দুই গুণ
দুই গুণ—বাবা নির্মলেন্দু গুণ ও মেয়ে মৃত্তিকা গুণ। দুজনই কবি, উপরন্তু আজ থেকে মেয়ের নামের পাশে বাড়তি একটি পরিচয়ও যুক্ত হচ্ছে—চলচ্চিত্রকার। দুই গুনে চার—অঙ্কের এই সরল হিসাবটি এঁদের ক্ষেত্রে একদমই খাটে না, দুই গুনে এঁরা কেবল দুই-ই, বড়জোর হতে পারেন দুই গুণ।
কথাটি ‘সিনিয়র’ গুণ, মানে নির্মলেন্দু গুণকে বলতেই সশব্দ হাসি ঝলকে উঠল কবির মুখে। নির্মলেন্দু গুণের কথার মধ্যে আকছার পাওয়া যায় নিজের জন্মভূমি নেত্রকোনার উচ্চারণ ও টান। মেয়ে মৃত্তিকা গুণ, অর্থাৎ ‘জুনিয়র’ গুণের পরিবাগের ফ্ল্যাটে সেদিন তাঁর হাসির ভেতরেও নেত্রকোনার সেই উচ্চারণ কবির নিজস্বতার ‘সাইনবোর্ড’ হয়ে ছিল।
‘আমি কখনো ভাবিনি মৃত্তিকা চলচ্চিত্র বানাবে।’ রাত বাজে ৮টার কিছু বেশি। মেয়ের বসার ঘরের সোফায় আয়েশ করে বসে মেয়ের দিকে চোখ রেখেই নির্মলেন্দু গুণ কথাটি বললেন। মেয়ে–জামাতা নাট্যনির্মাতা আশুতোষ সুজন তখনো বাড়িতে গরহাজির।
ঢাকা শহরের বিকট জ্যামের ঝঞ্ঝাট ঠেলে কামরাঙ্গীর চরের নয়াগাঁও থেকে বাবা এসেছেন মেয়ের বাড়িতে। আসার পরই শুরু হলো বাবা-মেয়ের আড্ডা। সেই আড্ডায় আমরা সাক্ষীগোপাল। তবে বাপ-মেয়ের কথাবার্তা যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আড্ডা’ হয়ে ওঠে, সে সময় তার তো একটা অসিলা লাগে। ওই অসিলাটি হলো মৃত্তিকা গুণ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র কালো মেঘের ভেলা। নির্মলেন্দু গুণের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে এবং সরকারি অনুদানে নির্মিত ছবিটি আজ মুক্তি পাচ্ছে।তাই ছবি মুক্তির আগে এ আড্ডা-আয়োজন। এখানে বাবা-মেয়ের আলাপ-সালাপে ছবির কথার পাশাপাশি আমরা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছি তাঁদের দুজনের জগতেও। আর দুজনই যেহেতু কবি এবং সৃজনশীল অঙ্গনের বাসিন্দা, ফলে তাঁদের সব পৃথিবী নিয়েই কথা হলো ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’।
তবে আলাপের মধ্যে ‘বাগড়া’ও ছিল।
মৃত্তিকার দুই বছরের ছেলে সিদ্ধার্থ পাবলো ও তিন মাস বয়সী মেয়ে দামিনী বর্ণমালা যখন বিনা নোটিশে আলাপে ঢুকে পড়ছিল, সে সময় সেটি কেবল ‘বাগড়া’ ছিল না, হয়ে উঠেছিল ‘মধুর বাগড়া’।
‘ভাইয়া...ভাইয়া’ বলে পাবলোকে সামলাতে সামলাতে নির্মলেন্দু গুণ বলছিলেন, ‘মৃত্তিকা অভিনয় করত, হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিকে কাজ করেছিল। আমি ভেবেছিলাম, ও অভিনয়ই করবে।’
এরপর কী যেন মনে পড়েছে, মুখে এমন একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বললেন, ‘১৯৮৫ সালে মৃত্তিকাকে তো নিয়ে গিয়েছিলাম সত্যজিৎ রায়ের বাসায়। কবি সম্মেলন উপলক্ষে আমরা গিয়েছিলাম কলকাতায়। মৃত্তিকার বয়স তখন চার। সেবার আমরা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলাম। সত্যজিতের সঙ্গে মৃত্তিকার একটা চমৎকার ছবি তুলেছিলেন নাসির আলী মামুন। আমার মনে হয়, সে সময় না বুঝলেও মৃত্তিকা বড় হয়ে ওই ছবিটির মূল্য অনুধাবন করেছে এবং অন্তরাল থেকে সত্যজিৎ রায় তাঁকে চলচ্চিত্র নির্মাণে কিছু বাড়তি সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছেন।’
