লাল জুলাই যে কারণে বৈশ্বিক চমক

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে ইতিমধ্যে বিপুল মতামত প্রকাশিত হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে আরও হতে থাকবে। একটা প্রভাবশালী মত হিসেবে—অনেকে বলেছেন, আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ব্যাপক ধাঁচের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিও ছিল না। এটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। 

এসব কথা পুরোপুরি অসত্য নয়। চেনা রাজনীতির সংকীর্ণ কারিগরি চোখে এই গণ-অভ্যুত্থানকে ওই রকমই মনে হতে পারে। অতীতের দেশ-বিদেশের গণ-অভ্যুত্থান সাহিত্য আমাদের এ রকমই বুঝিয়েছে, পড়িয়েছে। পুরোনো সেসব বোঝাপড়া নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেকে জুলাই-আগস্টের বাংলাদেশকে দেখেছেন। সেভাবেই রক্তপাতের রাজনৈতিক ময়নাতদন্ত সেরেছেন এবং তাত্ত্বিক উপসংহার টেনেছেন। এই ‘নতুন’কে মুখস্থ অতীত থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে বোঝার চেষ্টা কমই হচ্ছে। এভাবে অনেক ভাবুক-চিন্তকের হাতে মহান এই রাজনৈতিক গণ-অভ্যুত্থানের মতাদর্শিক ‘শহীদ’ বা বিকৃত হওয়ার ঝুঁকিও আছে। 

এই গণ-অভ্যুত্থানের নানান স্পষ্ট পটভূমি ছিল। এসব পটভূমি যে কেবল গত দেড় দশকে বা ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে তৈরি হয়েছে, তা নয়। এখানকার জনমানসের আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রসমূহ এত বেশি বেখাপ্পা হয়ে উঠেছে যে পরিবর্তনচেষ্টা এবং পরিবর্তন ঘটা এখানে অনিবার্য ছিল। বিগত ১৫ বছরের দমন-পীড়ন-দুর্নীতি এবং নির্বাচনব্যবস্থার অবক্ষয় তাকে দ্রুততর করেছে। এগিয়ে এনেছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সক্রিয়তা তার সাংগঠনিক শর্তসমূহ পরিণত করে তুলেছে। সর্বশেষ আমরা জনরোষের মুখে পুরো একটা জাতীয় সংসদকে উধাও হয়ে যেতে দেখলাম, তার সদস্যরা পালিয়ে গেলেন। কেবল ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের কলোনিগুলোতেই নয়, বিশ্বের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটনা হিসেবে এটা প্রায় অতুলনীয়।

প্রায় এক হাজার মানুষ মেরে সম্ভাব্য এই গণবিপ্লব থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। দেশীয় কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী কাঠামো ছাড়াও শাসকগোষ্ঠী সম্ভবত কয়েকটি বিদেশি শক্তির নৈতিক সমর্থনকেও রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছিল। কিন্তু রক্তের নদী পেরিয়ে জন-আন্দোলন বিজয়ী হয়েছে ৫ আগস্ট এবং পরবর্তী নতুন ও জটিল অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে সেটা। বলা যায়, সম্পূর্ণ অভিনব এক গণ-অভ্যুত্থানের হাত ধরে এগোচ্ছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

অভিনব বলেই রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের অনেকে একে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নানামুখী বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ একে পশ্চিমা প্রভাবিত ‘কালার রেভল্যুশন’ও বলছেন। বাস্তবতা হলো, এই গণ-অভ্যুত্থানকে তার মূলে গিয়ে বুঝতে আমাদের আরও সময় লাগবে। আরও অপেক্ষা করতে হবে। তত দিন আমাদের এই অভ্যুত্থানের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যেতে হবে।

বাংলাদেশ বরাবরই দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যতিক্রমী এক জনপদ। ঔপনিবেশিক শাসকেরা চলে যাওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের ভেতর দিয়ে এখানে মুক্তির যুদ্ধে এক ধাপ এগোয় বটে, কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে বদলানো যায়নি। জীবিত যোদ্ধারা সে ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশ ‘পাকিস্তান’ বা ‘ঔপনিবেশিক-ভারতে’র কাঠামো ছেড়ে বেরোতে পারেনি। ফলে গত ৫৪ বছর নানান নামের শাসক-কুলীনদের অধীনেও তার মুক্তিযাত্রা অব্যাহত ছিল এবং আছে। ২০২৪-এর আগস্টেও তাকে কারফিউ ভেঙে দ্রোহযাত্রায় নামতে হয়েছিল। একটা জনপদের মুক্তির এ রকম পুনঃপুন চেষ্টার বৃহত্তর ইতিহাসের মধ্যে রেখেই হয়তো কেবল ‘লাল জুলাই’কে প্রকৃত চরিত্রে বুঝতে পারব আমরা।

