শতবর্ষ–প্রাচীন হজের ডায়েরি
আমার দাদা আলহাজ ইয়াসিন আলী সরকারের কর্মের সুলুকসন্ধান করতে গিয়ে হঠাৎ একদিন একটি রত্নের সন্ধান পাই। পাওয়া যায় তাঁরই হাতে লেখা দিনপঞ্জি। শতাব্দীপ্রাচীন হজযাত্রীর ডায়েরি।
আমার দাদার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার বিলডগা গ্রামে। সেখানে ১৯২১ সালে তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেন সেখানে। ২০২১ সালে সেই স্কুলের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে নানা আয়োজনের উদ্যোগের মধ্যে ছিল স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের অনুসন্ধান।
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের শিক্ষা সংস্কার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববঙ্গ ও আসামে কয়েক শ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকারের সেটেলমেন্ট অফিসের সার্ভেয়ারের চাকরি ছেড়ে স্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন ইয়াসিন সরকার। বিদ্যালয়ের মঞ্জুরি আনার জন্য কিছুদিন পরে তিনি সে সময়ের বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর সহায়তা নেন।
খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় ইয়াসিন সরকারের সঙ্গে ধনবাড়ীর নবাবদের ভালো যোগাযোগ ছিল। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের ইতিহাস নিয়ে লেখা কেদারনাথ মজুমদার, এম আবদুল্লাহ, শৌরীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুর রহিমসহ বিভিন্নজনের বই ও সংকলন ঘেঁটে এসব তথ্য তুলে ধরেন ইতিহাসের শিক্ষক স্থানীয় সাংবাদিক ও গবেষক অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
শোনা যায়, দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ব্রিটিশবিরোধী মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হন ইয়াসিন সরকার। তাঁর বড় ভাই ছমির সরকার কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন। কিন্তু স্থানীয় হেমনগরের হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে বিরোধের জেরে পরে ধনবাড়ীর নবাবদের সঙ্গে খেলাফত আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন তাঁরা। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনুসন্ধানের একপর্যায়ে জানতে পারি, দাদার হাতে লেখা একটি নোটবই সংরক্ষিত আছে ছোট কাকা আবদুর রশিদের কাছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা। অবসরের পর ময়মনসিংহ শহরেই থাকেন। তাঁর কাছ থেকে নোটবইটি সংগ্রহ করি। বিস্মিত হয়ে তাঁর লেখা পড়তে শুরু করি। পকেট সাইজের নোটবইটি মূলত তাঁর হজযাত্রার দিনপঞ্জি।
১৯৩০ সালের মার্চে তৎকালীন বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) বন্দর থেকে জাহাজে করে হজে যান ইয়াসিন আলী সরকার। ফিরে আসেন জুনে। হজযাত্রার প্রতিদিনের টুকিটাকি বিবরণ লিখে রাখেন তিনি। তাঁর লেখার সূক্ষ্ম সাহিত্যরস ও পর্যবেক্ষণক্ষমতা অবাক করার মতো। ওই সময়ের জীবনযাপন, যোগাযোগ ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার নানা ইঙ্গিত আছে লেখায়। তাঁর হজ কাফেলার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
পেনসিল ও ফাউন্টেন পেনে লেখা ডায়েরির কিছু কিছু অংশ অস্পষ্ট। মূল নোটবইয়ের কিছু পাতা সম্ভবত হারিয়েও গেছে। ইয়াসিন আলী সরকারের পাণ্ডুলিপি দিনের পর দিন আতশি কাচ দিয়ে পড়ে পড়ে পুনর্লিখনের কাজ শেষ করি।
কিছু দুর্বোধ্য আরবি শব্দ এবং সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানের নাম যে পড়েছিলাম, তা সমাধান করে দেন সৌদিপ্রবাসী লেখক-অনুবাদক কাউসার আহমেদ। প্রায় ১০০ বছর পর পাঠকের সামনে এল এক হজযাত্রীর দিনপঞ্জি।
…
যাত্রাকালে দয়াময়ের নাম স্মরণপূর্বক দিঙ্মণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলিলাম। ভারতের পাহাড়তলীতে অসভ্যগণের ঝুপড়ি বান্ধা বাসস্থান দেখিলাম এবং তৎপার্শ্বেই তাহাদের চাষের উপযোগী সামান্য সামান্য রোয়ার (ধান চাষের) জমি দেখিলাম। গরু, মহিষ সবই খর্বাকৃতি। স্থানে স্থানে নিবিড় জঙ্গল, অল্প জঙ্গল ও অনেক প্রস্তরময় উচ্চভূমি। সুসভ্য লোকের বসতি আদৌ দৃষ্টিগোচর হইল না। তৎপর বহু আবাদিপূর্ণ প্রকাণ্ড সমভূমি দৃষ্ট হইল। মেয়েরা গোবর দ্বারা ঘুঁটে তৈয়ার করিয়া শুকাইতেছে। ২-১টা ঝোরা অর্থাৎ জলাধার দেখিতে পাইলাম।
বৃহস্পতিবার ১২ মার্চ সুবহে সাদেকে ফজরের নামাজের সালাম অন্তে হঠাৎ সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করিলাম। বাহির হইয়া দেখিলাম প্রস্তররাশি দ্বারা পরিপূর্ণ। তাহার পার্শ্বেই অত্যুচ্চ প্রস্তর পরিপূর্ণ পর্বতরাশি। তাহার পাদদেশেই কুটিরবাসী অধিবাসী। দুপুর সাড়ে ১২টার সময় হঠাৎ দুই পর্বতের মধ্যস্থলে একটা জলাশয় দেখিলাম। তৎপরবর্তী পাশে আমবাগান। উহার পার্শ্বেই কতিপয় মেয়েরা মাঠে কাজ করিতেছে। অধিকাংশ অধিবাসীরা খোলার ঘরে মেটে দেওয়াল করা ঘরে বাস করে। মাটিও লৌহবৎ।
গুদমা স্টেশনের নিকটবর্তী মাঠে কতিপয় পাইকার গরুর পৃষ্ঠে লাঠি-দড়ি চাপাইয়া গো-পাল লইয়া যাইতেছে। যাক, বেলা ১টায় স্টেশনে জোহর নামাজ পড়িলাম। তৎপর বেলা ৪টায় মধ্যপ্রদেশের রাজধানী নাগপুরে পৌঁছিলাম। পর্বতের উপরিভাগে শহরের কিয়দংশ। তৎপর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গাড়ি দ্রুতগতিতে চলিল। আমরা দুই দিকের পর্বতশ্রেণী দৃষ্ট দয়াময়ের জয় ঘোষণা করিতে করিতে তাঁহার কীর্তি দেখিতে দেখিতে চলিলাম। ২টি স্টেশন ছাড়াইয়া ১টি মাঠে ৩ জন লোকে একটি লোহার লাঙ্গলে ৬টি গরু জুড়িয়া ক্ষেত্র চাষ করিতেছে। ইহা নতুন একটি দৃশ্য। তৎপর মিন্দি স্টেশনের অনতিদূরে কতিপয় পুরুষ-স্ত্রী মিলিতভাবে গরুর সাহায্যে ক্ষেত্রে পানি সেচ করিতেছে।
সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ ও নিষ্ক্রান্ত এইভাবে উপর্যুপরি ৭ বার অতিক্রম করার পর কাসারু স্টেশনে পৌঁছিয়া দেখিলাম সময় সাতটা দশ। অত্যুচ্চ পর্বত উপরি রেলওয়ে টেলিগ্রাফ লাইন ও ২-১খানা ঘর। প্রত্যেক পর্বতের পাদদেশেই শহর। উপত্যকা প্রদেশের স্থানে স্থানে আবাদি জমি। তালবৃক্ষ অনেক। গরু-ছাগল সবই ফটকা রঙের (বুটিকের মতো)। নানাবিধ দৃশ্য দর্শন করতঃ বেলা ৮টায় কল্যাণগড় স্টেশনে পৌঁছালাম। এখানে বিশ্রাম করিলাম।
বেলা ৯টায় বোম্বে পৌঁছিয়া মার্কেট মুসাফিরখানায় ৩৬ নং রুমে বাসা নিয়া দোকানে খাবার খাইয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। বোম্বে শহরের সব মেয়েরা পাজামা পরে এবং অবশিষ্টগুলি শাড়ি পরিয়া কাছা লয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। হরেক রকমের জেনানার আমদানি। অনবরত গাড়ি, ঘোড়া, টমটম, ট্রাম, মোটর ইত্যাদি চলাফেরায় সরগরম। চারতলা, পঞ্চতলা দালানে পরিশোভিত। গরুর গাড়িগুলি খুব ছোট। আমাদের দেশীয় গাড়ির মতো গাড়িগুলি মানুষ টানে। এখানকার গরুগুলির শিংদ্বয় গোড়ার দিকটা পশ্চাতে হেলানো, তৎপর সম্মুখদিকে ক্রমে বাঁকা। অধিবাসীরা সবাই ব্যবসায়ী।
অদ্য ১৪ই মার্চ শুক্রবার বোম্বের লা-মাজহাবী সম্প্রদায়ের বড় মসজিদে জুম্মা পড়িতে যাইয়া দেখিলাম, দয়াময়ের ইচ্ছায় উক্ত সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান লোকে মিলিতভাবে মসজিদখানাকে তেতলায় পরিণত করিয়া জলের কল, পাখা, লাইট, ঝাড় ইত্যাদিতে পরিশোভিত করিয়াছে। বাস্তবিকই এমন মসজিদ আর দেখি নাই। ইহা একটা দেখিবার জিনিস বটে।
অদ্য ১৫ই মার্চ খোদা কি ওয়াস্তে দরিয়াপারের রিটার্ন টিকিট কিনিবার জন্য জনপ্রতি ১৯৫ টাকা হিসাবে জমা দিয়া রসিদ লইয়া অপরাহ্ণ ২ ঘটিকায় রাণীবাগ (চিড়িয়াখানা ও যাদুঘর) দেখিতে ট্রামে আধা আনা ভাড়া দিয়া গিয়াছিলাম। কলিকাতার পশুশালা ও যাদুঘরের তুলনায় এখানকার দৃশ্য কিছুই না বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। এখানে নানাবিধ ফুল ও ফলের গাছগাছড়া আছে ঠিক, কিন্তু কলিকাতার মতো অত সুন্দর ফিট রাস্তা নহে। পশুদের মধ্যে ৪-৫টি বড় বাঘ, ২টি বড় ভালুক, ৩টি জেব্রা, ২টি আধমরা সিংহ, তদ্ব্যতীত অন্য কিছু উল্লেখযোগ্য দেখিলাম না। যাদুঘরও তদ্রূপ। মোটের উপর এখানকার দালানকোঠা খুবই চমৎকার। প্রায়ই পাথরের সিমেন্ট ও ভিত্তি। বাঙ্গালী লোক মোটের উপর আধা আনা আছে কি না সন্দেহ।
অদ্য ১৮ই মার্চ বেলা ১২টায় পিলগ্রিম অফিসে টিকা লইবার ও পাসপোর্ট করিবার জন্য গেলাম। বহু ভীড় ছিল বলিয়া অনেক সময় লাগিয়াছিল। এমনকি জোহর নামাজ পর্যন্ত থাকিতে হইয়াছিল। কমিশনার অফিসের কর্মচারীগুলি গুজরাটি, সিন্ধুদেশবাসী ও বোম্বাইয়া। একটি ভদ্রলোক সুন্দর বাঙ্গালা বলিতে পারিল। এ কয়েক দিন এমন ভাল বাঙ্গালা শুনি নাই।
অদ্য ১৯শে মার্চ প্রাতে ফজর বাদ কিছু চা পান করিয়া এখানকার শাহ জামাল উদ্দীন শাহের মাজার শরিফ জেয়ারত করিতে গিয়েছিলাম। তথা হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া সমুদ্রের তীরে অর্থাৎ ডেকে নমাঞ্জি কোম্পানির অন্যতম জাহাজ ‘আরবিস্তান’ হাজী লইয়া কী রূপে যাত্রা করে, তাহাই দেখিতে গিয়াছিলাম। কিন্তু হাজীরা জাহাজে উঠিতেই বেলা অপরাহ্ণ হইয়া যাইবে শুনিয়া মুসাফিরখানায় প্রত্যাবৃত্ত হইলাম।
এই জাহাজে আমরাও টিকিট কাটিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। কিন্তু এই জাহাজ করাচি হইয়া যাইবে, রাস্তায় দেরি হইবে আশঙ্কায় আমরা মোগল কোম্পানির ‘খসরু’ জাহাজের টিকিট কিনিয়াছি, যে খোদার ফজলে সোজা জেদ্দা বন্দরে আমাদিগকে লইয়া যাইবে।
এখানে অনেক মুসাফিরখানা আছে। মার্কেট মুসাফিরখানা ৪ তলা। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ হাজী মাবু সিদ্দিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।
