসে, তবু আমি
বিষণ্ন উদ্বাস্তু একজন। ক্লান্ত মনে ধরে ঘুণ, শুধু ঘুণ।