এ জনপদের মানুষদের বিরুদ্ধে বিগত সময়ের সব স্বৈরাচার এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অপরাধসমূহ যেমন পেনাল কোডের পরিসরের চেয়েও বৃহৎ কিছু, তেমনি জুলাই-আগস্টের ‘বসন্ত’কেও গণ-অভ্যুত্থানের চিরচেনা লক্ষণ দিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আঁতুড়ঘরেই মেরে ফেলতে পারি আমরা। কিন্তু সত্য হলো, নজরদারিমূলক পুঁজিতন্ত্রের (The age of surveillance capitalism) চলতি আমলে এই গণ-অভ্যুত্থান পুরোপুরি ব্যতিক্রমী এবং আপাদমস্তক বৈপ্লবিক সম্ভাবনা বহনকারী একটা রাজনৈতিক ঘটনা ছিল। 

রাষ্ট্রযন্ত্রের গোয়েন্দা উৎকর্ষের এই কালে মানুষ স্বৈরাচারী শাসকদের তার সহযোগীসহ এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারে এবং আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতা দখল করতে পারে, সেটা রাজনীতিবিদ্যায় নিশ্চিতভাবে একটা মনোযোগ আকর্ষণী ঘটনা। আবার একই সঙ্গে এই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী অধ্যায়ও নিবিড় মনোযোগ দাবি করে। বিশ্বজুড়ে মুক্তিকামী মানুষেরা বাংলাদেশের চব্বিশের ঘটনা থেকে অনেক কিছু বুঝতে চাইছে। এর সফলতা-ব্যর্থতা থেকে নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রচিন্তার আন্তর্জাতিক পরিসরে কিছু নতুন দরকারি টীকা তৈরি হবে।

আপাতত দেশে আমরা, ঢাকার রমনা থেকে সুদূর টেকনাফ-তেঁতুলিয়া পর্যন্ত প্রতিনিয়ত অভ্যুত্থানের শহীদের কথা শুনছি। অভ্যুত্থানের জীবিত কর্মীরাও কথা ও কাজে আছেন। কারও কারও মতে, চব্বিশের শহীদ ও গাজি কেউই কোনো পরিকল্পিত রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নিয়ে মিছিলে শরিক ছিলেন না। সে কারণে এখানকার গণ-অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী আদল নেয়নি। অর্থাৎ চব্বিশের শহীদ ও গাজিদের মহত্ত্বের মুকুট দেওয়া হলেও রূপান্তরবাদী রাজনৈতিক নায়ক হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধা আছে অনেকের। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ের অনেক ঘটনা সেই দ্বিধাকে শুধু বাড়িয়েছে।

আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা হলো রাজনৈতিক নায়ক তৈরি হয় রাজনৈতিক দল থেকে। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা আদতে সে রকম নয়। এই আন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্রকাশসমূহ স্পষ্ট জানাচ্ছে, চব্বিশের শহীদ ও জীবিতদেরও অনেক ধরনের রাজনৈতিক স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল। আসলে দৃঢ় স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ছাড়া শাসকদের সন্ত্রাসী এবং রাষ্ট্রীয় রক্ষীদের বন্দুকের সামনে এভাবে নিজেদের সঁপে দিয়ে আসা যায় না।

কিন্তু আমাদের পুরোনো ‘শিক্ষা’ হলো যেকোনো রাজনীতি লিখিত-পড়িত হতে হবে। বিদ্যায়তনিক ভাবুকেরা সচরাচর পুস্তক ও দলিলপন্থী মানুষ। কিন্তু এ–ও তো সত্য, বিদ্রোহ ব্যাকরণ মেনে চলে না। বিশ্বের অনেক দেশে খোদ রাষ্ট্রীয় সংবিধানও কিতাবের মতো করে নেই। লিখিত সংবিধানহীন ইংল্যান্ড, ইসরায়েল, কানাডার মতো দেশগুলো নিশ্চয়ই রাজনৈতিক লক্ষ্য-আদর্শ ছাড়া চলছে না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকেও প্রথার বাইরে এসে পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়। তার জন্য এখনো অনেক সময়ও রয়েছে। আরও তথ্য-উপাত্ত পেয়েই কেবল সে রকম কাজ সম্পন্ন হতে পারে।

এই যাত্রায় আমাদের এ–ও বিবেচনায় নিতে হবে, বাংলাদেশের সমাজে গত দেড় দশক এবং স্বাধীনতা-উত্তর গত পাঁচ দশকে নীরবেই পরিবর্তনবাদী একটা রাজনৈতিক বোধ গড়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের সফলতা-ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা শেষে পরের প্রজন্মগুলো কীভাবে রাজনৈতিকভাবে তৈরি হচ্ছিল, সেটা আমরা নিবিড়ভাবে খেয়াল করেছি বলে মনে হয় না। হয়তো এ রকম নীরব সামাজিক প্রস্তুতির মর্মটুকুও গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি। আসা-যাওয়ার পথের ধারের নিত্যদিনের দেয়াললিখন, পোস্টার-ফেস্টুন-চিৎকারকে আমরা প্রয়োজনীয় গভীরতায় নির্মোহভাবে আমলে নিইনি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এ রকম ‘উদাসীন’, আমাদের জন্য নিশ্চিতভাবেই বিস্ময়।