অদ্য আমাদের জিনিসপত্রে মার্কা দিয়াছে।
২১ মার্চ শুক্রবার লা-মাজহাবিদের জুম্মা মসজিদে নামাজ পড়িয়া খতিব মৌলানা শেখ ইছমাইল সাহেবের হাতে আল্লাহর ওয়াস্তে তওবা পড়িলাম। বোম্বাই যে কয়েক দিন রহিলাম, রাত্রিদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আর বিশ্রামের সময় পাইলাম না। কারণ, প্রত্যেক রোড দিয়াই ট্রাম যাতায়াত করে। গো-গাড়ি, মোটর-লরি, মোটর–বাস, ঘোড়ার গাড়ি, মানুষে টানা গাড়ি কোন সময়ের তরেই বন্ধ থাকে না। সামুদ্রিক বন্দর হওয়ায় অনবরতই জিনিসপত্র আমদানি-রপ্তানি হইতেছে। তদুপরি এখানকার হিন্দুদের বিবাহের বাদ্য ও মিছিল বাহির হইয়া সর্বদাই শহরবাসীকে সরগরম করিয়া রাখিয়াছে।
রওয়ানার প্রস্তুতি
অদ্য ২২শে মার্চ শনিবার মুয়াল্লিম বলিলেন, কেহ কোথাও যাইবেন না। সকালেই রান্না করিয়া খাইয়া গাঁটরি-বোঁচকা বান্ধা শেষ করুন। বেলা ২ ঘটিকায় জাহাজে মাল উঠাইতে আসিবে। তাই তাড়াতাড়ি আলু-ভাতের ব্যবস্থা করিলাম। ভাত না খাইতেই কুলি আসিয়া হাজির। তাড়াতাড়ি পুটুলি বান্ধিয়া সব রওয়ানা করাইয়া দিয়া কিছু খাইলাম। হাঁড়ি-পাতিল আধোয়া অবস্থায়ই ছালায় পুরিয়া পাঠাইলাম। তৎপর ১২টায় সুফি মহম্মদ সানি এতিম, ইছমাইল হাজী, হোসেনালি, কিতাবালি প্রভৃতি সমভিব্যাহারে বড় ২৪ গজি একখান চট লইয়া জাহাজে জায়গা নির্দিষ্ট করিতে চলিয়া গেল। আমরা অবশিষ্ট কয়েকজন বাসায়-বাড়িতে শেষ চিঠি লিখতে বসিলাম। অদ্যকার রাত্রিই কেবল মুসাফিরখানায় থাকিতে হইবে।
আগামীকল্য ২৩শে মার্চ রবিবার খোদার ফজলে কিছু খাবার খাইয়া জাহাজে উঠিতে হইবে। বাকি তাঁহার মর্জি। অদ্য রাস্তায় এত ভীড়। হাজী সাহেবদের সামানা উঠাইতে অনবরত গো-গাড়ি চলিতেছে। আর তিষ্ঠানো যায় না। একদম মাথা ঘুরিয়া যাইবার উপক্রম হইতেছে। বাসায়ও বসিয়া থাকা দায় হইয়া উঠিল। জাহাজে উঠিতে যে কী হইবে, তাহা পরওয়ারদেগারই জানেন।
অদ্য অপরাহ্ণে এখানকার হিন্দু অধিবাসীর এক বিবাহের মিছিল দেখিলাম। রীতিমতো ব্যান্ডপার্টি, লোকজন (মেয়েলোক বহু এবং স্বেচ্ছাচারী), ছত্রের নিচে বর-কন্যাসহ কতিপয় লাইনে গন্তব্যে ফিরিল।
রাত্রিতে শুইবার কিছু পূর্ব হইতেই আমার মাথা ঘুরাইতে আরম্ভ করে। সকলে মিলিয়া আল্লাহর ওয়াস্তে ঝাড়ফুঁক দিয়া খুব তদবির করিতে থাকে। পরে সামান্য কমায় কিছু ঘুম হইলে রাত্রি শেষ হয়। এবং প্রাতে গোসল করিয়া কিছু খাইলেই শরীর খোদার মর্জি কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ করি। তৎপর জাহাজে উঠিবার পালা।
অদ্য ২৩শে মার্চ রবিবার আল্লাহর ওয়াস্তে ২ রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় পূর্বক জন্মভূমি ভারতের বুক শূন্য করে দয়াময়ের নাম করিতে করিতে বেলা ১০ ঘটিকায় জাহাজের উদ্দেশে পূর্ব দিকে ডকে চলিলাম। তথায় ১৫০০ যাত্রীরই সমাগম। অত্যন্ত ভীড় ও গরমে প্রায় মৃতাবস্থায় হেলথ সেন্টারে গেলাম। সেখান থেকে স্বাস্থ্যসনদ নিলাম।
অনেক কষ্টে সে গৃহে প্রবেশ করিলাম। (গৃহে প্রবেশকালীন অনেকেই অনেক রকম আঘাত পাইলেন) এই ঘরে ঢুকিতে অনেকে মনে করিয়াছিলেন যে এইখানে বুঝি আগুনের তাপ দিয়া দিবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে। এই ঘরে টিকা, পাসপোর্ট ও টিকিট চেক করিয়া স্বাস্থ্যের একখানা সার্টিফিকেট দেয় ও গণনা করে। তৎপর অপর দ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া অন্য এক ঘরে ওই সার্টিফিকেট নম্বর দিয়া পুনর্বাহির করিয়া দিলেই একদম দরিয়ার কূলে ডেকে পৌঁছিলাম।
এখানে ঠান্ডা শরবত (ফি সাবিলিল্লাহ) পান করিয়া ওই সার্টিফিকেট সাহেবের হাতে দিয়া বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলিয়া জাহাজের সিঁড়ি বাহিয়া উপরের তলায় আসিলাম। তথা হইতে এক হাবশি মোটবাহীর সঙ্গে আমাদের নির্ধারিত কক্ষের অনুসন্ধানে চলিলাম। কত তলা, কক্ষ দিয়া নামিতে নামিতে, ঘুরিতে ঘুরিতে যাত্রীদের থাকিবার সর্বতলে জাহাজের অগ্রভাগে পূর্বদিনের ধরা জায়গায় স্থান নিলাম। এবং তৎপর আপনা সামানাদির খোঁজখবর করিলাম। জিনিসপত্র হাতে করিয়া যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিতে লাগিলাম। অনেকেরই অনেক জিনিস মিলিল না। আমাদের দলের একটি লাঠি ও একটি পানীয় পাত্রের টিন মিলিল না। সুফি (সহকারী) বলিল, মিলিয়া যাইবে। তৎপর আমরা তায়াম্মুম করিয়া জোহরের নামাজ পড়িলাম।
জাহাজের যাত্রা
ঠিক আছরের নামাজের সময় ডক হইতে ছোট অপর একখানা অগ্রগামী জাহাজের সাহায্যে আল্লাহর ওয়াস্তে দরিয়ায় জাহাজ ছাড়িল। এই সময়ের দৃশ্য বর্ণনাতীত। জাহাজ কোম্পানি, শহরের গণ্যমান্য লোক ও আরোহীদিগের বেরাদরগণ সকলেই স্ব স্ব ইষ্টদেবের নিকট ভক্তিগদগদ চিত্তে যুক্তকরে জাহাজের আরোহীদিগের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করিতে থাকে। তখন উভয় পক্ষের সকরুণ মর্মোচ্ছ্বাস বোধ করি স্বয়ং খোদা তায়ালার আরশ পর্যন্ত যায় এবং দয়াময়ও তাঁহার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেন। যাক, এইভাবে বোম্বাই শহরকে ছাড়িয়া কিছুদূর পূর্বে আসিয়া দক্ষিণমুখে ঘুরিয়া দুইটি পর্বত ছেড়ে ক্রমেই শহরের প্রান্ত হইতে সোজা পশ্চিমমুখে রওয়ানা হইয়া বারদরিয়ায় পড়ায় ক্রমেই পশ্চিমমুখে যাইতে লাগিলাম। এই সময় আরোহীগণ দয়াময়ের জয়ধ্বনি করিতে করিতে সন্ধ্যাকালীন আরাধনায় যোগ দিলেন।
রাত্রিতে অনেকেই সামান্য খাবার খাইয়া আসিলেন। অধিকাংশই উপবাসে রহিল। আমাদের কাছেই জনৈক পূর্ণিয়া জেলাবাসী সপরিবারে মক্কা যাইতেছে। সে স্টোভ জ্বালিয়া পাক করিতেছে। হঠাৎ আগুন লাগিয়া কক্ষময় হইয়া উঠিল। দয়াময় দয়া করিয়া অল্পেই নির্বাণ করিয়া দিলেন। দিন অপেক্ষা রাত্রিতে জাহাজ ফোর্সে চালায়। কেননা তখন আরোহীগুলি আগে আগে খাইয়াদাইয়া চুপ করিয়া শুইয়া থাকে। আমি জাহাজে উঠিয়া দিনের বেলা চা ও ৩টা বিস্কুট খাই। রাত্রে জনাব মণ্ডলের সঙ্গে সামান্য রুটি আহার করিয়াছিলাম। সমস্ত রাত্রিতে মাথা একেবারে ঘুরিয়া গিয়াছে। আর কিছুতেই বসিয়া থাকিতে পারি না।
ফজরের একটু পর উপরে উঠিয়া হাত-মুখ ধুইয়া চা, পান, বিস্কুট ইত্যাদি খাওয়ার পর দ্বিপ্রহরে খিচুড়ি পাক করিয়া খাইলাম। বৈকালেও খিচুড়ি খাইলাম।
অদ্য জাহাজে থাকা জনৈক বৃদ্ধ হাজী মারা গেল। যে জাহাজে আমরা যাইতেছি, সেই জাহাজ রাত্রিতে ঘণ্টায় ১৫ মাইল, দিবাতে ঘণ্টায় ১২ মাইল গতিতে চলে।
অদ্য ২৬শে মার্চ ফজর বাদ উপরে যাইয়া দেখি, দরিয়ার জল অত্যন্ত স্থির রহিয়াছে। পশ্চিম দিকে প্রাচীরের ন্যায় দূরবর্তী পর্বত অস্পষ্টরূপে সময় সময় তড়িৎ-রেখাবৎ দেখা দিয়া অদৃশ্য হইয়া যায়। আধঘণ্টা পর খেয়াল হইল উহা দূরবর্তী মেঘমালা। তৎপর নিজ কামরায় আসিয়া চা পান করতঃ বিশ্রাম করিতেছিলাম। বেলা ১২টায় সামান্য দুই বদনা পানি দ্বারা কাকের মতো স্নান সারিয়া নিলাম। অদ্য হোসেনালি সরকারের জ্বর দেখা দিল। দেখা যাক, দয়াময় কী করেন। দয়াময়ের ইচ্ছায় আজ অধিকাংশ যাত্রীরই সুস্থবোধ হইতে লাগিল।
অদ্য ২৭শে মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে ছাদে বসিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন করিতেই হঠাৎ দক্ষিণ দিকে জলের নিচ হইতে ঊর্ধ্ব দিকে বাষ্প হইতে লাগিল। আবার তখনই বন্ধ হইল। এইরূপ উপর্যুপরি কয়েকবার দেখা গেল। কেহ বলিল জলহস্তী, কেহ বলিল তিমি। তৎপর অকস্মাৎ জাহাজের সম্মুখভাগে মৎস্যর ঝাঁক দেখা দিল। খানিকক্ষণ জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে খেলিতে খেলিতে ছুটিল। তৎপর দুই ভাগ হইয়া জাহাজের দুই দিকে খেলিতে লাগিল। সবই দয়াময়ের অপরিসীম লীলা।
নীচে নামিয়া চা পানান্তে কিছু নাস্তা খাইয়া কথোপকথনে ছিলাম। তৎপর দুপুরবেলা উপরে যাইয়া শুনিলাম, হাসপাতালে দুইজন লোক জন্মশোধ বিদায় লইয়াছে। একজন জামালপুর এলাকার, অন্য একজন ত্রিপুরাবাসী। দয়াময়, যাহা তোমার ইচ্ছা, তাহা কখনও অপূর্ণ থাকে না।
অদ্য ২৮শে মার্চ শুক্রবার সুবহে সাদেকের সময় পশ্চিম দিক হইতে একখানা জাহাজ আমাদের জাহাজের দক্ষিণ দিয়া বোম্বে অভিমুখে চলিয়া গেল। কিন্তু আমি দেখি নাই। কারণ, গত রাত্রির কিছু থাকিতেই আমাদের জাহাজ দরিয়ায় পড়িয়াছে। এ দরিয়ার প্রবল তরঙ্গতে জাহাজ সর্বদাই আন্দোলিত হওয়ায় অধিকাংশ আরোহী মাথা ঘুরিয়া শয্যাশায়ী হইয়াছে। তন্মধ্যে আমি আর কিছু বেশি নাজুক। অদ্য সমস্ত দিন আর উঠিতে পারিলাম না। সামান্য কিছু খাইয়া ওই অবস্থায়ই পড়িয়া ছিলাম। অপরাহ্ণে একজন বাঙ্গালী মৌলভী দ্বারা মিলাদ শরিফ পাঠ করাইলাম। সন্ধ্যাকালে আরেকখানা জাহাজ আমাদের জাহাজের উত্তর দিক দিয়া বোম্বেমুখে গেল। শুনিলাম, কিন্তু উত্থানশক্তি রহিত বিধায় আজ আর উপরে যাওয়া হইল না। সন্ধ্যার পর সুফি মোহাম্মদ আলী কমলা ও কলা নিয়ে আমাকে দেখিতে আসিল। তখন আমি বসিয়া নোট লিখিতেছিলাম।
দরিয়ার একেক ঢেউ বর্ণনাতীত। বাতাস নাই, তবু ওই রকম। জানি না দয়াময়ের কী অপরিসীম কুদরত? শেষ রাত্রিতে এডেন বন্দর ডান দিকে থাকিয়া গেল এবং ওই সময় হইতে দক্ষিণ দিকে একটা দূরবর্তী আলো দেখা যাইতে লাগিল। পরে জানা গেল উহা মেল জাহাজ।
অদ্য ২৯শে মার্চ শনিবার উপরে যাইয়া দেখিলাম দরিয়ার ভীষণ মূর্তি। প্রবল পুর্ব দিকের বাতাসে রান্নাকোঠার ধুঁয়ায় ভেতরে তিষ্ঠানো দায় হইল। উপরেও এঞ্জিনের কয়লাপূর্ণ ধুঁয়াতে তিষ্ঠানো দায় হইল। অবশেষে টুপি ও পাঞ্জাবিটা কোনোরূপে ধুইয়া আপন কক্ষে আসিলাম।
আজ ঘুরানিটা কিছু কম। হঠাৎ আছরের পূর্ব সময় হইতেই উত্তর দিকে একটা পর্বত দৃষ্ট হইল। তাহাতে প্রতীয়মান হইল যে কিনারা কিছু নিকটবর্তী। আজ ভয়ানক গরম বোধ হইতে লাগিল। আর কুলানো যায় না। বোধ হইতেছে লোহিত সাগর নিকটবর্তী।
