ফিলিস্তিনের গাজা শহরের আল ওয়াফা হাসপাতালের ওপর ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়েছিল ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর। ভয়াবহ সেই হামলার পর গাজাবাসীর প্রতিবাদে ভরে উঠেছিল এক্স হ্যান্ডল। বেশির ভাগ প্রতিবাদে উঠে এসেছিল হলিউডের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র দ্য হাঙ্গার গেমস-এর নায়িকা ক্যাটনিস এভারডিনের (জেনিফার লরেন্স) একটি সংলাপ। ওই চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে দেখা যায়, বোমা হামলায় পুড়তে থাকা একটি হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে তরুণী এভারডিন শাসক গোষ্ঠীর উদ্দেশে বলছে, ‘দেখুন, আগুন কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে। জেনে রাখুন, আমরা পুড়লে আপনিও পুড়বেন।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রায় দুই হাজার নাগরিক নিহত হওয়ার পর ইসরায়েল পাল্টা হামলা শুরু করে ওই বছরের ২৩ অক্টোবর। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ শুরু থেকেই ছিল একপক্ষীয়। হামাস নয়, গোটা গাজাবাসীকে শিক্ষা দিতে অঞ্চলটিকে এর মধ্যেই ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল, হত্যা করেছে ৪৪ হাজারের মতো মানুষকে। অসম এই যুদ্ধে এখনো ইসরায়েলের জয় নিশ্চিত হয়নি, নিশ্চিহ্ন হয়নি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। যেমন নিশ্চিহ্ন হয়নি হাঙ্গার গেমস-এর ডিস্ট্রিক্ট ১৩-এর বিপ্লবীরা। গাজার কথায় বারবার কেন আসছে এই চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ। বর্তমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের ঢের আগেই তো এই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন পর্ব মুক্তি পেয়েছিল। তা হলে সম্পর্ক কী করেই–বা থাকে?
ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক রামজি বারুদের মুখেই শুনুন সেই কথা। যুক্তরাজ্যের বামপন্থী সংবাদমাধ্যম মর্নিং স্টার-এ রামজি বারুদ লিখেছিলেন হাঙ্গার গেমস-এর মকিংজে পর্ব দেখার অনুভূতি। ‘গাজা এজ ডিস্ট্রিক্ট ১৩: দা হাঙ্গার গেমস মেড রিয়েল’ শিরোনামে সেই লেখার শুরুতে বারুদ লেখেন, ‘আমি কখনো কল্পনা করিনি যে গাজায় আমার শরণার্থীশিবির নুসাইরাতের সাহসী বাসিন্দাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের সঙ্গে কোনো হলিউডের সিনেমার তুলনা করব। কিন্তু হাঙ্গার গেমস মকিংজে দেখতে দেখতে আমার সব প্রতিরোধ ভেসে গেল।’
রামজি বারুদ লেখেন, ‘“ক্যাপিটলের” নির্মম হৃদয়হীন শাসকেরা যেভাবে তাদের অধিকৃত “ডিস্ট্রিক্টগুলো” ধ্বংস করছিল, তা দেখতে দেখতে আমি আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। যতই দেখছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল, এ যেন ফিলিস্তিনিরই কাহিনি, আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে গাজার সংগ্রামই যেন দেখছিলাম আমি।’
কেন রামজি বারুদের এমন অনুভূতি হয়েছিল, তা জানতে হলে আগে দেখতে হবে হাঙ্গার গেমস-এর পর্বগুলো। আসুন, আগে সংক্ষেপে জেনে নিই সিরিজ চলচ্চিত্রের কাহিনি।
যা আছে ‘হাঙ্গার গেমস’-এ