বছরের পর বছর ধরে দেশজুড়ে চলমান শত শত সভা-সেমিনার-পাঠচক্রকে আমরা হয়তো স্বপ্নবিলাসী মানুষের পাগলামি হিসেবে দেখেছিলাম কেবল। এসব যে সম্ভাব্য একটা গণ-অভ্যুত্থানের দীর্ঘমেয়াদি গর্ভযন্ত্রণা ও প্রস্তুতি, সেই বুঝের ঘাটতি ছিল আমাদের। মানুষের চিন্তা কিন্তু এ পথেই ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়েছে। বিশেষত তরুণ-তরুণীদের। ইন্টারনেট–জগতে ঢুকে এই নবীনেরা দেখেছে বাংলাদেশ নামের এই ‘প্রায় অন্ধকূপ বানিয়ে রাখা’ জনপদের বাইরেও বড়সড় একটা বিশ্ব আছে। সেখানে সাম্য-মৈত্রী-মানবিক মর্যাদার অনেক প্রচেষ্টা চলছে, যা এখানকার ‘একাত্তরে’র মতোই। সেসব দেখা-বোঝার জায়গা থেকেই ‘চব্বিশে’র তরুণেরা বলে উঠেছিল, ‘দেশটা কারও বাপের না!’ এর মানে তো এ–ও, ‘দেশটা সবার’। এই দেশে এই প্রথম লাখ লাখ ছাত্র-জনতা দেশের প্রায় সব জেলায় একসঙ্গে বলে উঠল ‘দেশটা সবার’। এর চেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র আর কী হতে পারে? এটাই তো সেই ‘নাগরিকতা’র ঘোষণাপত্র, যা সব ধর্ম-বর্ণ-ভাষার ঊর্ধ্বে হাজির করতে চায় তার রাষ্ট্রচিন্তাকে। এই চিন্তার ওপর দাঁড়িয়েই রংপুরের আবু সাঈদ এবং সিলেটের রুদ্র সেনরা জীবন দিয়েছেন। শত শত মাইল দূরে থেকেও ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বয়সী মানুষ কোনো গতানুগতিক ‘দল’ ধারণার বাইরে এসে যখন এভাবে জীবন দেয়, তখন তাদের মধ্যে চিন্তার কোনো ঐক্য না থেকে পারে না। সেই ‘চিন্তা’টাই ছিল চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মূল মর্ম। সেটাই ছিল এর রাজনৈতিক দর্শন। লাল জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতা যে তুমুল স্রোতের রক্তের নদীর আদল নিয়েছে, সেটা ওই দার্শনিক শক্তির জোরে। [...] 

এটা বাংলাদেশের নতুন এক আত্মার অভ্যুত্থান। যেখানে গ্রাফিতিতে লেখা হয়, ‘আমার রঙে স্বাধীনতা’! যে স্বাধীনতার চেতনা সব শ্রেণি-পেশার পাশাপাশি সব জাতিসত্তাকেও অন্তর্ভু​ক্ত করেছিল। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলোর সঙ্গে খাগড়াছড়িতে পাহাড়িদের সংহতি সম্ভবত এ কারণেই ঘটেছিল। অন্তত ৫ আগস্টের পর গ্রাফিতি উৎসবের মাধ্যমে সে রকম সাংস্কৃতিক সংহতি দেখা গেছে সেখানে। এসব নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধীরা নতুন এক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার কথা জানায়, যাতে বাঙালি-পাহাড়ি সবাই নিজেদের শামিল দেখতে চেয়েছে। একই বিবেচনা থেকে উল্লেখ করতে হয়, এ দেশের ইতিহাসে রাতের পর রাত সংগ্রামী ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বেরিয়ে হাজার হাজার ছাত্রীর মিছিল নিশ্চয়ই ২০২৪-এর আগে বেশি বের হয়নি। মধ্য জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সব জেলায় বিপুল সংখ্যায় ছাত্রীরাও আন্দোলনে শামিল ছিল।

জুলাই-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে এক দফা ঘোষণার দিন
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ, ৩ আগস্ট ২০২৪

বাংলাদেশে আমরা এত কাল বহু দল, বহু মতাদর্শ, বহু রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখেছি। কিন্তু একটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য দলহীন ‘ঐক্য’কে মূল পাটাতন হিসেবে বিবেচনার ধারণাটা ২০২৪-এর আগে এত মোটাদাগে কেউ বলেনি।