প্রবাসের ইশারা
রাত্রিতে এডেন বন্দরের আলো দেখা গেল। প্রাতে পেরিম উপদ্বীপ হইয়া বাবেলমান্ডের প্রণালী দ্বারা তাহার তীরস্থ কামরান দ্বীপে জাহাজ পৌঁছাইবে বলিয়া জাহাজের অধ্যক্ষ বেল বাজাইল। তাড়াতাড়ি রান্না হইল। না খাইতেই ঝাড়ুদারসহ একজন সাহেব অফিসার আমাদের কক্ষে আসিয়া ‘সামানা উঠাও উঠাও’ বলিয়া তাগিদ আরম্ভ করিল। আধখাওয়া খাইয়াই হাতাহাতি আসবাবপত্র সরাইয়া চট উঠাইলাম। ঝাড়ুদার ঝাঁট দিয়া পরিষ্কার করিয়াই দুর্গন্ধনাশক সাদা রকম এসিড ছড়াইয়া পুনঃ বিছানা করিতে বলিয়া ক্রমে কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে ওইভাবে পরিষ্কার করতঃ চলিয়া যাইতে লাগিল। প্রায় দ্বিতল পর্যন্ত পরিষ্কার করার পর কামরান দ্বীপের নিকটবর্তী উভয় পার্শ্বেই প্রস্তরচূর্ণ ও বালিরাশিপূর্ণ তীর দৃষ্ট হইতে লাগিল। বড় বড় পাখী (চিলের মতো অথচ শাদা রঙের) দেখা যাইতে লাগিল। কিছু পর অনুমান তিনটায় (রবিবার ৩০শে মার্চ) কামরান দ্বীপের অনতিদূরে মধ্যদরিয়ায় জাহাজের নোঙ্গর পড়িল।
নিকটস্থ তীর হইতে এবং দূরবর্তী তীর হইতে ছোট ছোট ডোঙ্গানৌকা লইয়া অতীব কষ্টে দলে দলে ভিখারিগণ আসিয়া উপস্থিত হইল। আরবি ভাষায় ‘ফি ছাবিলিল্লাহ, দরিয়ায় ফেকো, হাজী বাবা’ ইত্যাদি রবে ভিক্ষা চাহিতে লাগিল। হাজীগণও প্রত্যেকে এক পয়সা, এক আনা, দুই আনা করিয়া দরিয়ায় ফেকিতে লাগিল। ভিখারিগণ ডুব দিয়া দরিয়া হইতে পয়সা উঠাইতে লাগিল। কতিপয় ভিখারি মাছ লইয়া আসিল। জাহাজিরা জাহাজ হইতে টুকরি ও দড়ি দিয়ে মাছ কিনিয়া উঠাইয়া লইল। দরিয়ায় ডুব দিয়া পয়সা উঠানো নূতন ব্যাপার বোধ হইল। কারণ, দরিয়া হইতে জাহাজের উপরিভাগ প্রায় ৩০-৩৫ হাত। তথা হইতে পয়সা ফেকিয়া দিলে দরিয়ার প্রবল তরঙ্গাঘাত তুচ্ছ করিয়া ডুব দিয়া পয়সা উঠানো কী রকম কষ্টকর ব্যাপার, তাহা দয়াময়ই জানেন।
যাহা হউক, তীর হইতে গবর্নমেন্টের নিয়োজিত জুড়ির নৌকা লঞ্চের সাহায্যে সমস্ত আরোহীদিগকে তীরে অবতরণ করাইতে লাগিল। জাহাজ হইতে নৌকায় আরোহণ আরেক বিপজ্জনক ব্যাপার আরম্ভ হইল। সিঁড়িপথে প্রবেশ করিতে লোকের ভিড়ে প্রাণ বাহির হইবার উপক্রম হইল। দয়াময় দয়া করিয়া কোনোরূপে নৌকায় নামাইলেন। প্রত্যেক যাত্রীকে এক দিনের উপযোগী খোরাক, সামান্য বিছানা-কাপড়সহ নামিতে হইল।
জুড়ির নৌকা হইতে তীরে নামিয়া দয়াময়ের নাম লইতে লইতে খালি পায়ে কঙ্কর পরিপূর্ণ বালুকাপথে দ্বীপাভিমুখে রওয়ানা হইলাম। ক্রমেই খোলা বাতাসে আট দিনের পর ক্লান্ত দেহ বেশ সুস্থ বোধ হইতে লাগিল। তখন আছরের ওয়াক্ত, কিন্তু নামাজ পড়িবার সময় হইল না। অফিসগৃহে উপস্থিত হওয়ামাত্রই গেট খুলিয়া দিল। লোক দলে দলে ঢুকিতে লাগিল। কিছু ঢুকিবার পরই গেট বন্ধ করা হইল। তাহাতে দেখিলাম, আমাদের দলের মাত্র চারজন আমরা ঢুকিয়াছি।
তৎপর আমাদের পরিচ্ছদ খুলিয়া তাহাদের প্রদত্ত দুই খানা রুমাল পরিধান করিয়া আমাদের যাহা তহবিল ও টিকিট বাবদ সবই তাহাদিগকে দিয়া অপর কক্ষে ঢুকিলাম। তথায় ইলেকট্রিক পাখার বাতাসে শরীর জুড়াইয়া অপর কক্ষে ঢুকিয়া সারি দিয়া দাঁড়ানো হইল। তৎপর মেডিকেল অফিসার আসিয়া সকলের হাত ধরিয়া পালস পরীক্ষা করিয়া হাম্মামখানায় ঢুকিতে আদেশ করিলেন।
তথায় ঢুকিয়া র্যাকের উপর টিকিট ও তহবিল রাখিয়া দাঁড়াইলাম। তৎপর উপর হইতে ছিদ্রপথে জল পড়িয়া শরীর ভিজিয়া গেল। খাদেম আসিয়া সাবান মাখিয়া দিল। আমরা শরীর মর্দন করিয়া আট দিন পর গোসল করিলাম।
তৎপর তহবিল টিকিট লইয়া অপর কক্ষে প্রবেশ করিয়া গা মুছিয়া আমাদের নিজ নিজ কাপড় ভার দেওয়া বাছিয়া লইয়া পরিধান করিয়া অপর দ্বার দিয়া বাহিরে যাইয়া নিজ নিজ ঘটিবাটি-থালাবাসন লইয়া নিজ সুফির সঙ্গে নির্দিষ্ট বাসভবনে যাত্রা করিলাম।
এই অবস্থায় আছর হইয়া গেল। সেখানে যাইয়া বিছানা পাতিয়া পানি আনিয়া ওজু করিয়া মাগরিব পড়িয়া মাংস কিনিয়া দরকারি লাকড়ি লইয়া রান্না আরম্ভ করিলাম। খাওয়াদাওয়ার পর ঠান্ডা বাতাসে খোলা জায়গায় বিশ্রাম করার পর শরীরের সমস্ত অবসাদ দূর হইল।
খোদার শোকর করিয়া এশার নামাজের পর শয়ন করিলাম। কিছু নিদ্রার পরই পুনশ্চেতনা সঞ্চার হইয়া ওজু করিয়া দয়াময়ের প্রার্থনায় রত হইলাম। এইভাবেই ফজর হইল। তৎপর দ্বীপটি দেখিতে বাহির হইলাম।
আমাদের চারিপার্শ্বে রীতিমতো লোহার জালে ঘেরা দোচালা সিমেন্ট করা সুন্দর পাকা ঘর। টাট্টি, জলের কল, হাম্মামখানা সবই সুন্দর। রীতিমতো পাহারা। যাত্রীদের কোনো অসুবিধা দেখা গেল না। সকলেই আবার মাংস, মুরগি ইচ্ছামতো খরিদ করিয়া রান্না-খাওয়া আরম্ভ করিল। ওই দ্বীপের অধিবাসী আরবগণ তাহাদের হস্তনির্মিত খেজুরের পাতার টুকরি, বাস্কেট, শুষ্ক রুটি, মরা মাছ, জীবিত মাছ, মুরগি, তরমুজ, ক্ষীরা, আনারস, চা, সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি লইয়া বেড়ার চতুর্দিকে দণ্ডায়মান হইয়া আরবি জবানে খরিদ-বিক্রির কথাবার্তা বলিতেছে।
বেলা ১২টায় প্রবল রৌদ্রে ওই দ্বীপ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া সমুদ্রের বাঁধা ঘাটে আমরা জুড়ির নৌকায় উঠিয়া সমুদ্রের ভীষণ তরঙ্গাঘাতে দুলিতে দুলিতে আসিয়া পুনঃ জাহাজে আরোহণ করিলাম। কতক সময় বিশ্রামের পর জোহরের নামাজ আদায় করিলাম। তৎপর (কামরান দ্বীপটা বেশ স্বাস্থ্যকর স্থান। চতুর্দিকে দরিয়া।) খোদার ফজলে জাহাজ খুলিল। জাহাজ খুলিবামাত্রই দরিয়ার ভীষণ তরঙ্গাঘাতে জাহাজ এত জোরে দুলিতে লাগিল যে আর বসিয়া থাকার ক্ষমতা রহিল না। সমস্ত দিনরাত্রি আর খাওয়া হইল না। এইভাবেই ৩১শে মার্চ সোমবার অতিবাহিত হইল।
এহরাম বাঁধার দিন
অদ্য ১লা এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে কিছু চা-বিস্কুট খাইয়া ফজলে এলাহী কিছু শান্তি লাভ করিলাম। অদ্য গোসল–খাওয়ার পরই ইয়ালামলাম পাহাড় দৃষ্টে এহরাম বাঁধার দিন। দেখা যাক খোদা পাক কী করেন। আজ দরিয়ার কিছু শান্ত মূর্তি দেখা যাইতেছে। বাকি তাহার মর্জি। জোহর বাদ উপরে যাইয়া দেখিলাম আমাদের পূর্ববর্তী জাহাজ ‘আরবিস্তান’ অনেক পিছনে পড়িয়াছে। দেখিতেছি হঠাৎ কতকগুলি মৎস্যর ঝাঁক দেখা দিল। তাহারা অতি সন্তর্পণে জাহাজের সঙ্গে লাফাইয়া লাফাইয়া অনেক দূর পর্যন্ত খোদার কুদরতে হাজীদিগকে আগাইয়া স্ব স্ব স্থানে চলিয়া গেল।
আমরা জোহর বাদ খোদার ফজলে ওমরার নিয়তে এহরাম বাঁধিয়া দুই রাকাত নামাজ আদায় করিলাম। দোয়া সুফি বলিয়া দিল। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই কাপ্তেন দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে ইয়ালামলাম পাহাড়দৃষ্টে হুইসেল দিল। আগামীকল্য ফজলে এলাহী ৭-৮টায় জেদ্দা বন্দরে জাহাজ পৌঁছিবে। দয়াময়ের কী অপরিসীম লীলা! বলিহারি তাঁর বিধান। এহরাম বাঁধা অবস্থায় জনৈক হাজী মারা গেল। আমরা জানাজা পড়িয়া লোহিত সাগরে তাহাকে জন্মের মতো বিদায় দিলাম। বাকি দয়াময়ের ইচ্ছা।
অদ্য ৯ই জ্যৈষ্ঠ শুক্রবার প্রাতে হসপিটালে আরও একজন হাজী মারা গেল। অপরাহ্ণেও একজন চলিয়া গেল। সবই দয়াময়ের লীলা। অত্যধিক গরমে প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি করিতে লাগিল। কাজেই লোকের ব্যারাম না হইয়া যায় না। এ জাহাজে আরোহী ১,৪০০ জনের স্থান। তন্মধ্যে আরোহী ১,৮০০। স্থানের অভাব, বহু লোকের সমাগম ও লোহিত সাগরের অগ্নিময় হাওয়ায় লোক খুবই পীড়িত হইতে লাগিল। বুঝি বা কখন প্রাণপাখী পিঞ্জর ছাড়িয়া পালাইয়া যায়।
১০ (জ্যৈষ্ঠ) তারিখে বেলা ৯টায় শুনিলাম দুই দিনে ১২টি লোক মারা গিয়াছে। প্রধান কারণ, অত্যধিক গরম। বহু লোকের সমাগম। আজ কয়েক দিন যাবৎ কিছু কিছু পেটের অসুখ বুঝিতেছি, তাই মনটা বড় অস্থির। কিছু কিছু প্রতিকার করিতেছি ও দয়াময়ের নিকট মাগফেরাত মাঙতেছি।
অদ্য সোমবার ১২ জ্যৈষ্ঠ প্রাতে অনেক কষ্টে উপরতলায় বামে প্রস্রাব করিতে যাইয়া কিছু সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন করিলাম। সে সময় খেসু খাঁ ভাইসহ ছাদে বসিয়া ছিলাম। চতুর্দিকে অতল জলরাশি দর্শন করিয়া দয়াময়ের গুণকীর্তন করিতেছি এবং ছোট ছোট উড্ডীয়মান মৎস্যর গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছি। এমন সময় আমার মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাওয়ার উপক্রম হইলাম। খাঁ ভাই ধরাধরি করিয়া কোনোরকমে আপন কক্ষে নিয়ে আসিতেই বমি আরম্ভ হইল। সমস্ত দিন আর উঠিবার সময় হইল না। প্রায় সকলেই ওই রকম অবশ।
বেলা ১১টায় জনাব মণ্ডলের খুব জ্বর উঠিল। ওই অবস্থায়ই আছরের সময় জনাব মিঞা ভাই সাহেবকে স্বপ্নে দেখিয়া আমার নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত কহিল। দয়াময় তুমিই জানো।
আমিও তন্দ্রার মধ্যে মাঝে মাঝে মাকে দেখিলাম। কিন্তু আলাপ হয় নাই। ধনী, দরিদ্র, রাজা, প্রজা, বাদশাহ, সম্রাট, আমির, ওমরাও সব একাকার। শুধু দয়াময়ের পবিত্র ঘরের সম্মানার্থে খোলা মাথায় খোলা গায়ে একখানা তহবন পরনে অপর একখানা চাদরবৎ বুকে বাঁধা। এ দৃশ্য বাস্তবিকই অতীব মনোরম। দর্শন করিলে তাহার প্রতি ভক্তিরস উথলিয়া উঠে।
অদ্য মাগরিব বাদে নওয়াজেশ খলিফার পিতাকে জানাজা করিয়া ফেলিয়া দিল। দুপ্রহরেও একজন লোক মারা গিয়াছে শুনিলাম। অদ্য সব ভাই-ভাইয়ে হিংসা-দ্বেষ ভুলিয়া গলায়-গলায় মিলিত হইল। রাত্রিতে জাহাজ আবার কম্পিত হইতে লাগিল। তাহাতে আমাদের মাথা একদম ঘুরিতে লাগিল। যাক, দয়াময় দয়া করে প্রাতঃকালীন আলো দেখাইলেন।
