চিরায়ত লালনের সন্ধানে

১৭ অক্টোবর বাউল ও ভাবুক লালন সাঁইয়ের মৃত্যুদিন। আর এ বছর তাঁর ২৫০তম জন্মবর্ষ। বাংলার ভাব আন্দোলনে এই মনীষীর প্রভাব অপরিসীম। তাঁর দর্শনের তত্ত্বতালাশ

লালন সাঁই (১৭৭৪—১৭ অক্টোবর ১৮৯০)প্রতিকৃতি: এস এম রাকিবুর রহমান

লালন সাঁই—এই নামটি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে লোকায়ত বাঙালির মরমি সাধনা, সংগীত ও জীবনের সঙ্গে। গোঁড়ামি ও জাতপাতে জীর্ণ শাস্ত্রশাসিত এক অনুদার সমাজে জন্ম নিয়েও মুক্তবুদ্ধি ও অগ্রসর চিন্তার কল্যাণে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন লালন। তিনি ছিলেন নিগৃহীত-অবজ্ঞাত নিম্নবর্গের মরমি জনমানুষের একান্ত সহায় ও দিশারি। শাস্ত্র নয়, ধর্ম নয়; মানুষই ছিল তাঁর আরাধ্য আর গানই ছিল তাঁর শাস্ত্রবাণী। একদিকে যেমন তাঁর গান গূঢ় সাধনার ভাষ্য, অপর দিকে তেমনি পীড়িত সমাজমনের বক্তব্য। আবার শিল্পপ্রতিভার গুণে তা হয়ে উঠেছে রমণীয় সংগীত–সাহিত্য। অনন্য মানবিক দর্শন ও অনবদ্য মরমি সংগীতের গুণে তিনি আজ বিশ্বজনের আদরের সামগ্রী। এই দর্শন-দারিদ্র্যের দেশে লালন বাঙালির দার্শনিক হৃদয়চেতনায় যুগপৎ মরমি ও দ্রোহী।

লালন জন্মেছিলেন ২৫০ বছর আগে সংস্কারশাসিত বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে। ১১৬ বছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই দীর্ঘ জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। এই অভিজ্ঞতার বড় অংশই বেদনা ও বিস্ময়ের। জাতপাত, সম্প্রদায়-বিদ্বেষ, শাস্ত্র-ধর্মের দুঃসহ প্রতাপ, শ্রেণিপীড়ন, সামন্ত শোষণ, সামাজিক অনাচার, নারী নিগ্রহ, মনুষ্যত্বের অবমাননা, মানবতার লাঞ্ছনা—মানুষের জীবনকে স্থবির এবং সেই সঙ্গে বিষাদ-নৈরাশ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল। লালনের কাল থেকে দুই শতকের বেশি সময় পরও এ পরিস্থিতি পাল্টায়নি। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর রূপ বদলেছে, পরিবর্তিত হয়েছে শোষণ-নিগ্রহের পন্থা; কিন্তু সমাজদেহ থেকে এর ছাপ পুরোপুরি মুছে যায়নি।

লালনের সাধকজীবন দুইভাবে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে মরমি সাধনার নম্র ধারা, অন্যদিকে রয়েছে দ্রোহের আগুন। অথচ যে সাধনার ভুবনে তিনি প্রবেশ করেছিলেন, সেটা তো বাইরের জগতের ঘটনায় আলোড়িত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বাউলকে প্রতিবাদী ও দ্রোহী হতে হয় কেন? আসলে বাউলের জন্মই তো প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে, উচ্চবর্ণের মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করে—ক্ষমতাশালী বিত্তবানদের বিপক্ষে এ ছিল নীরব গরিব-গণবিদ্রোহ। মরমি সাধনায় যাঁরা শামিল হয়েছিলেন সমাজের অবজ্ঞা ও নিগ্রহ থেকে আত্মরক্ষার জন্য, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে তাঁরা অস্বীকার ও প্রত্যাখানের গরজ বোধ করেছিলেন অন্তরে। বাউলের তাই কোনো শাস্ত্র নেই—গুরুর আদেশ-নিষেধই গান হয়ে তাঁদের দিশা দেয়, পথ দেখায়। লালনের জীবন ও সাধনাও চলেছে এই ধারায়।

