গণ-অভ্যুত্থান এবং রক্তে লেখা সামাজিক চুক্তি

বারবার গণ–অভ্যুত্থান করে ছাত্র–জনতা বাংলাদেশে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। গণ–অভ্যুত্থানে ব্যক্ত জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা তারপরও কেন রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে? কেন বারবার রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের রক্তমাখা চুক্তি শাসকেরা পদদলিত করে? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেছেন লেখক

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের পর শাহবাগে জনতার উল্লাস, ৫ আগস্ট ২০২৪ছবি: আশরাফুল আলম

বাংলাদেশে এক রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটেছে। এ অভ্যুত্থান অভাবনীয়। দেশে নিবর্তনমূলক আইন, হত্যা আর নিপীড়নের মাধ্যমে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল যে এই শাসকের পতন কল্পনা করাও ছিল কঠিন। কিন্তু এখন এটাই সত্য। ভয়ংকর স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে এবং তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

আমরা বুঝতে পারি, দীর্ঘ দুঃশাসন দেশজুড়ে কী অপরিমেয় বারুদ জমা করেছিল, মানুষের ক্ষোভের বারুদ। সরকারের বলপ্রয়োগ ও ছাত্রহত্যা তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরে যায় মানুষের রক্তে। সেটা এমনই যে আবু সাঈদ পুলিশের বন্দুকের সামনে দু-হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। সারা দেশে, শহরে শহরে শত শত মিছিল এগিয়ে যায় বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ার শেল উপেক্ষা করে।

সহিংস আক্রমণে শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষ নিহত হলেও তাঁরা রাজপথ ছেড়ে যাননি। কারণ, তাঁরা দুঃশাসনের অবসান চান, চান রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত সংস্কার। গড়ে তুলতে চান এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যাতে নতুন কোনো স্বৈরাচারের জন্ম না হয়। যাঁদের ওপর দেশ পরিচালনার ভার পড়বে, তাঁদের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের রক্তে সেই চুক্তিই লেখা হয়ে গেছে।

  ২.

দেশ-বিদেশের গণ-অভ্যুত্থানগুলোর আলাদা বিশেষত্ব আছে। আমরা এসব অভ্যুত্থানে বিস্তর অমিলও খুঁজে পাব। কিন্তু সব ক্ষেত্রে একটা জায়গায় মিল—দুঃশাসনের কারণে জনগণ আগের চুক্তি বাতিল করে দেয়, শাসকের পতন ঘটে এবং নতুন শাসকের জন্য ধার্য হয় নতুন চুক্তিনামা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই চুক্তি জনগণের রক্ত দিয়েই লেখা হয়।

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে সান্ধ্য আইন ভেঙে বেরোনো মিছিলে পুলিশ গুলি করেছে। নিহত হয়েছেন আসাদ। এরপর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ক্রমশেই। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন কিশোর মতিউর। ক্যান্টনমেন্টে আটক অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে সার্জেন্ট জহুরুল হককে। রাজশাহীতে শহীদ হন ড. শামসুজ্জোহা। নিহত হন ছাত্র–কৃষক–শ্রমিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষ। তাঁরা সামরিক শাসকদের উৎখাত চেয়েছেন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের কার্যকর গণতান্ত্রিক রূপান্তর আমরা ঘটতে দেখিনি।

এ দেশে বারবার ফিরে এসেছে স্বৈরাচার। সঙ্গে এসেছে জুলুম, লুটপাট, দুর্নীতি আর দখলদারত্ব। শাসকের সঙ্গে জনগণের চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে বারবার। আমরা দেখেছি, এক তরুণ, নূর হোসেন বুকে–পিঠে স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান লিখে মিছিলে গেছেন। পুলিশ গুলি করতে পারে এটা জেনেও এবং পুলিশ ঠিকই গুলি করেছে। নূর হোসেনসহ অনেকে শহীদ হয়েছেন স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলনে। স্বৈরাচারের পতনও ঘটেছে। কিন্তু আন্দোলনের অংশীদারই ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ভুলে গেছেন।