অদ্য ২রা এপ্রিল বুধবার প্রাতে ফজরবাদ কিছু জলপান করিতেছি। এমন সময় জাহাজের সুইপার বিভাগের লোক জাহাজ পরিষ্কার করিয়া এসিড ছড়াইয়া দিবার সাড়া ফেলিল। যাক, কোনোরকমে কিছু খাইয়া সামানাদি গুটাইয়া নিয়া বসিয়া রহিলাম। প্রায় ৯টায় জাহাজ জেদ্দা বন্দরের ঘাটে দরিয়ার মধ্যে নোঙ্গর করিল।
মক্কার পথে
তৎপর সামানাদি শিকলের সাহায্যে জুড়ির নৌকায় নামাইতে লাগিল। তৎপর প্রায় ১১টায় জেদ্দা বন্দরে অবতরণ করিলাম। এ শহরটির গেট সম্পূর্ণ নূতন ধরণের। সমস্ত বাসিন্দারাই আরবি ভাষার। গেটটি পাথরের গাঁথুনি, উপরের ছাদ কাষ্ঠনির্মিত। এক টাকা প্রবেশ ফি দিয়া গেটে প্রবেশ করিয়া টিকিট, পাসপোর্ট দাখিল করিয়া দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া স্ব স্ব আসবাবপত্রের অনুসন্ধানে ব্রতী হইলাম। অনেক কষ্টে গলদঘর্ম অবস্থায় তাহা উদ্ধার করিয়া শহর থেকে বাহির হওয়ার পথে খচ্চরের গাড়িতে সমস্ত আসবাব উঠাইয়া নির্দিষ্ট ভাড়াটে বাড়িতে বাসা নিয়ে দুই টিন পানি দেড় আনায় কিনিয়া ওজু করিয়া জোহরের নামাজের পর কিছু জল খাইয়া পাকের আয়োজনে চলিলাম।
এখানে মাছির খুব উৎপাত দেখিতেছি। নামাজ পড়িতে হয় পূর্ব দিক। জাহাজেও এডেন বন্দরের পর হইতেই উত্তর দিকে নামাজ পড়িয়াছি। এখানে একটি সিকি ভাঙ্গাইয়া ১৪টি আরবি মুদ্রা লইয়া খয়রাত দিতে রাখিয়া দিলাম। সন্ধ্যাকালে বেড়াইতে বাহির হইয়া সমস্ত পাথরের চারতলা-পাঁচতলা দালান, দোকান, উষ্ট্র, খচ্চর, গাধা প্রভৃতি ভারবাহী পশুদিগকে দেখিতে দেখিতে মাগরিবের সময়ে একলা মাজহাবী মসজিদে সন্ধ্যাকালীন উপাসনা করিয়া নিজ বাসায় ফিরিয়া আসাকালীন সিরাজগঞ্জ নিবাসী জনৈক কাফেলাহারা হাজীকে (আব্দুল মোরাদ) পাইয়া বাসায় আনিয়া খাওয়াইয়া আপন সুফির সাহায্যে তাহাকে কাফেলায় পাঠাইয়া এশার নামাজ বাদ আল্লাহর ওয়াস্তে শয়ন করিলাম। কিন্তু মশার উৎপাত আরম্ভ হইল।
অদ্য ৩রা এপ্রিল বৃহস্পতিবার প্রাতে উঠিয়া এক টিন পানি কয়েক আনায় কিনিয়া গোসল করিয়া নামাজ পড়িলাম। অন্যান্য সকলে আদিমাতা হাওয়ার মাজার শরিফ জেয়ারত করিতে গেল। আমি পরে যাইব বলিয়া বাসার প্রহরী রহিলাম। মোটরে, গাধায়, খচ্চরে ও কাঁধে করিয়া মিঠাপানি আনিয়া বিক্রি করে। উষ্ট্র সংখ্যাতীত।
পূর্ব ব্যক্তিরা ঘুরিয়া আসিলে আমি খোদার ফজলে কয়েকজন সমভিব্যাহারে আদিমাতার গোর জিয়ারত করিতে রওনা হই। রাস্তায় অনেক কূপ, দালান, উট ও ভিখারির দল দেখিতে দেখিতে টাউনের প্রাচীরের বাহির হইয়া উত্তরমুখে যাইতে থাকি। পূর্ব দিকে একখানা নূতন বাড়ি দেখা গেল; বোধ হইল যেন কোনো রাজকর্মচারীর বাসভবন অথবা অফিস।
তৎপর কিছুদূর অগ্রসর হইয়া প্রাচীরবেষ্টিত গোরস্থানে গেট দিয়া প্রবেশ করিয়া ভক্তিগদগদ চিত্তে মাতা হাওয়ার গোর জেয়ারত করিলাম। মাতা দক্ষিণ শিয়রে পূর্বমুখে অর্থাৎ মক্কার দিকে মুখ করিয়া চিরনিদ্রায় নিদ্রিত রহিয়াছেন। তাঁহার সমাধির দুই দিকের লম্বা প্রাচীর ও নাভির উপরকার দালানটি এবনে সাউদ উঠাইয়া ফেলিয়াছেন। শুধু পদপ্রান্তে একটি দালান রহিয়াছে নাভি সোজা উচ্চ স্থান। পার্শ্বে আরও অনেক সন্তান-সন্ততি মাতার সঙ্গে একই প্রাচীরবেষ্টিত সমাধিস্থানে সমাহিত রহিয়াছেন। ধন্য লীলাময়ের রঙ্গলীলা। দর্শন করিলে ভক্তিরসে আপ্লুত হইতে হয়। পাহারাওয়ালা বেশি সময় দিল না। কাজেই চতুর্দিকে বিশেষভাবে দেখিবার সময় হইল না। অগত্যা গেট দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া ভিখারিদলকে কিছু আল্লাহর ওয়াস্তে দিয়া বিদায় লইলাম।
আসাকালীন উষ্ট্রের আড্ডায় কিছু সময় দাঁড়াইয়া তাহাদের হাবভাব মূর্তি, খাদ্য ইত্যাদি দর্শন করিলাম। উষ্ট্রগুলিকে সম্মুখের দুই পা দৃঢ়রূপে বাঁধিয়া শয়ন অবস্থায় রাখিয়াছে। পায়ের ক্ষুর জোড়া, কিন্তু উপরের দিক দেখিলে চেরা বলিয়া বোধ হয়। বাস্তবিক তাহা নহে। গাধার ক্ষুরও জোড়া। গাধা একেকজন মানুষ পৃষ্ঠে লইয়া ঘোড়ার মতো সুন্দর পথ চলিয়া যায়। এখানকার বাসিন্দাদের সবাই আরব। ফেরিওয়ালারা সর্বদাই খরবুজ, পানি, দুধ, আন্ডে ইত্যাদি রবে দিগন্ত প্রকম্পিত করে। পবিত্র ধামে যাওয়ার মোটর-রাস্তা, উষ্ট্র-রাস্তা সব ঘুরিয়া দেখিয়া বাসায় আসিলাম। আদিমাতার সমাধি অনুমান ৩০০ হাত লম্বা।
অদ্য ৪ঠা এপ্রিল শুক্রবার প্রাতে জনপ্রতি উকিল ফি (৫।/.) ও মক্কা যাইবার সরঞ্জাম নেওয়ার উষ্ট্রভাড়া জনপ্রতি (২।/১০) হিসাবে জমা দিয়া পাসপোর্ট মুয়াল্লিমের ছেলের নিকট আমানত রাখিয়া চাউল এক বস্তা, চৌকা বালতি উকিলের নিকট আমানত রাখিয়া জেদ্দার বাজার দেখিতে গিয়েছিলাম। আমদানি-রপ্তানি, খরিদ-বিক্রিও প্রচুর। স্থানে স্থানে গেটে এবনে সাউদের পুলিশ বন্দুক হস্তে পাহারা দিতেছে। মোটরের খেরখেরিতে ধুলার জন্য চক্ষু মেলা দায় হইয়া উঠিল।
জোহর বাদ ফজলে খোদা পবিত্র মক্কাধামে রওয়ানা হইতে হইবে। আসরের নামাজ বাদ গেট দিয়া শহরের বাহির হইয়া সামান্য কিছু খাবার পানি নিয়া দয়াময়ের নাম করিতে করিতে আদিমাতার চিরবাসস্থান ত্যাগ করে পদব্রজে পবিত্র মক্কাধামে যাত্রা করিলাম।
বেলাটুকু গাধা, উট, মোটর, বদুদের (আহলুল বদু মানে গ্রাম্য অধিবাসী) পাহাড়তলীর ঝুপড়ি বাঁধা পান্থশালা দেখিতে দেখিতে সোজা পূর্ব দিকে চলিলাম। ধু ধু মরুভূমি। স্থানে স্থানে উচ্চ কঙ্করময় স্থান। ওইভাবেই শেষ রাত্রিতে পার্বত্য শীত অকুলান ও ঘুমের উৎপাত সহ্য করিতে না পারিয়া উটের কাফেলা ত্যাগ করিয়া দুই পর্বতের মধ্যবর্তী সমতল রাস্তার উপর ধরিত্রীর বুকে আশ্রয় লইয়া ২ ঘণ্টার জন্য গড়াগড়ি দিতে লাগিলাম। তৎপর পূর্বাকাশ ফর্সা বোধ হওয়ায় রাস্তা ধরিলাম। সূর্যোদয় পর্যন্ত পূর্বমুখে আসিয়া ৫ই এপ্রিল শনিবার প্রাতে উত্তর-পূর্বমুখে চলিতে লাগিলাম। উভয় পার্শ্বে বিশাল পর্বতশ্রেণী। মধ্যস্থল সমতলভূমি দিয়া আমরা চলিতে লাগিলাম।
স্থানীয়দের স্বহস্তে রোপিত তরমুজ, খরবুজ ইত্যাদি শস্যজমি দেখিতেই গোটা নয়েকের সময় হিদ্দা নামক ভয়ানক কঠিন মঞ্জেলে উপস্থিত হইলাম। উভয় দিকের পর্বতরাশি হইতে অগ্নিশিখাবৎ সূর্যকিরণ বিদ্ধ হওয়ায় প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি করিতে থাকে। কোথাও দাঁড়াইবার লক্ষ্য নাই। খোলা রৌদ্রে উষ্ট্র, গাধা, খচ্চরের মলমূত্র পরিপূর্ণ মাঠের উপর রান্না করিয়া কোনো প্রকারে ক্ষুন্নিবৃত্তি করিয়া দয়াময়ের শোকর করিতে করিতে আড়াই টাকা দিয়া একটি গাধা ভাড়া করিয়া জোহর বাদ প্রচণ্ড সূর্যকিরণ তৎসহ অগ্নিময় বাতাসে গাধায় সওয়ার হইলাম।
কিছুকাল উত্তর-পূর্ব দিকে, তৎপর সোজা পূর্ব দিকে, তৎপর উত্তর-পূর্ব দিকে—এইভাবে পর্বত অতিক্রম করিতে করিতে চন্দ্র অস্তের পর রাত্রি ১২টায় পবিত্র মক্কাধামের গেটে অবতরণ করিলাম। পার্বত্য শীতে প্রাণ যাই যাই বলিতেছে। কোনোরূপে কিছুদূর অগ্রসর হইলে সুফির সাক্ষাৎ পাইলাম। সে বসিতে দিয়া চা-রুটি পান করাইয়া কতকটা সুস্থ করিল। কিন্তু দয়াময়ের ইচ্ছায় সেখানে আরেক উৎপাত আরম্ভ হইল। মশকের যন্ত্রণায় তিষ্ঠানো দায় হইল। রাত্রি প্রায় শেষের সময় সুফির বাসায় আসিয়া ওজু করিয়া খানা খাইয়া এশার নামাজ বাদ শয়ন করিলাম। কিন্তু মশকের অবস্থা পূর্ববৎ।
ওদিকে পবিত্র হেরেম শরিফ হইতে ফজরের সুমধুর আজান-ধ্বনিতে দিকদিগন্ত প্রকম্পিত হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়িতে বাসায়ই প্রাতঃকালীন উপাসনা শেষ করিয়া চক্ষুর শরীরের গ্লানির জন্য দয়াময় সমীপে প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। কারণ, উপর্যুপরি দুই রাত্রির অনিদ্রা ও শীতে শরীর বিশেষ অবসন্ন বোধ করিতেছিলাম। ইতিমধ্যে সুফি আসিয়া গোসল করিয়া খোদার ঘর তওয়াফ করিতে যাইতে বলিল। গোসল ও ওজু করার পর শরীর কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ হইল।
অগত্যা ৬ই এপ্রিল রবিবার আল্লাহ তায়ালার পবিত্র ঘর দর্শন করার জন্য ভক্তিগদগদ চিত্তে সুফির সহিত রওয়ানা হইলাম। বাসা হইতে সামান্য দূরেই পবিত্র উপাসনালয়। তাঁহার চতুষ্পার্শ্বে হেরেম শরিফ। পবিত্র কাবার চতুর্দিকে লোক তওয়াফ করে এবং চতুর্দিক হইতেই উক্ত ঘর লক্ষ্য করিয়া উপাসনা, পড়াশোনা, কান্নাকাটি করে। হেরেম শরিফ দ্বারা পবিত্র উপাসনালয় ঘেরা। ওই হেরেম শরিফের ভিতরে পবিত্র গৃহের পূর্ব দিকে ২১ গজ দূরে জমজম কুয়ার উপরে একখানা গৃহ। কাবা শরিফের দরজা পূর্বমুখে রূপার কপাটে সোনার চাবি-তালা আবদ্ধ। ৭ই এপ্রিল প্রাতে দরজা খুলিয়া খাদেমরা পরিষ্কার করিল। বহু লোক এবং আমি পবিত্র জমজমের নিকটস্থ রেলিংয়ের উপর দাঁড়াইয়া দর্শন করিলাম।
সন্ধ্যায় ওই দ্বারে রূপার বাতিদানে তিনটি বাতি দেওয়া হয়। এই পবিত্র গৃহের গুণ বর্ণনা আমার মতো মূর্খ কি লিখিতে পারিবে? ওই গৃহের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে হজরে আসওয়াদ। উহা হজ্বযাত্রীগণ কলেমা পাঠ করিয়া চুম্বন করে। দরজার উত্তর দিকে মাকামে জিব্রাইল। একটু পূর্ব দিকে মাকামে ইবরাহিম। এইখানে দুই রাকাত নামাজ পড়িতে হয়। উত্তর-পশ্চিম দিকে হাতিম। এইখানে দুই রাকাত নামাজ পড়িতে হয়। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে রুকনে ইয়ামেনিতে দোয়া করিতে হয়। জমজম কূপের উত্তরে সংলগ্ন দ্বারই বাবুস সালাম। ওইখানে পবিত্র গৃহের দরজার সিঁড়ি। সোনার তৈরি। হায়দ্রাবাদের নিজামের অর্থব্যয়ে তৈরি।
মদিনা অভিমুখে
অদ্য জনাব মণ্ডল প্রভৃতি উষ্ট্রারোহণে পবিত্র মদিনা শহরে জোহর বাদ রওয়ানা হইল। ভাড়া ১৪৪ টাকা। আমি, মদি সরকার প্রভৃতি মোটর ভাড়া করিয়াছি। দেখি দয়াময় কী করেন। মুনসেবালি হাজীও জ্বরসহ রওয়ানা হইল। খেতা খাঁ ভাইয়ের কান্দন দেখিয়া মদিনা যাওয়ার খরচ ১০ টাকা দিলাম। অদ্য ৮ই এপ্রিল মঙ্গলবার দ্বিপ্রহরে মহম্মদালির বাড়িতে দাওয়াত খাইয়া ফজলে এলাহীর মোটরারোহণে পবিত্র মদিনা নগরীতে যাত্রা করিলাম। দেখি দয়াময়ের কী অপরিসীম লীলা!
