সবিশেষ
মাওলানা রুমির জনপ্রিয় হয়ে ওঠা
সাত শ বছর আগে জন্ম নেওয়া কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন সারা দুনিয়ায়? আজকের প্রজন্ম কেন পড়ছে রুমির কবিতা?
জল থেকে ভেসে ওঠা বই
জায়গাটা হলো তুরস্কের কোনিয়া। বাইজেন্টাইনরা বলত ‘আইকোনিয়াম’। সেখান থেকে ‘কোনিয়া’। কোনিয়া অবস্থিত রুম নামের সেলজুক সালতানাতে। জালালুদ্দিন জীবনের বড় অংশ কাটাবেন এখানেই। সেখান থেকে পরে লোকে তাঁকে ডাকবে ‘রুমি’ নামে। আরবি ভাষায় ‘রুমি’ মানে রোমান। আরবরা এই জায়গা পুবের রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে দখল করেছিল। তাই এই অংশকে ডাকা হতো ‘রুম’ বা ‘রোমান’ নামে।
জালালুদ্দিন ছিলেন একজন ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্র–পণ্ডিত। তাঁর বাবা ও পিতামহ দুজনই ছিলেন বড় পণ্ডিত ও শিক্ষক। জ্ঞানী বলে খ্যাতি ছিল সর্বত্র। সাঁইত্রিশ বছর বয়সী জালালুদ্দিন একদিন বসে আছেন এক জলাধারের পাড়ে। সময়টা ১২৪৪ সাল। অনেকগুলো বই পাশে রাখা। একটা বই পড়ছেন তিনি।
এমন সময় কোথা থেকে এসে হাজির হলো একজন উষ্কখুষ্ক লোক। গায়ে মোটা কালো চাদর, ধুলোমাখা। জালালুদ্দিনকে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী পড়ছ?’ জ্ঞানগর্বী জালালুদ্দিন পড়া থেকে মাথা তুলে তাকালেন আগন্তুকের দিকে। অবজ্ঞার স্বরে বললেন, ‘এসব তুমি বুঝবে না।’ লোকটা হেসে চুপ করে রইল। তারপর সব কটি বই হঠাৎ ছুড়ে ফেলে দিল জলে। বইগুলো ডুবতে দেখে জালালুদ্দিন ‘হায় হায়’ করে উঠলেন। অমূল্য সব বই!
জালালুদ্দিনের আক্ষেপ দেখে হেসে এবার খ্যাপাটে লোকটা এগিয়ে গিয়ে জলে হাত ডুবিয়ে দিল। অবাক কাণ্ড! জল থেকে তিনি বই তুলে আনছেন একটা একটা করে। সব কটি বই শুকনা! এক–বিন্দু জলের স্পর্শ লাগেনি তাতে। বিস্ময়ে অভিভূত জালালুদ্দিন বলে উঠলেন, ‘এ কী করে সম্ভব?’ লোকটা এবার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলল, ‘এসব তুমি বুঝবে না।’
মাওলানা রুমি তাঁর জন্মজগতের বাইরে ভেসে উঠেছেন। একেবারে তাজা। কালের আর্দ্রতার কোনো স্পর্শ নেই তাঁর গায়ে।
জালালুদ্দিনের ‘রুমি’ হয়ে ওঠা
কাহিনিটা এ রকমভাবেই ছড়িয়ে আছে। হাজার বছর ধরে প্রাচ্যের মানুষের মুখে মুখে। ওই খ্যাপা লোকটার নাম শামস তাব্রেজি। মানে তাব্রেজের সূর্য। বিস্মিত জালালুদ্দিন শুষ্ক জ্ঞানের পথ পার হয়ে শামসের শিষ্য হলেন। একটানা চল্লিশ দিন দুজন বদ্ধঘরে আলোচনা করলেন। জালালুদ্দিনের রূপান্তর ঘটল। তিনি হয়ে উঠলেন প্রেমের মানুষ।
গুরু শামস তাব্রিজের নামে রুমির কাব্যগ্রন্থের নাম দিওয়ানে শামস তাব্রিজ। এতে আছে শামস তাব্রিজকে নিয়ে লেখা প্রায় তিন হাজার গজল। তিনি আরও লিখেছেন দুই হাজার রুবাই, মানে চার লাইনের কবিতা। আর তাঁর ছয় খণ্ডের মসনভির নাম কে না জানে?