কাছের ইতিহাস থেকে এমন চুক্তিভঙ্গের আরও কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। আরব বসন্তের গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়া থেকে। সেখানেও দুর্নীতি, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত করেছিল। জীবনধারণের সর্বশেষ অবলম্বন হারিয়ে নিজের শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন বুআজিজি নামের এক যুবক। তাঁর হাড়-মাংস পোড়ানো আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ে তিউনিসিয়ার শহরে শহরে। বিক্ষুব্ধ জনগণকে গুলি করে সেনাবাহিনী। শহীদ হন তিন শতাধিক মানুষ। কিন্তু নিহত ব্যক্তিদের রক্তের দাম শোধ করেননি পরর্বর্তী শাসকেরা। এই অভ্যুত্থানের পরে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরে আস্থা রাখতে পারল না জনগণ। ক্রমাগত নাজুক হয়ে পড়ল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা—রাষ্ট্রসংস্কার, সেটাও আর শুরু হলো না।

এমন চুক্তিভঙ্গের প্রায় একই চিত্র দেখা যায় মিসরে। তিরিশ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা স্বৈরশাসক হুসনি মোবারক পদত্যাগে বাধ্য হন ১৮ দিনের গণ-অভ্যুত্থানে। এতে নিহত হন ৮৪৬ জন। স্বৈরশাসকের পতনের পর ক্ষমতা পেয়েই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মুহম্মদ মুরসি। শুরু করেন দলীয়করণ। মুরসি সরকারের ওপর গণ-অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এই বাস্তবতায় সেনাবাহিনী তাঁকে বিতাড়িত করে।

লিবিয়ার দৃষ্টান্তও আমরা স্মরণ করতে পারি। মুয়াম্মার গাদ্দাফির স্বৈরশাসন ছিল আরও দীর্ঘ, ৪২ বছর। তিনিও বিক্ষোভ দমন করতে সহিংসতার পথ বেছে নেন। ছয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মারা যান কয়েক হাজার মানুষ। গাদ্দাফি নিহত হন, কিন্তু জনগণের রক্তে লেখা চুক্তি বাস্তবায়িত হয় না। দেশজুড়ে একই রকম থেকে যায় বেকার সমস্যা ও সামাজিক অস্থিরতা। শাসনপ্রণালির ভেতর জমতে থাকে ধোঁয়াশা এবং শাসকের জবাবদিহির প্রশ্নটিরও মীমাংসা হয় না।

আমাদের মনে পড়ে, হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো উপন্যাসের কথা। উপনিবেশ-উত্তরকালে বারবার গণ-অভ্যুত্থান ঘটলেও মেক্সিকোতে নতুন শাসকদের সবাই হয়ে উঠেছেন স্বৈরাচার এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি। এভাবে বিপ্লব বেহাত হয়েছে বারবার। পেদ্রো পারামোর কোমালা সেই মেক্সিকোর রূপক। বিপ্লবের পর এর সুবিধাভোগী হয়ে উঠেছে যে জমিদার ভূস্বামীরা, পেদ্রো পারামো তাদেরই একজন। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, হুয়ান প্রেসিয়াদোকে তার মা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বলছেন, সে যেন কোমালায় গিয়ে জনৈক পেদ্রো পারামোকে খুঁজে বের করে এবং তার কাছে যা যা পাওনা তা বুঝে নেয়।

জাঁ–জাক রুশো, লুই আলথুসার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  ৩.

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন ঘটে? গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে জনগণ যে আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটায়, নতুন শাসকেরা কেন তার সঙ্গে প্রতারণা করে? এটা কি কেবলই কার্যকারণ ও পরিস্থিতির ফল, নাকি খোদ রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই আছে গলদ? সার্বভৌম ক্ষমতাই কি ব্যক্তিকে বদলে দেয়? নাকি রাষ্ট্র ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত বহু পরস্পরবিরোধী পক্ষ, বহু কারক ও চলক এই রূপান্তর ঘটায়?

মানুষের পক্ষে কি সার্বভৌম ক্ষমতা কিংবা কোনো সিভিল কর্তৃত্বের বাইরে থাকা সম্ভব? তেমন মানুষের কথা নিশ্চয়ই কল্পনা করা সম্ভব। সে হবে নিঃসঙ্গ ও দরিদ্র, কিন্তু স্বাধীন। সার্বভৌম কর্তৃত্বের অনুপস্থিতিতে সেই প্রাকৃত দশায় কি বর্বরতা থাকবে, যেমনটা বলেন টমাস হবস? হবসের ধারণা, প্রাকৃত দশায় মানুষ পরস্পরের সঙ্গে বিবাদ করবে, সংঘর্ষে জড়াবে। ওই পরিস্থিতিতে ন্যায্যতা বলে কিছু থাকবে না, থাকবে কেবল ভয় ও বিপন্নতা। হবস বলেন, এই অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই দরকার একটা সিভিল কর্তৃপক্ষের, যার কাছে প্রাকৃত মানুষ নিজেকে সমর্পণ করবে। তবে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক ধার্য হবে একটা চুক্তির ওপর ভিত্তি করে, যা থেকে নির্ধারিত হবে উভয়ের কর্তব্য ও অধিকার। এটাই সামাজিক চুক্তি। শাসক যখন জনগণকে রক্ষা করতে পারবে না, তখন চুক্তি ভঙ্গ হবে এবং শাসক তার শাসনের অধিকার হারাবে।

