জাভেদ হুসেন: বাংলার দর্শন: প্রাক্–উপনিবেশ পর্ব বইটি এবার ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’–এর মননশীল শাখায় পুরস্কার পেয়েছে। বইটি লিখতে আপনি আগ্রহী হলেন কীভাবে?
রায়হান রাইন: বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিষয় পড়ার সময় বাংলার দর্শন নিয়ে কাউকে কিছু বলতে শুনিনি। এ বিষয়ে কোনো কোর্সও পড়ানো হতো না। প্রাচ্যের দর্শন বলতে কেবল একটা কোর্স পড়ানো হতো ‘ভারতীয়, জাপানি ও চীনা দর্শন’ নামে। বাংলা অঞ্চলে আদৌ কোনো দর্শনের অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। এর কারণ, ইউরোপীয় লেখক যাঁরা দর্শনের ইতিহাস লিখেছেন তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, ইউরোপের বাইরে কোনো দর্শন নেই। কেন নেই তার অদ্ভুত ব্যাখ্যাও তাঁরা দিয়েছেন। এ দেশের লেখকদের মধ্যে যাঁরা বাংলার দর্শন নিয়ে লিখেছেন, তাঁদের বক্তব্যও ছিল ঔপনিবেশিক লেখকদের মতোই। তাঁরাও বিশ্বাস করেছেন, ইউরোপের ইতিহাসটাই একমাত্র ইতিহাস, এর বাইরে আর কিছু নেই। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পর সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণণ্, হুমায়ুন কবির, ধীরেন্দ্রমোহন দত্ত প্রমুখের সম্পাদনায় গত শতকের মাঝামাঝি বেরিয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস। এরপর ভারতীয় দর্শন নিয়ে বিস্তর বইপুস্তক লেখা হয়েছে, ফলে ভারতীয় দর্শনের অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের একাডেমিক পণ্ডিতদের মধ্যে সংশয় ছিল না। কিন্তু বাংলায়? তাঁদের ভাষ্যে পারিভাষিক অর্থে দর্শন বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু এখানে নেই। ইউরোপীয় উপনিবেশজাত এই আপ্তধারণার মোকাবিলা করাটা জরুরি। একদিকে ইউরোকেন্দ্রিকতা—যার মূলে আছে এনলাইটেনমেন্টের সঙ্গে জড়ানো বর্ণবাদী মানসিকতা, অন্যদিকে আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবীদের অনেকের ভেতর থাকা ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা—উভয় ক্ষেত্রে লড়াইয়ের উপায় হিসেবে উপনিবেশপূর্ব দর্শনের নিবিড় অনুসন্ধানটা জরুরি মনে হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ভরযোগ্য বইয়ের অপ্রতুলতাও একটা বড় কারণ। সেই প্রয়োজন থেকে বেশ কয়েক বছর আগে কিছু দরকারি প্রবন্ধ একসঙ্গে জড়ো করেছিলাম, যেটা বাংলার ধর্ম ও দর্শন নামে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সংকলনেও অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। সব মিলিয়ে একটা শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা এ বই।
জাভেদ: সামগ্রিকভাবে ভারতীয় দর্শন বা অন্যান্য ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে বাংলার দর্শনের কোনো পার্থক্য আছে কি?
রায়হান: আছে অবশ্যই। তবে মিলের জায়গাটাও আছে। ভারতীয় দর্শনের বেশ কয়েকটি ধারা বাংলা অঞ্চলে স্বতন্ত্রভাবে বিবর্তিত হয়েছে। পুরো আর্যাবর্ত থেকে বাংলার একটা আলাদা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল। আর এটা তো ঠিক যে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা দর্শনেরও ভিন্নতা সৃষ্টি করে। ব্রাহ্মণরা এসে বাংলায় জাত খোয়াতেন। ভারতীয় বেদান্ত মত বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র হয়ে শঙ্করাচার্য, বল্লভ, নিম্বার্ক, মাধব, রামানুজ থেকে শ্রীচৈতন্যে এসে একেবারেই বদলে গেছে। এতে ঢুকে পড়েছে তন্ত্র। আবার, মহাযান বৌদ্ধমত চর্যাকারদের কাছে এসে সহজিয়া বৌদ্ধমতের আদল নিয়েছে, এতেও রয়েছে তন্ত্র ও যোগের প্রভাব। সহজিয়া বৌদ্ধমত থেকে বেরিয়েছে নাথপন্থা ও বৈষ্ণব সহজিয়া নামে স্বতন্ত্র দুটি ধারা এবং পরবর্তীকালে বাউল দর্শন—এ ধারাগুলোকে বাংলা অঞ্চলের বাইরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলার সুফিদর্শনেও আছে বাঙালিয়ানা। বাংলার দর্শনের দেহাত্মবাদ বাংলার সংস্কৃতির ভেতর থেকে উঠে এসেছে, যা সামগ্রিকভাবে ভারতীয় দর্শন থেকে একে আলাদা করেছে।
জাভেদ: ইউরোপে দর্শন হলো শাস্ত্র। আর বাংলায় দর্শন হলো জীবন চর্চার অংশ। এখন বাংলার দর্শন চর্চা করা কি এই বহুল প্রচলিত পশ্চিমা দর্শনের পদ্ধতির সঙ্গে কোনো সংঘাত তৈরি করবে?
