প্রদর্শনীটি বিশেষ একটি স্থাপত্যকে ঘিরে, তবে একই সঙ্গে আলোকচিত্রেরও। স্থাপত্যটি ৮০ শয্যার এক হাসপাতালের, যা ঘিরে রেখেছে চিংড়ির ঘের। স্থাপত্যকর্মটি আমরা দেখতে পাই মূলত আলোকচিত্রের মাধ্যমে। তবে স্থাপনার পূর্ণাঙ্গ মডেল এবং বিভিন্ন অংশের স্থাপত্যনকশাও রয়েছে। স্থাপত্যকর্মের স্রষ্টা কাশেফ চৌধুরী।
প্রদর্শনীটি দেশি লাল ইটের সেই হাসপাতালে ঘুরে আসার আনন্দ সঞ্চার করেছে। আমরা উপলব্ধি করি স্থাপত্যটির অবস্থান এবং বিশেষ স্থানিক বৈশিষ্ট্য। দেখি প্রকৃতি, নিসর্গ আর প্রতিবেশের সঙ্গে একাকার থাকা স্থাপত্যটি। টের পাই আলোছায়ার বিন্যাস, সূর্যালোক আর বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহ আত্মস্থ করার চেষ্টা।
স্থাপত্যটি জুড়ে আছে সরু খালের মতো পানির ধারা। তাতে নান্দনিক মাত্রার সঙ্গে এসে মিশেছে ব্যবহারিকতা। এসব খালের উদ্দেশ্য বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগানো। মাটির ওপরে–নিচে—সব পানিই যেখানে নোনা, সেখানে মিঠাপানি অমূল্য। তাই বৃষ্টির মিঠাপানির সামান্য অপচয়ও যাতে না হয়, পুরো স্থাপত্যে আছে তার পরিকল্পনা।
আগেই বলেছি, স্থাপনাটি একটি হাসপাতাল। স্থাপত্য শুধু উপভোগ করার শিল্পমাত্র নয়। এ শিল্পের বড় শর্ত হচ্ছে এর উপযোগিতা; স্থাপনাটি যে উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে, তার সার্থকতা। স্থাপত্যে উপযোগিতার চেয়ে শিল্প বড় হয়ে উঠলে বিপদ। বিশ্বখ্যাত জাপানি স্থপতি ইয়েশিও তানিগুচি বলেছেন, স্থাপত্য মূলত কোনো কিছুকে ধারণ করার আধার। চায়ের চেয়ে কেউ চায়ের কাপ বেশি উপভোগ করে বলে মনে হয় না।
বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের উদ্যোগে তৈরি এই ‘ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’ যেসব রোগী, চিকিৎসক বা কর্মীকে ‘ধারণ’ করে, তাঁরাই বলতে পারবেন, এটি তাঁরা কতটা ‘উপভোগ’ করতে পারছেন। তবে উপকূলবর্তী সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মানুষদের চিকিৎসাসেবার জন্য নির্মিত এই স্থাপনায় যে এলাকাটির ভূপ্রকৃতি এবং মানুষের জীবনাচরণের বিবেচনা আছে, তা অনুভব করা যায়। পরিবেশ-প্রকৃতিতে একাত্ম এই হাসপাতাল পিছিয়ে থাকা গ্রামবাসীদের মধ্যে অস্বস্তি বা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করার কথা নয়। এর শান্ত আবহ, করিডর ঘিরে সরু খাল, পর্যাপ্ত আলো বা বাতাস রোগীদেরও প্রশান্তির কারণ হবে।
আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে উপকূলে মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। প্রতিটি নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাই স্থাপত্যে নতুন কল্পনা জরুরি। এমন বিরূপ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে উপকূল অঞ্চলে কাশেফ চৌধুরীর স্থাপত্যটি আমাদের আশা জাগায়। আমাদের ভরসা দেয় যে উপকূলে সাশ্রয়ী খরচে টেকসই স্থাপনা তৈরি করা সম্ভব।
গুলশানের এজ গ্যালারির এই প্রদর্শনী হাসপাতালটি ঘুরে আসার একটি ভার্চুয়্যাল অভিজ্ঞতা দিয়েছে বটে, কিন্তু স্থাপত্যকর্মটি সরেজমিনে দেখার আকাঙ্ক্ষাও বাড়িয়ে তুলেছে।
এ কে এম জাকারিয়া