শ্রদ্ধা
আনিসুজ্জামান পাঠের নতুন উৎস
১৮ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্মদিন। এই বইমেলায় তাঁর চিঠি এবং তাঁকে লেখা চিঠিপত্র নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে প্রিয় আনিসুজ্জামান: তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র। বইটির সূত্রে পাওয়া গেল আনিসুজ্জামানের বহুবর্ণিল সত্তার খোঁজ।
চিঠির একটা আলাদা ক্ষমতা আছে। যা কথায় হয় না, যা অন্য আঙ্গিকের লেখালেখির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না, তা চিঠি দিয়ে সম্ভব। এটি ব্যক্তিকে অনেক বেশি মেলে ধরার ক্ষমতা রাখে। চিঠি তার লেখকের ইন্দ্রিয়কে যাবতীয় বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার ক্ষমতা রাখে। কথাগুলো মনে হলো প্রিয় আনিসুজ্জামান: তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র বইটি পড়তে গিয়ে। এই বইয়ে বিভিন্নজনের কাছে আনিসুজ্জামানের লেখা চিঠি আছে। আবার নানাজন নানা সময়ে আনিসুজ্জামানকে যেসব চিঠি লিখেছেন, সেসবও আছে। বইটি সম্পাদনা করেছেন মতিউর রহমান। বইটি আনিসুজ্জামানকে নতুনভাবে, অন্তরঙ্গভাবে জানার ও বোঝার দারুণ এক মওকা।
বাংলাদেশের বিদ্বৎদসমাজ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে মূলত সাহিত্যচর্চাকারী ও সংস্কৃতিসেবী হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু আনিসুজ্জামান একধরনের রাজনৈতিক চরিত্রও বটে। কারণ, তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন অবধি নানাভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। এমনকি বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা অনুবাদকও ছিলেন। ছিলেন মুজিবনগর সরকারের সক্রিয় কর্মী। একদিক থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় থেকে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে—বিশেষত আমেরিকা ও কানাডার একাডেমিশিয়ানদের পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও আর্থিক অনুদান সংগ্রহের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকে দেশের জন্য কাজ করার ব্যাপারটা তাঁর কমে গিয়েছিল। কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময় যে সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে থাকে, আমৃত্যু তিনি ছিলেন সেই ফ্রন্টের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ফলে যাঁরা বলেন, আনিসুজ্জামান মূলত রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন, তাঁরা খুব অমূলক বলেন না। রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে, মঞ্চে, বক্তৃতায় বা দলীয় পদ-পদবির মধ্যে থাকে, এ কথা ঠিক নয়। সাংস্কৃতিক তৎপরতারও রাজনীতি থাকে। আনিসুজ্জামান যতই রাজনৈতিক ঘটনাধারার সঙ্গে যুক্ত থাকেন না কেন, শেষ বিচারে তিনি মূলত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। এদিক থেকে তাঁর মতো তৎপর চরিত্র বাংলাদেশে খুব কমই ছিল বলে মনে হয়। প্রিয় আনিসুজ্জামান: তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র পড়লে বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
চিঠিপত্র সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একধরনের চিঠিপত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিগত অনুভব-অনুভূতি প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ছিন্ন পত্রাবলি এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। আরেক ধরনের চিঠিপত্র থাকে, যা মূলত প্রয়োজনে লেখা হয়। কাজের আলাপ সেখানে মুখ্য থাকে। দ্বিতীয়োক্ত পত্রগুলো কেজো হলেও সেই সব কাজের কথার ভেতর দিয়ে এর প্রেরক ও প্রাপকের জীবনবোধ ও রুচি সম্পর্কে একটা ধারণা ঠিকই লাভ করা যায়। প্রিয় আনিসুজ্জামান: তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায় একজন আনিসুজ্জামানের জীবনবোধ ও রুচিকে।
আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের বাঙালির সুষম মনীষার বোধ করি অন্যতম উদাহরণ। উচ্চণ্ড মানুষের প্রতাপের এই দেশে বাকে, আচরণে, পোশাকে, দায়িত্ববোধে, গবেষণায়, রসবোধে, পারস্পরিক সম্পর্কের সীমানা রক্ষায় তিনি এমন একটি সুষমা অর্জন করতে পেরেছিলেন যে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। শুধু এই ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবোধের কারণেই আনিসুজ্জামানের শূন্যতা বাঙালি বোধ করি বহুদিন অনুভব করবে।