তৎপর আধা রাত্রিতে জেদ্দা পৌঁছিলাম। দয়াময়ের ইচ্ছায় এবং মুয়াল্লিমের শিথিলতায় এখন আবার নতুন বিপজ্জালে জড়িত হইলাম। তিনজন আরোহী দুই মোটরে। চিটাগাং ও হিন্দুস্থানীদের সমভিব্যাহারে। আর কথা কহিবার দোসর রহিল না। অগত্যা দয়াময়ের নাম করিয়া নীরবে তাঁহার কীর্তি দেখিতে দেখিতে জেদ্দার মশক পরিপূর্ণ নীরব অন্ধকার কামরায় রাত্রিযাপন করিলাম।
ফজলে এলাহী অদ্য ৯ই এপ্রিল বুধবার সমস্ত দিন অর্ধ-উপবাসে দিন কাটাইয়া মাগরিবের সময় পবিত্র মদিনা শরিফাভিমুখে সমুদ্রের তীরবর্তী রাস্তা দিয়া রওনা হইলাম। প্রথম ধাবান মঞ্জেল, তৎপর তেউন মঞ্জেল অতিক্রম করিয়া তৃতীয় মঞ্জেল রাবুকে রাত্রিযাপন করিলাম।
এইখানে প্রায়ই টাউন হইয়াছে। আমরা ফজলে এলাহীর নাম নিয়া খাটের উপরে শয্যা রচনা করিয়া রাত্রি কাটাইলাম। আমি ও কুতু মাল অদ্য ১০ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার প্রাতঃকালীন উপাসনার পর বিনা তৈলে খিচুড়ি রান্না করিয়া ক্ষুণ্নিবৃত্তি করিয়া কিছু বিশ্রাম করিলাম। জোহর বাদ ছাড়িবে।
এইখানে খুব খেজুরের আবাদ। কয়েক রোজ পূর্বে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে শুনিলাম। তাহার নমুনা মাটিতে দেখা গেল। আমাদের দেশের মধুপুরের পাহাড়ের মাটির মতো লাল মাটি দেখিলাম। বাবলা কাঁটার জন্য রাস্তা চলা ভার। কতকগুলি গৃহ এখানে—খেজুরের গাছের খুঁটি, ধন্যা পার, বরগা ও খেজুরপত্রের চাল–পালাসহ ছাউনি। আমাদের দেশের মতো এইখানে দূর্বাঘাস দেখিলাম। যাহা-তাহা যাত্রীদের গোর লক্ষিত হইল।
বাহ্য–প্রস্রাব করিতে লোকে দূরে যায় না। নিকটে-নিকটেই সব যায়। অসভ্য বাসিন্দাদের ভয়ে। টাউনে ছাদ ব্যতীত পাকা পাথরের গাঁথুনি খেজুরগাছের বরগা নির্মিত গৃহাদি হইতেছে। পানি মিঠা। দোকানে চাউল, মাংস, রুটি, চা, কফি, মাছের ভাজি দেখা গেল। কিন্তু উহা রুচিকর নহে। এই সব লোকে দুই হাতে খাদ্যদ্রব্য নাড়াচাড়া করে এবং খায়। আমাদের দেশীয় সিকি দিলে ৯-১০ পয়সার সদাই পাওয়া যায়।
গরু ২-৪টি যাহা দেখিলাম, তাহা অত্যন্ত হৃষ্টপুষ্ট ও দুগ্ধবতী বলিয়া মনে হইল। বকরিগুলি যথেচ্ছা বিচরণ করিতেছে। মোরগ-মুরগিগুলি রাত্রিভর ডাকিতে থাকে। এখানে চার পয়সায় চারটি কাঁচা মরিচ কিনিয়াছিলাম। মেয়েরা মরিয়ম ফুল ও শামুক লইয়া আসিয়াছিল। পুরুষ ফেরিওয়ালা দিনভর তাহাদের স্ব স্ব বুলিতে সদাইপত্র নিয়া ঘুরিতেছে। কিন্তু কী করা যাইবে! তাহাদের একটি বর্ণও বুঝিবার ক্ষমতা নাই। ক্বচিৎ ২-১ জনে ২-১টা উর্দু বোঝে। ভিখারির দলের শেষ নাই। মেয়ে, পুরুষ, বালক, বালিকা সকলেই সমব্যবসায়ী। ইহারা বৎসরে হজ্জের মরশুমে যাহা কিছু রুজি করে, দয়াময় খোদা তাহাতেই তাহাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। এই দেশের পথিকগণ রাত্রিতেই অধিকাংশ সময় চলাফেরা করিয়া থাকে। বোধ করি ইহাই এই দেশের রীতি। পার্বত্যময় রাস্তা, উত্তপ্ত হাওয়া। চলন্ত মোটরে শেষ রাত্রে খুবই শীত লাগে।
এই দেশের বর্তমান গবর্নমেন্ট এবনে সাউদের কঠোর শাসনে দস্যুর ভয় অনেকটা কম বলিয়া বোধ হইতেছে। কিন্তু ওই অফিসারগুলিই আমাদের দেশের অফিসারদের মতো হাড়ে হাড়ে চোর। এক স্টেশন হইতে মোটরযাত্রী পূর্ণ করিয়া ছাড়িতে অন্তত ১৫ স্থানে গণনা, লেখা, পরিদর্শন করিয়া পাসপোর্টসহ রক্ষক দুই মাইল পর্যন্ত সঙ্গে আসিয়া তাহার ফাঁড়িতে অবতরণ করে। কেননা, ড্রাইভার কি মোটর কোম্পানি যদি কোনো নিষেধীয় জিনিস একস্থান হইতে ভিন্নস্থানে প্রেরণ করে এবং কাহারও দ্বারা গুপ্তভাবে অমুক জায়গায় থাকিবে এইরূপ বলিয়া পাঠায়—সেই জন্যই এইরূপ করিয়া থাকে। রাস্তায় রাস্তায় রক্ষক দেখা যায়। মোটকথা, যাত্রীদের কোনোই সুবিধা নাই। দিনভর বেকার অবস্থায় নিরাশ্রয়ভাবে ঘুরিতেছে। আর সমস্ত লোককে ‘পয়সা পয়সা’ রব শুনিতে হইতেছে। কাজেই এ সমস্তই খোদা–তায়ালা সহ্য করিতে বলিয়াছেন। তাহা করিলেই তিনি প্রীত এবং মুক্তি। নতুবা মুক্তির আশা কী?
বদু মেয়েরা একটা পাজামা পরিয়া স্তনের উপরিভাগে একটা তহবন্দ বাঁধিয়া মাজার সঙ্গে ক্রোড়স্থ শিশুসন্তান বাঁধিয়া মজুরানির কার্য করিতেছে। সভ্য মেয়েরা সাহেবদের মতো উঁচু গোড়ালি যত চাকচিক্যময় জুতা-মোজা, মূল্যবান পাজামা, বোরখা, ছাতা নিয়া স্বাধীনভাবে ভ্রমণ করে। দয়াময় এই বিশ্বাসে কত প্রকারভাবে সাজাইয়া রাখিয়াছেন, তাহা তিনিই জানেন। এই সমস্ত প্রদেশ যদিও বিপজ্জনক, তথাপি এখানে তাঁহার রহমত পূর্ণমাত্রায় খোলা। এই রাস্তার পথিকগণ জলাভাবে বাহ্য-প্রস্রাব এস্তেঞ্জা করিয়া থাকেন। গোসল, কাপড় কাচা, ওজু হয় না; পরিবর্তে তায়াম্মুম করেন। কিন্তু তাহাতেই উপাসনা দূর অস্ত হইবে।
মাগরেব বাদ রাবুক মঞ্জেল হইতে মোটর ছাড়িল। ওই স্টেশনের পরবর্তী রাস্তা বড়ই দুর্গম। পার্বত্য এবং বারপা কাঁটা ও খেজুরবনে পরিসৃষ্ট। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একটি পার্বত্য জলস্রোত লক্ষিত হওয়াতে আমরা আরোহীবৃন্দ অবতরণ করিলাম। মোটর পার হইলে পুনঃ আমরা আরোহণ করিলাম। ওই জলস্রোতের তলদেশ প্রস্তরে পরিপূর্ণ। আধহাত জলের স্রোত চলিতেছে। তৎপর ক্রমেই সমস্ত রাত্রি কঠিন হইতে কঠিন রাস্তা অতি কষ্টে অতিক্রম করিয়া এক মঞ্জেলে কিছু বিশ্রাম নিয়ে আবার মোটর চলিল। মদি সরকার অন্য গাড়িতে। ফজর বাদ অন্য এক মঞ্জেলে পৌঁছলাম। চতুর্দিকের বিস্তীর্ণ পর্বতরাশি দর্শন করিলে পরম প্রভুর আশ্চর্য কৌশলের কণামাত্রও ধারণায় আসিতে পারে না। রাস্তায় আমরা আরোহীবর্গ চালকসহ পরম প্রভুর জয় ঘোষণা করিতে করিতে আসিয়াছি।
অদ্য ১১ই এপ্রিল শুক্রবার। পবিত্র জুম্মাবার। আমার একান্ত আশা যে পবিত্র মদিনা শরিফে মসজিদ নববীতে জুম্মা আদায় করি। কিন্তু কী করিব? চালক বিহনে বড়ই বিপদাপন্ন। দেখি দয়াময় কী করেন। সারা দিন উপবাস থাকিয়া আসরের পূর্ববর্তী সময়ে পবিত্র মদিনা শরিফের বাহির ফটকে পৌঁছিয়া মোটর হইতে অবতরণ করিলাম। কিন্তু সে এক নূতন সমস্যা। একেকজন (এইখানে তিনজন মিলিত হইলাম) একেক জায়গায় লইবার জন্য টানাটানি-ডাকাডাকিতে প্রাণ বাহির হওয়ার জোগাড় হইল। আমাদের নিয়োজিত মুয়াল্লিমের সাড়াও নাই। তাই নূতন বিপদ। অগত্যা একজনকে সঙ্গী করিয়া শহরের ভিতর প্রবেশ করিয়াই হঠাৎ আমাদের মুয়াল্লিমের ছেলেকে পাইয়া গেলাম। আল্লাহ তায়ালার শোকর করিয়া তদীয় নির্ধারিত বাসায় আশ্রয় লইয়া গোসল করিয়া কিছু রান্না করিয়া খাইয়া দয়াময়ের ইচ্ছায় শান্তি লাভ করিলাম। কিন্তু মনোবাঞ্ছা পূর্ণ না হওয়ায় কেমন কেমন যেন বোধ হইতে লাগিল। যে দয়ার নবীর পবিত্র রওজা শরিফ জেয়ারত-আকাঙ্ক্ষায় আকুল হইয়া বাহির হইয়াছি, সেই পবিত্র সমাধি জেয়ারত না করায় আর শান্তি মিলিল না। কোনোরূপে রাত্রি কাটিয়া গেল।
অদ্য ১২ই এপ্রিল শনিবার বাদ ফজর কিছু চা পান করিয়া পবিত্র রওজা মোবারক উদ্দেশ্যে মুয়াল্লিমসহ রওয়ানা হইলাম। এক টাকা ও কিছু পয়সা খয়রাত দিলাম। পবিত্র মসজিদে নববীতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করিয়া পবিত্র রওজা মোবারক জেয়ারত করিলাম। এই রওজা মোবারকে নবীর দেহ, প্রধান আসহাব আবু বকর সিদ্দিক, ওমর (রা.)-র দেহ সমাহিত। দর্শনমাত্র ভক্তিরসে মনপ্রাণ আপ্লুত হইয়া ওঠে। ইহার মাহাত্ম্য বর্ণনা আমার সাধ্যাতীত।
তৎপর এই পবিত্র সমাধির অনতি দূরে পবিত্র জান্নাতুল বাকির গোর জেয়ারতে চলিলাম। বর্তমান শাসনকর্তার সমাধির চিহ্নমাত্র লোপ করিয়া ফেলিয়াছে। বাস্তবিকই রমণীয় সমাধিস্থান হিন্দুদের শ্মশানের মতো করিয়া ফেলিয়াছে। দর্শনমাত্র হৃদয় শতধা বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। কোনোরূপে জেয়ারত সমাধা করিয়া বুকে পাষাণ চাপা দিয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। জোহর মসজিদে পড়িয়া পুনঃ রওজা মোবারক জেয়ারত করিলাম। পিতা-মাতার নামে কালামুল্লাহর খতম পড়াইলাম। এশার নামাজ অন্তে বাসায় আসিয়া শয়ন করিলাম। সর্দিকাশিতে মাথাটা বড় ভাল বোধ হইতেছিল না।
অদ্য ১৩ই এপ্রিল রবিবার ফজর বাদ বাসা হইতে পশ্চিমমুখে মুয়াল্লিমসহ বাহির হইয়া ক্রমে উত্তরমুখে হজরত হামজার গোর তদীয় সঙ্গীয় শহিদানের গোর জেয়ারত করিতে প্রায় মাইল চারেক পদব্রজে পার্বত্য পথ অতিক্রম করিয়া চলিলাম। রাস্তায় কোনো স্থানে আটার মতো সাদা মাটি, কোনো স্থান নিম্ন। খেজুরবনে পূর্ণ কোনো স্থান। পর্বতমালা প্রাচীরের ন্যায় বীরদর্পে মস্তকোত্তোলন করিয়া দয়াময়ের লীলা ঘোষণা করিতেছে। স্থানে স্থানে পর্বতের উপরিভাগে কূপ দৃষ্ট হইল। কিন্তু তাহার নিকট যাওয়া বিপজ্জনক।
মদিনা নগরী সুদৃঢ় প্রাচীরে বেষ্টিত। তদুপরি প্রাকৃতিক প্রাচীরে আরও অধিকতর সৌন্দর্য্য বিকাশ করিতেছে। বর্তমান শাসনকর্তা স্থানে স্থানে গেটে তাঁহার সৈন্যগণকে সমাবেশ করিয়াছেন। হজরত হামজার গোর শরিফের নিকটে একটা পানির নহর। তথায় নামিয়া হাত-মুখ ধুইয়া অতীব মিষ্ট পানি পান করিলাম। দয়াময়ের মহিমার পার নাই। নহরের তলদেশ প্রস্তরাবৃত। তথায় ছোট ছোট মৎস্য ক্রীড়া করিতেছে। এই নহরের উত্তর দিকে উহুদ পাহাড়। এই পাহাড়ে হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমাদ মওলার (সা.) দন্ত মোবারক শহীদ হন। এই পর্বতের সহিত মদিনার এত ঘনিষ্ঠতা যে উভয়েই উভয়ের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে চাহিয়া আছে। তাহার জাজ্বল্যমান প্রমাণ দয়াময় আমাদিগকেও দেখাইলেন। ধন্য কৌশলীর কৌশল! সামান্য মানবে কী বুঝিবে?
