অমিতাভ ঘোষের সাক্ষাৎকার
‘লেখক অনেকভাবেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক তৈরি করেন’
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ। তাঁর পূর্বপুরুষের জন্ম বাংলাদেশের পদ্মাপারে। আর এখন তিনি থাকেন নিউইয়র্কে। প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে সাহিত্যের পাশাপাশি এই লেখক বলেছেন সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে তাঁর উপলব্ধির কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম: আপনার লেখায় সব সময় বলার চেষ্টা থাকে, আমাদের পরিচিত এই আধুনিকতাকে যে ‘অগ্রগতি’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, তা মূলত অগ্রগতি নয়। এই তথাকথিত অগ্রগতি আসলে নৃশংসতার উপাখ্যান। সহজে যদি ব্যাখ্যা করতেন।
অমিতাভ ঘোষ: যে সময়কে ‘আধুনিক সময়’ বলে আমাদের শেখানো হয়েছে, সেটাকেই ‘উন্নতি’ বলে পরিচিত করানো হয়েছে। কিন্তু দেখুন, ঔপনিবেশিক আগ্রাসন মূলত পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। মানুষের ক্ষতি করেছে। ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপের বাসিন্দাদের মেরে, দাস বানিয়েছিলেন ডাচ ব্যবসায়ীরা, যার মূলে ছিল একটি ফলের বাণিজ্য। এভাবে ওখানে আধিপত্য বিস্তার করা হয়। ভারতবর্ষে আফিমের চাষ আর চীনে জবরদস্তিমূলকভাবে ঢোকানো
হয় আফিমের চালান—দুটোই তো আসলে নৃশংসতার গল্প।
ঘটনাগুলো যে শুধু ওই সময়েই ঘটেছে, তা নয়। জীবাশ্ম জ্বালানি ও উদ্ভিদকেন্দ্রিক রাজনীতি সব সময়ই প্রাসঙ্গিক। আমাদের শেখানো হয়েছে শিল্পায়ন বা ব্যবসার মতো কেবল সম্পদ আহরণকেন্দ্রিক ধারণাই হলো ‘অগ্রগতি’। এখানে আসলে কোনো আত্মিক সংযোগ নেই। পৃথিবীর সঙ্গে মানুষ নানাভাবে নিজের আত্মিক সম্পর্ক হারিয়ে ফেলছে। ফলে তার নিজের যা কিছু অর্জন, তা থেকে সে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এটা যেমন ব্যক্তিগতভাবে হারানো, তেমনি প্রকৃতির জন্যও ঝুঁকির কারণ। ফলে সে যা করতে পারত বা পৃথিবীকে দিতে পারত, সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না, বরং প্রাকৃতিক ক্ষতি বাড়ছে। আর এটা তো বহুবার বলা কথা যে প্রকৃতি নিজের পাওয়া আঘাতের কথা সবই মনে রাখে।
সাদিয়া: আপনার ‘হাংরি টাইড’
উপন্যাসে ঠিক এমন একটা উদাহরণ কি মাতলা নদীতে বন্দর তৈরি দেখে পেডিংটনের দেওয়া সেই ভবিষ্যদ্বাণী, যা পরে সত্যি হয়েছিল?