রুমির কবিতা লেখার কায়দা ছিল অন্য রকম। তিনি শিষ্য–পরিবেষ্টিত অবস্থায় থাকতেন নিজের আলোচনা ঘরে। সেখানে ভাবোন্মত্ত অবস্থায় ঘরের মধ্যখানের খুঁটি ধরে ঘুরতে ঘুরতে বলে যেতেন একের পর এক কবিতা। শিষ্যরা সেগুলো লিখে রাখতেন। ঘূর্ণায়মান সেই নৃত্য এখন রুমির ঘরানার বৈশিষ্ট্য। যে কারণে ইংরেজরা তাদের নাম দিয়েছে ‘ড্যান্সিং দরবেশ’।
‘পপুলার’বেস্ট সেলার রুমি
যুক্তরাষ্ট্রের কালচারাল আইকন বিয়ন্স তাঁর যমজ মেয়েদের একজনের নাম রেখেছেন রুমি। যুক্তরাষ্ট্রে রুমি হলেন বেস্ট সেলার। ব্রিটিশ রকব্যান্ড কোল্ডপ্লের ক্রিস মার্টিনের বিচ্ছেদ হলো অভিনেত্রী গিনেথ পেল্ট্রোর সঙ্গে। সেই বিষণ্নতার কালে মার্টিনকে এক বন্ধু রুমির কবিতার বই উপহার দেন। পরে মার্টিন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বইটা আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে।’ পরের অ্যালবামে মার্টিন রুমির কবিতার আবৃত্তি রাখলেন: ‘মানুষ এক অতিথিশালা/ প্রতিদিন নতুন অতিথি আসে/ কখনো আনন্দ, বিষাদ বা হীনতা/ কখনো আসে ক্ষণিকের বোধ/ আশা না করা অতিথির মতো।’
যুক্তরাষ্ট্রের বই ব্যবসায়ীদের ভাষায় যে ‘রুমি রেনেসাঁ’, তা ঘটেছে যাঁর হাত ধরে, তাঁর নাম কোলম্যান বার্কস।
১৯৬৭ সালে কবি রবার্ট ব্লাই ক্যামব্রিজের পণ্ডিত এ জে আরবেরির মসনভির ছয় খণ্ড ইংরেজি অনুবাদ বার্কসের হাতে তুলে দেন। তিনি তখন কোলম্যান বার্কসকে বলেছিলেন, কবিতাগুলোকে তাদের খাঁচা থেকে মুক্তি দেওয়া দরকার।
বার্কস এগুলোকে কঠোর একাডেমিক ভাষা থেকে আমেরিকান-শৈলীর মুক্ত পদ্যে রূপান্তরিত করেছেন। তার পর থেকে পরবর্তী ৩৩ বছরে বার্কস ২২টি বই অনুবাদ করেছেন রুমিকে নিয়ে। সেগুলো দুনিয়াজুড়ে ২০ লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়েছে। ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে বিশ্বের ২৩টি ভাষায়।
কী সন্ধানে আমি যাই সেখানে
কিন্তু কেন রুমির এমন জনপ্রিয়তা? ভোগেই মুক্তির ‘উন্নত’ বিশ্বে ধনী সেলিব্রিটিদের জগতে কিসের ঘাটতি? কোন অভাব যুক্তরাষ্ট্রের সচ্ছল নাগরিকদের পৃথিবীতে?
বার্কস এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন এভাবে, ‘আমার মনে হয়, এখন পৃথিবীজুড়ে একটা আন্দোলন চলছে। একটা তাড়না চাইছে সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যাওয়া সীমান্ত দিয়ে টুকরা করে রাখা সীমান্তকে এক করে দিতে।’ কিন্তু যেসব শহরের রাজপথ তৈরি হয় অগণিত কবির পাথর হয়ে যাওয়া হৃদয় দিয়ে, সেখানে এই তাগাদার মানে কী?