বারবার আঘাত এসেছে বাউল সম্প্রদায় ও লালনের ওপর। বাউল-তাচ্ছিল্যের পরিচয় মিলবে মধ্যযুগের দু-একটি পুঁথি বা পদে। ওয়াহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের ফলে বাউলদলন জোরালো হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরকালে জারি হয় ‘বাউল ধ্বংস ফত্ওয়া’—রচিত হয় ভণ্ড ফকির, রদ্দে নাড়া, জওয়াবে ইবলিস-এর মতো পুস্তক-পুস্তিকা। আক্রান্ত হন লালন। লালন সম্পর্কে যে অবজ্ঞা-নিন্দা-বিদ্বেষ, সে এক অর্থে বিকারগ্রস্ত সমাজমনেরই প্রতিক্রিয়ার ফসল। লালন ছিলেন মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন মানবতাবাদী দর্শনকে, ঘুণে ধরা সমাজটাকে বদলাতে চেয়েছিলেন, জাত-ধর্মকে দূরে সরিয়ে মানুষকে মানবিক বোধে বিকশিত করার ব্রত নিয়েছিলেন। সামান্য মরমি ফকিরের এসব উল্টো ধারার কর্মকাণ্ড বরদাশত করবেন কেন সমাজের উচ্চবর্ণের প্রভাবশালী মানুষ! কেননা ধর্মের অসিলায়—শাস্ত্রের নামে—অর্থের জোরে—শক্তির দম্ভে সমাজ–ঘরের সব জানালা তাঁরা বন্ধ করে চিরস্থায়ী এক আঁধারের রাজ্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন। লালন তাতে বাদ সেধেছিলেন বলেই না তিনি আলোর ঝলক সইতে না-পারা পেচক প্রজাতির মানুষের দুশমন হয়েছিলেন। পাষণ্ড, ব্রাত্য, ন্যাড়া, জারজ—এসব কুকথা তাঁকে শুনতে-সইতে হয়। তবে আরোপিত কলঙ্ক আর নিন্দা সমকালেই—উত্তরকালে তো বটেই—মুক্তচিন্তার বিবেকবান মানুষের সুবিবেচনার কল্যাণে লালনের গৌরবচিহ্ন হয়ে উঠেছিল।

লালনের তো শুধুই লেখার কথা ‘তিরপিনির তিরোধারে মীনরূপে সাঁই খেলা করে’, ‘আয় হারালি আমাবতী না মেনে’, ‘গেড়ে গাঙেরে খ্যাপা হাপুরহুপুর ডুব পাড়িলে’, ‘ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে’, ‘আজব আয়নামহল মণি-গভীরে’ কিংবা ‘ধর রে অধরচাঁদেরে অধরে অধর দিয়ে’—এসব সাধনার গান, জটিল বাউলতত্ত্বের গান। কিন্তু অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণে তিনি বুঝেছিলেন, সমাজের আঁধার না ঘুচলে সাধনার আলো ফুটবে না। সাধন ঘরানার বাইরে গিয়ে তাই তাঁকে লিখতে হলো সমাজকে জাগানোর গান—মানুষকে আলোকিত করার গান। সমাজের নানা অনাচার, কুরীতি ও অসংগতি ধরা পড়েছে লালনের চোখে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি জেনেছিলেন, ‘কলিতে অমানুষের জোর/ ভালো মানুষ বানায় তারা চোর’। নীতিনৈতিকতা হয়ে ওঠে কথার কথা, ‘তলে তলে তলগোঁজা খায়/ লোকের কাছে সতী কওলায়/ এমন সৎ অনেক পাওয়া যায়/ সদর যে হয় সেই পাতকী’।