অদ্য ১৬ই এপ্রিল বুধবার খোদার মর্জি মসজিদে নববীতে জোহর পড়িতে গিয়াছিলাম। মাঝের কয় দিন জ্বরে ভুগিতেছিলাম।
অদ্য ১৮ই এপ্রিল শুক্রবার উষ্ট্রারোহী কাফেলা খোদার ফজলে মদিনায় উপস্থিত হইয়াছে। মসজিদে নামাজ পড়িতে যাইয়া সকলের সহিৎ সাক্ষাৎ করিলাম ও তাহাদের দুঃখের কাহিনী শ্রবণ করিলাম। নামাজ অন্তে খেতা খাঁ ভাইকে দেখিতে গিয়াছিলাম। তাহার অবস্থা অতীব শোচনীয়। একপার্শ্বে নিউমোনিয়ায় আক্রমণ করিয়াছে, জ্বরও খুব। সমস্তই দয়াময়ের লীলা। মানুষের আশা বৃথা। কাফেলার অন্যান্য সকলে ফজলে এলাহী ভাল। আমাদের সুফি মহম্মদ আলী গতকল্য বৈকালে এখানে পৌঁছিয়াছে।
পবিত্র মসজিদে নববীর বর্ণনা ও ব্যাখ্যা পরম করুণাময় মঙ্গলময়ই জানেন। পবিত্র জান্নাতুল বাকিতে হজরত উসমান, বিবি হালিমা, হজরত রসুল মকবুলের (সা.)-এর দুই ফুফু আম্মার কবর। হজরত ফাতেমা খাতুন, জয়নাল আবদিন, হজরত রসুল মকবুল (সা.)-এর খাদিজা ব্যতীত অন্যান্য বিবিগণের একত্র মাজার শরিফ দর্শন করিলে দুনিয়ার খেয়াল থাকে না, থাকিতে পারে না। কিন্তু এবনে সাউদ যে এই পরমাত্মাদের চিরনিদ্রায় এত ব্যাঘাত করিয়াছে, ইহা বাস্তবিকই হৃদয়বিদারক ঘটনা। হজরতের মাজার শরিফের ভিতর হইতে সুগন্ধের রাশি বাহির হইয়া দর্শনার্থীদিগদের বিমোহিত করিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু তাঁহার করুণার ভেদ সামান্য মানব কী করিয়া ব্যক্ত করিবে?
আবার মক্কায়
১৯শে এপ্রিল শনিবার দুপ্রহরে আধা ভাত খাইতেই মক্কা রওয়ানা হইবার সাড়া পড়িয়া গেল। এমনকি মাখা ভাত ঢালিয়া ফেলিয়া আধা বাঁধাবস্থায় সামানা টানিয়া-টুনিয়া লইয়া স্টেশনে রওয়ানা হইলাম।
এখানের সব লোকই বদমায়েশের সেরা। যাত্রীদিগের মলমূত্র পর্যন্ত খাইতেও কম করে না। খোদা তায়ালার অনুগৃহীত জীব এবং তাঁহার অতীব পেয়ারা বলিয়া হাদিসে উক্ত। কিন্তু রহম ইহাদের দুনিয়ায় আমল পায় নাই। খোদা যেন হক ইনসাফ করেন। মদিনার মুয়াল্লিম, খোরাকি জনপ্রতি ১০ (দশ) টাকা করিয়া দিয়াছি। তথাপি চোর বেটারা এখানকার রক্তপায়ীদিগকে দেয় নাই। তাহারা রসিদ দিয়া পুনঃ তিনজনের বাবদ (২১।।.) টাকা লইয়া ছাড়িল। আমরা দুপুর রোদে স্টেশনে আসিয়া সমস্ত দিন নানারূপ লাঞ্ছনা-গঞ্জনা অসম্মান-বদনে সহ্য করিয়া এশার নামাজের পর মদিনা স্টেশন হইতে দয়াময়ের কৃপায় আমাদের রহমাতুল্লিল আলামিন শাফিয়ুল মুজনিবিন সাল্লাল্লাহের মাজার শরিফ হইতে ভক্তি করিয়া বিদায় নিলাম।
মদি সরকারের পো দুপুরবেলায়ই আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া গেলেন। আমরা দয়াময়ের সুদয়া প্রার্থনা করিয়া রহিলাম। দিনরাত্রিতে আর আহার জুটিল না। রবিবার বাদ জোহর যাহা তিনি সামান্য বরাদ্দ করিয়াছিলেন, তাহাই খাইয়া শোকর ভেজিলাম। সন্ধ্যাকালে বাহ্য-প্রস্রাব করিয়া নহরের পানিতে মাথা-শরীর ধুইয়া মাগরেব নামাজ সমাপানান্তে তথা হইতে রওনা হইয়া দুপুররাত্রিতে মছকুরা মঞ্জেলে রাত্রিযাপন করিয়া অদ্য সোমবার প্রাতে চা পান করিয়া নোট লিখিলাম। রাত্রিতেই সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া শেষরাত্রিতে ফজলে এলাহী মক্কাধামে পৌঁছিয়া পবিত্র কাবা তওয়াফ ও সাফা-মারওয়া করিয়া সুফি মহম্মদের বাসায় কিছু খাইয়া বিশ্রাম করিলাম। (মোটর ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় সরকারের পো রাস্তায় একদিন কষ্ট পাইয়া পরদিন পৌঁছান।) আরাফাতে উপস্থিত হওয়ার পরে কাবামুখে দাঁড়াইয়া দোয়া পড়িলাম।
অদ্য ২৪শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার প্রাতে হেরেম শরিফ হইতে বাসায় ফিরিয়া সৈয়দালি হাজীর সঙ্গে জাবালু আবু কোরাইশে হজরত বেলালের আজান দেওয়ার স্থানে দুই রাকাত নামাজ পড়িলাম। হজরত বড় পীরের তপস্যালয়। হজরত রসুল করিম (সা.) চন্দ্র দ্বিখণ্ড করিবার মোজেজার স্থান দর্শন করিয়া নামাজ পাঠান্তে বাসায় ফিরিলাম। ওই পর্বতের নিম্নদেশে হজরত আলী কাররামাল্লাহুর মৌলুদ গৃহ। হজরত নবী করিম (সা.)-এর মৌলুদ গৃহ। হজরত খাদিজার বসবাসগৃহ। হজরত রসুল (সা.)-এর ওজু করিবার, নামাজ পড়িবার স্থান ছিল। কিন্তু এখন সবগুলি অনির্দিষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। মসজিদে নববীর মধ্যে ফাতেমার কূপ ও বাগান জিয়ারত করিতে হয়। ওই বাগানে একটি মোজেজার খর্জুরবৃক্ষ, একটা আমলকী ও একটা লেবুগাছ আছে। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববীর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত।
অদ্য ২৯শে এপ্রিল মঙ্গলবার হজরত রসুল করিম (সা.)-এর জন্মস্থান, হজরত আলী কাররামাল্লাহুর ওয়াজহাহুর জন্মস্থান ও বিবি ফাতেমা জান্নাত খাতুনের পবিত্র আটা পিষিবার স্থান জেয়ারত করিলাম।
পবিত্র মক্কা শহর পর্বতের অধোদেশে অবস্থিত। ইহার চতুর্পাশ্বেই পর্বতমালা। শহরটি দেখিতে পরিষ্কার। প্রস্তর-নির্মিত ঘরবাড়ি প্রায় চার পাঁচতলার উপরে। উপরে বালি বিছাইয়া ছাত আঁটিয়া দিয়াছে। এইখানে কোনো গাছপালা নাই। মধ্যে-মধ্যে দুই-একটা বরইগাছ দেখা যায়। তরিতরকারি ভিন্ন ভিন্ন দেশ হইতে আমদানি হয়। মক্কাবাসীরা সর্বদা রুটি, খর্জুর, চা-কফি পান করেন।
পবিত্র কাবা শরিফ প্রায় ২৬ গজ, আধা হাত লম্বা, প্রস্থ ২৫ গজ ৬ অঙ্গুলি। উর্ধ্বে প্রায় ২৭ গজ। দুইটি ছাদ প্রায় এক হাত তফাত। একটি ২১ গজ, দ্বিতীয়টি ২০ গজ। পূর্বভাগে কাবার দ্বার জমি হইতে চার হাত উঁচুর উপরে, ঊর্ধ্বে প্রায় ছয় গজ। হজরে আসওয়াদ জমি হইতে আড়াই গজের উপরে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে দেওয়ালে গাঁথা। চার আঙ্গুল গর্তের ভিতর স্থাপিত। উহাতে চুম্বন করিতে হয়। উত্তর দিকে যে হাতিম আছে, তাহার বেড় মাপে ৪০ গজ।
৩০শে এপ্রিল ১৭ই বৈশাখ বুধবার সন্ধ্যাকালে হেরেম শরিফে বসিয়া পবিত্র ঈদুল আজহার চন্দ্র দর্শন করিয়া মাগরিবের নামাজ আদায় করিলাম। মক্কায় ৯টা ৩০ মিনিটে ফজরের জামাত হয়, ৫টা ৪০ মিনিটে জুম্মার খোতবা, ৬টায় জুম্মার নামাজ আদায় হয় (সম্ভবত লেখকের হাতঘড়িতে বাংলাদেশি সময় অনুযায়ী)।
২০শে বৈশাখ শনিবার পবিত্র আরাফাতে হজ্ব করিবার নিয়তে পবিত্র কাবা শরিফে তওয়াফ করিয়া এহরাম বাঁধিয়া সাফা–মারওয়া সায়ী (প্রদক্ষিণ) করিলাম। ফজলে এলাহী শীঘ্রই আরাফাতে রওয়ানা হইব।
অদ্য ২২শে বৈশাখ সোমবার সাড়ে আটটার সময় আরাফাতে রওয়ানা হইলাম বাকী তাঁহার মর্জি। পবিত্র মক্কা হইতে পূর্ব দিকে দয়াময়ের কত কীর্তি দেখিতে দেখিতে কাফেলা অগ্রগামী নিশানধারীর পশ্চাতে চলিল। মক্কার পূর্ব প্রান্তে জিন্নতমালা। উহার পার্শ্বেই বর্তমান শাসনকর্তার সুরম্য প্রাসাদ। আরও বর্ধিত করা হইতেছে। চন্দ্রোদয়ের পরদিন এবনে সাউদ মক্কা নগরীতে সদলবলে আগমন করিয়াছেন। ইনি দেখিতে অত্যন্ত সুশ্রী, হৃষ্টপুষ্ট যুবক। মুখে দাড়ি, কিন্তু ডান চক্ষুটি একটু খারাপ। সর্বদা চশমা চক্ষে দিয়া থাকেন।
আরাফাতে যাইবার রাস্তার উভয় পার্শ্বে বিশাল পর্বত প্রাচীরবৎ রাস্তাটিকে রক্ষা করিতেছে। মাঝখানে কঙ্করময়। কোনো স্থানে বালুকারাশি, কোনো স্থানে পাথরের খোয়াবিশিষ্ট দুর্গম রাস্তা। বাবলা কাঁটার লতানে গাছের কাঁটা প্রায়ই লাগে। বর্তমান শাসনকর্তার সৌজন্যে পথিপার্শ্বে স্থানে স্থানে বরফ মিশ্রিত পানি পান করিয়া হাজীগণ ঘর্মাক্ত পথশ্রান্ত দেহকে সুস্থ করিয়া চলিতেছে।
বেলা ১১টায় পবিত্র মিনা বাজারে কাফেলা উপস্থিত হইল। এই শহরটি রাস্তার উভয় পার্শ্বে লম্বাভাবে অবস্থিত। এখানে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁহার প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে উৎসর্গীভূত করেন। প্রথম রাস্তার বাম পার্শ্বে বড় শয়তান জামারাতুল আকাবা, মধ্যবর্তী ওই পার্শ্বেই জমরাওল ওয়াস্তা, ডান পার্শ্বে ছোট শয়তান জমরাওল উলা অবস্থিত। তিন স্থানেই কঙ্কর মারিতে হয়। তৎপর পূর্ব দিকে কোরবানি করার স্থান। শহরটি ছাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগিল। বাহিরে যাইয়া মাগরেব পড়িলাম।
তৎপর রাত্রি ১১:৩০ মিনিটে মুজদালিফায় পৌঁছিলাম। এখানে দুই রাত্রি থাকিয়া আরাফাতের দিনের কাজা মাগরিব এশার সঙ্গে একত্রে পড়িয়া শয়তানকে ঢেলা মারিবার কঙ্করসহ ফজরে মিনায় ফিরিতে হয়। আমরা আরাফাত প্রান্তরের অতি দূরবর্তী স্থান হইতে ওই মহাপ্রান্তরের আলোকমালা দর্শন করিয়া দয়াময়ের জয়গান (কালেমা) করিতে করিতে অন্তত তিন মাইল স্থান অতিক্রম করিলাম। তত্রাচ তাহার নিকটস্থ হইতে পারিলাম না। অগত্যা প্রান্তরের প্রবেশপথে আদম (আ.)-এর বাড়ির নিকটবর্তী মাঠে রাস্তার উপর দয়াময়ের প্রদত্ত শামিয়ানার নিচে তাঁহার রহমতের শয্যায় শয়ন করিলাম। তখন রাত্রি প্রায় ২টা ৩০ মিনিট। কিন্তু জ্বর জ্বর ভাব হওয়ায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলাম। কাজেই কোনো দিকে বেশি লক্ষ ছিল না।
প্রাতে ফজর বাদ ২৩শে বৈশাখ মঙ্গলবার জাবালু রহমতের পর্বতের মিনারার নিম্নস্থ মুয়াল্লিমের নির্দিষ্ট তাঁবুতে আশ্রয় লইয়া রান্না করিয়া খাওয়া-লওয়া করিলাম। পবিত্র আরাফাত মহাপ্রান্তরের কী ব্যাখ্যা লিখিব? এখানে ধনী–নির্ধন, রাজা, বাদশাহ, ভিখারি সাধারণ সব একবেশে উপস্থিত। এই দৃশ্য অতীব মনোরম এবং তৃপ্তিকর। দয়াময়ের অপরিসীম লীলা! তাহার কণামাত্র বুঝিবার ক্ষমতা মানুষের নাই।