মানুষের এই কেনাবেচাসর্বস্ব সভ্যতা বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস। নিজের তৈরি করা পণ্যের বাজারে সে নিজেকেই বিক্রি করে প্রতিদিন। বাজারে না বিকোলে মানুষের দাম নেই, মূল্য তো অনেক পরের কথা। নিজের তৈরি করা জিনিস এখন মানুষের মালিক হয়ে গেছে। এই জগতে মানুষের অনেক কিছু আছে, কিন্তু মানুষ নিজে নিঃস্ব। এই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানুষ নিজের খণ্ডিত ব্যক্তিসত্তার চেয়ে বড় কোনো ‘আমি’কে অন্বেষণ করে। নিজের সঙ্গে, জগতের সঙ্গে মানুষের এই বিচ্ছিন্নতায়, বড় কোনো ‘আমি’র অন্বেষণে অর্থবহ হয়ে ওঠে রুমির কবিতার বিরহ। এই সত্যই আজকের সময়ে, আজকের ভাষায় ভাবনায় মাওলানা রুমিকে এত আপন করে দেয়।
এখানেই অনেক কিছু থেকেও নিজে শূন্য হয়ে যাওয়া ক্রিস মার্টিন শান্তি খুঁজে পান রুমির কাছে এসে।
ইংরেজির হাত ধরে বাংলায় রুমি
হালে বাংলাভাষী ‘শিক্ষিত’ মানুষ রুমির দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন। ফেসবুকে রুমি ক্ষণে ক্ষণে হাজির হন। সেগুলো মূলত কোলম্যান বার্কসের ইংরেজি অনুবাদের হাত ধরেই। বাংলায় রুমির অনেক অনুবাদ হচ্ছে ইংরেজি থেকে। ইংরেজিতে বাজার ধরার তাগিদে রুমিকে আমেরিকান করে ফেলার প্রতিবাদ অনেক দিন ধরে জানিয়ে যাচ্ছেন ফারসিভাষী পণ্ডিতেরা। কিন্তু পুঁজি নিজের আদলে জগৎ পাল্টে ফেলে। রুমি এর থেকে নিষ্কৃতি পাবেন কেন? শুধু কবিতা নয়, কথাসাহিত্যেও রুমি হাজির হয়েছেন। রবিশংকর বলের আয়নাজীবন বা শিবানন্দ পালের দুই খণ্ড রুমি আধুনিক মানুষের সমস্যা হাজির করতে চেয়েছে রুমির জগতের সূত্র ধরে।
আবার রুমির কবিতাকে অনেকের কাছে কেবল ‘আমি-তুমি’র ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি বলে মনে হতে পারে। এর পেছনে কারণ আছে। অনেকের মতে, আমাদের শিক্ষিত বাংলাভাষী লোকের কবিতার জগৎ পশ্চিমা কাব্যতত্ত্বের অনুবাদ। যেমন আমাদের রাষ্ট্র ইউরোপীয় রাষ্ট্রের অনুবাদ। এই পশ্চিমা কাব্যবীক্ষার বাইরে যে আর কোনো কাব্যবীক্ষা থাকতে পারে, তা শিক্ষিতদের কাব্যের বাংলা ভাষায় একেবারে অনুপস্থিত। অথচ মাওলানা পাগলামির কথা বলেন প্রজ্ঞার কণ্ঠে। প্রজ্ঞার বয়ান করেন পাগলামির ছন্দে। তিনি সমাজের বেঁধে দেওয়া অর্থের সীমা চুরমার করে এগিয়ে যান। শব্দের বহাল সাম্রাজ্যের দিকে তিনি অবজ্ঞার চোখেও তাকান না। শব্দ তাঁর কাছে অর্থের উথালপাথাল স্রোত থেকে জন্ম নেওয়া বুদ্বুদমাত্র।
বাংলায় রুমির প্রত্যাবর্তন?