জন লক অবশ্য মনে করেন, প্রাকৃত মানুষ স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ থাকতে পারে। তারা অবশ্যই বাঁচতে চাইবে এবং সম্পত্তির অধিকার চাইবে। মানুষের এসব চাহিদাও প্রাকৃত। সিভিল সরকারের সব দায়িত্ব এ অধিকারগুলো রক্ষা করা।

জাঁ–জাক রুশো মনে করেন, যেখানে সমাজ নেই, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব নেই, মানুষ সেখানে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন, যদিও নিঃসঙ্গ। কিন্তু সমাজে ঢোকার পর তার সত্তার রূপান্তর ঘটে। আগের স্বাধীন সত্তা সে হারিয়ে ফেলে। তার মনে জন্ম নেয় ঈর্ষা, দম্ভ ইত্যাদি। সমাজ গঠনের পর সেখানে অসমতা প্রকট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র সেই অসমতা টিকিয়ে রেখেই সামষ্টিক কল্যাণ ও স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। রাষ্ট্র ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করে বলে তা হয়ে ওঠে ধনীদের রক্ষাকবচ। অসম স্বার্থ রক্ষার জন্যই দরকার পড়ে আইন ও বিধিবিধান। এ কারণে এই সামাজিক চুক্তির মধ্যেও থেকে যায় প্রতারণা।

মানুষ রাষ্ট্রের জরুরত যেমন উপলব্ধি করেছে, তেমনই একে নিয়ে পড়েছে চরম সংকটে। একদিকে সামষ্টিক স্বার্থরক্ষার তাগিদ, অন্যদিকে নিজের স্বাধীনতা হারানো। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনার অন্ত নেই। রাজনৈতিক দার্শনিক উইলিয়াম গডউইন বলছেন, রাষ্ট্রের সমস্যা তার গঠনে নয়, এর অস্তিত্বই শয়তানি আর পাপের আকর। রাষ্ট্র মানুষের সমাজকে একটা ব্যঙ্গচিত্র বানিয়ে ফেলে।

ফ্রেডরিক নিটশে তাঁর দাস স্পেক জরথুস্ত্র বইয়ে বলেন প্রায় একই কথা—রাষ্ট্র হচ্ছে শয়তানের ফাঁদ। রাষ্ট্রের যেখানে শেষ, সেখানেই প্রকৃত মানুষের জন্মের শুরু। আমরা বিনয় মজুমদারের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলতে পারি, রাষ্ট্র নিকটে এলে প্রকৃত মানুষ উড়ে যায়।

লুই আলথুসার ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রবিষয়ক এক লেখায় বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রমাত্রই দমনমূলক। পুলিশ, জেলখানা, সেনাবাহিনী, সরকার ও প্রশাসন নিয়ে যে রাষ্ট্রযন্ত্র—সব মিলে যেমন একটা একীভূত দমনমূলক অস্তিত্ব তৈরি হয়, তেমনই ভাবাদর্শযন্ত্রও দমনমূলক হয়ে ওঠে। ধর্ম, শিক্ষা, পরিবার, সংস্কৃতি, আইন, সমিতি—এসবের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের ভাবাদর্শযন্ত্র এক ভৌত রূপ লাভ করে। অর্থাৎ নাগরিকদের আচরণে ওই ভাবাদর্শ মূর্ত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষেত্র জনপরিসর হলেও ভাবাদর্শযন্ত্র নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরে
ঢুকে পড়ে।

কর্তৃত্বপরায়ণতা নেই, এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা কি তাহলে স্ববিরোধী ব্যাপার? রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর কি সম্ভব নয়? এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা কি সম্ভব, যেখানে সার্বভৌম ক্ষমতাও থাকবে, আবার মানুষের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা যাবে?