উত্তাল জুলাইয়ে নোয়াখালীর মাইজদী, ঢাকার উত্তরা, রাজশাহীর সাহেববাজার মোড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র-জনতা জাতীয় ঐক্যের ওই ঐতিহাসিক বোঝাপড়া নিয়েই পথে নেমেছিল। তাদের চিন্তায় এবং হাতের মুষ্টি দুই জায়গায় স্পষ্ট ‘কর্মসূচি’ ছিল এবং সেটা কোটাব্যবস্থার সংস্কার তো বটেই, এমনকি সে সময়কার সরকারের পদত্যাগের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। নিশ্চয়ই তার একটা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনাও ছিল। কেবল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নয়, এই গণ–অভ্যুত্থানের সাংস্কৃতিক-দার্শনিক আকাঙ্ক্ষা শনাক্ত করার কাজটিও গুরুত্বপূর্ণ। [...]

প্রকৃতপক্ষে সব মজলুম যাবতীয় রাষ্ট্রীয় জুলুমকে অর্থহীন করে দেয় জীবনকে প্রতিদান হিসেবে দিয়ে। চব্বিশের আহত-নিহতেরা গুম, খুন, সাইবার অ্যাক্টের মতো জংলি আইনকানুনের ঊর্ধ্বে এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথাই বলছিলেন ওইভাবে। সে কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার নজিরকে গবেষণাপুস্তকে খোঁজার বদলে পোস্টার, গ্রাফিতি, দেয়াললিখন ও র​্যাপে গানে খোঁজার অভ্যাসও রপ্ত করতে হবে আগামীর বাংলাদেশকে। কেবল এ পথেই চোখ বন্ধ করে কান পাতলে এখনো এই স্লোগান আমরা শুনতে পাব, ‘আমার খায়/ আমার পরে/ আমার বুকেই গুলি করে’। এই স্লোগান নিশ্চিতভাবেই এমন এক জবাবদিহিপূর্ণ রাষ্ট্র-প্রশাসনের কথা বলছে, যার হাতে বন্দুক বা চাবুক থাকবে না। যে প্রশাসন কোনো রাজনৈতিক দল বা পরিবারের পা চাটবে না। ‘আয়নাঘর’ বানাবে না।

আন্দোলনের সময়ে উত্তরবঙ্গের সেই কিশোরী দলের বিখ্যাত ভিডিওটির কথাও বাংলাদেশে অনেকেই দীর্ঘদিন স্মরণে রাখবেন হয়তো। যেখানে স্লোগান ছিল, ‘কে এসেছে? কে এসেছে?/ পুলিশ এসেছে/ কী করছে? কী করছে?/ স্বৈরাচারের পা চাটছে’। এসব স্লোগান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নতুন এক ‘পাল্টা নির্মাণ প্রক্রিয়া’ নির্দেশ করে। যে নির্মাণ বা মেরামতপ্রক্রিয়ার নায়কও হতে চাইছে মিছিলের মানুষগুলোই এই বলে, ‘তুমি কে আমি কে/ বিকল্প বিকল্প’। তারা দেয়ালে লিখেছে, ‘আমরা সবাই সমন্বয়ক’।

নিজেকে ‘বিকল্প’ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই প্রথম কোনো দল বা দলীয় নেতার বদলে জনতা নিজে তার ‘ঘুণে ধরা নষ্ট সমাজের’ ‘মেরামতকারী-নায়ক’ হয়ে ওঠার ঘোষণা দিচ্ছে। জনতার যৌথ এবং সম্মিলিত এই আত্মপ্রকাশকেই আমরা লাল জুলাইয়ের ‘কর্মসূচি’ হিসেবে শনাক্ত করতে পারি, যা একই সঙ্গে পুরোনো ধাঁচের গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়েও অনেক বেশি। বলা যায়, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ নিজেই তার নিজের রাজনৈতিক নির্মাতা হয়ে ওঠার ঘোষণা দিচ্ছে। যে ঘোষণায় স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। শত শত অকুতোভয় মৃত্যুর সশস্ত্রতায় ন্যায়বিচারের এত উদ্দাম ঘোষণা সমকালীন দক্ষিণ এশিয়ার আর কোথাও দেখা যায় না।

নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসের চব্বিশের অভ্যুত্থানকারীদের সংযোজন বিপুল। যেখানে মিছিলে যাওয়ার আগে তরুণ-তরুণীরা লিখে যায়, ‘যতবার হত্যা করো জন্মাব আবার—দারুণ সূর্য হব, লিখব নতুন ইতিহাস’। এই নতুন ইতিহাসকে পূর্ণাঙ্গতায় বুঝতে তার তথ্য-উপাত্তের অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে আরও কিছুদিন।