রায়হান: আলাদা সংস্কৃতিতে চিন্তার আলাদা পরিকাঠামো থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনকি আলাদা পদ্ধতিও। এবং এসব স্বতন্ত্র পদ্ধতি ও পরিকাঠামোর মধ্যে দ্বান্দ্বিকতার ভেতর দিয়েই দর্শনের বিবর্তন ঘটে। এটা সংঘাতের ব্যাপার হবে, যদি কোনো একটি পরিকাঠামোকে অন্য পরিকাঠামোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। উপনিবেশ এ কাজটাই করে। বাংলায় ব্রিটিশের রাজনৈতিক উপনিবেশ ক্রমেই সাংস্কৃতিক উপনিবেশে পরিণত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে আমাদের জ্ঞানজগতেও আধিপত্য বিস্তার করেছে। দর্শন জীবন চর্চার অংশ হওয়াটা দোষের কিছু না, বরং এটাই কাম্য। অথচ ইউরোপীয় লেখকেরা এটাকে মানতে চাননি। তাঁদের কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন, দর্শন জীবন চর্চার অংশ হলে সেটা ধর্মে পরিণত হয়। এটা ঠিক, কিন্তু কোনো
দর্শনের একটা চর্চার দিক থাকলে কি সেই দর্শন পরিত্যাজ্য হয়ে যাবে? আমরা কি বৌদ্ধ যুক্তিবিদ্যা কিংবা বৌদ্ধ দর্শনকে
বর্জন করব, যেহেতু এর একটি চর্চার দিক আছে?
মননশীল শাখা
বাংলার দর্শন: প্রাক্–উপনিবেশ পর্ব
রায়হান রাইন
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
৩২৮ পৃষ্ঠা
দাম: ৫৫০ টাকা।
জাভেদ: বাংলার দর্শন কি শুধুই ইতিহাস? আমাদের বর্তমান জীবনের প্রাত্যহিক সমস্যা বা এর সমাধানের সঙ্গে বাংলার দর্শন চর্চার সম্পর্ক কী বলে আপনি মনে করেন?
রায়হান: ইতিহাসকে আমরা কী হিসেবে নেব তার সঙ্গে আমাদের কালচেতনার সম্পর্ক আছে। আধুনিক ইউরোপ ইতিহাসকে প্রগতি, বিকাশ, উন্নতি ইত্যাদি ধারণা দিয়ে বুঝতে চায় এবং এই কালচেতনা একরৈখিক। এতে ইতিহাস একটা পেছনে ফেলে আসা ব্যাপার। কিন্তু আসলেই কি ইতিহাস ফেলে আসা ব্যাপার! যে মুহূর্তে আমরা অতীতের কোনো ধারণা নিয়ে কথা বলছি বা কাজ করছি, তখন কিন্তু সেটা আর অতীত নেই, তা বর্তমান হয়ে উঠছে এবং আমাদের কাজের অংশ হয়ে আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। অন্যদিক থেকে দেখলে, উপনিবেশপূর্ব বাংলার জনদর্শনের অনেক ধারা এখনো চর্চিত হয়ে আসছে। এগুলো আমাদের দর্শনের সজীব ধারা। ঠিক প্রাত্যহিক সমস্যার সমাধান না হলেও আমাদের দার্শনিক জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে এসবের ভূমিকা আছে নিঃসন্দেহে।
জাভেদ: এই বইয়ে আপনি বাংলার দর্শন পাঠ করতে গিয়ে পশ্চিমা পারিভাষিক অর্থ আরোপ করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। অন্যদিকে এ–ও বলছেন যে ঔপনিবেশিক কালের ভেতর দিয়ে এসে এই দর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের ‘স্মৃতিবিলোপ’ বা এমনেশিয়া ঘটেছে। তাহলে বাংলার দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে আপনার প্রস্তাব কী? অতীত জ্ঞানচর্চা হিসেবে, নাকি একে পুনরুদ্ধার বা অন্য কিছু—কোনোভাবে আমরা বাংলার দর্শন চর্চা করব?
রায়হান: পশ্চিমা পারিভাষিক অর্থ আরোপের কারণে উপনিবেশপূর্ব বাংলার দর্শনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা সংকট ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। এটাকে ‘কলোনিয়াল এমনেশিয়া’ বলা যায়। উপনিবেশপূর্ব স্মৃতি ফিরিয়ে আনার সমস্যা এটা। কাজেই আমাদের জ্ঞানজগতের উপনিবেশকে নিষ্ক্রিয় করার উপায় খুঁজতে হবে এই ইতিহাসের ভেতর থেকেই। এটা বিপউপনিবেশায়নের একটা প্রক্রিয়া। উপনিবেশপূর্ব দর্শনের পরিভাষাগুলোকে বুঝতে হবে সতর্কতার সঙ্গে, যাতে এ দর্শনের ওপর পশ্চিমা পারিভাষিক অর্থ ভর না করে। এর মানে পশ্চিমা দর্শনকে বর্জন করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য পশ্চিমা দর্শনের আধিপত্য ঘুচিয়ে বাংলার দর্শনের সঙ্গে নিজেদের বর্তমানকে যুক্ত করা।
জাভেদ: বর্তমানে বাংলার দর্শনের পাঠ বা চর্চার জন্য কি আলাদা কোনো কাঠামো প্রস্তাব করছেন?
