যে কারনে এখন থেকে আর কবিতা প্রকাশ করবেন না জয় গোস্বামী

যদি আর পাঁচ–সাত বছর বেঁচে থাকেন, তখন ভেবে দেখবেন, কবিতা প্রকাশ করবেন কি করবেন না।

জয় গোস্বামীছবি: তানভীর আহাম্মেদ

কবিতায় একদা তিনি লিখেছিলেন, ‘এক পৃথিবী লিখব বলে একটি খাতাও শেষ করিনি!’ পশ্চিমবঙ্গের সেই জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী এবার দিলেন এক বিস্ময়কর ঘোষণা, এখন থেকে আর কবিতা প্রকাশ করবেন না তিনি। সম্প্রতি নিজের কবিতা প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা প্রকাশের ৫০ বছরে নামের এক পুস্তিকায় দীর্ঘ একটি লেখার মাধ্যমে জয় গোস্বামী এ ঘোষণা দিয়েছেন। তবে কবিতা প্রকাশ না করলেও কবিতা লেখা থেকে অবসর নিচ্ছেন না এই খ্যাতিমান কবি। জয় গোস্বামী জানিয়েছেন, এখন থেকে তিনি নীরবে-নিভৃতে লিখে যাবেন। যদি আর পাঁচ–সাত বছর বেঁচে থাকেন, তখন ভেবে দেখবেন, কবিতা প্রকাশ করবেন কি করবেন না।

কবিতা প্রকাশের ৫০ বছরে পুস্তিকায় জয় গোস্বামী লিখেছেন: ‘আমার ৫০ বছর কবিতা প্রকাশের পূর্তি আমি আমার রচনা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েই উদ্​যাপন করতে চাই। যেসব সম্পাদক আমার লেখা সম্মান দিয়ে এত বছর প্রকাশ করে এসেছেন, তাঁদের কাছে আমার আভূমি-নত কৃতজ্ঞতা অর্পণ করি। পাশাপাশি আমার কাছে আর লেখা চেয়ে চিঠি না দেওয়ার অথবা ফোন না করার জন্যও মিনতি জানাই। তাঁদের “না” বলতে আমার দুঃখ হবে, অথচ “না” তো বলতেই হবে আমার আত্মপরীক্ষার জন্য। তাঁরা যে আমাকে দুঃখ দিতে চান না, এ-কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি!’

নিজের এ সিদ্ধান্তকে জয় গোস্বামী ‘আত্মপরীক্ষা’ বলে উল্লেখ করে এখন থেকে কেউ যেন পুরস্কার দেওয়ার জন্য তাঁর নাম বিবেচনা না করেন, এমন অনুরোধও করেছেন।

জয় গোস্বামী দুবার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়া বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সাম্মানিক ডি লিটও লাভ করেছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় এই কবি।

গেল ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের সময় কবিতা প্রকাশের ৫০ বছরে শিরোনামের পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়েছে। বিনা মূল্যে পুস্তিকাটি পাওয়া যাচ্ছে কলকাতার বিভিন্ন বইয়ের দোকানে। সেই পুস্তিকায় জয় গোস্বামী আরও লিখেছেন, ‘একটি কবিতার পেছনে সর্বোচ্চ পরিশ্রম প্রয়োগ করার সময় লেখাটি কবে ছাপা হয়ে বেরোবে, এই বাসনাকে বিচ্ছিন্ন করা। যেকোনো বাসনার মধ্যেই একরকম উত্তেজনা থাকে। লেখার উত্তেজনাটি জাগ্রত রইল। ছাপার বাসনা তথা উত্তেজনা নির্বাপিত হলো সম্পূর্ণ। তা কি সম্ভব আমার পক্ষে? এই বয়সেও যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তা কবে হবে?...এই পথই আমার সামনে পড়ে রয়েছে একমাত্র পথ হিসেবে। নিজের সম্পর্কে মমত্ব বর্জন করার এই এক উপায়। এ কেবল এক আত্মপরীক্ষা চালানো। এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন।’

সম্প্রতি ৭০ বছরে পা রেখেছেন জয় গোস্বামী। ৭০ বছর বয়সে পৌঁছে কেন আর কবিতা প্রকাশ করবেন না এই কবি? তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন পুস্তিকায়। বলেছেন, ‘৫০ বছর ধরে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কবিতা লেখা কি আমি শিখতে পেরেছি? নিজের কাছে কারচুপি করব না এই বয়সে। স্বীকার করে নেব—না, কবিতা কী করে লিখতে হয় আমি আজও শিখিনি। মুদ্রণ-উপযোগী কিছু লাইন “কবিতা”র নামে ছাপিয়েছি শুধু।’ নিজের কবিতা সম্পর্কে এমন  মন্তব্যের পর জয় গোস্বামী বলেন, এবার তিনি নিজের কাব্যভাষা খোঁজার চেষ্টা করবেন। তাই নিজেকে খোঁজার জন্য, নিজস্ব নিভৃতিতে বসে কাব্যরচনার প্রয়াস নেওয়ার সময় এখন তাঁর। লেখা প্রকাশের বাসনা থেকে নিবৃত্তি নিয়ে শুধু লেখার উত্তেজনাকে জাগিয়ে রাখা সম্ভব কি না, সেই নিরীক্ষায় তিনি প্রবেশ করতে চান।

চারদিকে যখন আত্মপ্রকাশের উৎসব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, টিকটক আর ইনস্টাগ্রাম যখন হরদম উসকানি দিচ্ছে প্রকাশ্য হওয়ার, ঠিক তখনই প্রকাশের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন জয় গোস্বামী।

সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমসআনন্দবাজার পত্রিকা

গ্রন্থনা: অন্য আলো প্রতিবেদক