অমিতাভ: এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে ইতিহাসে। প্রকৃতির সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, সে তা কোনো না কোনোভাবে ফিরিয়ে দেয়। বরং আরও বেশি অসহনশীল হতে সে বাধ্য হয়। কিছুক্ষণ আগে এখানকার আলোচনায় বলছিলাম, বর্তমান বিশ্বে নানা জায়গায় অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। সান ফ্রান্সিসকোর রাস্তায় হঠাৎ ম্যানহোল ফেটে ফোয়ারার মতো পানি বের হচ্ছে। ভেনিস বা মিয়ামিতে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে। প্রকৃতির এমন আচরণ বহুদিন ধরে আমাদের করা অত্যাচারের ফলাফল। আপনি আজ এমন একটা নদীতে এমন জায়গায় বাঁধ দিলেন, যেখানে পানির প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, এই যে পানি আর পলি দুটোই বাধা পেল, এর কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না? এমনভাবে সে কখনো ভাঙবে যে তখন আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতি হবে। মানুষের প্রাণনাশ হবে, গ্রাম ভেসে যাবে। তেমনি জীবাশ্ম জ্বালানি, কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রেও একই কথা। এসব হচ্ছে প্রকৃতির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা, যা আবার সে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু দেখুন, আগেকার মানুষ তার প্রয়োজন হলে প্রকৃতির সঙ্গে সদ্ভাব রেখেই তা করার চেষ্টা করত।
সাদিয়া: এশিয়ার সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এ অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পসংস্কৃতি কম বর্ণাঢ্য নয়। কিন্তু তথাকথিত ‘আধুনিক’ পর্যায়ের কবলে পড়ে এশিয়ার মর্মান্তিক বিপর্যয় ঘটেছে। আপনার ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ বইয়ে আছে সে কথা। সেই প্রেক্ষিতে জানতে চাই, এশিয়ার প্রচীন ইতিহাসের কোন বিষয়গুলোর সঙ্গে আমাদের সংযোগ দরকার?
অমিতাভ: বস্তুগত ঐতিহ্যের চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানুষের মানবিক সম্পর্ক, যা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। একটা শরণার্থীশিবির থেকে উদাহরণ দিই। ইতালির শরণার্থীশিবিরে অনেক যুবকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাঁরা জানালেন, একসময় গ্রামে তাঁরা চাষাবাদ করতেন। অভাবের সঙ্গে সুখও ছিল সেই যৌথ জীবনে। কিন্তু তাঁরা নাকি ছোটবেলা থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন। সেখানে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখতেন কোনো আত্মীয়ের প্রবাসজীবনের ছবি। ভেবেছিলেন, ভালোই থাকবেন। কিন্তু কতখানি ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের সেসব ছেলে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে নানা শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় পেয়েছেন, তা আমরা সবাই জানি। কতজন এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন! তো সেসব যুবকের মানবিক সম্পর্কগুলো এখন ইন্টারনেটে বাড়ির আপনজনদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে মেটে। যে শব্দ তিনি গ্রামে থাকতে ব্যবহার করতেন, যে গান তিনি গাইতেন, সেই সুর, শব্দ এখন আর তাঁর জীবনে নেই—যেমন গ্রামের জীবনের সম্পর্কগুলো বদলে গেল, তেমনি তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেল কিছু গ্রামীণ শব্দ। আপনজনদের সঙ্গেও সম্পর্কটা কতখানি দূরবর্তী হয়ে গেল। ফলে আমার কাছে অতীতের মানবিক সম্পর্কগুলোই ভীষণ জরুরি।
সাদিয়া: আপনার ‘গান আইল্যান্ড’ উপন্যাসে উঠে এসেছে এই শরণার্থীশিবিরের কথা। একই বইয়ে বাংলা সাহিত্যের ‘মনসামঙ্গল’ থেকে চাঁদ সওদাগর চরিত্রটি আবার তুলে এনেছেন আপনি। এত আগের একটি চরিত্র পুনঃসৃজনের পেছনে কি সেই অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছা কাজ করেছে?
অমিতাভ: একজন লেখক অনেকভাবেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক তৈরি করেন। একটু আগের আলোচনায় (লিট ফেস্টের সদ্য সমাপ্ত সেশনে) বলছিলাম, মনসামঙ্গল কাব্য, পদ্মপুরাণ—এসব হচ্ছে আমাদের ‘আই ওপেনার’ বা চোখ খুলে দেওয়ার সাহিত্য। এসব সাহিত্যে শুধু চরিত্রের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। বর্ণনার যে ধারা, তা এ অঞ্চলের প্রকৃতি, পরিবেশ, একই সঙ্গে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও ধারণা তৈরি করে।
সাদিয়া: আপনার মাত্র তিনটি বই বাংলায় অনূদিত হয়েছে। আপনার কাছ থেকে আইবিস ট্রিলজির মতো সাহিত্যকর্মও আমরা পেয়েছি। কিন্তু এটির বাংলা অনুবাদ হয়নি। এর বাংলা অনুবাদের ব্যাপারে আপনাকে কেউ কিছু বলেননি?