মার্কিন লেখক সুজান কলিন্সের উপন্যাস হাঙ্গার গেমস অনুসরণে ২০১২ সালের ২৩ মার্চ মুক্তি পায় দ্য হাঙ্গার গেমস চলচ্চিত্রের প্রথম পর্ব। প্রথমেই বিপুল সাড়া ফেলে চলচ্চিত্রটি। এরপর একে একে মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রের সিকুয়েলগুলো। ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর প্রেক্ষাগৃহে আসে দ্য হাঙ্গার গেমস: ক্যাচিং ফায়ার, ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর দ্য হাঙ্গার গেমস মকিংজে-এর প্রথম পর্ব, ২০১৫ সালে দ্য হাঙ্গার গেমস মকিংজে-এর দ্বিতীয় পর্ব মুক্তি পায়। সর্বশেষ এই চলচ্চিত্রের প্রিকুয়েল দ্য ব্যালাড অব সংবার্ড অ্যান্ড স্নেক মুক্তি পায় ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর।
গ্যারি রস পরিচালিত এই চলচ্চিত্রের দুটি সিকুয়েলে অভিনয় করে দর্শকদের মন কেড়েছেন জেনিফার লরেন্স। চলচ্চিত্রটির পটভূমি ভবিষ্যতের একটি দেশ, যার নাম পানেম। এটির অবস্থান বর্তমান উত্তর আমেরিকায়। পানেমের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক অঞ্চলের নাম ক্যাপিটল। একদল অভিজাত ও ধনী নাগরিকের বসবাস সেখানে। উন্নত প্রযুক্তি আর মারণাস্ত্র দিয়ে ক্যাপিটল শাসন চালু রেখেছে তার ১৩টি রাজ্যে। রাজ্যগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ডিস্ট্রিক্ট। বহু বছর আগে ক্যাপিটলের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ডিস্ট্রিক্টগুলো। ব্যর্থ সেই অভ্যুত্থানের পর ডিস্ট্রিক্টের মানুষ তাদের ন্যূনতম অধিকারও হারায়। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রতিবাদী ১৩ নম্বর ডিস্ট্রিক্টকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল ক্যাপিটলের শাসকেরা। তবে ধ্বংসস্তূপের নিচে সেই রাজ্যের ভূগর্ভেই গড়ে ওঠে বিপ্লবীদের আস্তানা।
শক্তিধর ক্যাপিটলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফল কী হতে পারে, তা মনে করিয়ে দিতেই নিষ্ঠুর ক্যাপিটলের শাসকেরা চালু করে এক মরণ খেলার। এই খেলার নামই হাঙ্গার গেমস। যুগ যুগ ধরে ডিস্ট্রিক্টগুলোর বাসিন্দারা এই খেলার মধ্য দিয়ে এক সম্মিলিত সাজা ভোগ করতে থাকে। হাঙ্গার গেমসের নিয়ম অনুযায়ী, পানেমের শাসকেরা যেখানে প্রতি ডিস্ট্রিক্ট থেকে ১২ বছর বয়সী দুজন করে মোট ২৪ কিশোর-কিশোরীকে লটারির মাধ্যমে বাছাই করে খেলার জন্য। উন্মুক্ত এক স্থানে প্রতিযোগীরা বাধ্য হয় একে অন্যকে হত্যা করতে। টেলিভিশনে এই হত্যালীলা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এই ভয়ংকর রিয়েলিটি শোর পেছনে ক্যাপিটলের বিভিন্ন কোম্পানি বিপুল বিনিয়োগ করে। সেই বিনিয়োগের কিছু অংশ যায় ডিস্ট্রিক্টগুলোয়। সেই টাকা দিয়েই চলতে হয় তাদের। কিনতে হয় খাদ্য ও ওষুধ। ১৩ নম্বর ডিস্ট্রিক্টের বাসিন্দা কিশোরী ক্যাটনিস এভারডিন (জেনিফার লরেন্স) শৈশবে তার রাজ্য ধ্বংস হতে দেখেছে। এরপর পরিবারের সঙ্গে সে পাড়ি জমায় ১২ নম্বর ডিস্ট্রিক্টে। সেখানে শ্রমদাস হিসেবে সেনাবাহিনীর কঠোর প্রহরায় নাগরিকেরা রাত–দিন কাজ করে যায় ক্যাপিটলের জন্য। বিনিময়ে মেলে না খাবারও। এ অবস্থায় কিশোরী ক্যাটনিস তার ১২ বছর বয়সী বোনকে বাঁচাতে নিজে স্বেচ্ছায় যোগ দেয় হাঙ্গার গেমসে। গেমসে অংশ নিয়ে জিতেও যায় সে। ২৪ প্রতিযোগীর মধ্যে ক্যাটনিস সে যাত্রায় একাই রক্ষা পায়। কিন্তু এরপরই সে ধীরে ধীরে বিদ্রোহীদের সংস্পর্শে আসে, হয়ে ওঠে ক্যাপিটলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নতুন মুখ।