একমনে মুঠোফোন দেখছিলেন মৃত্তিকা। খানিক বাদে বাবার কথার রেশ ধরে বললেন, ‘নিয়তিই বোধ হয় আমাকে এ পথে নিয়ে এসেছে। অভিনয় করতে গিয়ে দেখলাম, পরিচালকের নির্দেশে সবকিছু করতে হয়। কিন্তু বেশিক্ষণ অর্ডার শোনা তো আমার ধাতে নেই। তাই চলচ্চিত্রবিদ্যা আয়ত্ত করে একসময় ভাবলাম, এবার নিজেই অর্ডার দিই।’
এ কথার শানে–নজুল হলো, অ্যাকশন-কাটের ঝকমারি ভুবনকে তিনি ভালোবাসলেন। একসময় চলচ্চিত্র বানাবেন বলে রাঘববোয়াল, কাণ্ডারী, মিরাজুল—এসব টেলিছবি নির্মাণ করে হাতও মকশো করলেন। এ ছাড়া ইমপ্রেস টেলিফিল্মের নানা চলচ্চিত্র ও বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে চাকরিসূত্রে তিনি তো সেই ২০০৬ সাল থেকে জড়িত।
অথচ এ মেয়ের শুরুটা কবিতা দিয়ে। বাবা কবি, মা নীরা লাহিড়ীও কবি। মেয়ের কবি না হয়ে উপায় আছে!
‘প্রথমে তো মেয়ে ছড়া লিখত। শিশু একাডেমির শিশু পত্রিকায় ছাপাও হতো। পরে কখন যে সে কবি হয়ে উঠল!’ বোহিমিয়ান ও বহির্মুখী স্বভাবের নির্মলেন্দু গুণ এসব না-ই জানতে পারেন। তবে বড় হওয়ার প্রহরগুলোতে মৃত্তিকা কবিতা লিখে ভরিয়ে ফেলেছিলেন নিজের ইচ্ছে লেখার খাতা।
‘আমি কবি-লেখকই হতে চেয়েছি, চাইও এখনো।’—গুণকন্যার কথা শেষে আমরা ফিরে তাকাই তাঁর লেখা বইগুলোর দিকে। চট্টগ্রামের ‘বাতিঘর’ থেকে চারকাহন নামে এ বছরও বেরিয়েছে তাঁর দ্বিতীয় গল্পের বই। ২০১২-তে কাব্যগ্রন্থ আমার আকাশে বৃষ্টির মাধ্যমে সেই যে আরম্ভ হয়েছে বইয়ের দুই মলাটবদ্ধ হওয়া, এখনো তা চলছেই। গল্প-কবিতা মিলিয়ে এখন অব্দি বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি।
লেখালেখির অনুপ্রেরণা কি বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন?
‘না, ছোটবেলা থেকে মামা সুমন লাহিড়ী আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। এভাবেই লেখালেখির শুরু। বাবা আমাকে জীবনটা সহজ করে দেখতে শিখিয়েছেন। আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, কোনো কিছুতে বাধা দেননি।’
বাবার দিকে এক পলক তাকালেন মেয়ে। নির্মলেন্দু গুণ তখন ‘বিরাট শিশু’ হয়ে বর্ণমালার সঙ্গে খেলায় মত্ত। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেয়ের কবিতা কেমন লাগে?’
ষাট দশকের উজ্জ্বলতম এই কবি খরচা করলেন তিনটে শব্দ, ‘ভালো...ভালো...ভালো।’
‘বাবা সহজে কারও প্রশংসা করেন না। তিনি ভালো বলছেন!’—মৃত্তিকার মুখে চাপা উচ্ছ্বাস। তাঁকে বললাম, বাবার লেখা আপনার প্রিয় কবিতা কোনটি?
‘“জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দাবাদ”, “তুমি চলে যাচ্ছ”, “স্মরণ”, “আমি বিষ খাচ্ছি অনন্ত”—আরও অনেক আছে।’
মেয়েকে নিজের কবিতার নাম বলতে দেখেও কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক নির্মলেন্দু গুণ। তিনি কি এ মুহূর্তে স্মৃতি খুঁড়ে তুলে আনছেন তাঁর সেই ছোট্ট মেয়ে মৃত্তিকা ফুল গুণকে?
