লেখক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনপ্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) জন্ম, শিক্ষা, বিকাশকাল, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা এবং বাংলার নারীর জীবন-জগৎ বিষয়ে তাঁর উপলব্ধি বিশ শতক থেকে শুরু করে একুশ শতকের বর্তমান সময়েও আমাদের চিন্তার খোরাক জোগায়।

বাঙালি নারীবাদী নেত্রী রোকেয়া বর্তমানে শুধু বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের তাত্ত্বিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শিক নেত্রী নন; সাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর স্বতঃমূল্য রয়েছে। অবরোধের ঘেরাটোপে বন্দী রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের শত শত নারীর মতো তিনি শেওলার স্রোতে ভেসে যাননি—মানুষ হওয়ার স্বপ্ন সফল করেছেন। সেই সংগ্রামের বীজ রোপিত হয়েছিল তাঁর শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের অবরুদ্ধ পরিবেশে।

সৃজনশীল সাহিত্যিক মেধা, ব্যক্তিত্ব, নারীশিক্ষা প্রসারে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আন্দোলনরূপী-বিদ্রোহীরূপী সংগ্রামের বিষয়ে আমরা জানতে পারি তাঁর সাহিত্য পাঠ করে। নারীর মানবাধিকার হরণ, পারিবারিক বিবাহপ্রথার বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। ঔপনিবেশিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান, পুরুষের প্রাধান্য না মেনেও স্বচ্ছন্দে নারী তার কাজ করতে পারে, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অনুশীলনে কৃতিত্ব দেখাতে পারে ইত্যাদি তাঁর সাহিত্যে অপূর্ব নান্দনিক শৈলীতে রূপায়িত হয়েছে।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা থেকেই জানা যায়, তিনি নিরন্তর পাঠক ছিলেন।

১৮ বছর বয়স থেকে (১৮৯৮) তিনি বিহারের ভাগলপুরে নিজের সংসারে বাস করেছেন ১১ বছর (১৯০৯)। সে সময় তিনি লেখালেখি শুরু করেন, সমাজসেবামূলক কাজ করেন এবং মাত্র পাঁচজন মেয়ে ও একজন শিক্ষিকা নিয়ে স্কুলের কাজও শুরু করেন।

বলা দরকার, সে সময় মুসলিম নারীকে জাগানোর জন্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাঙালি নারীর মধ্যে ফয়জুন্নেসা চৌধুরী (১৮৩৪-১৯০৩) ও করিমুন্নেসা খানম (১৮৫৫-১৯২৬) ছাড়া আর কোনো পূর্বসূরি পাননি।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাহিত্যচর্চার শুরু ১৯০২ সালে প্রকাশিত ‘পিপাসা’ শিরোনামে মহররমবিষয়ক একটি প্রবন্ধ দিয়ে। আর সাহিত্যচর্চার শেষ হয়েছে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাতে মৃত্যুর আগে অসমাপ্ত লেখা ‘নারীর অধিকার’—প্রবন্ধ দিয়ে। (মোশ্‌ফেকা মাহমুদ রচিত পত্রে রোকেয়া পরিচিতি বইয়ে আরও কিছু অসমাপ্ত লেখার উল্লেখ রয়েছে।) মাঝখানে ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু সাহিত্যচর্চা বন্ধ ছিল না। সে জন্য বলা যায় তিন দশক ধরে তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত সব রচনা এবং অপ্রকাশিত কিছু লেখা সংকলিত করে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচটি বই—মতিচূর (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), পদ্মরাগ, অবরোধ-বাসিনী সুলতানাস ড্রিম। তাঁর এই পাঁচটি বইয়ের সব রচনাসহ অগ্রন্থিত ২৫টি প্রবন্ধ, ৭টি ছোটগল্প ও রস-রচনা, অগ্রন্থিত ১২টি কবিতা, ইংরেজি ভাষায় রচিত ২টি প্রবন্ধ এবং ইংরেজি-বাংলা ভাষায় লেখা ২২টি চিঠি সংকলিত করে বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় আবদুল কাদির সম্পাদিত রোকেয়া রচনাবলি

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ‘নারী কল্যাণ সংস্থা’ থেকে প্রথম রোকেয়ার লেখা বিভিন্ন বই পুনঃপ্রকাশ করে বাংলাদেশে প্রচারিত হয়েছে ১৯৬০-এর দশকে। এখনো বহু লেখক, প্রকাশক রোকেয়ার লেখা ও তাঁর বিষয়ে লেখা বই প্রকাশ করছেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা থেকেই জানা যায়, তিনি নিরন্তর পাঠক ছিলেন। বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু—সব রকম সাহিত্য, বিজ্ঞান, কৃষি, পুষ্টি, চিকিৎসার বই, প্রবন্ধ, সাময়িকী ও সংবাদপত্র পাঠের নিরলস শ্রম, আনন্দ ও ব্যুৎপত্তি তিনি অর্জন করেছিলেন। তিনি মেরিউলস্টন ক্রাফট, স্টুয়ার্ট মিলে বই পড়েছিলেন কি না জানা যায়নি। তাঁর নারীমুক্তির যুক্তি-চর্চা পরিশীলিত হয়ে উঠেছিল নানা দেশের ও ভাষায় জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে।