রায়হান: ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাসকে চিরন্তন ধরে বাংলা অঞ্চলে নিৎশে কিংবা হেগেলকে খোঁজা খুবই ভুল পদ্ধতি। ইউরোপকে রেফারেন্স ধরে তুলনামূলক পাঠ হতেই পারে। কিন্তু আমাদের দর্শনে কোনটা বস্তুবাদ, কারা অস্তিত্ববাদী এমন অন্বেষণের অর্থ ইউরোপীয় ইতিহাসের বিস্তারকে খোঁজা। এমন অখণ্ড ইতিহাস খোঁজার যে পদ্ধতি তার মূলে আছে যুক্তিকে সার্বভৌম হিসেবে দেখার বিশ্বাস। কিন্তু আদতে যুক্তি সংস্কৃতিনিরপেক্ষ ব্যাপার নয়। বাংলার দর্শন ধারাগুলো যুক্তিতর্ক–নির্ভর। বৌদ্ধ যুক্তিবাদ, নব্য-ন্যায় এবং বাউল দার্শনিকদের মধ্যে নানা তর্ক-পদ্ধতি আছে। এগুলোই আমাদের দেখার চোখ। এই চোখ দিয়ে বাংলার দর্শনকে দেখাকেই সংগত মনে হয়।
জাভেদ: এই বিষয়ে অন্য যেসব কাজ হয়েছে সেগুলোর তুলনায় বাংলার দর্শন: প্রাক্উপনিবেশ পর্ব বইটির কোন বিশিষ্টতা আপনি উল্লেখ করতে চাইবেন?
রায়হান: কিছু ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা তো আছেই। এ বিষয়ে অন্যান্য কাজের মধ্যে আছে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশে দর্শন: ঐতিহ্য ও প্রকৃতি অনুসন্ধান নামে একটা সম্পাদিত বই। এ বইয়ের প্রথম খণ্ডটা বেশ পরিকল্পিত। নানা দিক থেকে লেখাগুলোকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। তবে পরের দুটি খণ্ড নানা ধরনের লেখার নির্বিচার সংকলন ছাড়া কিছু নয়। অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদনা করেছেন বাঙ্গালীর ধর্ম ও দর্শনচিন্তা নামে একটা বই। এ বইয়ে কী করে প্লেটো এবং কোঁতের দর্শন ঢুকে পড়ল তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এ বইটাতেও ইউরোপীয় যুগ বিভাজনের আলোকে বাংলার দর্শনের ইতিহাসকে আদিযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ—এভাবে ভাগ করা হয়েছে।
বাংলার দর্শন: প্রাক্–উপনিবেশ পর্ব বইয়ে দর্শনকে আমি বুঝতে চেয়েছি সংস্কৃতির জায়গা থেকে। যেহেতু এখানে দর্শন অর্থপূর্ণ হয়েছে জীবন চর্চা হিসেবে। দর্শনের পারিভাষিক অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই এখানে পশ্চিমা পরিভাষার আরোপন এড়িয়ে বাংলার দর্শনকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। এতে বিষয়ভিত্তিক অনুসন্ধানের পাশাপাশি দার্শনিক গোষ্ঠী ধরেও অনুসন্ধান আছে। যথাসম্ভব প্রাথমিক উৎসগুলোকেই নিয়েছি ভিত্তি হিসেবে। দর্শনচিন্তার পাশাপাশি এ বইয়ে আছে প্রাক্ঔপনিবেশিক বাংলার সেই সব সমাজ-পরিস্থিতি ও সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিক বিবরণ, যার ভেতর দিয়ে দর্শন-ধারাগুলো বিবর্তিত হয়েছে।
জাভেদ: এই বইয়ের বিস্তার প্রাক্উপনিবেশ পর্যন্ত । উপনিবেশ–পররর্তীকালের বাংলার দর্শন নিয়ে কোনো পরিকল্পনা কি আছে আপনার?
রায়হান: খুব স্পষ্ট নয় এখনো। তবে উনিশ শতককে অনুসন্ধানের একটা ক্ষেত্র করা যেতে পারে। বাংলার দর্শনের ইতিহাসে এই শতক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়জুড়েই ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উপনিবেশ ক্রমেই সাংস্কৃতিক উপনিবেশে পরিবর্তিত হয়েছে। এ সময়ের দার্শনিকদের চিন্তা নিয়ে অনুসন্ধান নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর ব্যাপার হবে।