বাবা নাম রেখেছিলেন মৃত্তিকা। মা রেখেছিলেন ফুল। দুইয়ে মিলে মৃত্তিকা ফুল গুণ। কিন্তু শৈশবেই সেই ‘ফুল’ নিজের নাম থেকে হাওয়া করে দিয়েছিলেন মৃত্তিকা, ঠিক যেন বাবারই মতো, একইভাবে। তাঁর বাবাও তো কবিজীবনের প্রথম প্রহরে নিজের পিতৃপ্রদত্ত নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণকে ছেঁটে ছোট করে নিয়েছিলেন।
‘অনেকে মনে করেন, “তুমি আমার মৃত্তিকা/ভালোবাসার মৃত্তিকা”—এই কবিতাটি বাবা আমাকে নিয়ে লিখেছেন। আসলে তা নয়।’ বললেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর মৃত্তিকা। আরও বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার এক সহপাঠী কোত্থেকে যেন শুনল, আমি নির্মলেন্দু গুণের মেয়ে। সে তো বিশ্বাসই করতে চায় না। আমাকে বলল, “তুমি নির্মলেন্দু গুণের মেয়ে হবে কী করে, তিনি তো বিয়েই করেননি।” কথাটি সে এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল, আমি আর তার ভুল ভাঙাতে পারিনি।’
আড্ডার রাতে নিজের ছবি আর বাবাকে নিয়ে রাজ্যের গল্প করছিলেন মৃত্তিকা।
সেই যে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালে প্রথম পড়েছিলেন বাবার লেখা শিশুতোষ উপন্যাস কালো মেঘের ভেলা। তারপর থেকে ওই উপন্যাসের নায়ক দুখীর (মৃত্তিকা ছবিতে নাম দিয়েছেন দুখু) প্রতি এক ধরনের মায়া অনুভব করেন তিনি, সাত-আট বছরের সেই ছেলেটাকে দেখতে পান।
আজ এত বছর পর ওই দুখীকেই মৃত্তিকা আঁকলেন নিজের চলচ্চিত্রের ফ্রেমে ফ্রেমে। সেখানে কি নির্মলেন্দু গুণ—কিশোরবেলায় যাঁর নাম ছিল রতু—তাঁর ছায়া আছে? আছে কি বারহাট্টার কাশতলা—অধুনা কাশবন—গ্রামের সেই ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার ছেলেবেলা?
বিস্তারিত জানতে প্রেক্ষাগৃহে বসে কালো মেঘের ভেলা দেখেই ফেলি, চলুন...।
‘কালো মেঘের ভেলা’ নিয়ে
যে বছর মৃত্তিকা গুণের জন্ম, তার এক বছর আগে ১৯৮১ সালে নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন কালো মেঘের ভেলা। উপন্যাসটি প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল শিশু পত্রিকার ঈদসংখ্যায়। পরে বের হয় বই হিসেবে । এ আখ্যানে আছে নিম্নবিত্ত পরিবারের দুখীর গল্প।
২০১৫ সালে মৃত্তিকা যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন বলে ঠিক করেন, তখনই বেছে নিয়েছিলেন উপন্যাসটি। আর নিজের উপন্যাস অবলম্বনে এ ছবির জন্য সে সময় মেয়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন বাবা নির্মলেন্দু গুণ। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত এ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন ফারুক হোসেন ও মৃত্তিকা গুণ। ছবির প্রধান দুটি চরিত্র দুখু ও রোজীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুনা খান ও আপন।
সিনেমার জন্য নতুন করে একটি গান লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ। গানের কথাগুলো এমন: ‘ইস্টিশনে জন্ম আমার রেলগাড়িতে ঘর, রেলের চাকায় বান্ধা আমার লোহারই অন্তর’।
উপন্যাসটি শিশুতোষ হলেও একে শিশুতোষ চলচ্চিত্র বানাতে চাননি মৃত্তিকা। এখানে তিনি দেখাতে চেয়েছেন একজন কিশোরের জীবনসংগ্রামের গল্প, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কিশোরবেলাতেই যে বয়স্ক হয়ে ওঠে।
২০১৬-তে স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায় সরকারি অনুদান পাওয়ার পর মৃত্তিকা ছবির কাজ শুরু করেন। শুটিং হয় বারহাট্টার কাশবনে নির্মলেন্দু গুণের বাড়ি, কমলাপুর রেলস্টেশনসহ আরও কয়েকটি জায়গায়।
প্রথমে ৫৫ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির শুটিং করার পর আত্মবিশ্বাসী পরিচালক এর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে এটি শুটিং করেন। চলচ্চিত্রটি আজ মুক্তি পাচ্ছে ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে ও যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাসে।
ছবি নিয়ে মৃত্তিকা বলেন, ‘এখানে একজন বাচ্চার চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে আমাদের সবার ভেতরেই একাকিত্ব আছে। সেই একাকিত্বের প্রকাশ আছে এ সিনেমায়। ছবিটি দর্শকের মধ্যে একটা ঘোর তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস।’