মানুষের ব্যক্তিগত চিঠির পরতে পরতে ভরা থাকে পরিবারের কাঠামোর মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের একান্ত দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়া। প্রিয় আনিসুজ্জামান: তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র বইয়ে আনিসুজ্জামানকে লেখা তাঁর ছোটবু, দুলাভাই, আব্বা, ছোট বোনের মেয়ে, ফুফু, মেজবু, বড়বু, স্ত্রীসহ পরিবারের অনেকের চিঠি আছে। আবার আনিসুজ্জামানও তাঁদের কাছে কিছু চিঠি লিখেছেন। এসব চিঠিতে দারুণ অন্তরঙ্গতায় ধরা পড়েছে পারিবারিক আবেগ আর সম্পর্কের ধরন। পারিবারিক পরিসরের এসব চিঠি অধিকাংশই ১৯৬২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে লেখা। ১৯৬৪ সালে আনিসুজ্জামান ছিলেন আমেরিকায়। তাঁর বাবা এ টি এম মোয়াজ্জম ছেলেকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার কিছু অংশ এমন—‘তোমার মা পূর্বাপেক্ষা একটু ভালো মনে হয়। আখতার ভাল আছে। তোমার শরীরের দিকে বিশেষ রূপ লক্ষ্য রাখিবে। দুধ দিনের মধ্যে অন্তত একবার খাইবে। ফলের রস খাইতেছ শুনিয়া সুখী হইলাম। ঐরূপভাবে খাঁটি দুধ খাইলে আরও শান্তি পাইব। তোমার জন্য আমরা সকলেই ব্যস্ত থাকি। ৮ দিনে ডাক্তারখানায় ২/১ ঘণ্টা বসিয়া চলিয়া আসিয়াছিলাম। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হইত। তুমি প্রায় পত্র দিও। খরচ বেশি সুতরাং বৌমাকে দিলে চলিবে। তোমার প্রেরিত কার্ড সকলেই পাইয়াছে। ... বাচ্চার দুইটা কথা ফুটিয়াছে—আব্বা, বু প্রায় বলে। আর গলা দিয়া একটা আওয়াজ করে ভারি সুন্দর।’ চিঠিটা শুধু চিঠি নয়। এটি আনিসুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের আন্তঃসম্পর্কের স্মারকও শুধু নয়। এটি তাঁর পরিবারের এক বিশেষ যাপনপদ্ধতিকেও প্রকাশ করেছে। আনিসুজ্জামানের শ্রেণি আর ব্যক্তিত্বকে বোঝার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম উৎস আর কী হতে পারে!
আলোচ্য গ্রন্থটি আনিসুজ্জামানকে জানা-বোঝা ও নির্মাণের এক স্বতন্ত্র উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে মনে করি। এমনকি সাধারণ্যে আনিসুজ্জামানের যে পাঠ চালু আছে, তাকে পরখ করে নেওয়ার দারুণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে চিঠিপত্রের এই সংকলন।
প্রিয় আনিসুজ্জামান: তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র
সম্পাদক: মতিউর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২২, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ৩৩৬ পৃষ্ঠা, দাম: ৬৫০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে। আর বইমেলায় বইটি পাবেন: প্রথমার ৬ নম্বর প্যাভিলিয়নে।
১৯৭১ সালে সহধর্মিণী সিদ্দিকা জামানকে লেখা আনিসুজ্জামানের একটি চিঠি
দিল্লি
১৭ মে ১৯৭১
বেবী,
আগের চিঠি দুটো নিশ্চয় পেয়েছ। পরশু রাতে দিল্লী এসে পৌঁছেছি। এখানেও ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউসে আছি। থাকার ব্যবস্থা ভাল—খাওয়া চলনসই, কিন্তু পরিবেশন অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। কোন কোন বেলা বাইরে খাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় চলে যাচ্ছে।
কাল ইউনিভার্সিটিতে মল্লিক সাহেব বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমরা পাবলিক রিলেশন্স করছি। আজ মিসেস গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। দিল্লীতে একটু বেশী থাকতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বিদেশে তাঁর সফরের মেয়াদ বাড়িয়েছেন। সম্ভবতঃ ২৩ তারিখের আগে তাই আমাদের দিল্লী ছাড়া হচ্ছে না। কলকাতায় ফিরতে ৩০ তারিখ হয়ে যেতে পারে। দিল্লী থেকে আগ্রা-লক্ষ্ণৌ-গোরখপুর-বেনারস হয়ে ফেরার পরিকল্পনা। বেনারসে না–ও যেতে পারি শেষ পর্যন্ত।
ভাল আছি। ট্যাক্সি চড়ে কারো অফিসে বা বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করাই প্রধান কাজ। দু-একটা সভায়ও হয়তো যেতে হবে। স্নানাহার ঠিকমতো করছি। অসুবিধে কিছু হচ্ছে না। কেবল তোমাদের খবর পাচ্ছি না।
ভাল আছো আশা করি। রুচি-শুচিকে ভালবাসা জানিও ও লক্ষ্মী হয়ে থাকতে বোলো। বাসার সবাই কেমন?
আনিস
আনিসুজ্জামানের সহধর্মিণীর ঘরোয়া নাম বেবী। চিঠিটি নেওয়া হয়েছে প্রিয়আনিসুজ্জামান: তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকে। চিঠিতে ব্যবহৃত ভাষা ও বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে।