পাঠকের কাছে এটা বিস্ময় যে লেখকেরা কীভাবে লেখেন? কোন ক্ষমতাবলে তাঁরা শত শত পৃষ্ঠার উপন্যাস লেখেন; পাঠককে হাসান, কাঁদান বা বিমর্ষ করে তোলেন? এ বিষয়ে পাঠকের কৌতূহল অনিঃশেষ। কিন্তু সাহিত্যপ্রতিভার এ গূঢ় রহস্যের মনোতোষ ব্যাখ্যা আজ অবধি লেখকেরাও দিতে পারেননি।
গল্প বা উপন্যাস লেখার মোটামুটি চারটি স্তর আছে। ক. কাহিনির বীজ প্রথমে মনে আসে; খ. কিছুদিন তা নিয়ে ভাবনা চলে; গ. খসড়া রচনার কাজ আরম্ভ; ঘ. পরিমার্জন/সংশোধনের কাজ সম্পন্ন করা। কোনো কোনো লেখক পরিমার্জনের পেছনে সময় দেন কম। আবার কেউ কেউ থিম নিয়ে বেশি ভাবেন না; যথাসম্ভব দ্রুত লিখতে বসে যান। জনপ্রিয় ও লেখার চাপসম্পন্ন লেখকদের বেলায় এমনটা হয়ে থাকে। অন্যদিকে এমন লেখকও আছেন, যাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংশোধন করতে চান। মারজোরি কিনান রলিংস, জেমস থারবার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ সে ধরনের লেখক। মার্কিন কথাশিল্পী থারবার তো একটা গল্প ৮–১০ বারও পরিমার্জন করেছেন। আর রলিংস এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘যদি সপ্তাহে তিন পৃষ্ঠা লিখতে পারি, তাহলেই আমি খুশি।’ অভিজ্ঞ ও পটু লেখকেরা খসড়া দ্রুত শেষ করতে পারেন। কাহিনির শুরু নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামান না। যত সমস্যা নবীন ও অনভিজ্ঞ লেখকের। গোড়াতেই পাঠককে চমত্কৃত করে দিতে হবে, এমন ভাবনা কাজ করে বলেই পছন্দমাফিক শুরু তাঁরা সহজে করতে পারেন না। লেখা কীভাবে আরম্ভ হবে, সে বিষয়ে কবি ও গদ্যলেখক বিনয় মজুমদার সাদা কাগজ সামনে রেখে বসে থাকার (অপেক্ষার) পরামর্শ দিয়েছেন। মোপাসাঁ বলেছেন, কাগজের ওপর অনেকটা সময় ধরে কলমের আঁচড় কাটতে।
ঘষামাজা সম্বন্ধে বলা যায়, এ কাজ খুব বেশি করলে লেখা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পরিমার্জনা রচনাকে যথাযথ ও নির্মেদ করে তোলে। আবার তাতে স্বতঃস্ফূর্ততাও ক্ষুণ্ন হয়। সংশোধনের পেছনে সময় কম দিলে লেখা নিচু মানের হবে, এটাও বলা চলে না। হেমিংওয়ে কাটাকাটি খুব কম করতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিমার্জনে বিশ্বাসী ছিলেন না; কদাচিৎ একটা–দুটো শব্দ বা পঙ্ক্তি নতুন করে লিখতেন। আসলে পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে ব্যক্তিপ্রতিভা ও দক্ষতার ওপর। ৫০–৬০ বছর ধরে লিখেও ভালো ইমেজ তৈরি করতে পারেননি, এমন লেখকের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। অন্যদিকে ২০–২৫ বা তারও বেশি সময় ধরে নিজেকে সক্ষম ও প্রস্তুত করে তোলার পর ৪৫-৫০ বছর বয়সে আত্মপ্রকাশ করেছেন, এমন লেখকও পৃথিবীতে কম নেই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে এ ধরনের লেখক বেশি ছিলেন। জার্মানি ও ফ্রান্সেও বেশ কিছু ছিলেন। বাংলাদেশে এখন দেখি, অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী লেখকদের বই ছয়-সাতটি বা তারও