মানুষের স্বাধীনতা থাকতেই হবে। কারণ, এটাই তার অস্তিত্বের সারবস্তু। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পূর্বশর্তও এই স্বাধীনতা। স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়েই সে কেবল সৃষ্টিশীল হতে পারে। গড়ে তুলতে পারে মুক্ত সমাজ। মানুষ তার সৃষ্টিশীলতা দিয়েই প্রাকৃত থেকে অপ্রাকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে। রাষ্ট্র নিয়ে মানুষকে যে সংকটের মধ্যে থাকতে হচ্ছে—যার একদিকে সার্বভৌম কৃর্তৃত্ব এবং অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা—এটা নিশ্চয়ই বর্তমানের মানব–পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে। কিন্তু ভবিষ্যতে এর থেকে উত্তরণের ভেতর দিয়ে মানবসত্তার নতুন রূপান্তর ঘটা সম্ভব, যে পরিস্থিতিতে সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে কোনো বিরোধ থাকবে না।

যাঁদের ওপর দেশ পরিচালনার ভার পড়বে, তাঁদের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের রক্তে চুক্তি লেখা হয়ে গেছে।

  ৪.

ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা থেকে সবাইকেই শিখতে হয়। অবশ্য যাঁরা শাসন ক্ষমতায় বসেন, তাঁরা এই শিক্ষা নেন না। সব স্বৈরশাসকের একই পরিণতি বারবার দেখতে থাকি আমরা। জাঁ লুক গদার ভিভরে সাভিয়ে ছবিতে দার্শনিক–শিক্ষক ব্রাইস পারাইনকে দিয়ে একটা দারুণ কথা বলিয়ে নেন, ‘এটাই সত্য যে ভুলের মধ্যেও সত্য থাকে। সতেরো শতকের ফ্রান্স যেটা দেখতে পায়নি।’ ফরাসি বিপ্লব এই শিক্ষাই আমাদের দেয় যে সরাসরি সত্যে পৌঁছানো যায় না, সত্যে পৌঁছাতে হয় ভুলের ভেতর দিয়ে। এটাই মানবজীবনের সত্য। কিন্তু এদেশের স্বৈরশাসকেরা বুঝে-শুনেই ভুলগুলো করেন। তাঁরা অবশ্য সেই বুঝে-শুনে করা ভুলের পরিণাম দেখেও শিখতে পারেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসকেরা নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছেন, জবরদস্তিমূলক শাসন, নিবর্তনমূলক আইন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, লুটপাট, দলীয়করণ এবং বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর রাজনৈতিক ব্যবহারের কী পরিণাম।

জবরদস্তিমূলক শাসন সমাজে নতুন নতুন অপরাধের জন্ম দেয়। নৈরাজ্যবাদীরা অবশ্য মনে করেন, বিধিবিধানমাত্রই জবরদস্তিমূলক। সেটা অপরাধের জন্ম দেবেই। চীনা দার্শনিক লাওৎসু তাঁর তাও-তে-চিং বইয়ে বলেন, শাসকদের উচিত জনগণকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং জনগণকেই অনুসরণ করা। তাঁর কথা খানিকটা বদলে দিয়ে হেনরি ডেভিড থরো বলেন, সেই সরকারই সেরা যে শাসনই করে না।

আমরা দেখতে পাই, স্বৈরশাসকমাত্রই সত্য ও বাস্তবতাকে প্রদর্শনবাদিতার আড়ালে ঢেকে রাখেন। আর যেসব মিথ্যা ও ইমেজ দিয়ে সত্যকে ঢাকা হয়, গণমাধ্যম হয়ে ওঠে সেসব বানোয়াট ইমেজ তৈরির কারখানা। ২০২৪ সালে আমরা দেখলাম প্রদর্শনবাদিতার এই খোলস জনগণ ভেঙে দিয়েছে। কাজেই স্বৈরশাসকেরা নিশ্চয়ই মনে রাখবেন, এই অস্ত্র আর ব্যবহারযোগ্য নেই।

রাষ্ট্র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, রাষ্ট্র হবে সেই ডিমের মতো, যা প্রাণকে আগলে রেখে তাকে ফুটে বেরোতে সাহায্য করবে। কিন্তু দমনমূলক রাষ্ট্রকে আমরা তার উল্টোটাই করতে দেখি, সেখানে খোলসটা এত শক্ত হয়ে ওঠে যে এর ভেতরে থাকা প্রাণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়। রাষ্ট্র যদি সত্যি সত্যি প্রাণের স্ফূরণ ঘটাতে পারে, তখন ওই খোলসের আর দরকার পড়ে না। ১৯২৪ সালের এই গণ-অভ্যুত্থান সেই সত্যকেও আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছে। দেশের মানুষ এই অভ্যুত্থানের বিপ্লবাত্মক বোধে উজ্জীবিত থাকলে যেকোনো সরকার ও শাসকই সোজা পথে
চলতে বাধ্য।