পবিত্র আরাফাত প্রান্তরের পূর্ব কিঞ্চিৎ উত্তরে পবিত্র জাবালু রহমত পাহাড় অবস্থিত। অন্যান্য পর্বত হইতে এই পর্বতটি পৃথক। ইহার চতুর্দিকে প্রস্তরগুলি কাটিয়া প্রাচীরের ন্যায় করা হইয়াছে। সিঁড়ি বহিয়া উপরে উঠিতে হয়। তাহাতে ১৭-১৮টি ধাপ। ওই প্রাচীরে জলের নহর চতুর্দিকে ঘেরা। কোথা হইতে ওই নহর বাহির হইয়াছে খোঁজ পাওয়া দায়। একটি (উত্তর দিকে) তলদেশ-বাঁধা পুকুরও আছে। এই নহরটি নহর-এ জুবাইদা নামে খ্যাত। এই পাহাড়ের পূর্ব দিকে নিচে ছোট একটি মসজিদ আছে। এটি মসজিদে রসুল। এখানে হজ্বের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবা পাঠ করিয়াছিলেন। এখন হজের সময় ওইখানে মক্কার ইমাম খুতবা পাঠ করেন। এখানে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়িতে হয়। তৎপর আরও উপরে আরেকটি মসজিদ। এইখানে নবী আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াকফ করিয়াছিলেন। তৎপর সর্ব উপরে একটি মিনারা। আমি বেলা ১১টা বাজিবার ২০ মিনিট বাকি থাকিতে পাহাড়ে আরোহণ করিয়া প্রায়ই মাগরিবের সময় নামিয়া আসি।
এই পবিত্র পর্বতগাত্রে অনেক অসভ্য পার্বত্য জাতি বাস করে। তাহারা যাত্রীদিগের সর্বস্ব লুণ্ঠন করিতে সর্বদাই আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছে।
২৫শে বৈশাখ বৃহস্পতিবার আছর বাদ ১০-১১টায় পবিত্র হজ্বব্রত সম্পন্ন হইল। ওই সময় সমস্ত যাত্রীকেই জাবালে রহমত পাহাড়ের দিকে তাকাইয়া মুয়াল্লিমসহ কলেমা পাঠ করতঃ দয়াময়ের নিকট তাহার রহমত চাওয়া এবং বুরাই কাজ হইতে দিলকে তওবা করতে হয়। সকলেই তাঁবুর বাহিরে দাঁড়াইয়া পরওয়ারদেগারের নিকট স্ব স্ব জীবনের আউলাদ-বুনিয়াদ-দেশবাসীর গুনাহ বখশিশ চায়।
ভীষণ প্রান্তর। সে মহাপ্রান্তরের কিনারা নির্ণয় করা সম্ভবপর নয়। তাঁবুতে অরণ্যবৎ দেখা যায়। সে দৃশ্য অতীব মনোমুগ্ধকর। কতজন ওই মহাপ্রান্তরে ওই অল্প সময়েই দয়াময়ের চিরনিদ্রায় নিদ্রিত। হজ্বের সঙ্গে সঙ্গেই এ প্রান্তরে শুধু চিরনিদ্রার নিদ্রিতগণ ব্যতীত সকলেই স্ব স্ব যানবাহন সাজসরঞ্জামসহ প্রান্তরকে একেবারে অরণ্যবৎ করিয়া বহু জণাকীর্ণ প্রান্তরকে মুহূর্তে মহাপ্রান্তরে পরিণত করিয়া জনস্রোত ক্রমে ক্রমে লীন হইয়া যায়।
মাগরিব কাজা করিয়া পবিত্র আরাফাত ত্যাগ করিতে হয়। হজ্বের সময় বর্তমান শাসনকর্তা এবনে সাউদ আবদুল আজিজ সসৈন্যে মহাপ্রান্তরে উপস্থিত হইয়া হজ্বব্রত সম্পাদন করেন। তাঁহার সৈন্যগণ পর্বতোপরি উষ্ট্রপৃষ্ঠে বসিয়া নিষ্পেষিত আম হস্তে বন্দুক কাঁধে করিয়া হজ্বের শোভা বর্ধন করতঃ স্ব স্ব পাপের মার্জনাকাঙ্ক্ষায় কান্নাকাটি করিতেছে।
অগত্যা ১২-১০ মিনিটে কাফেলাসহ দয়াময়ের গুণকীর্তন করিতে করিতে অসংখ্য লোক পূর্ণ মহাপ্রান্তর নীরব প্রান্তর করিয়া রাত্রি বোধ হয় সাড়ে তিনটায় মুজদালিফায় পৌঁছিয়া নীরম্বু উপবাসে ধূলিশয্যায় রাত্রি কাটাইলাম। সবই লীলাময়ের লীলা। তারপর রাত্রিতে সাড়ে আট ঘটিকায়ই মিনা বাজারে কাফেলা রওয়ানা হইয়া যথাসময়ে ফজরের অব্যবহিত পরেই পৌঁছিয়া শয়তানকে কঙ্কর মারিতে গেলাম। আজও সমস্ত দিন খাওয়া হয় নাই। অদ্য দম দিয়া মস্তক মুণ্ডন করিয়া ক্ষুধার তাড়নায় দয়াময়ের নিকট শোকর করিলাম।
২৭শে বৈশাখ শনিবার আল্লাহর ওয়াস্তে যৎকঞ্চিৎ কোরবানি করিলাম। বিকালে শয়তানকে কঙ্কর মারিয়া পুনরায় কোরবানি করিলাম। ২৮শে বৈশাখ রবিবার সাড়ে আট ঘটিকায় মিনা হইতে যাত্রা করিয়া শয়তানকে কঙ্কর মারিয়া ১১ ঘটিকায় পবিত্র মক্কাধামে পৌঁছিলাম। তৎপর জিন্নাত পর্বতমালা জেয়ারত করিয়া বাসায় পৌঁছিয়া নাস্তা কিছু করিয়া পবিত্র কাবা তওয়াফ করিয়া আসিলাম। এখনও সব কাফেলা আসিয়া পৌঁছে নাই। দেখি দয়াময় অতঃপর কী করেন! অদ্য ২৯শে বৈশাখ সোমবার কাফেলার কতক লোক পদব্রজে জেদ্দা রওয়ানা হইল।
হজ্বের শেষে
আমরা পবিত্র বায়তুল্লাহ শরিফে শেষ তওয়াফ করিয়া মাগরিব বাদ পহেলা জ্যৈষ্ঠ বৃহস্পতিবার খচ্চরের গাড়িতে মালপত্রসহ শহরতলীতে মোটরের অপেক্ষায় রাত্রিযাপন করি। পরদিন শুক্রবার দিনভর ওইখানেই কাফেলাসহ অবস্থান করিলাম। কিন্তু মোটরের সাড়াও নাই। সন্ধ্যা ১২টায় মোটরে জেদ্দা রওনা হইয়া রাত্রি ৫টায় পৌঁছিলাম। শনিবার প্রাতে পাসপোর্ট দাখিল করিলাম। কিন্তু জাহাজে যাইবার অনুমতি পাইলাম না। সারা দিন বাহিরেই থাকিলাম। পূর্ববর্তীরা রবিবার ফজরে জাহাজে উঠিতে চলিল। আমরা দয়াময় ভজিয়া শূন্য ময়দানে রহিয়া গেলাম। দেখি অতঃপর তিনি কী করেন!
রবিবার দ্বিপ্রহরে এক দালানে বাসা লইয়া রান্না করিয়া খাইয়া লইলাম। কিন্তু দয়াময়ের ইচ্ছায় তিলেকের তরেও মনে শান্তি পাইলাম না। দুই বেলাই দরিয়ার কূলে বসিয়া কাটাইলাম। জেদ্দার আমানতি আসবাবপত্র অন্যান্য পাওয়া গেল, কিন্তু চাউল খোঁজ করা গেল না। আমার বিশ্বাস, দুষ্টবুদ্ধি পুরাতন হাজি চাউলগুলি চুরি করিয়া বিক্রি করিয়াছে। নূতন হাজিরা খাওয়ার অভাবে হাহাকার করিতেছে। ইহাদের বিষাদমাখা মুখদর্শনে হৃদয় শতধা বিদীর্ণ হইতেছে। কিন্তু কী করিব? নিজেরও তেমন সম্বল এখন নাই। যে তক পারা যায়, তাহা করা হইয়াছে। বাকি দয়াময়ের ইচ্ছা!
প্রত্যহই দুই বেলা দরিয়ার কূলে বসিয়া বসিয়া মনের আবেগ মনে চাপিয়া রাখিয়া দয়াময়ের নাম করিতে করিতে বাসায় ফিরিয়া তাঁহার নিকট শুকুর করি।
৬ই জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার অপরাহ্ণে আদিমাতার গোর জেয়ারত করার উদ্দেশ্যে গিয়াছিলাম। কিন্তু গেটের ভিতরে যাওয়া হইল না। সরকারি লোক কর্তৃক গেট রুদ্ধ। বাহির হইতে দোয়া করিয়া বাসায় ফিরিলাম।
টিকিট লওয়ার জন্য উকিলের বাসায় দৈনিক কতবার যাওয়া হয়, তাহার সংখ্যাই নাই। বেটাদের একটা কথারও মূল্য নাই। শাম, সুবেহ, জোহর ইত্যাদি বলিয়া ঘুরায়। হজ্ব কমিটির সেক্রেটারি মুন্সি আহছানউল্লা সাহেবের নিকট নালিশ করিতে যাইব বলায় কতক চাউল মিলিল। বাকি চাউলের দরবার করিলে মিলানো যাইত, কিন্তু হাঙ্গামা করিতে মনে লয় না। যাহা পাওয়া গেল, খোদার মর্জি ইহার দ্বারাই চলিয়া যাইবে।
অদ্য ৭ই জ্যৈষ্ঠ বুধবার প্রাতে টিকিটের জন্য ঘুরিয়া আসিয়া আসবাবপত্র ইত্যাদি বাঁধা ঠিক করিয়া খোদার ওয়াস্তে কিছু খানা খাইয়া তৈয়ার হইলাম। দেখি দয়াময় কখন বিদায় করেন। বেলা ৯টায় বাসা ছাড়িয়া আসবাবপত্রসহ উকিলের বাসায় টিকিট লওয়ার জন্য উপস্থিত হইলাম। কিন্তু তাহাদের ৫ মিনিট আর ফুরায় না। এইভাবে বহু কষ্টের পর বেলা ১২টায় টিকিট লইয়া দয়াময়ের নাম করিয়া জুড়ির নৌকায় আসবাবপত্রসহ নয় আনা ভাড়া দিয়া দরিয়ায় যাত্রা করিলাম। আল্লাহ পাক একটার সময় জাহাজে আরোহণ করাইলেন কিন্তু স্ব স্ব আসবাবপত্র গুটাইয়া নিয়া স্থান ধরিতে চারটা বাজিয়া গেল। অগত্যা ওজু করিয়া জোহর-আছর একত্রে পড়িয়া কিছু জলযোগ করিলাম। এইভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরোহীগণ জাহাজে আরোহণ করিলেন। রাত্রে আর রান্না খাওয়া হইল না। কেহ কেহ হোটেলে কিছু কিছু খাইলেন।
রাত্রি ১০টায় এশার নামাজ অন্তে খোদাকে ভাবিয়া শয়ন করিলাম। ঘণ্টাখানেক তন্দ্রাবৎ থাকিয়া জাগিয়া উঠিয়া দেখি ১২টা বাজিতেছে। ওই সময় আমাদের জাহাজের অনতি দূরে জাভাবাসী আরোহীপূর্ণ একখানা ফ্রান্স কোম্পানির জাহাজ এঞ্জিন ফাটিয়া জাহাজময় আগুন লাগিয়াছে। তাহার নিকটে অন্য একখানা জাহাজও ছিল। কোনো প্রকারে কিছু রক্ষা করিতে পারিয়াছে কি না খবর নাই।
বাঙ্গালার প্রাণ বাঙ্গালায়
আমাদের আকবর জাহাজ আর রাত্রিতে খুলিল না। সমস্ত রাত্রি ওই জাহাজে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হইল। দয়াময়ের ইচ্ছায় ফজর বাদ আমাদের জাহাজ খোদার নাম লইয়া বোম্বে যাত্রা করিল। তখনও ওই জাহাজে অগ্নিলীলার অবসান হয় নাই। দরিয়ার পানি দিলে লবণাক্ত পানিতে আগুন আরও প্রবল হইয়া ওঠে। দয়াময়ের ইচ্ছায় সবই সম্ভবপর! একদম সব শেষ!
অদ্য ৮ই জ্যৈষ্ঠ বৃহস্পতিবার। অদ্য সন্ধ্যার প্রাক্কালে জাহাজের হসপিটালে ময়মনসিংহ জেলার এক হাজী মারা গেল। গরম আর কুলাইতে না পারিয়া গোসলখানার লোনাজলে গোসল করিয়া ভাল কিছু পানি মাথায় দিয়া তবে কতকটা সুস্থ হইলাম। সন্ধ্যাকালে পেরিম উপদ্বীপ দেখা গেল। আশা করি, শীঘ্রই জাহাজ আরব সাগরে পড়িবে। তাহা হইলে গরম হইতে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যাইবে।
অদ্য ১১ই জ্যৈষ্ঠ রবিবার প্রাতে এডেন বন্দর ছাড়াইলাম। আজও হসপিটালে একজন হাজী মারা গেল। আজ জাহাজ আরব সাগরে পড়িয়াছে। বাকি খোদার মর্জি!
অদ্য ১২ই জ্যৈষ্ঠ সোমবার প্রাতে চা পান করিয়া উপরের ডকে ক্লান্তি দূর করার জন্য ছয়টা হইতে সাতটা পর্যন্ত বসিয়া থাকিলাম। তখন জাহাজ ঠিক পূর্ব দিকে যাইতেছিল। এমন সময় একখণ্ড মেঘ পূর্বাকাশে দেখা দিল। ঝড়-আশঙ্কায় কাপ্তেন ঘন ঘন সশঙ্কচিত্তে দূরবীক্ষণের সাহায্যে আকাশ লক্ষ করিতেছিল। বৃষ্টি দুয়েক ফোঁটা পড়িয়া ক্রমেই মেঘটা লীন হইয়া গেল। মুহূর্তের মধ্যেই দয়াময়ের ইচ্ছায় সকলেই সন্তুষ্ট হইল।
তৎপর নিচে অবতরণ করিয়া শীত বোধ হওয়ায় কিছু সময় শয়ন করিয়া থাকিলাম। তৎপর সাড়ে আট ঘটিকায় পুনঃ মেঘ সঞ্চার হইয়া একপশলা বারিবর্ষণ হইয়া গেল। এখন ক্রমেই ভারতের দিকে অগ্রসর হইতেছি। তাই মেঘ-বৃষ্টির মুখ দেখিতেছি। অদ্য হসপিটালে একটি পশ্চিমা স্ত্রীলোক মারা গেল। সবই পরওয়ারদেগারের ইচ্ছা! অদ্য অপরাহ্ণ হইতে জাহাজ অত্যন্ত কম্পিত হইতেছিল। তাই আরোহীবৃন্দ আর বসিয়া থাকিতে পারিতেছে না। কেহ কেহ বমি করিতেছে।
আজ মঙ্গলবার আর কাহারও রন্ধন করিবার অবসর হইতেছে না। মাতালের মতো জ্ঞানহারাবস্থায় শয্যায় শায়িত। আমার তো কথাই নাই। সঙ্গীরা অদ্য পানির জোগাড় করিল না। দেখি তিনি কী করেন!