বেশি। যেন গ্রন্থসংখ্যা বাড়লেই লেখক হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাবে। তবে ভালো দৃষ্টান্তও আছে এবং তা বিরল। দুজনের নাম বলব—সানোয়ার মনি ও রাজা হাসান। দুজনই বাংলাদেশের আশির প্রজন্মের শক্তিমান লেখক। প্রথমজন কথাসাহিত্যিক। দ্বিতীয়জন কবি। সানোয়ার মনিরের প্রথম গল্পগ্রন্থ ঘুমের প্রার্থনা (২০১৯) বেরিয়েছিল লেখকের বয়স যখন ৫৮। রাজা হাসানের প্রথম কবিতা-বই আমাদের শীতকাল ও আঙুরলতার সম্মোহন (২০১৫) প্রকাশিত হয়েছিল কবি যখন ৫৪ পেরিয়েছেন।
গল্পের আইডিয়া লেখকের মাথায় আসতে পারে নানাভাবে—কোনো একটা কথা, মানুষের মুখ থেকে শোনা গল্পের কিছু অংশ, পুরোনো স্মৃতি বা মনে দাগ কাটার মতো কোনো ঘটনা কাহিনির বীজ পুঁতে দিতে পারে মাথায়। প্রসঙ্গত, জয়েস কেরির একটি অভিজ্ঞতার কথা বলব। কেরি একবার ম্যানহাটান দ্বীপে ২৭-২৮ বছরের এক হাসিখুশি তরুণীকে দেখেন নৌকায় চড়ে বেড়াতে। মেয়েটার কপালে গভীর বলিরেখা। তাঁর প্রাণস্ফূতির সঙ্গে ওই বলিরেখার অসামঞ্জস্য ছিল, যা জয়েস কেরিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। সপ্তাহ তিনেক পর একদিন ভোরে লেখকের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি স্বপ্নে একটা গল্পের প্লট পেয়ে গেছেন। পরবর্তী চার-পাঁচ ঘণ্টার ভেতর যে গল্প লেখা হলো, তার নায়িকার কপালে গভীর বলিরেখা! এ গল্পের পটভূমি ম্যানহাটান দ্বীপ নয়। নৌভ্রমণও নেই এখানে। তাহলে বলিরেখা এল কীভাবে? পরে কেরির মনে পড়ল সেই মেয়েকে। তাঁর অবচেতন মনে সে ছিল; এখন গল্পের ভেতর অজান্তেই এসে পড়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ কীভাবে আরম্ভ করবেন, এ নিয়ে লেখকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কে একজন তাঁর উড়নচণ্ডী ভাইয়ের সন্ধানে এসে তাঁরই বোহেমিয়ান বন্ধুদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা কী শুরু করেছেন!’ ওই দলেরই একজন ছিলেন সুনীল। শেষ পর্যন্ত এ সংলাপ দিয়েই শুরু হয় আত্মপ্রকাশ-এর গল্প। এ–জাতীয় উদাহরণ অনেক আছে। পাঠক, আশা করি এ দুটো দৃষ্টান্ত থেকে বুঝে নিতে পারবেন, কত বিচিত্রভাবে একটা ছোটগল্প বা উপন্যাস আরম্ভ হতে পারে।
থিম বা গল্পের বীজ মাথায় আসার পর থেকে লিখতে আরম্ভ করার মাঝখানের সময়টি হতে পারে দুই দিন, দুই সপ্তাহ বা দুই মাস। নিয়মিত পড়াশোনা করেন এবং সেই সঙ্গে নানা রকম লেখালেখিতে ব্যস্ত লেখকের বেলায় সময়টা ছয় মাস-এক বছর কিংবা দুই বছরও হতে পারে। কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী এ সময়পর্বটিকে বলেছেন, ‘লেখকের দশ মাস দশ দিন’।