গাজার সঙ্গে যেখানে মিল
দ্য হাঙ্গার গেমস চলচ্চিত্রের নিষ্ঠুর শাসক প্রেসিডেন্ট স্নোকে দেখে যেকোনো দর্শকের ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কথা মনে পড়বে। চলচ্চিত্রটিতে ক্যাপিটলের সেনারা যে ধরনের পোশাক পরে ও অস্ত্র ব্যবহার করে, তার সঙ্গে মিল রয়েছে ইসরায়েলের সেনাদের। চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র ক্যাটনিস নামের কিশোরীর পারমাণবিক শক্তিধর ক্যাপিটলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হলো তির আর ধনুক। ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরেরা যেমন পাথর হাতে প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে যায়, ক্যাটনিসও সেভাবে লড়াইয়ে নামে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ভবিষ্যদ্বাণীও যেন হাঙ্গার গেমস-এ আমরা পাই। সেখানে ১৩ নম্বর ডিস্ট্রিক্টের ভূতলের বিপ্লবীরা ঠিক একই কায়দায় ক্যাপিটলে হামলার ছক কষে এবং শেষ পর্যন্ত জয়ীও হয়। হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে বলে দম্ভভরে ইসরায়েলের শাসকেরা যেমন ঘোষণা দিচ্ছেন, তেমনি পানেমের ক্যাপিটলের শাসকেরাও ১৩ নম্বর ডিস্ট্রিক্ট ধ্বংস হয়েছে বলে প্রচার করেছিল। কিন্তু গাজার মতোই ভূগর্ভে নিজেদের কর্মকাণ্ড টিকিয়ে রেখেছিল ১৩ নম্বর ডিস্ট্রিক্টের বিপ্লবীরা।
তবে লেখক সুজান কলিন্স কি সত্যিই গাজার কথা ভেবেই লিখেছেন তাঁর উপন্যাস? নিউইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এমন এক প্রশ্নের উত্তরে কলিন্স এর সরাসরি জবাব দেননি। তিনি বলেন, যুদ্ধ, ক্ষমতা, তার প্রতিক্রিয়া ভাবতে গিয়ে এই কাহিনির জন্ম। প্রাচীন গ্রিসের গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই, ইরাকে মার্কিন হামলার ঘটনাও তাঁর ভাবনায় প্রভাব ফেলেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে এই চলচ্চিত্রের পরিচালক গ্যারি রসসহ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংলাপ, গান ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াইয়ে বিশ্ববাসীকে রসদ জুগিয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। সেখানে অধিকাংশের মুখে ছিল হাঙ্গার গেমস–এর সেই গান, যেখানে বলা হয়েছে:
‘তুমি কি আসছ এই গাছের কাছে
যেখানে ডাকছে মৃতরা ভালোবাসার আবেশে।
তুমি কি আসছ এই গাছের কাছে
যেখানে বলেছি তোমাকে ছুটে যেতে
আমাদের দুজনের মুক্তির পথে।’
৪ নম্বর ডিস্ট্রিক্টে হাসপাতালের ওপর বোমা হামলার সেই দৃশ্য দিয়ে শুরু করেছিলাম এই লেখার। শেষ করছি আবারও সেই দৃশ্যের কথা দিয়ে। দ্য হাঙ্গার গেমস মকিংজে চলচ্চিত্রে পুড়তে থাকা হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ক্যাটনিস নামের বিপ্লবী তরুণীকে বলতে শুনি, ‘জনগণকে আমি বলতে চাই, তারা আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করে, তার প্রমাণ দেখুন। আপনারা জেনে রাখুন, তারা কারা এবং তারা আসলে কী। জেনে রাখুন, কেন আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে, লড়াই করতে হবে।’
ক্যাটনিসের এই সংলাপ তো বিশ্ববাসীর প্রতি গাজার নাগরিকদের বার্তা। সেই বার্তাই বলে দেয়, গাজা কখনো পরাভূত হবে না। কখনো হারবে না।