কবিতা পড়লে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে কী ঘটে

কবিতা পড়লে কী ঘটে—জার্মানির এক গবেষণায় জানা গেল সেই কথা। গবেষণাপত্র ঘেঁটে জানাচ্ছেন হানযালা হান

ইনিদ থেকে পাঠ করছেন মহাকবি ভার্জিল। শুনছেন সম্রাট অগাস্তাস ও তাঁর স্ত্রী লিভিয়া। কবিতার একটি অংশ শুনে সম্রাটের ছোট বোন অক্তাভিয়া মূর্ছা গেছেন। পাশে উদ্বিগ্ন মুখে সম্রাটের দুই উপদেষ্টা মার্কুস অ্যাগ্রিপ্পা ও গাইয়ুস মেইসেনেস। ১৮১২ সালে এই ছবি এঁকেছিলেন জ্যঁ আউগুস্তু দোমিনিক অ্যানগ্রে

কারও কারও কবিতা পড়ে আমরা এতটা মুগ্ধ হই যে অগোচরে বলে ফেলি, গা শিউরে উঠছে। এটা কিন্তু কেবল কথার কথা নয়। সত্যিই, তখন গায়ে কাঁটা দেয়। এক গবেষণায় এমনটাই জানা গেছে। কয়েক বছর আগে জার্মানির বার্লিনের ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণা হয়। পরে ২০১৭ সালে এই গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় অক্সফোর্ড একাডেমিক জার্নাল–এ। সেখানে বলা হয়েছে, কবিতার রয়েছে মারাত্মক জাদুকরি শক্তি।

শিল্পকলা‍র অংশ হিসেবে কবিতা বহু পুরোনো। সাহিত্যের অন্য ফর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। কিন্তু এত দিন এটা অজানা ছিল যে কবিতা পড়লে বা শুনলে আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে কী ঘটে। কবিতার ফিজিওসাইকোলজি এবং নিউরোসায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা উঠে এসেছে এই গবেষণায়।

গবেষণায় মোট তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। এক. কবিতা কি আনন্দ প্রকাশে পুরোপুরি সক্ষম? দুই. এটা কি সংগীতের মতো মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করতে পারে? তিন. কাব্যের কোন উপাদানটি এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে?

দুই ধাপে অনুষ্ঠ‍ি‍ত এই গবেষণার প্রথম ধাপে অংশ নেন ২৭ জার্মান। আগেই অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের পছন্দের কবিতার কথা জানিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাছাই করে পেশাদার আবৃত্তিশিল্পীদের তৈরি করা তিন মিনিটের কবিতাপাঠ শোনানো হয় অংশগ্রহণকারীদের।

কবিতা শোনার সময় অংশগ্রহণকারীদের ত্বকের সংকোচন ও প্রসারণ, হৃৎস্পন্দন, মুখের পেশির নড়াচড়া—রীতিমতো যন্ত্র বসিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। শ্রোতাদের হাতের নিচে একটি বোতাম রাখা ছিল, যাতে গায়ে শিরশিরে ভাব আসার সঙ্গে সঙ্গে তা চাপা যায়। এখানে আবার তিনটি বিষয়ে গভীরভাবে লক্ষ রাখা হয়। এক. শিরশিরে ঠান্ডা বা গায়ের লোম খাড়া হয় কি না। দুই. নিজস্ব অথবা অন্য উদ্দীপকের প্রভাব। তিন. প্রথম ও দ্বিতীয়বার উদ্দীপনার পার্থক্য।

পরীক্ষা শেষে ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গড়ে প্রত্যেকেরই ঠান্ডায় গায়ে কাঁটা (ত্বক ফুলে ও‍ঠা) দিয়েছে। ১১ জনের শরীরে লোম খাড়া হয়েছে।

গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে বেছে নেওয়া হয় ১৮ জার্মানকে। এখানে আগের মতোই অংশগ্রহণকারীরা কবিতা বাছাই করে দেন। দৈর্ঘ্য ২৬০ সেকেন্ড। এবার এমআরআই যন্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। কবিতা পড়ার সময় সবার মস্তিষ্কে অনুরণন ছিল তীব্র। এই পর্বে গবেষকেরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেন, কোনো কোনো শব্দ পাঠকদের শরীর ও মনে বেশি প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। কবিতার কোন অংশ পাঠকের আবেগের চূড়া স্পর্শ করে, তা–ও এতে স্পষ্ট হয়। এখান থেকে গবেষকেরা অনুমান করেন, সাধারণত কবিতার শেষে আবেগের চূড়া থাকে।

জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইম্পেরিয়াল অ্যাসথেটিকসের একদল গবেষক জানিয়েছেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। কবিতাই নাকি মানুষকে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করে। কীভাবে এই সিদ্ধান্তে আসা গেল?

এক সমীক্ষায় ১৩ জনকে একে একে পড়তে দেওয়া হয় নথি, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সনেট ও তাঁদের প্রিয় কবিতা। শেষে দেখা যায়, প্রিয় কবিতাই তাঁদের সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করছে। সক্রিয় হচ্ছে মস্তিষ্কের ডান পাশ, যা মানুষের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তোলে।

মস্তিষ্কের এই ডান পাশে থাকা অংশটিই স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। সেই যে শৈশবে আমরা ছড়া পড়েছি, আজও সেসব আমাদের মাথায় গেঁথে আছে। এবার নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে কারণটি পরিষ্কার হলো। এই অংশে গোলমাল ঘটলে মেরুদণ্ডে কাঁপুনি পর্যন্ত হতে পারে।

কবিতা পড়ার এত এত উপকারিতা দেখে সাহিত্য সমালোচক স্টেফেন বার্টের কথা মনে পড়ল, ‘কবিতা আমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।’ এ কারণে হয়তো তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত ‘আমার কবিতা’ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আমার কোনো রুপালি জিন পরানো ঘোড়ায় চড়ার নেই/ বেঁচে থাকার মতো কোনো উত্তরাধিকার নেই/ কোনো ধন–সম্পদ কিংবা বাড়ি নেই/ একপাত্র মধু—এ–ই আমার সব।’ ফলে দৈনন্দিন রুটিনে অন্তত একটি কবিতা পড়ার সময় রাখলে উপকার বৈ ক্ষতি নেই।

সূত্র: একাডেমিকডট ওইউপি ডটকম, এসসিআই-নিউজ ডটকম।