মধ্যযুগের সহজিয়া কবি রূপকের ছলে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার জন্য লালন সেই রূপকের আড়াল তুলে দিয়ে সরাসরি বললেন, ‘অন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই/ দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/ জন্ম নিতে মানবে’। পুনর্জন্মে বিশ্বাস ছিল না লালনের, তাই একবারের জন্য নশ্বর এ পৃথিবীতে আগমনের সুযোগকে সুকৃতিতে সার্থক করে তোলার পক্ষে তাঁর ছিল একান্ত আকুতি, ‘কত ভাগ্যের ফলে না জানি/ মনরে পেয়েছে এই মানবতরণি/ বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়/ যেন ভারা না ডোবে’। ‘জগৎ সত্য ব্রহ্ম মিথ্যা’—এ চেতনা যে অনেকখানিই লালনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাঁর গানে, সেই পরিচয় একেবারে ঢাকা থাকেনি। ইহজাগতিকতার হাতছানিতে লালন সাড়া না দিয়ে পারেননি, ‘এমন মানবজনম আর কি হবে/ মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে’। পরলোকে স্বর্গপ্রাপ্তির চেয়ে দুনিয়ার ‘নগদ পাওনা’র প্রতিই তাঁর বেশি ঝোঁক ছিল—নিজের গানে সে কথাই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।

মানুষই ছিল লালনের মনোভূমির কেন্দ্রে। তাই মানবজীবন, মানবগুরু, মানবভজনার কথা বারবার উঠে এসেছে তাঁর গানে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘ভবে মানবগুরু নিষ্ঠা যার/ সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার’, ‘আছে যার মনের মানুষ মনে তোলা, সে কি জপে মালা’, ‘সেই মানুষে আছে রে মন যারে বলে মানুষরতন’, ‘মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/ সে কি অন্য তত্ত্ব মানে’—লালনের এসব পদ সাধনার প্রয়োজনে বাঁধা হলেও তা মূলত মানববন্দনারই গান। ‘মানুষ অবিশ্বাসে পাই নে রে সে মানুষনিধি’—এই পদ মানুষের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ও ভালোবাসার পরিচয় বহন করে। পাঠক! এই সঙ্গে নিশ্চয়ই স্মরণে আসবে লালনসাগরে অবগাহন করে তুলে আনা রবীন্দ্রনাথের মরমি মুক্তামণির কথা—তারই স্পর্শমাখা এই সুভাষণ, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’।

বাউলের আবার জাত কী, ধর্ম কী? এসব ধুয়েমুছে ফেলেই তো সে ঘরসংসার ছেড়ে ‘মনের মানুষ’কে খুঁজে ফেরার জন্য ‘সাধবাজারে’ এসে ঠাঁই নিয়েছে। লালনও তো জাত-ধর্ম-শাস্ত্র কিছুই মানেননি—গোত্র-বর্ণের বালাই নেই তাঁর কাছে। নারী ও পুরুষ—এই হলো মানুষের জাত। এর বাইরে আর কিছু নেই—লালন স্বীকার করেননি। এই সাধক নিজের চোখেই তো দেখেছেন—জাত-ধর্ম আর হিন্দু-মুসলমান—এই ভেদ-বিভেদের ফল কী ভয়াবহ—কলহ-বিবাদেই জীবন গেল—এ যেন ‘বসতবাড়ির ঝগড়া-কেজে মিটল না’।