বাংলার ভাবজগতের বিরহ আর রুমির কবিতার বিরহ একাকার হয়ে গেছে অনেক আগে। উভয়েই মানুষের ‘এলিয়েনেশন’ মানে বিচ্ছিন্নতার সমাধান করতে চায়। দুজনই সেই বিচ্ছন্নতাকে হাজির করে ‘বিরহ’ নামের বয়ানে। কাব্যের জগৎ বলেই তা যতটা যাওয়া, তাঁর চেয়ে বেশি যেতে চাওয়া।
বাংলায় রুমি ফিরে আসার ক্ষেত্রে আসলে ইংরেজির হাত ধরার কথা নয়। রুমির জনপ্রিয়তা এমন জগন্ময় হয়েছিল যে এই বাংলা মুলুকে চৈতন্যদেবের মহত্ত্ব প্রচারে পনেরো শতকের কবি জয়ানন্দ চৈতন্যমঙ্গল-এ লিখছেন:
‘মসনবি আবৃত্তি করে থাকে নলবনে।
মহাপাপী জগাই মাধাই দুইজনে।।’
সে আমলে দিব্যি মাওলানা রুমির চর্চা হচ্ছে। আর তা হচ্ছে ফারসি ভাষা থেকেই। কারণ পরিষ্কার, ফারসি তখন আমাদের এখানে রাজভাষা ছিল। শিক্ষিত মানুষমাত্রই ফারসি জানতেন। পড়ে দেখা যায় যে ইংরেজ আমলের প্রথম যুগেও ফারসিচর্চা ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তো হাফিজ সিরাজির ফারসি গজল পড়তে পড়তে ভাবোন্মত্ত হয়ে পড়তেন। খুলনায় জন্ম আর ঢাকা, যশোরের স্কুলশিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (মৃত্যু: ১৯০৭) পর্যন্ত এ ধারা বজায় ছিল। তিনি হাফিজের কবিতা ভাবানুবাদ করে সদ্ভাবশতক (প্রকাশ: ঢাকা ১৮৬১) লিখেছিলেন এবং তা তুমুল জনপ্রিয়ও হয়েছিল।
১৮৫৯ সালে উইলিয়াম ফিটজেরাল্ডের অনুবাদে বের হয় রুবাইয়াত অব ওমার খৈয়াম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে তা ভিকটোরিয়ান জগতের ধসে পড়ার ইংরেজ হতাশাকে ধারণ করে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই থেকে ইংরেজি হয়ে ফারসি কাব্যের বাংলায় আসা শুরু হয়। ব্যতিক্রম কাজী নজরুল ইসলাম আর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।
তবে ইসলামধর্মীয় শিক্ষাঙ্গন থেকে রুমির মসনভির একাধিক অনুবাদ আছে। সেগুলো সম্পূর্ণ অনুবাদ মূল ফারসি থেকে। কিন্তু বাংলাভাষার বহমানতাকে ধারণ না করায় সেগুলো পাঠকের স্বাদ ও চাহিদা ধরতে পারেনি।
তাহলে বাংলায় আজকের শিক্ষিতজনের রুমিচর্চা কি কেবল ইংরেজি জগতের অনুকরণ? যে কারণে একজন আন্তনিও নেগরি বলেছিলেন, ‘আজকের পৃথিবীতে আমরা যেখানেই থাকি না কেন, উই অল লিভ ইন নিউইয়র্ক।’ আমেরিকান আর বাংলাভাষীদের রুমিচর্চা কি একই কারণে? সেই সূত্র কি ভিন্ন, নাকি বাংলাভাষার হারিয়ে যাওয়া কাব্যবীক্ষার হাহাকার আবার রুমির কবিতার মধ্যে কোনো আকুতি জানাচ্ছে?
পুনশ্চ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে একটা ফেসবুক পোস্ট হাফিজ সিরাজির শেরের অনুবাদ উল্লেখ করেছিল:
‘ফুলের বাগানে ভোরের বাতাসকে শুধালাম
রক্তের কাফন পরা সব ফুল কার জন্য শহীদ হয়েছে?’
শহীদদের আত্মত্যাগ যদি সফল না হয়, যদি আমরা ভুলে যাই কেন ছিল সেই আত্মত্যাগ! এই শঙ্কা সাত শ বছর আগের একজন কবির জবানিতে ব্যক্ত হচ্ছে। আর কী মোক্ষমভাবে!