অমিতাভ: ঠিকই বলেছেন, আইবিস ট্রিলজির বাংলা হয়নি। অনেকেই আমাকে বলেছেন, ফ্লাড অব ফায়ার, সি অব পপিস, রিভার অব স্মোক মিলে আমার তিন খণ্ডের আইবিস ট্রিলজির যে আয়তন, তা এত বড় যে পাঠকের কষ্টই হয় পড়তে। পাঠকের চেয়ে অনুবাদকের জন্য নিশ্চয়ই আরও বেশি কঠিন হবে। হয়তো এ জন্য এসব বইয়ের বাংলা অনুবাদের ব্যাপারে কেউ আগ্রহ দেখাননি। আমার অন্তত এখন মনে পড়ছে না যে
এগুলো কেউ করতে চেয়েছেন। তবে আমার সর্বশেষ উপন্যাস নাটমেগ কারস–এর অনুবাদ হচ্ছে কলকাতা থেকে। আর আইবিস ট্রিলজি নিয়ে নির্ভরযোগ্যভাবে অনুবাদ করতে পারবেন, এমন কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি আগ্রহী হলে আমি নিশ্চয়ই চাইব, এর বাংলা হোক।
সাদিয়া: ব্রিটিশ শাসন না এলে এই
সময় ভারতবর্ষের চেহারা কেমন হতো বলে
মনে করেন?
অমিতাভ: ইতিহাস তো অনেক পথ ধরে তৈরি হয়। অতীতের দিকে তাকালে দেখবেন, সব সময়ই বিকল্প ছিল। মানুষ তা খুঁজে দেখতে চেয়েছে। বর্তমানে দাঁড়িয়েও আমরা কিন্তু সেসব দিক নিয়ে ভাবি। ডেভিড ওয়েনগ্রোর দ্য ডন অব এভরিথিং বইটা পড়েছেন? এতে দেখিয়েছে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ অনেক রকম পছন্দের মধ্যে দিয়ে এসেছে। আজকের সময়টা অনেকভাবেই আসতে পারত। ধরা যাক, গান্ধীজির গ্রাম নিয়ে ধারণার কথা। সেখান থেকে আমরা ‘স্মলেস্ট বিউটি’ ধারণাটা পেতে পারি। গ্রামকে কেন্দ্র করে ছোট পরিসরের স্বনির্ভর অর্থনীতির একটা সমাজের কথা ভেবেছিলেন তিনি। তেমন ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটা ব্যবস্থাপনা হয়তো আরও ভালো কিছু দিত আমাদের। তাই অনেক অনেক ধারার ভেতর থেকে একবারে নির্ধারণ করে কিছু বলা ঠিক হবে না।
সাদিয়া: অনেক বছর পর বাংলাদেশে এসেছেন। আমাদের দেশে বহু পাঠক আপনার বই খুঁজে খুঁজে পড়ে। এখনকার তরুণদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কোনো পরামর্শ আছে?
অমিতাভ: আমার মনে হয়, লেখা বিষয়টি লেখকের নিজস্ব ভ্রমণ। অন্য কেউ বলে দিতে পারে না ঠিক কী করতে হবে। ফলে কোনো পরামর্শ না দেওয়াই ভালো।
অমিতাভ ঘোষ
জন্ম: ১১ জুলাই ১৯৫৬, কলকাতা, ভারত
জাতীয়তা: ভারতীয়, মার্কিন
পূর্বপুরুষের দেশ: বাংলাদেশ
মাতৃভাষা: বাংলা
লেখালেখির ভাষা: ইংরেজি
পড়াশোনা: ডুন স্কুল, সেন্ট স্টিভেনস কলেজ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়
ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
কর্মক্ষেত্র: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: দ্য সার্কেল অব রিজন, দ্য শ্যাডো লাইনস, দ্য গ্লাস প্যালেস, দ্য হাংরি টাইড, গান আইল্যান্ড, সি অব পপিস, রিভার অব স্মোক, ক্যালকাটা ক্রোমোজোম
উল্লেখযোগ্য সম্মাননা: পদ্মশ্রী সম্মাননা, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, মার্গারিট অ্যাট উডের সঙ্গে যৌথভাবে ড্যান ডেভিড সম্মাননা, রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচার ফেলো