লালন হিন্দু না মুসলমান—তাঁর জাত-পরিচয় জানার জন্য সমকালের মানুষের অবাঞ্ছিত কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছিল। লালন এড়িয়েও পার পান না, শেষে কৌশলে জবাব দেন, ‘সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান’। এরপরও অতৃপ্ত জাতসন্ধানীদের জানাতে হলো জাতপাতের অসারতার কথা—যুক্তি দিয়ে বোঝালেন, ‘বিবিদের নাই মুসলমানি/ পইতা নাই যার সেও তো বাওনি/ বোঝ রে ভাই দিব্যজ্ঞানী/ লালন তেমনি জাত একখান’। মধ্যযুগে ভারতের সন্ত-সাধকেরাও তুচ্ছ করেছেন জাত-ধর্মকে—কি কবির, রামদাস, কি পল্টু, রজ্জব, নানক, তুলসীদাস, কি দাদূ—সবার মুখেই ওই একই কথা। লালন কী করে পেয়েছিলেন ‘পিঁড়েয় বসে পেঁড়োর খবর’? নাকি সব মরমির মন ও ভাব একই ছাঁচে ঢালা! এখানে স্থান-কাল-ভাষা সব হারিয়ে যায়—এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা থাকে শুধু মানবপ্রেমী সাধকের মন। ভক্ত কবির বড় ধন্দে পড়েছিলেন—কী কী করবেন, তিনি—পুজোয় মন দেবেন, না নামাজ পড়বেন—হজ করতে যাবেন, না তীর্থদর্শনে দিন কাটাবেন? অনেক ভেবে শেষে বললেন, ‘ভরম সব ভাগা, এক নিরঞ্জন সূ মন লাগা’। কয়েক শতক পর বাংলা মুলুকে জন্ম নিয়ে লালনেরও তা–ই মনে হলো, ‘যে যা ভাবে, সেই রূপে সে হয়/ রাম-রহিম-করিম-কালা এক আত্মা জগৎ–ময়’। আবার আরেক কালে জাতবিচারের গর্বকে খারিজ করে নিজেকেই সাক্ষী রেখে সাধক পল্টু বলছেন, ‘পল্টু, উঁচি জাতকা, মাত কোই কর অহংকার/ সাহেবকা দরবার মে, কেবল ভক্তি প্যায়ার’। চেতনা ও বিশ্বাসে লালন তো তাঁদেরই উত্তরসূরি, তাই তাঁর কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়, ‘ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই/ হিন্দু কি যবন বলে তার জাতের বিচার নাই’। সমাজ ছিল শ্রেণি-বর্ণ-গোত্রে বিভক্ত—জাতপাতের কঠিন নিগড়ে বাঁধা। লালন তাঁর দ্রোহের আগুনে এসব অসাম্য-বিভাজনকে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন, ‘জাত না গেলে পাইনে হরি/ কি ছার জাতের গৌরব করি/ ছুঁসনে বলিয়ে/ লালন কয় জাত হাতে পেলে/ পুড়াতাম আগুন দিয়ে’।

লালন তো মানুষকে দিশা দিতে চান, তাই সুসময়ের জন্য আশা জাগিয়ে রাখেন, ‘কবে হবে সজল বরষা, রেখেছি মন সেই ভরসা’!

সৌম্য-শান্ত-স্থিতধী লালন যে কার্যকারণসূত্রে দৃঢ় সংকল্পের প্রতিবাদী পুরুষে রূপান্তরিত হতে পারেন, তার দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় শিলাইদহের জমিদারদের প্রজাপীড়নের খবর ছেপে তাঁদের রোষে পড়েন। সম্পাদককে শায়েস্তা করার জন্য জমিদারপক্ষ লাঠিয়াল প্রেরণ করে। এ খবরে লালন বিচলিত হন। সুহৃদ হরিনাথকে রক্ষার জন্য একতারা ফেলে হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে শিষ্য-শাবকসহ লালন ছুটলেন কুমারখালীতে। হাঁকিয়ে দিলেন জমিদারের পাইক-বরকন্দাজকে। রক্ষা পেলেন বিপন্ন প্রজাদরদি হরিনাথ। সাধক বাউল বুঝিয়ে দিলেন, অত্যাচার-অন্যায়ের প্রতিবাদ করা—সত্য-ন্যায়ের পথে থাকা—মানুষের সম্ভ্রম-সম্মান রক্ষাই মানুষের ধর্ম—এ-ও ‘মানুষ সত্য’ সাধনারই অঙ্গ। বাউলেরা যে সমাজবিচ্ছিন্ন নন, নির্জন সাধনাতেই যে শুধু তাঁদের জীবন কাটে না, নিজের ভূমিকার ভেতর দিয়ে এর প্রমাণ তো দিয়ে গেছেন। তাঁর কণ্ঠ বেজে উঠেছে প্রতিবাদে-বেদনায়, ‘রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি/ চোরেরও শিরোমণি/ নালিশ জানাব কার কাছে’। এ কি শুধুই রূপক—বাস্তবতাবর্জিত তত্ত্বকথা—এখানে কি অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রকাশ একেবারেই ঘটেনি?

