মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কবিতা ছাপা হয়নি 

  ভূমিকা  

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরদিন ২৬ মার্চ ৭৭ নম্বর সামরিক আইনবিধিতে গণমাধ্যমের ওপর প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করে পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র। যার মোদ্দাকথা হলো, সরকারিভাবে নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আগে পেশ না করে এবং কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো বিষয় প্রকাশ করা যাবে না। তাই অবরুদ্ধ বাংলায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখি সহজ ছিল না।

তবে সেই কঠিন দুঃসময়ে কেউ কেউ লেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব ছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের সপক্ষে পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠালেও সেসব লেখা প্রকাশ করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ছাপাতে না পারা এমনই তিনটি কবিতা ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি দৈনিক বাংলার ‘মহিলা মহল’ পাতায় প্রকাশিত হয়। (সরকারি এ সংবাদপত্রের আগের নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধের পর নাম পরিবর্তন করে পত্রিকাটি দৈনিক বাংলা নামে প্রকাশিত হয়)। দুজন নারীর লেখা কবিতাগুলোর ওপর লেখা হয় ‘যে লেখা ছাপতে পারিনি’। সেখানে কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ও জরিনা আখতারের কবিতা ছিল। তবে এখানে এখন কেবল জরিনা আখতারের কবিতা ও সেই কবিতাসংক্রান্ত সাক্ষাৎকারই ছাপা হলো।

জরিনা আখতারের কবিতা লেখা শুরু ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, স্কুলছাত্রী থাকাকালে। পেশাগত জীবনে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করে এখনো লেখালেখিতে সক্রিয় তিনি।

তো ১৯৭১ সালে ‘সহমর্মিতা’ শিরোনামে জরিনা আখতার দৈনিক বাংলায় পাঠিয়েছিলেন দুটি কবিতা—‘বান্ধবীকে’ ও ‘দামাল কিশোর আজ’।

এই কবিতায় পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা উঠে এসেছে। এর ভাষা, শব্দপ্রয়োগ ও ভাবার্থের দিকে খেয়াল করলে পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন, কবিতাগুলো যুদ্ধকালে কেন প্রকাশিত হয়নি।

কবিতা দুটিতে সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

সহমর্মিতা

জরিনা আখতার

১. বান্ধবীকে

শুনেছি তোমার ঘর নেই, এলোমেলো

                        হয়ে গেছে সব;

প্রিয় টেবিল, পুস্তক কোথায় বিলীন হলো।

তোমার ঠিকানা লুকানো ছিল

            মাধবীর ঝাড়ে,

শ্বাপদের নখের মতো কোনো নখ

            তোমার ঠিকানা তুলে নিল;

বিক্ষত মাধবীর ঝড়ে পড়ে আছ,

            তোমার ঠিকানা নেই।

শুনবে আমার কথা।

আমি ভালোই আছি, আমি যে সইতে জানি;

 গোপন বেদিতে নিশিদিন বেদনার

                        নিধনযজ্ঞ ঘটাই।

যদি বেঁচে থাকো—

আমার নামের অস্ত্র ধারণ করো নিউজপেপারের পৃষ্ঠা হতে।

২. দামাল কিশোর আজ

অশান্ত চোখ তুলে কি দেখছ কিশোর।

লাটিম-ঘুড়ির স্তূপ জমে আছে

            সবুজ ঘাসের বুকে;

কাদার ভেতর হতে চকচকে মাছেরা এসে লুটায় তোমার পায়ের কাছে।

কত দিন ডেকেছি তোমাকে,

হে দামাল কিশোর, পালিয়েছ হেসে।

আজ বড় কাছাকাছি এসে গেছ,

লাটিম-ঘুড়িবর্জিত হাতে কি তুলেছ আজ।

অশান্ত চোখ হাতে আমারই মতো

                        কি ছড়াতে চাও।

এসো হে কিশোর, আজ বধ্যভূমিতে

                        দাঁড়াতে হবে।

  যেভাবে কবিতা দুটো পাঠিয়েছিলেন কবি

জরিনা আখতারের সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন: ‘বান্ধবীকে’ ও ‘দামাল কিশোর আজ’ কবিতা দুটি মুক্তিযুদ্ধকালে ঠিক কোন সময় লিখেছিলেন?

উত্তর: কবিতা দুটো মুক্তিযুদ্ধকালে ঠিক কোন সময়ে লিখেছিলাম, তা মনে করতে পারছি না। তবে এইটুকু স্পষ্ট মনে আছে, স্বাধীনতার পরপরই আমার ওই কবিতা দৈনিক বাংলায় ‘যে কবিতা ছাপতে পারিনি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কবিতাগুলো তখন আমি সংরক্ষণ করতে পারিনি। ফলে হারিয়ে যায়।

প্রশ্ন: আপনি তখন ঢাকায় ছিলেন?

উত্তর: আমি ঢাকায়ই ছিলাম। থাকতাম আসাদ গেটসংলগ্ন একটি কলোনিতে, যেটিকে নিউ কলোনি বলা হতো। তখন এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। বিহারিদের আনাগোনা সব সময় লেগে থাকত। তারা নানা রকম ভয়ভীতি দেখাত।

প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখি করা বেশ কঠিন ছিল। আর কবিতা লিখে সেটি ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ পাঠানো তো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

উত্তর: মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে কবিতা দুটো লেখা এবং তা পত্রিকায় পাঠানোর ব্যাপারটি ছিল মূলত আবেগের তাড়না। মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন এবং নিজেদের স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্নের সপক্ষে কবিতা দুটো লিখেছিলাম। পরে ডাকমারফত সে কবিতা পত্রিকায়ও পাঠিয়েছিলাম। তখন আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি। আজ বুঝতে পারি, সেদিনের বাস্তবতায় কতটা অপরিণামদর্শী ছিল আমার এই পত্রিকায় পাঠানোর ব্যাপারটি। কিন্তু আমি গর্বিত যে স্বাধীনতার পক্ষে আমার কলম কথা বলেছিল।

 ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বাশার খান