আমার দ্বিতীয় উপন্যাস পটভূমি একাত্তর-এর বীজ মাথায় নিয়ে ঘুরেছি চার বছর। অবশেষে লেখা শেষ করতে পেরেছি ২০-২১ সালের মার্চে। অনেকগুলো ছোটগল্প আমি পরিমার্জন করেছি দু-তিনবার। কোনো কোনোটি চারবার। উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, ‘শিল্পে আমরা পূর্ণতার কথা বলি, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই তা অর্জন করতে পারেনি। সৃষ্টি অপূর্ণতাও ধারণ করে আর সে জন্যই লেখকদের সাধনা অব্যাহত থাকে।’ আমরা অনেক সময় বলতে শুনি, বিশেষ করে নবীন লেখকদের, যে তিনি অমুক লেখকের মতো বা অমুক লেখকের চেয়ে বড় লেখক হতে চান। এমন উচ্চাশা কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজে আসে না। আমি ভেবে অবাক হই, তাঁরা নির্দিষ্ট কোনো লেখকের চেয়ে বড় হতে না চেয়ে কেন নিজের লেখার উন্নতি কীভাবে হবে, তা চিন্তা করছেন না।
ফকনার তাঁর সমকালীন লেখকদের বই খুব কমই পড়তেন। আমাদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হকরাও তা-ই করতেন। কথা হলো, সমালোচকদের মন্তব্য শোনার সময় কই মনস্বী লেখকদের? সমালোচনামূলক গদ্য পড়েন কারা? যাঁরা লেখক হতে চান, তাঁদের একাংশ। যাঁরা লেখা শুরু করেছেন পুরোদমে, তাঁদের সময় নেই ওসব পড়ার। তবু বলতে চাই, যাঁরা সৃজনশীল সমালোচনাগদ্য লিখতে জানেন, তাঁদের লেখা মাঝেমধ্যে পড়ে দেখা ভালো। তাতে করে লেখক নিজের অবস্থান সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে পারেন।
‘ফ্রান্সের কনান ডয়েল’ বলা হয়েছে যাঁর সম্বন্ধে, সেই জর্জ সিমেন লেখকের কাজ বিষয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যেক লেখক নিজেকে তাঁর লেখা ও চরিত্রের মধ্যে খুঁজে পেতে চান’। নিজেকে খুঁজে পাওয়া বা আবিষ্কার করার সঙ্গে অনেক শিল্পাকাঙ্ক্ষা ও ভাবনা-কল্পনা জড়িত। প্রখ্যাত সমালোচকেরা এবং প্রবন্ধ লেখেন না এমন কথাশিল্পীরাও ওই আশা-চিন্তা-কল্পনা, জীবনদর্শন, সমাজচেতনা প্রভৃতি সম্বন্ধে গভীর কথা বলেছেন সাক্ষাত্কারে। রাইটারস অ্যাট ওয়ার্ক নামে একটি খুব উল্লেখ্য সাক্ষাত্কারগ্রন্থ আছে। প্যারিস রিভিউ পত্রিকার তরফ থেকে নেওয়া ১৬ জন লেখকের সাক্ষাৎকার স্থান পেয়েছে এতে। এখানে দেখা যাচ্ছে, ই এম ফরস্টার, আলবার্তো মোরাভিয়া, ফ্রাঙ্ক ও’কনোর, অ্যাঙ্গাস উইলসন, জয়েস কেরি, নেলসন অ্যালগ্রেন সবাই কমবেশি বিচিত্র ধরনের কথাবার্তা বলেছেন। কথা এমন ভঙ্গিতে বলেছেন যেন লেখকবৃত্তিকে লঘুভাবে নিয়েছেন তাঁরা। তবে গুরুগম্ভীর কথা বা মন্তব্যও আছে। যেমন নেলসন অ্যালগ্রেনকে তাঁর সর্বাধিক খ্যাত উপন্যাস দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন আর্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে লেখক তার জবাবে যা বলেন, তার সারমর্ম হচ্ছে, আইডিয়ার সঙ্গে অনুভূতিকে মেশানোর বিষয়টি গুরুত্ববহ।
লেখককে, যদি সত্যিকার লেখক হন, সারা জীবন এক অতনু দৈত্যের আদেশ পালন করে যেতে হয়। একবার যে শিল্পের আড়কাঠে মাথা রেখেছে, তার নিস্তার নেই আর। টাকা থাক বা না থাক, প্রিয়তমা থাক বা না থাক, তাকে লিখে যেতেই হয়। সে স্বজনপ্রিয় থেকে জনপ্রিয় হতে পারবে কি না, এ ভাবনার প্রয়োজন নেই। তার দরকার অনেকখানি অবসর, একটা টেবিল আর কাগজ-কলম। ওই যে, অতনু দৈত্য দাঁড়িয়ে আছে লেখকের মাথার পেছনে!