নারীর জীবন কেমন ছিল লালনের কালে—দুই শ-আড়াই শ বছর আগে? নারীকে কী চোখে দেখেছিলেন লালন—এসব কৌতূহল জাগানো প্রশ্নের জবাবে এক নতুন লালনকে খুঁজে পাওয়া যায়। বাউলের সাধনা ও উপলব্ধিতে নারীর রূপ-স্বরূপের যে পরিচয়, গুণ-মাহাত্ম্যের যে বৈশিষ্ট্য, তা সবচেয়ে আন্তরিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে লালনের গানে। প্রেমপ্রত্যাশী পুরুষকেও যে কখনো কখনো নারীর কাছে নতজানু হতে হয়, কৃষ্ণের তুলনা দিয়ে সে কথাই বলেছেন লালন, ‘কোন প্রেমে বল গোপীর দ্বারে/ কোন প্রেমে শ্যাম রাধার পায়ে ধরে...’। নারীর মহিমা, শ্রেষ্ঠত্ব ও দৃঢ়তার পরিচয়ের প্রকাশ মেলে লালনের এই গানে, ‘মায়েরে ভজলে হয় সে বাপের ঠিকানা/ নিগূঢ় বিচারে সত্য গেল তাই জানা’। এই বাণী পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্যকে চূর্ণ করেছে। নারীর প্রতি লালনের যে শ্রদ্ধা, মনোযোগ, অনুরাগ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি, তা তাঁর সম্প্রদায়ের দর্শন থেকেই এসেছে।

উনিশ শতকে বাঙালি ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিল। সেই ঘুমভাঙানিয়া নকিব ছিলেন রামমোহন। কিন্তু তাঁর ডাক তো শুনেছিলেন শুধু কলকাতার মানুষ আর তার প্রতিধ্বনি জেগেছিল বাংলার দু–চারটি বড় শহরে। কিন্তু আঁধারে ঢাকা পড়ে রইল বৃহত্তর বঙ্গদেশের গ্রামের পর গ্রাম। সেই গ্রামদেশে মাটির প্রদীপ জ্বালালেন লালন ফকির। প্রতিক্রিয়ার দমকা হাওয়ায় বারবার সেই আলো নিবে যেতে চায়, লালন বুক দিয়ে আগলে রেখে সেই আলোর শিখার বলয় প্রসারিত করলেন বিশাল বাংলায়। রামমোহন নিজে লেখাপড়া জানতেন—তাঁর অনুসারীরাও, তাই তাঁর কীর্তি-কর্মের কথা পাঁচমুখে প্রচার পেল। কিন্তু উচ্চবর্গের ভদ্রজনের উপেক্ষা-অবহেলায় লালন চাপা পড়লেন। কে তাঁর কথা বলবে? পেশাদার ইতিহাসবিদেরা এ বিষয়ে নীরব হয়ে রইলেন বাংলার সামাজিক ইতিহাস লিখতে গিয়ে। একবার অমলেন্দু দে আগ্রহ নিয়ে কথাটি তুলেছিলেন। তবে অন্নদাশঙ্কর রায় গুরুত্বের সঙ্গে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা বিশেষ স্মরণযোগ্য, ‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব, বাংলার লোকমানসের দেয়ালি উত্সবে লালনেরও সেই গুরুত্ব।’

লালন ছিলেন কালের অগ্রগামী পুরুষ। কিন্তু বিরোধী ছিল কাল। সমাজমন তৈরি ছিল না তাঁর কথা শোনা কিংবা তার তাত্পর্য বোঝার জন্য। তাই তাঁকে অনেক আঘাত সইতে হয়েছে। মনের মধ্যে কখনো বেদনা, কখনো হতাশা জেগেছে, তাই হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে গান রচনা করেছেন, ‘এ দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথা যাই না জানি/ পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা জনম গেল সেচতে পানি’। কিন্তু মানবগুরু লালন তো পরাভব মানতে পারেন না, হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ তো তাঁর ধর্ম হতে পারে না। যাঁর তরঙ্গমুখর নদী হওয়ার বাসনা ছিল, দুকূল ভাসানো স্রোতস্বিনী হওয়ার কথা ছিল, তিনি কিনা হয়ে রইলেন ‘আন্ধেলা পুকুরে’র সামান্য ‘কূপজল’! কিন্তু লালন তো মানুষকে দিশা দিতে চান, তাই সুসময়ের জন্য আশা জাগিয়ে রাখেন, ‘কবে হবে সজল বরষা, রেখেছি মন সেই ভরসা’! একদিন বর্ষা নামবে, নবজলধারায় সিক্ত হবে এই রুক্ষ মাটি, সবুজে ভরে যাবে ফসলের মাঠ—সত্য হয়ে উঠবে লালনের স্বপ্ন।