এখন তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করি, ‘অবনতি প্রসঙ্গে’ নামে এক লেখায় সমাজকর্মীদের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা-গ্লানি, উপেক্ষা-অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে; মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’

আমৃত্যু এই মহীয়সী তাই করেছিলেন। তাঁর নিজের লেখায় প্রতিবাদরূপে ফুটে উঠেছে সেসব, ‘...আমি আজীবন কঠোর সামাজিক “পর্দ্দার” অত্যাচারে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ আছি—ভালরূপে সমাজে মিশিতে পাই নাই...—আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্ব্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে নিকৃষ্ট জীব কাহারা, জানেন? সে জীব ভারত-নারী! এই জীবগুলির জন্য কখনও কাহারও প্রাণ কাঁদে নাই।...পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে, তাই যত্রতত্র “পশুক্লেশ-নিবারণী সমিতি” দেখিতে পাই। পথে কুকুরটা মোটর চাপা পড়িলে তাহার জন্য এংলো-ইন্ডিয়ান পত্রিকাগুলিতে ক্রন্দনের রোল দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধবন্দিনী নারীজাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এ ভূ-ভারতে নাই।’ (‘একেই কি বলে অবনতি’, কলিকাতা, নবনূর, ২য় বর্ষ: ৭ম সংখ্যা (কার্তিক: ১৩১১ বঙ্গাব্দ)।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের এসব কথা থেকেই আমরা জানতে পারি, আশৈশব কত সংগ্রাম, বাধা, অনাদৃত সামাজিক জীবনের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

সমসাময়িক সামাজিক-সাংস্কৃতিক কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যে ধর্মশিক্ষা, সততা, জ্ঞান ও সাহস অর্জন করেছিলেন রোকেয়া, তাঁর লেখনীতে এর প্রকাশ রয়েছে।  সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠাসহ সমসাময়িক নারীতীর্থ প্রতিষ্ঠানের (ডা. লুৎফর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত) সভানেতৃত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে নারীসমাজের জাগরণ ঘটাতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। লেখালেখিও তিনি করেছেন নারী জাগরণের নিমিত্তে। নারীর সমানাধিকার বিষয়ে অব্যাহতভাবে প্রবন্ধ, উপন্যাস তথা সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে নারীর বঞ্চনাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি।

বস্তুত তাঁর সমগ্র সাহিত্য সাধনা ও লেখালেখির মূল বিষয় ছিল সমাজের গলদ তুলে ধরা, নারীর প্রকৃত শক্তির উদ্‌ঘাটন করা ও নারীকে অধিকারসচেতন করে তোলা। ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ শিরোনামের প্রবন্ধে যেমন বলেছেন, ‘...প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে জানি;...কি করিলে আমরা দেশের উপযুক্ত কন্যা হইব? প্রথমত সাংসারিক জীবনের পথে পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা অথবা দৃঢ় সংকল্প আবশ্যক। এবং আমরা যে গোলাম জাতি নই, এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে।’

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শেষনিশ্বাস ফেলার কয়েক ঘণ্টা আগে ৮ ডিসেম্বর রাতে অকালপ্রয়াত রোকেয়া লিখছিলেন ‘নারীর অধিকার’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ। অসম্পূর্ণ হলেও এই প্রবন্ধেও বাংলার নারী আন্দোলনের জন্য নির্দেশিত হয়েছে একটি তত্ত্ব ও ইস্যু, ‘আমাদের ধর্ম্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্র-পাত্রীর সম্মতি দ্বারা। তাই খোদা না করুন, বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা?...বৃদ্ধ পুরুষদের বালিকা-বিবাহে কত আগ্রহ ও সাধ, সেই সম্বন্ধে উত্তর-বঙ্গে এই একটি ছড়াও প্রচলিত রয়েছে:

          হুকুর হুকুর কাশে বুড়া

          হুকুর হুকুর কাশে।

          নিকার নামে হাসে বুড়া

          ফুকুর ফুকুর হাসে।।’

রোকেয়ার মাত্র ৫২ বছরের জীবনের সমগ্র সময়টুকুই ছিল সংগ্রামমুখর। প্রথম জীবনে অবরোধ প্রথার নিদারুণ নির্যাতন ভোগ করেছেন তিনি। মাত্র ১১ বছর স্বামীর সহযোগিতাপূর্ণ সুখী-সুন্দর জীবন যাপন করেছেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি যেমন কর্মব্যস্ত ছিলেন, তেমনি কঠোর সংগ্রামী ছিলেন, লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। নারীসমাজের প্রতি সব বৈষম্য ও শোষণ বন্ধের জন্য একদিন তিনি হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন, তাঁর রচনাসমূহের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, আর এটিই লেখক হিসেবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে অনন্য করে তুলেছে।