সম্প্রতি বাংলাদেশে অভূতপূর্ব এক গণ–অভ্যুত্থান ঘটে গেল। ছাত্র-জনতার বীরোচিত এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। গণশক্তিকে অবজ্ঞা করার ফল শেখ হাসিনা হাতেনাতে পেয়েছেন। তিনটি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নানা চাপ সামলে ওঠার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, তিনি সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আপামর জনগণের নজিরবিহীন গণজাগরণ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। বিদায় নেওয়ার আগে শেখ হাসিনার নির্দেশে আনুষ্ঠানিক হিসাবে ছয় শতাধিক প্রাণ ঝরে পড়েছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
এই গণ–অভ্যুত্থানে—অনেকের মতে যা এখনো চলমান—ঢাকাকে অন্য এক রূপে দেখা গেল। ঢাকা পরিণত হয়েছে গ্রাফিতি, দেয়াললিখন আর ক্যালিগ্রাফির নগরীতে। এর আগে কখনোই ঢাকার দেয়াল এত রঙিন রূপ ধারণ করেনি। শুধু নান্দনিকতার বিচারেই নয়, গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনের বক্তব্যে যে রাজনৈতিকতা ফুটে উঠেছে, তার তাৎপর্য অপরিসীম। গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত হতে শুরু করেছে। তরুণ শিক্ষার্থীদের হাত দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই যেন দেয়ালে দেয়ালে ব্যক্ত হচ্ছে। সারা ঢাকা শহরের দেয়াল বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যে ছেয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার একটা দল গঠন করে পুরো ঢাকা শহরের দেয়াললিখনের বক্তব্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিলে তাদের ঘোষিত পুনর্গঠন প্রকল্প ভাবনার অর্ধেক কাজ এগিয়ে যাবে। জনগণের, বিশেষত তরুণ শিক্ষার্থী সমাজের মূর্ত ইচ্ছা ও অভিপ্রায় জানার এত সহজ সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো উচিত হবে না।
কী বলছে ঢাকার দেয়াল? গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন স্পষ্টতই প্রমাণ করছে, বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চৈতন্য, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর চৈতন্যের স্তরকে ছাপিয়ে বহুগুণ এগিয়ে গেছে। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা খোলাসা করা যাক। টিএসসি–সংলগ্ন দেয়ালে বড় করে রঙিন হরফে লেখা—‘এখন দরকার জনতার সরকার’। রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতে (শতাংশের দিক থেকে কখনো কখনো মোট প্রাপ্ত ভোটের অর্ধেকের কম) সরকার গঠন করতে চায়, জনগণ সেখানে দাবি করছে, তাদের এমন সরকার চাই, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারের চেয়ে বেশি কিছু; যা আক্ষরিক অর্থেই ‘জনতার সরকার’ হবে; যে সরকারকে অন্তত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সমর্থন করতে পারবে। অর্থাৎ সেটি হবে গণসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে গঠিত এমন সরকার, যার নৈতিক, আইনি ও রাজনৈতিক বৈধতা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নির্বাচিত সরকারের চেয়ে অনেক বেশি। গণ–অভ্যুত্থানের আইনি ও রাজনৈতিক বৈধতা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রেও প্রশ্নাতীত।
দেয়াললিখনগুলোর বক্তব্যে প্রধানত ধরা পড়েছে পরিবর্তনেরই আকাঙ্ক্ষা। পাশাপাশি আছে তীব্র স্বৈরাচারবিরোধী সেন্টিমেন্ট। আছে স্বাধীনতার অনুভূতি। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে দেয়াললিখনগুলো পড়লাম। জনগণ, স্বাধীনতা, সংস্কার, পুনর্গঠন, অসাম্প্রদায়িকতা, বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি, বাক্স্বাধীনতা, নির্বতনমূলক আইনের বিরোধিতা—ঘুরেফিরে এই বর্গগুলোই ছিল গ্রাফিতিগুলোর প্রধান বিষয়। এর মধ্যে ‘জনগণ’ বর্গটি ভালোভাবে নজরে পড়ে। ‘জনতায় ভরসা’, ‘জনগণই বিকল্প’, ‘ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার চেয়ে গণক্ষমতা বেশি শক্তিশালী’, ‘জনতাই আইন’—এ ধরনের বক্তব্য বিভিন্ন দেয়াললিখনে দেখা যাচ্ছে। ‘জনতাই আইন’ কথাটা প্রাথমিকভাবে মব রুলের ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন’-এর আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে এর পেছনে ক্রিয়াশীল নিগূঢ় রাজনৈতিক-দার্শনিক চিন্তা ধরা পড়ে। গণ–অভ্যুত্থান স্রেফ ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন ঘটায় না, পুরোনো আইনি কাঠামোকেও অকার্যকর করে তোলে এবং এক নতুন আইনি মুহূর্ত আকারে হাজির হয়। এর মধ্য দিয়ে জনগণ গাঠনিক ক্ষমতার আসনে বসে এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়নের আইনি শর্ত অর্জন করে। জনগণ আইন প্রদায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জটিল বই পড়ে জনগণের এই চৈতন্য তৈরি হয়নি। গণ–অভ্যুত্থানের বাস্তব অভিঘাতে জনগণের রাজনৈতিক চৈতন্য রাতারাতি অনেক এগিয়ে যায়।
‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনব’—ঢাকার বেশ কয়েকটি অঞ্চলের দেয়ালে এ বক্তব্য দেখা গেল। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার প্রশ্ন আসছে কেন? বাংলাদেশ তো বহিঃশক্তির দ্বারা আক্রান্ত ছিল না। তবু হাসিনার আমলের শাসনের ধরনটাই এমন ছিল, জনগণের মধ্যে পরাধীনতার বোধ প্রবলভাবে দানা বেঁধেছিল। গুম, খুন, ক্রসফায়ার, বাক্স্বাধীনতা হরণ, সংবাদপত্রের ওপর কড়া সেন্সরশিপ কায়েমের মাধ্যমে ত্রাসের এক রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। তাই গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনাশাহির পতন সংগত কারণেই স্বাধীন হওয়ার অনুভূতি তৈরি করেছে।
কোনো কোনো দেয়ালে ‘বাংলাদেশ ২.০’ লেখা রয়েছে, যেন একটা নতুন শুরু। এই মর্মেই ‘সংস্কার’ বর্গটি দেয়ালে দেয়ালে রাষ্ট্র হয়ে গেছে! স্বাধীনতা অর্জনই যে কর্তব্য শেষ নয়, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোরও যে সংস্কার ও পুনর্গঠন দরকার—এই ঐতিহাসিক চৈতন্য সমাজে হাজির রয়েছে। গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
‘একাত্তর দেখিনি, চব্বিশ দেখেছি’ বা ‘ন্যায়ের আইন’—এ ধরনের বক্তব্যও দেয়ালে জায়গা করে নিয়েছে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ না দেখলেও তার ইতিহাস এই প্রজন্ম ধারণ করে। ১৯৭১ সালের সঙ্গে ২০২৪ সালের ধারাবাহিকতা তারা অনুভব করে। এটা আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র চেয়ে অনেক গভীর ও রাজনৈতিক। এত দিন আইন ছিল, কিন্তু তা যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি, ‘ন্যায়ের আইন’ যেন সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
‘দুর্নীতির মাশুল চুকায় জনগণ’—পল্লবী মেট্রো স্টেশনের পিলারে এই বক্তব্য চোখে পড়ল। অর্থাৎ ‘জেন-জি’ বলে যাদের ঐতিহাসিক অর্জনকে খাটো করার চেষ্টা চলছে, রাজপথে তারা এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শিক্ষা অর্জন করেছে যে দুর্নীতির ফায়দা লোটে মাফিয়াগোষ্ঠী আর ভুক্তভোগী হয় গরিব জনগণ। ইকবাল রোডের দেয়ালে অভিজাত গোষ্ঠীর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নাকচ করে গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের তাগিদ দেখা গেল।
দেয়াললিখন জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচারের দাবি জানাচ্ছে। শেখ হাসিনাকে সরাসরি ‘কিলার হাসিনা’ ও ‘খুনি হাসিনা’ বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচারের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। ‘নিষেধ’ শব্দটি কেটে দিয়ে বলা হচ্ছে—‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’। ঢাকা যেন এখন বিপ্লবী বিদ্রোহী তারুণ্যের শহর!
ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস ডিক্লারেশনের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ লেখা রয়েছে লালমাটিয়ার এক দেয়ালে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, মর্যাদা ও সুনামের ওপর অযাচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয় এই অনুচ্ছেদ। আন্দোলনকারী তারুণ্যকে ‘রাজাকারের বংশধর’ বলে তাঁদের সম্মানহানী করেছিলেন শেখ হাসিনা। এর প্রতিবাদে মেয়েরা মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করেন। পরে ছেলেরাও যুক্ত হন। অধিকার চাওয়ার ‘অপরাধে’ রাজাকার তকমা দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অপমান করা হয়েছিল। সর্বজনীন মানবাধিকারের ধারা দেয়ালে লিখে তারুণ্য অপমানমূলক সেই তকমাই যেন প্রত্যাখ্যান করল। পাশাপাশি ফোন চেক করার মতো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনমূলক বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও নিজেদের অবস্থান জানাল।
আছে অসাম্প্রদায়িকতা, বহুত্ববাদ ও সহিষ্ণুতারও আহ্বান, সাম্প্রদায়িক হামলা রুখে দেওয়ার প্রত্যয়। গ্রাফিতি ও ক্যালিগ্রাফির সহাবস্থানও দেখা যাচ্ছে। পোস্ট-ইডিওলজিক্যাল বা মতাদর্শ-উত্তর এই প্রজন্ম পাতানো বিভাজনের সব ফাঁদ ভেস্তে দিতে বদ্ধপরিকর।
একটি দেয়ালে মাদ্রাসার এক কিশোর ছাত্রকে ‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’ লিখতে দেখা গেল। লালমাটিয়া মহিলা কলেজের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ‘এক জাতির দেশ নয়, বহু জাতির বাংলাদেশ’। অর্থাৎ সংকীর্ণ বাঙালি ও মুসলিম জাতিবাদের ঘেরাটোপে এই প্রজন্ম নিজেদের ঘিরে ফেলতে চায় না। বহু ধর্ম আর বহু জাতির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই তারুণ্যের বাসনা।
ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের তারুণ্য যে নিজেদের সম্পৃক্ত বলে মনে করে, দেয়াললিখনে তারও নজির রয়েছে: ‘ফ্রম গাজা টু ঢাকা জাস্টিস মাস্ট বি সার্ভড’ বা ‘গাজা থেকে ঢাকায় ইনসাফ দিতে হবে’ কিংবা ‘ফ্রম ঢাকা টু গাজা, লং লিভ দ্য ইন্তিফাদা’ বা ‘ঢাকা থেকে গাজায় ইন্তিফাদা জারি থাক’। ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসনের সঙ্গে ঢাকার তারুণ্য যে নিজেদের সম্পর্কিত করছে, এর তাৎপর্য বিপুল।
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের দেয়ালে লেখা রয়েছে—‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, সহিংসতা প্রতিরোধ করো’। এ ক্ষেত্রে বাঁশের লাঠি সহিংসতার প্রতীক নয়, বরং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও দলীয় বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ পুলিশি সহিংসতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার আহ্বানমাত্র।
শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে তরুণেরা দেয়ালের মাধ্যমে নিজেদের আকুতি ব্যক্ত করছেন। তাঁদের রাষ্ট্রকল্পের পরিষ্কার রূপরেখা গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনে ফুটে উঠছে। গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এক রাষ্ট্রকল্পই তাঁরা লালন করেন, যেখানে বিচারহীনতা থাকবে না, মৌলিক অধিকারবিরোধী আইন থাকবে না, গুম-ক্রসফায়ার-বাক্স্বাধীনতা হরণ, দুর্নীতি ও লুটপাট থাকবে না। বৈষম্য থাকবে না। তারুণ্যের আত্মত্যাগ আর বীরত্বে ঠাসা জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক মাস। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ছাড়া এই আত্মত্যাগ ও শহীদির প্রতি সম্মান জানানোর আর কোনো বিকল্প নেই।