অদ্য ১৫ই জ্যৈষ্ঠ বৃহস্পতিবার জাহাজের কম্পন ভাবটা কিছু কম বলিয়া বুঝা যাইতেছে। তাই মানুষ একটু নড়াচড়া করিতেছে। কিন্তু আলোক, বাতাস, ভাল খাদ্যাভাবে মানুষ মৃতপ্রায়। চেহারা বিকট, মাথা খারাপ। কিছুতেই আর তিষ্ঠাতে পারা যায় না।
আমরা জাহাজের নিম্নতলে স্থান লইয়াছি। কিন্তু সব তলেরই একই অবস্থা। উপরের তলে দুই বেলা রান্না করা হয়। ধুঁয়া, রৌদ্র, পায়খানার দুর্গন্ধ ইত্যাদিতে টেকা দায়। তদুপরি লবণাক্ত দরিয়ার জলের হাওয়া। কোনোরূপেই শান্তি নাই। দেখি, দয়াময় এই অবস্থায় আর কত দিন রাখেন। অদ্য সন্ধ্যায় মহরমের চন্দ্র দেখা গেল। এবং অদ্যকার দিনে হসপিটালে তিনজন লোক মারা গেল। তন্মধ্যে হিন্দুস্থানি এক বৃদ্ধের একটি ১০-১২ বৎসর বয়স্ক ছেলে। ওই বৃদ্ধের হাবভাব দর্শন করিলে পাষাণও গলিত হয়।
অদ্য ১৬ই জ্যৈষ্ঠ শুক্রবার। অত্যধিক গ্রীষ্মে আর কুলাইতে না পারিয়া লোনা জলেই স্নান করিয়া সামান্য মিঠা পানি মাথায় দিয়া কাপড় পরিবর্তন করিলাম। জাহাজে মিঠা পানি নাই বলিয়া সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। দেখা যাক, খোদাওন্দ করিম অতঃপর কোন ব্যবস্থা করেন। বৈকালে পানীয় জল পুনরায় দেওয়া হইল। একটি লোক মারা গেল। অদ্যকার গরম অসহ্য বোধ হওয়ায় ছটফট করিয়া জাহাজসুদ্ধ ঘুরিয়া কোথাও তিষ্ঠাতে না পারিয়া মাথা ঘুরিয়া যাওয়ার উপক্রম বুঝিয়া সর্ব উপরিতলের অগ্রভাগে যাইয়া দাঁড়াইলাম।
দয়াময়ের ইচ্ছায় সেখানে নূতন এক দৃশ্য দেখলাম। বহুসংখ্যক মৎস্য ঝাঁকসহ জাহাজের নিকটস্থ হইয়া জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার কাটিয়া খেলিতে থাকিল। কখনও লাফাইয়া অগ্রসর হইয়া পড়ে। দুই দিকে দুইটি কানকো, পিঠে খাড়া একটি কাঁটা, মুখ গোল অবস্থার সম্মুখে সূচের ন্যায় সরু। দয়াময়ের অপরিসীম লীলা মানববুদ্ধির অগোচর। যাওয়ার কালে মৎস্যগণ এইভাবে আমাদিগকে দৃশ্য দেখাইয়া গন্তব্যপথে উৎসাহ দিতেছিল। ফেরতকালেও আমাদিগকে তাহাদের দৃশ্য দেখাইয়া দয়াময়ের আদেশ ও তাহাদের কর্তব্য পালন করিল। রাত্রি ৯টার সময় আমাদের কামরায় নেত্রকোনা নিবাসী জনৈক বৃদ্ধ হাজী মারা গেল।
অদ্য ১৭ই জ্যৈষ্ঠ শনিবার প্রাতঃকাল হইতেই আরোহীবৃন্দ বোম্বে বন্দর দেখিতে সমুৎসুক। ক্ষণকালের জন্যও কেহ কোনো প্রকার শান্তি পাইতেছে না। এমনকি রান্না-খাওয়াও নাপছন্দ হইয়া উঠিয়াছে। ঘন ঘন অফিসারদের নিকট জিজ্ঞাসা করা হইতেছে, কখন পৌঁছিবে। কারণ, সম্পূর্ণ ১০ দিনে (আবদ্ধ পাখি স্বাধীনতা ভিন্ন যেমন সুবর্ণ খাঁচায় ছটফট করে) গরমে আবদ্ধ থাকায় স্বাস্থ্য একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অদ্য দিনেও ৩-৪টা লোক মারা গেল। সমস্ত দিন অপেক্ষার পর রাত্রি ১০টায় দয়াময়ের ইচ্ছায় প্রায় তিন মাস পর ভারতমাতার সীমান্ত বন্দর বোম্বের ঘাটে ভারতসন্তানসহ জাহাজ নোঙ্গর করিল। দয়াময় সুদয়া করে রাত্রি প্রভাত পর্যন্ত জীবিত রাখিলে তাঁহার কৃপায় তীরে অবতরণ করিব। বন্দরের শোভা মনোমুগ্ধকর সমস্ত আলোয় আলোকিত।
অদ্য পহেলা জুন রবিবার প্রাতে তীরে অবতরণ করিব বলিয়া সকলেই মহোল্লাসে মুগ্ধ। রাত্রিভর নিদ্রাদেবীর আশ্রয় পাইলাম। কিন্তু দয়াময়ের ইচ্ছা অন্য রূপ, অখণ্ডনীয়। জোয়ার চলিয়া যাওয়ায় জাহাজ তীরে পৌঁছাইতে না পারিয়া জোয়ারের অপেক্ষায় ১২টা পর্যন্ত ক্ষুধার্ত আরোহীসহ মাঝদরিয়ায় নোঙ্গর করিয়া থাকিল। অগত্যা খোদা তায়ালার আদেশে জোয়ার আসিয়া আমাদিগকে তীরে পৌঁছাইল। কিন্তু তীরে সামানাদি লইয়া অবতরণ করা বড় বিপজ্জনক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল। অগত্যা কুলি দ্বারা সব লইয়ে অবতরণ করিয়াই দয়াময়ের ইচ্ছায় মুসাফিরখানার কর্তার আদিষ্ট এবং দান একজোড়া সুমিষ্ট কলা, একখানা রুটি ও বরফ মিশ্রিত সুপেয় পানীয় জল দ্বারা হাজীবৃন্দ তৃপ্তিলাভ করতঃ তাঁহারই মুসাফিরখানায় আশ্রয় নিলাম। হাজীদিগের অবতরণকালীন বোম্বেবাসীর সংবর্ধনা অতীব স্মরণযোগ্য। হাজী-হাজীনদিগের প্রতি পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ, হস্তমর্দন, কপালচুম্বন, পুষ্পমাল্যে পরিশোভিত করিয়া সহানুভূতি প্রদর্শন আশ্চর্যজনক ঘটনা।
তৎপর কিছু বিশ্রাম করতঃ পায়খানা-স্নান অনেক দিন পর স্বাধীনভাবে মনের মতো সারিয়া নিয়া প্রায় তিনটায় জোহর পড়িলাম। হোটেলওয়ালা এক প্লেট খানা মাংসসহ আনিয়া সকলকে বিতরণ করিতে লাগিল। মূল্য বাবদ কিছু দিতে হইল। অগত্যা আছরের নামাজের পর বাড়ি যাওয়ার টিকিট ও গাড়ির খোঁজ নিতে সকলেই ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল। তন্মধ্যে আমরা বাঙ্গালীই সমধিক। অন্যান্য সকলে ২-১ দিন বিশ্রামসুখ উপভোগ করে সদাইপত্রসহ রওয়ানা হইবে।
আমার টাকার বিশেষ অভাব না হইলেও সঙ্গী হোসেনালির চিন্তায় অত্যধিক চিন্তিত হওয়ায় মাথা ঘুরিয়া গেল। যাহা হউক, দয়াময়ের ইচ্ছায় তাহার টিকিটসহ জনপ্রতি ১৮/১০ হিসাবে হাওড়া পর্যন্ত টিকিট কিনিলাম। সাড়ে চার ঘটিকা-সাড়ে নয় ঘটিকায় কলকাতা মেল ছাড়িবে। সব ঠিকঠাক করে বিদায় হইয়া স্টেশনে আসিতে আর খাওয়ার সময় হইল না। তত্রাচ মেলট্রেনে স্থান না পাইয়া অতি কষ্টে এক্সপ্রেস ট্রেনে স্থান নিলে সমস্ত রাত্রি উপবাস থাকিয়া ক্ষুধায় জ্বলিতে থাকিলাম। সবই লীলাময়ের লীলা!
মেল রাত্রি সাড়ে নয় ঘটিকায় ছাড়িল। আমাদের গাড়ি পৌনে দশটায় ছাড়িয়া চলিল। ইহাতেও অশান্তি। কারণ, পরদিন সোমবার বেলা ১১:৩০টায় হোসেঙ্গাবাদ জেলাস্থ ইটার্নি নামক জংশনে গাড়ি চেঞ্জ করিয়া এলাহাবাদ লাইনে এলাহাবাদ চলিলাম। থ্রু কলিকাতা যাওয়া হইল না। দেখা যাক, অতঃপর খোদা কী করেন! এইখানে সমস্ত দিনরাত্রি অপেক্ষা করিয়া পরদিন মেল ১১টায় ধরা যাইবে। নানা দিক বুঝিয়া খোদার ওপর ভরসা করিয়া ওই লাইনেই চলিলাম। বেলা তিন ঘটিকায় গাড়ি ছাড়িল। অল্প সময় পর হঠাৎ এক সুড়ঙ্গপথে গাড়ি প্রবেশ করিয়া পাঁচ মিনিটে নিষ্ক্রান্ত হইল। অত্যন্ত গরম, রৌদ্র। তাহাতে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করায় মরমর অবস্থা হইয়াছিলাম। গত রাত্রিতে যথাক্রমে ১০-১১ বার সুড়ঙ্গে প্রবেশ ও নিষ্ক্রান্ত হইয়াছি।
এই লাইনে জব্বলপুর খুব বড় জংশন ও বড় শহর। সমস্ত রাত্রি না খাইয়া ভোর সাড়ে পাঁচটায় এলাহাবাদ পৌঁছলাম। এ শহরটি সংযুক্ত প্রদেশের রাজধানী। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর মিলনস্থান। হিন্দুদিগের তীর্থস্থান। খুব ভাল স্বাস্থ্যপ্রদ শহর। মাঝে মাঝে হিন্দুদের স্নান হয়। আমরা এখানে অবতরণ করিয়া মুসাফিরখানা বা ওয়েটিংরুমে আশ্রয় লইয়া সরকারি সুবন্দোবস্তে বাহ্য-প্রস্রাব হাম্মামখানায় স্নান ইত্যাদি সারিয়া লইয়া স্টলে অর্ডার দিয়া দুই রাত্রি এক দিন পর অন্ন আহারে হাজার শোকর করিলাম। তৎপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া ক্যালকাটা এক্সপ্রেস ট্রেনে পৌনে বারোটায় খোদার ফজলে যাত্রা করিলাম।
রাস্তায় বড় স্টেশন মীর্জাপুর, চুনার মাঠগুলি বৃক্ষে পরিপূর্ণ। জমি সব চাষ করা। মাঝে মাঝে পেয়ারার বাগান, আখক্ষেত, কাঁকুড়, তরমুজ ইত্যাদি দেখিলাম। স্থানে স্থানে হিন্দুদের শ্মশানে অত্যুচ্চ মঠ দৃষ্ট হইল। দূরে-অদূরে পর্বতশ্রেণী সঙ্গে সঙ্গেই আছে। বাঁশবন, কুলবন আরও অন্য অনেক বাগান দেখিলাম। সব চিনিতে পারিলাম না। অত্যধিক গরম বাতাস। চাষ করা মাঠ হইতে অগ্নিবর্ষণ করিতেছে। গাড়িতে তিষ্ঠানো দায়।
অদ্য মঙ্গলবার। মোগলসরাই জং, দিলদারনগর জং, বকসার, ডামরাওন, রঘুনাথপুর, পাটনা জং, পাটনা সিটি ইত্যাদি অতিক্রম করতঃ ভোর ৬টায় বর্ধমান জংশনে পৌঁছিয়া চা পান করিলাম।
অদ্য ৪ঠা জুন বুধবার। বর্ধমান জেলার উর্বর পলিমাটি দেখা গেল। খুব জঙ্গল, বাঁশঝাড়, কলার বাগান। স্থানে স্থানে পাটের জমি নিড়াইতে দেখিলাম। পানের বরজ, খেজুরবন, তালগাছ, নারিকেলবাগান যথেষ্ট। কতক জমি এখনও অনাবাদি। কেবল চাষ করা হইতেছে। আজ বাস্তবিকই চক্ষুদ্বয় জুড়াইল। কেননা, বাঙ্গালার প্রাণ বাঙ্গালায় ফিরিয়া আসিয়াছে। সাড়ে সাতটায় বেলুড় স্টেশনের (পরমহংসদেব) পর রেলওয়ের বড় কারখানা লিলুয়া দেখিলাম। অসংখ্য কুলি–মিস্ত্রী কাজ করিতেছে। ৭-৩৫ মিনিটে হাওড়া স্টেশনে গাড়ি থামিল। তৎপর গাড়ি হইতে অবতরণ করতঃ প্ল্যাটফর্ম হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ঘোড়ার গাড়িতে বেলা ৯টায় শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছিলাম। স্নানাহারের পর টেলিগ্রাম করতঃ রাত্রিতে ৮টায় গাড়িতে উঠিলাম।
অদ্য বৃহস্পতিবার ৫ই জুন প্রাতে সিরাজগঞ্জ ঘাটে স্টিমারে আরোহণ করিলাম। বাকি খোদার মর্জি। ৯টা ১৫ মিনিটে পিংনা স্টেশনে স্বীয় আত্মীয়স্বজন পরিবৃত হইয়া অবতরণ করিলাম। তৎপর পিংনা বাজারের হরিষা জনৈক হাজী সাহেবের বাড়ীতে, রাস্তায় রাস্তায় প্রায় সকলের সহিত মিলিত হইতে হইতে প্রায় তিন ঘটিকায় বাড়ি পৌঁছিলাম।
ধন্য লীলাময়! তোমার লীলার অবধি নাই। তিন মাস পর পুনঃ স্বস্থানে মিলিত করিলেন। হাজার শোকর তোমার দরবারে।
অদ্য ২২শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৭। ইং ৫ জুন ১৯৩০।